Monthly Archives: জুন 2020

আবার কিসের উন্নয়ন?

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন বিষয়ক একটি আলোচনা[১]

উনিশশত সত্তরের দশকের আগে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের খুব একটা পরিচয় ছিল না। এর আগের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মত পদক্ষেপকে সরকারিভাবে বা আন্তর্জাতিক মহলে ‘উন্নয়ন’ হিসাবে অভিহিত করা হত, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে স্থানীয় পর্যায়ে এই ধারণাকে স্বাগত জানানোর মত বিশেষ কেউ তখন ছিলেন না। অন্যদিকে ১৯৭৬ সালে যখন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ গঠিত হয়, তখনকার প্রেক্ষিতেও ‘উন্নয়ন’ শব্দটির প্রতি স্থানীয় জনগণের বিশেষ কোনো মোহ থাকার কথা ছিল না। থাকলেও দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে অস্তিত্ব ও ভূমি রক্ষা এবং অত্যাচার নির্যাতন ও হামলা এড়ানো বা সম্ভব হলে প্রতিহত করা – এসবই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবনের মূল মন্ত্র।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ছবি, নভেম্বর ১৯৫৭-এ John Dominis -এর তোলা

তবে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শান্তি’ চুক্তির পর দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে এবং ‘উন্নয়ন’ হয়ে ওঠে অনেকের আরাধনা, আলোচনা ও কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রেক্ষিতে  ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর ১৮-১৯ তারিখে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন’ শীর্ষক সম্মেলনের জন্য লেখা একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়ে নিজের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরার একটা সুযোগ আমার হয়েছিল (Tripura 1998)।[২] তবে সেসময় ‘উন্নয়ন জগত’ সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো প্রত্যক্ষ ধারণা ছিল না, যা আমি পরে অর্জন করি অনেকটা কাকতালীয়ভাবে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (কেয়ার বাংলাদেশে) যোগদানের মাধ্যমে, এবং সে সুবাদে টানা প্রায় এগার বছর একজন পূর্ণকালীন উন্নয়ন-পেশাজীবী হিসাবে কাজ করার মাধ্যমে। কাজেই বর্তমান প্রবন্ধের পেছনে একদিকে রয়েছে বিদ্যাজাগতিক পরিসরে থাকা অবস্থায় আহরিত আমার বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও জিজ্ঞাসা, এবং অন্যদিকে উন্নয়ন খাতে কাজ করার সূত্রে অর্জিত আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

উন্নয়ন ধারণার ইতিবৃত্ত

সমকালীন অর্থে ‘উন্নয়ন’ বলতে যা বোঝায়, এটি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সবাই কমবেশি জানেন যে দুনিয়া জুড়ে এই ধারণার প্রসার মূলত ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর কালে, যখন ইউরোপ-কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে গিয়ে অনেক নতুন দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে, এবং বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আসন পাকাপোক্ত করে নেয়। উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান – যেমন জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা, এবং কেয়ারের মত বেসরকারি সংগঠন (যাদের সবার জন্মসাল ছিল ১৯৪৫ বা এর কাছাকাছি) –  আত্নপ্রকাশ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপক প্রয়াসের অংশ হিসাবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ‘উন্নয়ন’ বলতে সচরাচর অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই বোঝানো হত, যেগুলি মূলত ছিল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। এ ধরনের উন্নয়নের ধারণার মূল উৎস ছিল এমন একটি ভাবাদর্শ যেখানে ‘পশ্চিমা’ দেশগুলিকে সবচাইতে ‘উন্নত’ ও ‘আধুনিক’ ধরে নিয়ে তাদের দেখানো পথে অগ্রসর হওয়াকে অন্য সবার জন্য কাঙ্ক্ষিত ও সম্ভব হিসাবে দেখা হত। টেকসই উন্নয়ন, অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন ইত্যাদি ধারণা এসেছে অপেক্ষাকৃত পরে, উন্নয়নের মূল ধারার বিভিন্ন ব্যর্থতা বা নেতিবাচক প্রভাবের কারণে, নানাবিধ সমালোচনা ও প্রতিরোধের মুখে। অবশ্য ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের দেখানো উন্নয়নের পথে হাঁটার বদলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নও বিশ্বের অনেক প্রান্তে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই প্রেক্ষিতে ধনতান্ত্রিক দেশসমূহের দেওয়া উন্নয়ন সহায়তার পেছনে সমাজবাদ (অর্থাৎ ‘কমিউনিজম’) ঠেকানোর অভিপ্রায়ও কাজ করেছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ মতাদর্শিক কাঠামোই বিশ্ব জুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে থাকে, যার ছায়াতে পরিচালিত হয়েছে উন্নয়নের ধারণাকে পরিশীলিত করার, এবং বিভিন্ন দেশের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে সাজিয়ে নেওয়ার নানাবিধ প্রয়াস।

