তিরিশ বছরের একটি সম্পর্কের কাহিনী

প্রশান্ত ত্রিপুরা

ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তারিখে, আমার জীবনের একটা বিশেষ সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।[১] এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ভালোবাসা ও স্বপ্ন, কিন্তু এতে কখনো কোনো সংশয় বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব যে এসে পড়েনি, তা নয়। এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছে কিভাবে তিরিশ বছর আগের এই দিনে নির্ঘুম এক রাত কাটানোর পর সাত সকালে আমি আমার তৎকালীন সহকর্মী তথা পরবর্তীকালের স্ত্রী আইনুনের মোহাম্মদপুরস্থ তাজমহল রোডের পারিবারিক বাসায় হাজির হয়েছিলাম অনাহূতভাবে। উল্লেখ্য, আমাদের সহকর্মী পরিচয়টাই তখন মুখ্য ছিল, অন্তত আমাদের আশপাশের অন্য সবার কাছে, যার প্রেক্ষিতে আইনুনদের যৌথ পরিবারের বাসায় আমার সেই আকস্মিক প্রাতঃকালীন উপস্থিতি একাধারে অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব ছিল। তবে তাদের বাসায় যেহেতু আগে থেকেই আমার আসা যাওয়া ছিল, একটু ব্যতিক্রমী সময়ে সেখানে গেলেও সেদিন সকালের নাশতাসহ সাদর আপ্যায়ন ঠিকই পেয়েছিলাম। সে যাই হোক, এখানে যে গল্পটা বলতে বসেছি, তা আইনুনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নয়! বরং আমি বলতে বসেছি একটি শব্দের সাথে আমার সম্পর্কের কথা, যে শব্দটি একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের একটা প্রান্তিক অংশের কাছে আশা-ভরসা-স্বপ্ন তথা যৌথতা ও আন্দোলনের আধার হয়ে উঠতে শুরু করেছিল ১৯৯৩ সাল নাগাদ। আমি বলছি ‘আদিবাসী’ শব্দটির কথা, যেটির সাথে উল্লিখিত বছরের আগে আমার নিজের সুপরিচিতি বা ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিল না (এ প্রসঙ্গে পরিশিষ্ট-১-এ সংযুক্ত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।

অনেকে হয়ত জানেন, ১৯৯৩ সাল ছিল জাতিসংঘ-ঘোষিত International Year of the World’s Indigenous People, যেটির বাংলা করা হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার যে অবস্থান নিয়েছিল – ‘বাংলাদেশের উপজাতীয়রা এদেশের আদিবাসী নয়’ (যে ধরনের বক্তব্য সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতেও পরিচিত মনে হতে পারে অনেকের কাছে) – সেটির বিপরীতে গিয়ে তৎকালীন দু’জন আওয়ামি লীগ দলভুক্ত তথা বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ঢাকায় বেসরকারিভাবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯৩ তারিখে[২] আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেটিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর।[৩]

উপরে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমি ছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন প্রভাষক। উল্লিখিত ভূমিকায় আমার শিক্ষকতার বয়স হয়েছিল মাত্র দু’বছর, কাজেই নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বটা বেশ গুরুই মনে হয়েছিল আমার কাছে। তদুপরি জাতিসংঘের মত পরিসরে ঠিক কোন অর্থে ও কোন উদ্দেশ্যে ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’[৪] কথাটার প্রচলন শুরু হয়েছিল, বাংলা ‘আদিবাসী’ শব্দটি একই অর্থ বহন করে কিনা, এসব বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো পূর্বধারণা ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটেই খেটেখুটে নিজের প্রবন্ধটা শেষ করেছিলাম একেবারে শেষ মুহূর্তে, সেমিনারের নির্ধারিত দিনের ভোরে। (আজকের মত তখন আঙুলের ডগায় ইন্টারনেট, গুগল, মোবাইল ফোন প্রভৃতি কিছুই ছিল না। কাজেই আমার কাছে অপেক্ষাকৃত নতুন ছিল এমন একটি বিষয়ে নানান সূত্র যাচাই করে অল্প সময়ে লেখা দাঁড় করানো সহজ ছিল না।)

