Monthly Archives: এপ্রিল 2024

ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞান

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

ধর্ম ও জাদুর মত ধারণা নৃবিজ্ঞানে যে ধরনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরার পাশাপাশি এই পোস্টে ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং পার্থক্য নিয়ে নৃবিজ্ঞানী জেমস ফ্রেজারের আলোচনার একটা সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়েছে। তবে তা এই পোস্টে সরাসরি তুলে দেওয়ার পরিবর্তে এতে মূলত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান পরিচিতি  শীর্ষক একটি পাঠ্যবইয়ের ধর্ম-বিষয়ক অধ্যায়ের অংশবিশেষ (পাঠ-৩: ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক) একটি পিডিএফ ফাইল হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পাঠ্য বইটির লেখকদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম, এবং সেই সুবাদে এটির ভূমিকা আমি লিখেছিলাম (যেটির অংশবিশেষ এই ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে ‘নৃবিজ্ঞান পরিচিতি’ শিরোনামে)। ভূমিকার পাশাপাশি বইটির আরও যে দু’একটি অধ্যায় লেখার দায়িত্ব আমার ছিল, সেগুলির একটি ছিল ধর্ম-বিষয়ক অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের শুরুতে নৃবিজ্ঞানে ধর্মের ধারণা সংক্রান্ত যে আলোচনা রয়েছে, সেটির অংশবিশেষ নিচে তুলে দেওয়া হল:

নৃবিজ্ঞানে সাধারণভাবে ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত সত্তা, ক্ষমতা বা শক্তি সংক্রান্ত বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সামষ্টিক রূপ হিসাবে। ‘অতিপ্রাকৃত’ বলতে বোঝায় সেইসব বিষয় যেগুলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক জগতের বাইরে বা উর্ধ্বে বলে গণ্য করা হয়, যেগুলোর অস্তিত্ব বা সত্যতা নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাসের উপর। প্রতিটা সমাজেই ‘অতিপ্রাকৃত’ জগতের সাথে মানুষের সম্পর্ককে ঘিরে বিভিন্ন বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্ম লক্ষ্য করা যায়। তবে সকল সংস্কৃতিতে ‘অতিপ্রাকৃত’ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক জগতের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা হয় না। যেমন, ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এমন অনেকের কাছে এসব সত্তা চারপাশের গাছপালা পাহাড়-পর্বত জীবজন্তুর চাইতে কোনো অংশে কম ‘বাস্তব’ নয়।   

উল্লেখ্য, ধর্মের ধারণা সংক্রান্ত আলোচনার যে ছোট অংশ উপরে তুলে দেওয়া হল, এটি এই পোস্টে জুড়ে দেওয়া পিডিএফ ফাইলে নেই, যেখানে মূলত জাদুর ধারণার উপরই আলোকপাত করা হয়েছে, সে সাথে জাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও পার্থক্য বিষয়ে ফ্রেজারের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে। পিডিএফ ফাইলের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃতি হিসাবে দেওয়া হল যদি কোনো পাঠক পুরো ফাইলটা নামিয়ে পড়ে দেখার আগে একটা ধারণা পেতে চান এতে কি ধরনের আলোচনা রয়েছে।

মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে বিশেষ কলাকৌশল প্রয়োগ করে অতিপ্রাকৃত শক্তি বা সত্তাসমূহকে বশে আনা যায়, সেগুলোর সাহায্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইপ্সিত ফলাফল অর্জন করা যায়, তখন এ ধরনের বিশ্বাস ও কলাকৌশলকে নৃবিজ্ঞানীরা ‘জাদু’ হিসাবে চিহ্নিত করেন।

[জেমস ফ্রেজারের] মতে মানব সমাজে জাদুর অস্তিত্ব ছিল ধর্মের উৎপত্তির আগে। জাদুর সাহায্যে অতিপ্রাকৃতকে আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকে ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বলে ফ্রেজার মনে করেন। … আমরা দেব-দেবী বা ইশ্বরের কাছে বিশেষ কিছু চাইতে পারি, কিন্তু এটা ধরে নিতে পারি না যে, যা আমরা চাইব, তা পাবই। পক্ষান্তরে জাদু-বিশ্বাস অনুসারে নির্দিষ্ট কোনো কলাকৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসতে বাধ্য। ধর্মে মানুষ অতিপ্রাকৃতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, কিন্তু জাদুতে সে চেষ্টা করে অতিপ্রাকৃতকে বশে আনার। এদিক থেকে জাদু-বিশ্বাসের মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্য কাজ করে।

জাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞান ধারণাসমূহ ফ্রেজার যে ধরনের অর্থে ব্যবহার করেছেন, সেগুলি বোঝানোর জন্য এখানে আমরা কিছু বাস্তব উদাহরণ বিবেচনায় নিতে পারি। জাদুর একটি উদাহরণ হিসাবে বৃষ্টির আশায় ‘ব্যাঙের বিয়ে’ দেওয়ার রীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভাবুন, কোন্‌ অর্থে এই রীতির পেছনে জাদু-বিশ্বাস ক্রিয়াশীল? আল্লাহ্‌ বা ইশ্বরে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি হয়ত বলবেন, বৃষ্টি নামা না নামা সম্পূর্ণ আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর নির্ভর  করে, কাজেই বৃষ্টি চাইলে ‘মোনাজাত’ করাই শ্রেয়। পক্ষান্তরে একজন বিজ্ঞানী প্রকৃতির বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বৃষ্টির সম্ভাব্যতা নিরূপণ করবেন, এবং, তিনি আস্তিক বা নাস্তিক যাই হোন না কেন, আকাশে বিশেষ কোনো পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি নামানোর কোনো ব্যবস্থা থাকলে তিনি প্রয়োজনে তা কাজে লাগাবেন।

ফ্রেজারের দৃষ্টিকোণ থেকে জাদু একাধারে ‘ভ্রান্ত বিজ্ঞান’ বা ‘প্রকৃত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী’ বিবর্জিত  বিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু জাদুর যদি কোনো ‘কার্যকারিতা’ নাই থাকে, তাহলে সমকালীন বহু মানুষের মধ্যে কেন নানা ধরনের জাদু-তুল্য বিশ্বাস ও আচার আচরণ লক্ষ্য করা যায়? সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দল বেঁধে ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা করা বা বৃষ্টির জন্য সবাই মিলে মোনাজাত করা কোনোটাই আসলে নিরর্থক নয়, যেমনটা মনে হতে পারে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মুখস্থ সূত্র মেনে সমাজ-সংস্কৃতি ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে চাওয়ার স্থূল প্রচেষ্টা থেকে। এসব বিষয়ে নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও একটু বিস্তারিত আলোচনা পড়তে আগ্রহী পাঠক নিচে দেওয়া পিডিএফ ফাইলটা পড়ে দেখতে পারেন।