অবশ্য উত্তরাধুনিকতাবাদের অভিঘাতে বিদ্যাজগতে উন্নয়ন সংক্রান্ত আলাপ আলোচনার মোড় অনেকটাই ঘুরে গেছে গত তিন দশকের মধ্যে। ‘কি ধরনের উন্নয়ন চাই’, বা ‘কিভাবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে’ এ ধরনের প্রশ্নের বদলে অনেকে নজর দিয়েছেন উন্নয়নের ধারণা যেভাবেই প্রয়োগ করা হোক না কেন, সেগুলির বাস্তব ফলাফল কি – এই বিষয়ের উপর। এ ধরনের বিশ্লেষণের সূত্রে উন্নয়নের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটা ক্রমবর্ধমান ধারা বিদ্যাজগতে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, কোনো দেশ, গোষ্ঠী বা জনসমষ্টিকে ‘উন্নয়নের লক্ষ্যবস্তু’তে পরিণত করার কাজটি যে শুধু জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, বরং  ক্ষমতা-চর্চার একটি বিশেষ পন্থা তথা ফলাফল, এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশ বা জনগোষ্ঠীকে কিভাবে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা যাবে, সে প্রশ্ন করার বদলে কারা কেন তাদেরকে ‘অনুন্নত’, ‘দরিদ্র’ ইত্যাদি হিসাবে আখ্যায়িত করছে, এবং সেটি করার ক্ষমতা কারা কখন কিভাবে পায়, বা এই ক্ষমতা প্রয়োগের বাস্তব ফলাফল কি দাঁড়ায়, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দিকেই অধিকতর মনোযোগ দেওয়া শুরু হয়।[৩] এ ধরনের দৃষ্টিকোণের প্রবক্তাদের মধ্যে অনেকে (যেমন Ferguson 1990,  Escobar 1995, Rahnema and Bawtree 1997) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিকল্পধারার উন্নয়ন (টেকসই, জনঅংশগ্রহণমূলক ইত্যাদি) অন্বেষার বদলে ‘উন্নয়নের বিকল্প’ খোঁজার উপরই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করতে শুরু করেন।[৪]

উন্নয়নের ঢেউ যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে লাগল

‘উন্নয়ন’ বিষয়ক বৈশ্বিক ডিসকোর্সে বাংলাদেশ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ কিভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক, আর্থসামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেই কাহিনীর একটা বড় অংশ জুড়ে আছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষদের তথা তাদের সহযোগী অনেক দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু কীর্তিগাঁথা। সেগুলির মধ্যে একদিকে আছে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ইউনুস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শুরু করে পৃথিবীর বৃহত্তম এনজিও হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ব্র্যাকসহ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অগণিত এনজিওর কাহিনী,[৫] অন্যদিকে মূলত শস্তা নারী শ্রমকে পুঁজি করে প্রসার লাভ করা রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, আর এদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠা বহু লক্ষ অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিক। তবে জাতীয় ‘মূলধারা’র এসব প্রবণতা থেকে দীর্ঘকাল ধরে অনেকটাই দূরে রয়ে গিয়েছিল  পার্বত্য চট্টগ্রাম, যে অঞ্চলের খবর যতটুকু দেশবাসী বা বিশ্ববাসীর কানে আসত, তা হত রাষ্ট্রীয় উপেক্ষা ও দমন নীতি সংক্রান্ত, বা বিদ্রোহ, সংঘাত ও সহিংসতার খণ্ডিত বয়ান।