মনে পড়ে, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারারাত জেগে মোহাম্মদপুর টাউন হলে সেখানকার এক পেশাদার টাইপিস্টকে দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ’ শীর্ষক আমার প্রবন্ধটি টাইপ করিয়েছিলাম।[৫] এরপর ১৮ তারিখ ভোরে কাজ শেষ করে সাত সকালে হাজির হয়েছিলাম আইনুনদের বাসায়, যেখানে প্রাতঃরাশ সেরে আমি সরাসরি চলে গিয়েছিলাম সেমিনারে অংশ নিতে। সেদিন যে প্রবন্ধ আমি পাঠ করেছিলাম, সেটি এক অর্থে ফরমায়েশি লেখা হলেও এর জন্য আমার কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ পাওয়ার, বা ক্ষমতাসীন কাউকে তুষ্ট করার, কোনো ব্যাপার ছিল না। আর তখন বয়সে ছিলাম তরুণ। মনের ভেতরে ছিল টাটকা কিছু ধ্যানধারণা, স্বপ্ন ও আশাবাদ। তাই দেশের আদিবাসী জনগণের প্রতি অনুভূত একাত্মতাবোধকে বুকে ধারণ করে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান অনুযায়ী যে ধরনের প্রবন্ধ আমার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল, তাই আমি তৈরি করেছিলাম সানন্দে, ভালোবাসার স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে যে স্বপ্নকে সামনে রেখে আমি লেখাটা লিখেছিলাম, সেটি আরো অনেকেই ধারণ করতেন, এবং এখনো করেন বলেই আমার বিশ্বাস। হতে পারে এমন মানুষেরা সংখ্যায় কম। আর সাধারণভাবে যাদের কথা আমরা আলোচনা করছি, সেই আদিবাসীদের সংখ্যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনমিতিকভাবে এতই কম যে, তাদেরকে প্রতিনিয়ত ‘ক্ষুদ্র’ বিশেষণে আখ্যায়িত করে, তাদের ‘নগণ্য’ বিবেচনা করে, নিজেদের গুরু-ত্বতে আশ্বস্ত অনুভব করার লোকের অভাব নেই এদেশে। তার উপর জাতীয় নির্বাচনের মত বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে তেমন প্রেক্ষিতে আদিবাসীদের সাংখ্যিক তথা রাজনৈতিক ‘নগণ্য’তা সরচারচর অনেক প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে বেশিরভাগ জায়গাতেই। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে সুদূর পরাহত কোনো স্বপ্ন নিয়ে ভাবার অবকাশ খুব একটা থাকে না কারও। তবুও যেমনটা আমি ১৯৯৩ সালের লেখায় বলেছি, ‘আদিবাসী’দের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে শুধু তাদের স্বার্থে নয়, বরং দেশের তথা বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ মাত্রায় ধরে রাখার একটা দীর্ঘমেয়াদী বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রচনার তাগিদেই। আসুন, সে আলাপ আমরা করে যেতে থাকি সময় সুযোগ পেলেই, আগামী তিরিশ, পঞ্চাশ বা একশ’ বছর পরের সম্ভাব্য বিশ্বকে কল্পনায় রেখে (এ প্রসঙ্গে পাঠক পরিশিষ্ট-২ দেখে নিতে পারেন)।

পরিশিষ্ট-১: নিজের লেখালেখিতে ১৯৯৩ সালের আগে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার একমাত্র নমুনা  

‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উপলক্ষে ১৯৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর উপস্থাপনার জন্য যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তার আগে নিজের পুরানো কোনো শখের লেখালেখিতে বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো প্রবন্ধে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম, এমন বিশেষ কোনো নমুনা খুঁজে পাইনি একটা ব্যতিক্রম বাদে। ব্যতিক্রমটার কথা আমি উল্লেখ করেছি ‘অরণ্য থেকে অন্তর্জালে, রাঙা মাটির পথ থেকে রাজপথে’ শীর্ষক আমার একটি নিবন্ধে, যেখান থেকে একটা  প্রাসঙ্গিক বিবরণ নিচে তুলে দেওয়া হল।