তবে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে উন্নয়নের হাওয়া লাগতে শুরু করে, এবং এক পর্যায়ে সেখানে বৈদেশিক অনুদান-নির্ভর বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যক্রম চালু হয়ে যায়। শুরুর দিকে এসবের সাথে আমার তেমন কোনো প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সংস্কৃতি, আত্নপরিচয় ও উন্নয়ন’ নামে ১৯৯৮ সালে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম বটে (Tripura 1998), তবে তা ছিল মূলত পুঁথিগত বিদ্যার ভিত্তিতে লেখা। এর পরে বছর তিনেক আমি মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও বিভাগীয় সভাপতিত্বের পাশাপাশি সাংসারিক দায়িত্ব নিয়েই মগ্ন ছিলাম, যখন উন্নয়ন জগত সম্পর্কে বিশেষ খোঁজ খবর রাখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ২০০১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে কেয়ার বাংলাদেশে কাজ করার একটা প্রস্তাব পাই, যাতে শুরুতে অনীহা থাকলেও পরে আমি আগ্রহ দেখাই, এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কর্মসূচী সমন্বয়কারী’ হিসাবে উক্ত সংগঠনের একটি পরীক্ষামূলক ও রাঙ্গামাটি-ভিত্তিক নতুন পদে যোগদান করি।[৬] শুরুতে আমার পরিকল্পনা ছিল সর্বোচ্চ তিন বছর সেই পদে কাজ করে আবার শিক্ষকতায় ফিরে যাব, কিন্তু পরে আর সেটা হয়ে ওঠেনি। কেন তা হয়ে ওঠেনি, সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বর্তমান আলোচনায় অনেকটা অবান্তর। তবে কেয়ারে কাজ করার সময় এ অঞ্চলের উন্নয়নকে কিভাবে দেখতে চেয়েছিলাম, সে বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তার আগে অবশ্য কেয়ার সম্পর্কে দুটি কথা বলে নেওয়া দরকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া কেয়ার শুরুতে ছিল বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে তোলা একটি বিশেষ সংগঠন, যেটির মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে সরাসরি ত্রাণ সামগ্রী (‘কেয়ার প্যাকেজ’) পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এমন একটি সীমিত কর্মপরিধি ও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন কালক্রমে কিভাবে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি বিশাল উন্নয়ন সংস্থায় রূপান্তরিত হয়, সেটি বেশ লম্বা কাহিনী, যার পুরোটা এখানে বলার দরকার বা সুযোগ নেই। তবে এই রূপান্তরের কিছুটা কেয়ারের নামের পরিবর্তনশীল ব্যাখ্যার মাধ্যমেও বোঝানো যায়। কেয়ার (CARE) নামের আদি সম্প্রসারিত রূপ ছিল Cooperative for American Remittance in Europe, যা তিন দফা পাল্টে পরবর্তীতে Cooperative for Assistance and Relief Everywhere করা হয়। এসব পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আমি এমন এক সময়ে কেয়ারে যোগ দেই, যখন সংগঠনটির খোল-নলচে – ভিশন মিশন থেকে শুরু করে লোগো – সব পাল্টে গিয়েছিল। যেমন, ১৯৯৯ সালে কেয়ার Household Livelihood Security-কে তাদের কার্যক্রমের বিশ্লেষণী কাঠামোর একটি ভিত্তি হিসাবে বেছে নেয়, এবং ২০০০ সালে এসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে Rights-Based Approach (RBA) -এ কাজ শুরু করে। কেয়ারের এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মোটা দাগে তিনটি প্রধান পর্বে ভাগ করে দেখা যেতে পারে, প্রতীকীভাবে যেটাকে বলা যেতে এভাবে: শুরুতে কেয়ার ক্ষুধার্ত মানুষদের মাছ বিলাত; তবে একটা পর্যায়ে তারা মাছ ধরার বড়শি দিয়ে এর ব্যাবহার শেখাতে শুরু করে; তবে পরে বুঝতে পারে, ‘উপকারভোগী’ কোথায় মাছ ধরবে – অর্থাৎ জলাশয় বা ভূমিতে অধিকারের প্রশ্ন – সে কথা আগে ভাবার দরকার ছিল!

কেয়ারের আবির্ভাব ঘটেছিল খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে। জরুরি পরিস্থিতিতে এই পন্থায় দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করেই কেয়ার তার নাম কুড়িয়েছিল, কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের পেছনে গভীর কারণ রয়েছে, সেগুলির যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়া যে বেশিদূর আগানো যাবে না, এই উপলব্ধি (তথা উন্নয়ন জগতের পরিবর্তনশীল হাওয়া) কেয়ার নেতৃত্বকে বাধ্য করে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক আত্নসমীক্ষায়। তারা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দরিদ্রদের পাশে সত্যিকার অর্থে দাঁড়ানোর অর্থ তাদেরকে ক্ষুধার অন্ন জোগানো, বা প্রযুক্তি ও জ্ঞান হস্তান্তর করা নয়, বরং তাদের হারানো ভূমির অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, এবং তাদের নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার উপর আস্থা স্থাপনে কাজ করা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ।  কেয়ারের ভেতরে বিশ্বব্যাপী সূচিত এসব দৃষ্টিভঙ্গীগত পরিবর্তনের প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের কর্মকাণ্ডের গতিপথকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন, ১৯৯৯ সালে কেয়ার সেখানে একটা Livelihood Security Assessment সম্পন্ন করেছিল। আর আমি যখন ২০০১ সালের শেষ দিকে কেয়ারে যোগ দেই, তখন RBA-র আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো কেয়ার বাংলাদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলপত্র (LRSP) আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, ওটিকে সংগঠনের ‘বাইবেল’ হিসাবে মেনে চলে কাজ করতে। নবদীক্ষিত একজন উন্নয়ন কর্মী হিসাবে আমি সত্যিই তাই করার চেষ্টা করেছিলাম, উন্নয়নের ধারণাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখার বিদ্যাজাগতিক চশমা খুলে সরিয়ে রেখে!

কেয়ার সারা বাংলাদেশ জুড়েই বেশ ব্যাপক পরিসরে কাজ করে আসছিল অনেক বছর যাবত। তবে কেয়ার বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় কর্মসূচী বা প্রকল্পের কোনোটাই পার্বত্য চট্টগ্রামে চালু ছিল না। সেগুলিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্প্রসারণের কোনো  পরিকল্পনাও কেয়ারের ছিল না, কারণ সারা দেশ জুড়েই কেয়ারের বড় আকারের চলমান কর্মসূচীগুলিকে গুটিয়ে ফেলা বা ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চলছিল। অবশ্য ‘চলেন’ (CHOLEN, যার পূর্ণাঙ্গ রূপ হল CHT Children’s Opportunities for Learning Enhanced) নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক একটি ছোট কলেবরের মৌলিক শিক্ষা প্রকল্প চালু ছিল, যেটি বেশ ভালভাবেই চলছিল একদল নিবেদিত কর্মী ও কিছু স্থানীয় সহযোগী এনজিওর মাধ্যমে। সেই প্রেক্ষিতে চলমান কার্যক্রমের দেখাশোনায় বেশি সময় না দিয়ে আমার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচীর রূপরেখা প্রণয়ন করা, যার ভিত্তিতে এ অঞ্চলে কেয়ার ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।  কাজটা করতে গিয়ে আমি অধিকার-ভিত্তিক পন্থায় কাজ করতে গেলে কিভাবে এগুতে হবে, এ সম্পর্কে কেয়ারে তখন চালু ধ্যান ধারণার আলোকে অগ্রসর হয়েছিলাম। এ কাজে কেয়ারের সাংগঠনিক কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন সহকর্মীর সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেও সম্পৃক্ত করেছিলাম।  আমাদের প্রথম কাজ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে কি ধরনের সমস্যার উপর কেয়ার কাজ করবে, তা নিরূপণ করা, এবং সেই সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উপর কাজ করার পন্থা নির্ধারণ করা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হিসাবে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম এখানকার আদিবাসীদের প্রান্তিকতাকে, এবং এই প্রবণতার মূলে আমরা প্রধান যেসব কারণ চিহ্নিত করেছিলাম, যেগুলোর মধ্যে ছিল (CARE Bangladesh 2005):

  • পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা দেশের অন্যত্র আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকা;
  • আদিবাসীদের প্রতি ‘বৃহত্তর’ সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন নেতিবাচক ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গী;
  • রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান আদিবাসী-বিমুখ বিভিন্ন নীতিমালা ও চর্চার ব্যাপকতা, অথবা বিদ্যমান অনুকূল নীতিমালার প্রয়োগের অভাব;
  • ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রান্তিক অবস্থান, এবং নিজেদের শ্রমের ফসল বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পাহাড়ি কৃষকদের বিভিন্ন পন্থায় প্রতারিত ও বঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা।