আমি ‘আদিবাসী’ শব্দটা নিয়ে ছোট বেলায় কখনো খুব বেশী মাথা ঘামিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে কিশোর বয়সে লেখা নিজের একটা কবিতায় আমি এটা খুঁজে পেয়েছি। ‘ওপার’ নামের এই কবিতার শুরুটা এরকম:

এই মাঠটাকে হঠাৎ, কাজ করতে করতে
মনে হল বড় বেশি ফাঁকা, ধু ধু –
চলে গেলাম নদিটার ওপাশে,
ওই পারের সবুজ বনে, নীল পাহাড়ে।

সেখানে আমি গত দিনগুলিতে
ফসল ফলিয়েছি,
গতকালও আমি আদিবাসী ছিলাম –
সেখানে জুমচাষ করেছি।

[ঢাকা, ১৯৭৯]

যে সময় আমি কবিতাটা লিখেছিলাম, তখন [উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের শিক্ষার্থী হিসাবে] আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, এই দুটি ভূমিকার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া, যেভাবে সময় ও পরিপার্শ্ব ঠিক করে দিয়েছিল। সে অনুযায়ী [১৯৮০ সালে] উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বুয়েটে ঢুকলাম তড়িৎ প্রকৌশলী হওয়ার চিন্তায়।  সেখানে একটা ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া, রাত জেগে পোস্টার লেখা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে বছরখানেক জড়িত থাকার পর হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম একটা বৃত্তি, তাও আবার এমন একটা দেশে, যেটির কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে স্লোগান দিতাম! … বিদেশে পাড়ি দিলাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী হবার চিন্তা করে…কিন্তু আট বছর পরে ফিরে এলাম অর্ধপক্ক এক নৃবিজ্ঞানী হিসাবে [যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ‘আদিবাসী’ বা ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’-এর ধারণা নিয়ে সরাসরি খুব একটা মাথা ঘামাইনি!]।

পরিশিষ্ট-২: ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার তথা এই ধারণার তাৎপর্য সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক ভাবনা

‘আদিবাসী’ শব্দ তথা ধারণাকে ঘিরে বেশ অনেকদিন ধরে যেসব বিভিন্নমুখী আলোচনা ও বিতর্ক দেখে গেছে, তার প্রেক্ষিতে নতুন করে আমিও বেশ লেখালেখি করেছিলাম ২০১৩ সালে। সেই বছর লেখা একটি নিবন্ধে (যা ‘আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে: বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনর্নির্মাণের দুই দশক (১৯৯৩-২০১৩)’ শিরোনামে এই ব্লগে রয়েছে) যে কথাগুলি দিয়ে আমি উপসংহার টেনেছিলাম, তা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। তাই কথাগুলি নিচে আবার তুলে ধরা হল।

[১৯৯৩ সালে] যে প্রত্যাশা নিয়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের পক্ষে ওকালতি করতে শুরু করেছিলাম আমরা অনেকে, তার কিছু দিক ভালভাবেই পূরণ হয়েছে এর মধ্যে। যেমন,  আদিবাসীদের মধ্যে এই পরিচয় স্বেচ্ছায় ও সগৌরবে ধারণের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সেসাথে এ নামে যারা পরিচিত, বা পরিচিত হতে আগ্রহী, তারা যে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কিছু অধিকার পাওয়ার দাবীদার, এ নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে সচেতনতা বেড়েছে।  এক্ষেত্রে অবশ্য অনেকের মধ্যে প্রত্যাশার পরিধিও হয়তবা একটু বেশিই বেড়েছে, যেনবা ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি পেলেই সকল ধরনের বঞ্চনা থেকে সহসা মুক্তি মিলবে। অন্যদিকে, আদিবাসী ধারণার বিরোধীরাও বসে ছিল না, বা বসে নেই, এবং কিছু ক্ষেত্রে তারাও তাদের অবস্থান সংহত করতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে মোটা দাগে আদিবাসী ধারণার প্রতি বিরোধিতার দ্বিবিধ কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন, একদল আছে যারা মনে করে আদিবাসীদের অনেক বেশী ছাড় দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে, এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তাদেরকে আদিবাসী হিসাবে মেনে নেওয়া হলে তাতে নানাভাবে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে। আরেকদল আছে যারা মনে করে, ‘আদিবাসী’ (বা ইনডিজেনাস) ধারণা আসলে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস সঞ্জাত অপরাধবোধ লাঘবের জন্য উদারনৈতিক পশ্চিমাদের একটি ফন্দি, যা শেষ পর্যন্ত বর্তমান ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থই বেশি রক্ষা করে। …

‘আদিবাসী’ শব্দটির উপর কথিত সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণমাধ্যম ও উন্নয়ন ডিসকোর্সে এটির ব্যাপক ব্যবহার (ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’ এবং তার সমার্থক হিসাবে বাংলা ‘আদিবাসী’) অনেকটাই অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কারা শব্দটি ব্যবহার করছে, তার চাইতেও বড় কথা কোন্‌ অর্থে এবং কী উদ্দেশ্য তারা তা করছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ‘আদিবাসী’ শব্দটা ব্যবহার করলেই যেমন ধরে নেওয়া যাবে না যে সে সংশ্লিষ্ট নামে অভিহিত কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার, সংস্কৃতি বা ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন, তেমনি শব্দটি ব্যবহারে কেউ আপত্তি করলেই এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, সে উক্ত জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে চায় না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা, আইন, সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রভৃতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেগুলিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আছে কি নেই, এমন বাহ্যিক বিষয়ের চাইতেও সেগুলির অন্তঃসারের দিকে নজর দিতে হবে। …

রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদিবাসীরা সব ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে, তা নয়। তেমনটা রাতারাতিতো হবেই না, দীর্ঘ মেয়াদেও কতটুকু হবে, তা দেখার বিষয়। এখানে সংশয়ের দুটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথমত, আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ যতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে দেওয়া আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা-নির্ভর প্রকল্প-ধর্মী উদ্যোগের মধ্যে সীমিত থাকবে, ততদিন সেগুলির তেমন কোন ব্যাপ্তি ও গভীরতা আশা করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে, আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের পেছনে একটা প্রধান কারণ হচ্ছে ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার বর্তমান দাপট, এবং ‘জাতিসংঘ’ হচ্ছে মূলত জাতিরাষ্ট্রসমূহের একটি সংগঠন, যা কাজ করে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও আপোসের মধ্য দিয়ে। কাজেই এমন একটি সংগঠনের ছায়ায় আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের মৌলিক সুরাহা কতটা হবে, তা তলিয়ে দেখার বিষয়।  তার মানে আবার এই না যে, ‘আদিবাসী’ ধারণাকে সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার মনে করে সম্পূর্ণ পরিহার করে চলতে হবে, যেমনটা বিভিন্ন ঘরানার মতাদর্শিক অবস্থান থেকে অনেকে বলে থাকেন।

চলমান বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, বিতর্ক ও প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে আদিবাসী ধারণাকে বর্তমানে আমি নিজে যেভাবে তুলে ধরতে চাই, তা হল এই, এটি যেমন সর্বরোগহর কোন দাওয়াই নয়, তেমনি নয় কোন চেতনানাশক বড়ি, বা কোন বিষবৃক্ষের গুপ্ত বীজ। আদিবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আদিবাসী হিসাবে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তাদেরকে সর্বাগ্রে ঘর গোছাতে হবে, এবং অভিন্ন কিছু লক্ষ্য, পন্থা ও ক্ষেত্রকে ঘিরে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।  পাশাপাশি তাদেরকে মিত্র বাছার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে, এবং সচরাচর বৈরী বলে বিবেচিত, এমন পরিসরেও সহায়ক শক্তির খোঁজে চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। আর ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার থাকা না থাকাকে বিভিন্ন উদ্যোগ, নীতি, কর্মসূচী প্রভৃতির মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি না ধরে, শেষোক্ত বিষয়গুলির অন্তঃসারের উপর অনেক বেশী মনোযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রবক্তা হবেন, তাঁদেরকে দেশ ও বিশ্বের সামনে এ ধারণার সার্বজনীন আবেদন তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে দেশ বা বিশ্ব আদিবাসীদেরকে কি দিতে পারে, সেটার চাইতেও বেশি জোর দিতে হবে, ‘আদিবাসী’ ধারণার ধারক-বাহক-প্রবক্তারা দেশ বা বিশ্বকে কি  দিতে পারে, এ বিষয়ের উপর। এ প্রসঙ্গে আমার ‘আদিবাসী চেতনার সন্ধানে’ নামের একটি লেখায় যেমনটা বলেছি, ‘আদিবাসী’ শব্দটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ‘বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি অন্তত তিনটি আদর্শ, যেগুলোর জোরালো অস্তিত্ব ছিল বা রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে। এই আদর্শগুলো হল- প্রকৃতি সংলগ্নতা, সমতা ও সহভাগিতা।