এ ধরনের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, এবং বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকের সাথে কয়েক দফা আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য প্রযোজ্য উন্নয়ন কর্মসূচীর একটা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ধার্য করা হয় যেটির মূল কথা ছিল এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রান্তিকতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।  এক্ষেত্রে কাজের কিছু প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ভূমি (অধিকার ও উৎপাদনশীলতা, উভয় দিক)। প্রতিটা ক্ষেত্রেই এ অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য বিশেষ শাসন ব্যবস্থার আওতায় কাজ করা, এবং সেই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে সহযোগিতা দানের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, এবং এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে সকল কর্মকাণ্ডের মূলে থাকবে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন। এসব ক্ষেত্রে কেয়ার বা অনুরূপ কোন সংস্থার ভূমিকা কি হতে পারে, তার একটা তালিকা করা হয়েছিল নিম্নরূপ:

  • বিশ্লেষণ
  • প্রত্যক্ষ সহায়তা (জরুরি ত্রাণ, আর্থিক ও কারগরি সহায়তা প্রভৃতি)
  • উন্নয়নকামী স্থানীয় জনগণের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করা (এডভোকেসি)
  • অনুঘটকের ভূমিকা পালন (ফ্যাসিলিটেশন)
  • সংলাপের ব্যবস্থা করা ও মধ্যস্থতা

এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল, কেয়ারের মত বাইরের কোনো সংস্থা একা সব ধরনের কাজ করবে না, বরং তারা সময়ের পরিক্রমায় তালিকার নিচের দিকে থাকা কাজগুলিতেই বেশী নজর দেবে, এবং একটা সময় নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেবে। এক্ষেত্রে প্রত্যাশাটা ছিল এরকম যে, স্থানীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কাজ যাদের যেটা করার কথা, তারা সেগুলোকে যথাযথভাবে করতে শুরু করবে, ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা পেতে শুরু করবে কাঙ্ক্ষিত সেবা, প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের অধিকার এবং কেয়ারের মত প্রতিষ্ঠানের আর বিশেষ কোনো প্রয়োজন থাকবে না।

বাস্তবে অবশ্য বিভিন্ন কারণে কেয়ার পার্বত্য চট্টগ্রামে তার প্রত্যাশিত কর্মসূচী সে অর্থে শুরুই করতে পারেনি কখনো, এবং সে অবস্থাতেই সংগঠনটি সে অঞ্চল থেকে তার সকল কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয় (ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে আরো আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম কর্মসূচী সমন্বয়ের দায়িত্ব থেকে সরে এসেছিলাম)। তথাপি একভাবে কেয়ারের সূচিত বা পরিকল্পিত অনেক কর্মকাণ্ডই চালু থেকে গিয়েছিল, বা নতুন করে আবার চালু হয়েছিল, ইউএনডিপির মাধ্যমে। (বিষয়টি কাকতালীয় ছিল না, কারণ কেয়ার ও ইউএনডিপির মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপি তার কার্যক্রম শুরু করার ক্ষেত্রে নানাভাবে কেয়ারের সহায়তা নিয়েছিল।) কেয়ারে কাজ করার সময় শেষ দিকে বছর তিনেক পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে কোনো পেশাগত যুক্ততা ছিল না আমার ব্যক্তিগতভাবে, তবে পরে ইউএনডিপির ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন ফ্যাসিলিটি’তে যোগদানের পর আবার এ অঞ্চলে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ি আমি (২০০৯-২০১২)। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তথা অন্যান্য বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা সিদ্ধান্ত টেনেছি যে, কাগজে কলমে উন্নয়নের ধারণাকে যতই যৌক্তিক বা সুচিন্তিত মনে হোক  না কেন, বাস্তব দুনিয়া চলে ভিন্ন হিসাব নিকাশে, এবং সেখানে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কারা কিভাবে পুরো বিষয়টিকে দেখছে, নিজেদের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করছে – এসব বিষয়ের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। আর প্রচলিত অর্থে উন্নয়ন বলতে আমরা যা বুঝি, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তা এখনো ‘দাতা’দের চাহিদা ও পরিকল্পনা ধরেই পরিচালিত হয়।  এই বাস্তবতায় যতক্ষণ মৌলিক পরিবর্তন আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘কেমন উন্নয়ন চাই’ এই প্রশ্নের পাশাপাশি ‘আদৌ উন্নয়ন চাই কিনা’ সেটাকেও সামনে নিয়ে আসার দরকার রয়েছে।

উন্নয়ন ছাড়া কি গতি নেই?

বেশ আগে লেখা এক প্রবন্ধে (Tripura 1998) আমি গল্পচ্ছলে শোনা একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির একটা মন্তব্য তুলে ধরেছিলাম, যা ছিল এরকম, ‘আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষেরা উন্নয়ন ছাড়াইতো চলেছি বহু বছর। না হয় উন্নয়ন একটু দেরীতেই আসল, ক্ষতি কি?’ এখন ধরা যাক বিগত দুই তিন দশকে উন্নয়ন কতটা কি আকারে আসল, তা আমরা খতিয়ে দেখলাম, এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে, উন্নয়ন বলতে যা আমরা অনেকে প্রত্যাশা করেছিলাম, তা সে অর্থে এখনো আসেনি। এই প্রেক্ষিতে যদি কেউ বলে বসেন, উন্নয়নের দরকারইবা কি? এত সময়, মেধা ও অর্থ খরচ করে মরীচিকার মত যে উন্নয়নের পেছনে বহু মানুষ দৌড়াচ্ছে, তা যদি নাইবা আসে, ক্ষতি কি? ক্ষতির বদলে লাভওতো হতে পারে যদি সবাই তাদের সময় ও মেধা অন্য কোনোভাবে কাজে লাগায়! প্রসঙ্গত আবারো স্মর্তব্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উন্নয়ন’ ধারণাটা বিস্তার লাভ করেছিল ১৯৯৭ সালের ‘শান্তিচুক্তি’র প্রেক্ষিতে। কিন্তু যত সময় গেছে, সেই চুক্তির প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা, বিতর্ক ও মতপার্থক্য আরো বিস্তৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসাবে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিরাজমান জটিলতাসমূহের নিরসনের প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের মনোযোগ দেওয়ার দরকার রয়েছে। অবশ্য ‘চুক্তি বাস্তবায়ন’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়, ‘যেটুকু হয়নি, তা কবে হবে সে আশায় বসে থাকার কোনো মানে আছে কি? তা যদি আদৌ কখনো না হয়, তাতে কার কি লাভ বা ক্ষতি হচ্ছে?’ উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের রাঙ্গামাটি ঘোষণাপত্রের এক জায়গায় ‘শান্তি’ চুক্তি বাস্তবায়নের ধীর গতিতে উৎকন্ঠা ব্যক্ত করা হয়েছিল। এখন কথা হল, যে ধরনের উৎকন্ঠা ষোল বছর ধরে ব্যক্ত হয়ে আসছে, সেগুলি নিয়ে আর কতকাল মাথা ঘামাবে মানুষ? প্রায় অভ্যাসে পরিণত হওয়া এসব কথার বদলে নতুন কোনো চিন্তা, নতুন কোনো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসার সময় হয়নি কি? কথাগুলি আমি বলছি স্রেফ আমাদের চিন্তায় একটু নাড়া দেওয়ার জন্য, সবার ভাবনাকে একটু উস্কে দেওয়ার জন্য।

ভাবনার খোরাক হিসাবে উন্নয়ন বিষয়ে আর একটি কথা যোগ করেই বর্তমান আলোচনার ইতি টানব। এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতির লোকেরা নিজেদের ভাষায় ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে কিভাবে কথা বলে? তারা কি এর কোনো প্রতিশব্দ তৈরি করেছে, নাকি বাংলা ‘উন্নয়ন’ শব্দটাই ব্যবহার করে? এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলার পর দেখলাম, যেমনটা ধারণা করেছিলাম, বাস্তবে উন্নয়নের কোনো বহুল প্রচলিত নিজস্ব প্রতিশব্দ কোনো ভাষাতেই চালু নেই, তবে ‘উপরে ওঠা’, ‘বিকাশ’, ‘ভালো থাকা’ ইত্যাদি বোঝায়, এ ধরনের শব্দকে উন্নয়ন অর্থে ব্যবহার করেন অনেকে, আবার সরাসরি বাংলা ‘উন্নয়ন’ শব্দও অনেকে ব্যবহার করেন।[৭]  এসব বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হল,  ‘বিকাশ’ অর্থে ‘উন্নয়ন’ শেখানোর দরকার পড়ে না উদ্ভিদ বা পশুপাখির বেলায় – তারা আপনাআপনিই বিকশিত হয় অনুকূল পরিবেশ পেলে। মানুষের বেলায় তাহলে ‘উন্নয়ন’ শেখাতে বা তা নিয়ে এত ভাবতে হবে কেন? অন্যদিকে গাছের বিকাশের জন্য যে আলো বাতাস পানি খনিজ দরকার, সেগুলো তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অবস্থায় যদি প্রশ্ন ওঠে, তার বিকাশ কিভাবে দেখতে চাই, উত্তরটা স্পষ্ট নয় কি?

<>

টীকা

[১] এই লেখাটি হল বহুজাতির বাংলাদেশ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ২০১৫) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একই শিরোনামের একটি নিবন্ধের ঈষৎ সম্পাদিত ভাষ্য। সেই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছিল রাঙ্গামাটিতে জুন ১৩ ও ১৪, ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘আদিবাসী ফ্যাসিলিটেটর্স গ্রুপ’-এর ৫ম সহায়ক সম্মেলনের প্রথম দিনে উপস্থাপিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নকে কিভাবে দেখতে চাই?’ শীর্ষক প্রবন্ধটি একটু সংক্ষিপ্ত আকারে সম্পাদিত করে। উল্লেখ্য, উক্ত সম্মেলনে আয়োজকদের পক্ষ থেকে উত্তরা ত্রিপুরা ও নুকু চাকমার করা প্রাথমিক যোগাযোগ অনুসারে এটির প্রাথমিক শিরোনাম ঠিক করা হয়েছিল। প্রবন্ধটি উপস্থাপনার পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটা সমৃদ্ধ আলোচনা হয়েছিল জনলাল চাকমা, আজিজুর রহমান খান, অশোক কুমার চাকমা প্রমুখের অংশগ্রহণে, তবে প্রবন্ধের বর্তমান ভাষ্যে সেই আলোচনার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয়নি।

[২] একজন প্রবন্ধকার হওয়ার পাশাপাশি আমি উক্ত সম্মেলনের সহ-আহ্বায়কও ছিলাম (মূল আহ্বায়ক ছিলেন রাজা দেবাশীষ রায়), কিন্তু অনিবার্য কারণে শেষ পর্যন্ত আমি আর অনুষ্ঠানে থাকতে পারিনি।  যাহোক, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন-বিষয়ক চিন্তাভাবনার ইতিহাসে সেই সম্মেলনটি একটা মাইলফলক হয়ে আছে, কারণ সেখানে গৃহীত হয়েছিল ‘রাঙামাটি ঘোষণাপত্র’ (ডিসেম্বর ১৯, ১৯৯৮), যেটাকে দেখা যেতে পারে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে কেমন উন্নয়ন দেখতে চাই?’ এই প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট অনেকে মিলে তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখা হিসাবে।

[৩] এ বিষয়ে কবির দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটি অনবদ্য বয়ান তুলে ধরেছেন তারাপদ রায়, তাঁর ‘দারিদ্র রেখা’ কবিতায় (যা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়)।

[৪] উল্লিখিত লেখকদের একজন (Escobar) যে সময় বার্কলেতে তাঁর পিএইচডি শেষ করছিলেন, সে সময় একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শুরু করেছিলাম। আমার ছাত্রাবস্থাতেই উল্লিখিত আরেকজন লেখক – Majid Rahnema – সেখানে বেশ কয়েকবছর শিক্ষকতা করেছিলেন। শেষোক্ত জন ছিলেন ইরানে শাহের শাসনামলের একজন মন্ত্রী, যিনি একসময় জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধিও হয়েছিলেন, এবং পরে মালিতে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছিলেন। বার্কলেতে ছাত্র থাকাকালে আমি রাহনেমার দু’একটি লেকচার শুনেছিলাম, তবে এস্কোবারের কাজ সম্পর্কে তখন বিশেষ কিছু জানতাম না বা তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও ঘটেনি।

[৫] বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা অনেকে এদেশে এনজিওদের প্রসার লাভের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন (যেমন আনু মুহাম্মদ ১৯৮৮), তবে এসব লেখালেখি বিভিন্ন বাম সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক হারে এনজিও কর্মীতে পরিণত হওয়া রোধ করতে পারেনি।

[৬] এটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য সৃষ্টি করা ‘প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর’ পদ, যা সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের পোস্ট ছিল, এবং এটি তৈরি করা হয়েছিল কেয়ারের সাংগঠনিক ও কর্মসূচীগত পুনর্গঠনের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। সেই সুবাদে আমাকে প্রতি এক সপ্তাহ অন্তর ঢাকায় এসে ‘একজিকিউটিভ ম্যানেজমেন্ট টিম’-এর সভায়ও যোগ দিতে হবে, এমন ছিল ব্যবস্থা, ফলে ঢাকার হেডকোয়ার্টারেও আমার বসার ব্যবস্থা ছিল। যাই হোক,  ২০০১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ যখন অপ্রত্যাশিতভাবে উক্ত পদে কেয়ার বাংলাদেশে কাজ করার প্রস্তাব পাই, তা আমি প্রাথমিকভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ এনজিওতে কাজ করব, এমন কোনো ভাবনা তখন আমার মাথায় ছিল না। সত্যিকার অর্থে, কেয়ার কি ধরনের সংগঠন, তাই আমি জানতাম না তখন। তবে কয়েকমাস পর কেয়ারের পক্ষ থেকে যখন আমার সাথে আবার যোগাযোগ করা হয়, তখন একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কারণে – একটি পরিবর্তিত পারিবারিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে রাঙামাটিতে থেকে কাজ করা আমার জন্য সাময়িকভাবে সুবিধাজনক হবে দেখে – আমি তাদের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাই। এরপর বেশ লম্বা একটা প্রক্রিয়া পার হয়ে নভেম্বর ২০০১-তে আমি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কর্মসূচী সমন্বয়কারী’ হিসাবে কেয়ারে যোগদান করি।

[৭] বিভিন্ন পাহাড়ি ভাষায় উন্নয়ন শব্দের কি ধরনের প্রতিশব্দ আছে, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে আমি যাঁদের সাথে কথা বলেছি, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ক্য সা চিং, মৃনাল কান্তি ত্রিপুরা, উছাছা-এ চাক (ঊষা), যোহন ম্রো, প্রবীর ত্রিপুরা, পাইচিংমং মারমা, সুখেশ্বর চাকমা, অরুণেন্দু ত্রিপুরা ও কং চাই। তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, তবে বলা বাহুল্য, আমার বোঝার মধ্যে কোনো ত্রুটি বা ঘাটতি থেকে থাকলে সে দায় তাঁদের কারো উপর বর্তায় না।

তথ্যসূত্র

  1. আনু মুহাম্মদ (১৯৮৮) বাংলাদেশে উন্নয়ন সংকট ও এনজিও মডেল, প্রচিন্তা প্রকাশনী, ঢাকা।
  2. প্রশান্ত ত্রিপুরা (২০১৫) বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, সংবেদ, ঢাকা।
  3. CARE Bangladesh (2005) Overcoming Marginalization: A Program Strategy Paper for the CHT Region. [Unpublished document: Revised draft, March 2005]
  4. Escobar, Arturo (1995) Encountering Development: The Making and Unmaking of the Third World.  Princeton: Princeton University Press.
  5. Ferguson, James (1990) The Anti-Politics Machine: “Development”, Depoliticization, and Bureaucratic Power in Lesotho.  University of Minnesota Press.
  6. Rahnema, Majid and Victoria Bawtree (1997) The Post-Development Reader.  Dhaka: University Press Limited.
  7. Tripura, Prashanta (1998) Culture, Identity and Development in the Chittagong Hill Tracts. in Discourse: A Journal of Policy Studies, Vol. 2, No. 2 [Dhaka:  Institute for Development Policy Analysis and Advocacy at Proshika, 1998] [Reprinted in The Chittagong Hill Tracts: Life and Nature at Risk, ed. P. Gain, Dhaka: SEHD, 2000] (নিবন্ধটির পিডিএফ ভাষ্য লেখকের ইংরেজি ব্লগ Neolithic Musings থেকে নামিয়ে নেওয়া যাবে; লিংক:   http://ptripura2.files.wordpress.com/2014/01/p-tripura-culture-development.pdf)