টীকা


[১] এই লেখাটির প্রথম অংশটা হল ‘পঁচিশ বছর আগের একটি সম্পর্কের কাহিনী’ শিরোনামে ১৭/১২/২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি ফেসবুক পোস্ট-এর হালনাগাদকৃত ও সম্পাদিত তথা টীকাযুক্ত ভাষ্য, যেটির সাথে ‘পরিশিষ্ট’ হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আমার পূর্বপ্রকাশিত আরও দু’একটি প্রাসঙ্গিক লেখা থেকে নেওয়া কিছু উদ্ধৃতি।

[২] ১৯৯৩ তারিখে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদ্‌যাপনের জন্য যে তারিখ বেছে নেওয়া হয়েছিল, তার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল: সেটা এই যে, ১৯৯০ সালের ১৮ই ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ১৯৯৩ সাল পালিত হবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতাতেই পরে এসেছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক, আদিবাসী দিবস ইত্যাদি।

[৩] উল্লেখ্য, মূল প্রবন্ধ লেখার দায়িত্বের পাশাপাশি কাগজে কলমে আমাকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদ্‌যাপনের জন্য গঠিত একটি পরিচালনা পরিষদের সদস্য করা হয়েছিল, এবং অধিকন্তু ‘স্মরণিকা ও প্রকাশনা উপ-কমিটি’র আহ্বায়কও করা হয়েছিল (এই উপ-কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন সঞ্জীব দ্রং, প্রতিম রায় পাম্পু, মংনু চিং, আসিফ মুনীর, রেমন্ড আরেং, প্রমুখ)। মজার ব্যাপার হল, ১৮/১২/২০১৩ তারিখের অনুষ্ঠানের জন্য পরিকল্পিত স্মরণিকাটি যথাসময়ে প্রকাশিত হলেও এতে আমার নিজের প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি যেহেতু নিজের লেখাটি আমি শেষ করেছিলাম দেরিতে! (এই পোস্টে সেই স্মরণিকার প্রচ্ছদের ছবির পাশাপাশি সেখানে তৎকালীন সংসদের বিরোধী দলের নেত্রীর যে বাণী প্রকাশিত হয়েছিল, তাও তুলে ধরা হল। সে সাথে স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক ‘উদ্‌যাপন কমিটি’ ও ‘পরিচালনা পরিষদ’-এর সদস্যদের তালিকাও জুড়ে দেওয়া হল।)

[৪] এখন ইংরেজিতে বহুবচনযুক্ত ‘Indigenous Peoples’ কথাটা অধিকতর প্রচলিত হলেও ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ-ঘোষিত বর্ষটির নামে একবচনে ‘Indigenous People’ কথাটাই ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু এটি উল্লেখ করলাম যাতে মনোযোগী পাঠকদের কেউ না ভেবে বসেন যে, আমি ভুলে একবচনে ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’ কথাটা লিখেছি।    

[৫] তিরিশ বছর আগের সেই প্রবন্ধটি আগ্রহী পাঠক এই ব্লগেই পড়ে নিতে পারেন: ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ’


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান