~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িরা পর্যায়ক্রমে যে দুটি রাষ্ট্রের সীমানায় চলে এসেছিল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, সেগুলির আওতায় ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (cf. Anderson 1983) তৈরির প্রকল্পে ব্যবহৃত কোনো প্রধান পরিচয়ই – যথাক্রমে ‘মুসলমান’ ও ‘বাঙালি – তাদের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, পাহাড়িদের মত জনগোষ্ঠীরা কেমন রাষ্ট্র চেয়েছিল, বা চাইতে পারে? উল্টোদিক থেকে বলা যায়, আধুনিক যে কোনো জাতি-রাষ্ট্র তার নির্ধারিত ছকের বাইরে গিয়ে কি বহুজাতির তথা সর্বজনের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে? এ ধরনের প্রশ্নই আমরা বর্তমান অধ্যায়ে[১] বিবেচনা করব বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিত এক বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম ও স্বপ্নের প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে।
এম এন লারমা কে ছিলেন, এবং কেন তাঁর সম্পর্কে জানা দরকার
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৩৯ – নভেম্বর ১০, ১৯৮৩), যিনি তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীদের মধ্যে ‘এম এন লারমা’[২] নামেও পরিচিতি, সাক্ষর শ্রেণীর গড়পড়তা বাংলাদেশিদের মধ্যে কতটা পরিচিত, বা ঠিক কী হিসাবে পরিচিতি, তা একটি গবেষণাসাপেক্ষ বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়েন ও রাজনীতির খোঁজ রাখেন, এবং যাঁদের বয়স কমপক্ষে পঞ্চাশ, তাঁরা হয়তবা কমবেশি সবাই তাঁর নাম শুনেছেন। কিন্তু এদের কত ভাগ তাঁর জীবনবৃত্তান্ত, রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশের যে প্রান্তিক বলয়ে (বিবিধার্থে) তাঁর বিচরণ ছিল, যে সময়ে ও যে ধরনের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন, এবং তাঁর জীবদ্দশায় গোটা দেশ যে ধরনের উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গেছে, এসব প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে সহজেই বোঝা যায় তাঁর সম্পর্কে জনপরিসরে পর্যাপ্ত ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য কেন কখনই সহজলভ্য ছিল না, যে শূন্যতা এখনো রয়ে গেছে।
আমার মনে হয়, পাহাড়ি সমাজের বাইরে বড় জোর বাম রাজনীতিকদের অনেকের মধ্যে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বা আদিবাসীদের নিয়ে পড়াশোনা করা লোকজনদের মধ্যে, এম এন লারমা সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকেবহাল লোকজনের দেখা মিলবে। এর বাইরে তাঁকে হয়তবা স্রেফ ‘শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা’, একজন ‘উপজাতীয় নেতা’ ইত্যাদি পরিচয়ে অনেকে জানতেন, এবং দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে বাঙালিদের অধিকাংশ তাঁকে হয়তবা সন্দেহের চোখেই দেখতেন, বা এখনো নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই স্মরণ করেন। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সমাজে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বিরল উচ্চতার একজন ক্ষণজন্মা নেতা হিসাবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হলেও ব্যক্তিপূজার ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়নের চেষ্টা যে খুব বেশি হয়েছে, সে কথা বলা যায় না। তবে সরাসরি সেই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে এই অধ্যায় রচিত হয়নি, যেহেতু কাজটি করতে হলে যে ধরনের জানাশোনা থাকা দরকার, তা এই লেখকের নেই। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান অধ্যায়ে মূলত পরিবেশিত হয়েছে প্রাথমিক একটি আলোচনা, যেখানে এম এন লারমা সম্পর্কে জানার তাগিদ আমি নিজে কখন কেন বোধ করেছি, এযাবত কতটুকু কিভাবে তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি, সেসব কথা বলার পাশাপাশি তাঁর যথাযথ ঐতিহাসিক মূল্যায়নের জন্য যে ধরনের প্রশ্ন তোলা জরুরি, সেগুলিই কিছুটা সামনে আনার চেষ্টা করেছি লারমাকে নিয়ে আমার ফেসবুক-কেন্দ্রিক লেখালেখির সূত্র ধরে, এবং সেসবের সাথে হাতের কাছে থাকা কিছু প্রাসঙ্গিক উৎস থেকে সংগৃহীত আরো কিছু নতুন তথ্য ও পর্যবেক্ষণ যোগ করে।
নিজের পুরানো লেখালেখির ঝুড়িতে লারমা-কেন্দ্রিক আমার প্রথম যে লেখা খুঁজে পাই, তা হল একটি অসমাপ্ত ফেসবুক নোটের খসড়া, যা ২০১২ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখে (লারমার মৃত্যুদিবসে) লিখেছিলাম, কিন্তু তখন আর প্রকাশ করিনি এটা ভেবে যে, তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট না জেনে, পড়াশুনা না করে, কোনো লেখা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। যাই হোক, পরের বছর, ২০১৩ সালে, লারমার মৃত্যুদিবসে সেই অসমাপ্ত খসড়াটিই আমি প্রকাশ করি প্রাসঙ্গিক আরো কিছু ভাবনা ও আলাপ সমেত সাজানো বৃহত্তর কলেবরের একটি ফেসবুক নোটের অংশ হিসাবে। ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: যাঁর স্বপ্নের নাগাল পাওয়া চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত সেই লেখাটির কিছু নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হল:
[১০ই নভেম্বর, ২০১৩] নিজেরই এককালীন অনুসারী বা সহযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসমূহের স্বাধিকারের স্বপ্নকে যিনি একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমার এই ছোট লেখা…।
এম, এন, লারমাকে কোনদিন চোখে দেখিনি। তবে তিনি যে একজন দূরদর্শী, বিরল ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর এককালের অনুসারীরা এখন বহুধাবিভক্ত হলেও অন্তত তাঁর নাম উচ্চারিত হলে সবাইকে নতমস্তক হতে দেখি। সন্দেহ নেই, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলী তাঁকে এক ভিন্ন আসনে উন্নীত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তিন দশক হতে চলল। এখনো তিনি বৈষম্য-বঞ্চনা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষের রুখে দাঁড়ানোর ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অফুরান প্রেরণার উৎস। অন্যভাবে বলা যায়, এম, এন, লারমা এখন একটা কীংবদন্তি, একটা প্রতীক। কিন্তু এর বাইরে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা, দর্শন, আদর্শ – এসব নিয়ে আজকের প্রজন্ম কতটা জানে? তরুণ প্রজন্মের কথা বাদ দেই। আমি নিজেকেই একই প্রশ্ন করে দেখলাম, আসলে প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ ধারণা খুব একটা নেই।
…
ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের এখনো অনেক কিছুই জানার আছে, বোঝার আছে এম, এন, লারমা সম্পর্কে। সে উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করে পড়াশুনার চেষ্টা এখনো করা হয়ে ওঠেনি আমার, তবে … বিভিন্ন উৎস থেকে ব্যক্তি এম, এন, লারমার জীবন আর তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও সংগ্রাম সম্পর্কে যতই জানতে পারছি, ততই অন্য অনেকের মতই আমার মধ্যেও তাঁর প্রতি মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধা বাড়ছে। তবে সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাসের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমি জানি, তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা নিতে হলে আমাদেরকে ব্যক্তিপূজার ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে। [আর তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি এ পর্যন্ত, তাতে আমার এও মনে হয়েছে যে,] মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম ও স্বপ্ন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের জন্যই নয়, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চান, এমন সবার জন্যই খুব জরুরি। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন সঙ্গত কারণেই। তবে এই গর্বকে সমুন্নত রাখতে হলে, আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে আত্মঘাতী সহিংসতা ও সংঘাতের বৃত্ত থেকে।
উপরে উল্লিখিত ফেসবুক নোটটি প্রকাশের ঠিক এক বছর পর, ২০১৪ সালের ১০ই নভেম্বর, ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কে ছিলেন?’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফেসবুক নোটে আমি নতুন একটা প্রশ্ন ওঠানোর চেষ্টা করি, যেটা ছিল, লারমাকে একজন ‘আদিবাসী নেতা’, বা ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক’ গোছের কোনো খোপে আটকে ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত। একই সাথে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে পেশ করা খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনার সময় মৌলিক কিছু বিষয়ে কিভাবে লারমা একাই বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন, সেটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলাম। লেখাটির কিছু নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হল:
বাংলাদেশ বহু জাতি ও বহু ভাষার দেশ। কিন্তু এদেশের সংবিধানে এখনো এই বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলন নেই। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে যথাযথ আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই যোগ করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের নাগরিকেরা বাঙালী হিসাবে পরিচিত হবে’, এমন একটি ধারা, যেটির বিরুদ্ধে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের মাত্র একজন সদস্য প্রতিবাদ করেছিলেন। উপেক্ষিত সেই নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী কন্ঠ যাঁর ছিল, তিনি ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
[…]
১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করার সময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেগুলির যেসব নমুনা আমরা পাই, তাতে তাঁকে ‘আদিবাসী’ বা ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী’ ধরনের কোনো খোপে আটকে ফেলার জো নেই। যেমন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট একটা বিধান রাখার দাবিতে সোচ্চার হয়ে তিনি বলেছিলেন, “আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বরা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি আমরা উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোন অর্থ হয় না।…এই সংবিধানের মাধ্যমে আমরা যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি সেই সমাজতন্ত্রের নামে আমরা আবার যদি উচ্চ শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও সেই ক্ষমতা অপব্যবহারকারীদেরই দেখতে পাই তাহলে ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যারা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তারা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে গিয়েছেন।” [গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪; ১৯ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলোচনার অংশ হিসাবে দেওয়া লারমার বক্তব্যের অংশবিশেষ]
সারাদেশের খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সংবিধানে হয়নি, এমন বিরল আক্ষেপও ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর কন্ঠেই: “আমার বিবেক, আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে কথা পুরোপুরি এই খসড়া সংবিধানে নেই। … আজ আমি দেখতে পাচ্ছি পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই মনের কথা এ সংবিধানে লেখা হয়নি। আমি বলছি, আজকে যাঁরা রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন, তাঁদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি” [গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯; ২৫ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলোচনার অংশ হিসাবে দেওয়া লারমার বক্তব্যের অংশবিশেষ]
উপরের কথাগুলিতে সমগ্র বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষ নেওয়া যে বড় মাপের নেতার আভাস আমরা পাই, তিনি কবে কিভাবে খণ্ডিত অবয়বে (যেমন প্রধানত একজন ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী’ নেতা হিসাবে) পরিচিত হয়ে উঠলেন?
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে নিয়ে আমার আগের বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টের ধারাবাহিকতায় আমি পরেও একই মাধ্যমে একাধিক লেখা প্রকাশ করেছি তাঁর সম্পর্কে, যেগুলির কোনোটিতে আগে তোলা কিছু প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেছি, আবার কোনোটিতে হয়তবা নতুন কোনো দৃষ্টিকোণ যোগ করার চেষ্টা করেছি। যেমন, ২০১৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে (অর্থাৎ লারমার জন্মদিনে) দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টে অন্য আরো কিছু কথার সাথে আমি যোগ করেছিলাম,
‘জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক’ গোছের কোনো খোপ যে লারমার প্রকৃত ঐতিহাসিক জায়গা নয়, তা তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজ নিলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদে তিনি যেসব বক্তব্য পেশ করেছিলেন, সেখান থেকে একটা অংশ এখানে উদ্ধৃতি দিচ্ছি [বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯; ২৫ অক্টোবর ১৯৭২]:
“আজকে যারা কল-কারখানার চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ, প্রতিটি জিনিস তৈরি হচ্ছে, সেই লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের মনের কথা এখানে নাই।
তারপর আমি বলব, সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে এই যে, আমাদের মা-বোনদের কথা নেই। নারীর যে অধিকার, সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।”
এইকভাবে ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে, অর্থাৎ আবারও লারমার জন্মদিনে, ফেসবুকে আরেকটি লেখা পোস্ট করেছিলাম, যেখানে শুরুতে তাঁর নাম উল্লেখ করিনি আমার সম্ভাব্য পাঠকদেরকে কৌতূহল জাগানোর কৌশল হিসাবে। সেই পোস্টটির একটা সংক্ষেপিত ভাষ্য নিচে তুলে ধরা হল:
তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায়। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে আটক করেছিল পুলিশ। তাঁর প্রকৃত ‘অপরাধ’ ছিল তখনকার রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সমাজের একটা অভিজাত অংশ পেছনে ছিল, এমন একটি বিরাট ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের বিরোধিতা করা। … তখন অন্য কেউ সেই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।
যাঁর কথা বলছি, তিনি ছিলেন জনসম্পৃক্ত একজন মানুষ, যিনি সাধারণ জনগণের কথা ভাবতেন, এবং দুইবার (১৯৭০, ১৯৭৩) জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। …
একজন রাজনীতিবিদ ও জননেতা হিসাবে [লারমার] সব পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত কি ঠিক ছিল? যেমন, তিনি নাকি বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও এ নিয়ে আমার নিজের বিশেষ জানা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে এসব প্রশ্নের বিচার করবে ইতিহাস। আমার নিজের যে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই, তা হল, যাঁর কথা বলছি, তাঁর চিন্তাচেতনা জুড়ে সব সময়ই সবার শীর্ষে ছিল সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও আর্থসামাজিক মুক্তি। আর একথা শুধু তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকার প্রেক্ষিতে নয়, বরং আরো বৃহত্তর পরিসরে দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রযোজ্য ছিল।
উপরে আমার ফেসবুক-কেন্দ্রিক যেসব লেখা থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা-বিষয়ক আমার বিবিধ ভাবনা, উপলব্ধি, প্রশ্ন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলির রচনাকালে আমার হাতের কাছে তেমন কোনো সহায়ক গ্রন্থ ছিল না, যেগুলির একটি হতে পারত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম শিরোনামে প্রকাশিত একটি স্মারক গ্রন্থ (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬)। উল্লেখ্য, এটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে, কিন্তু প্রকাশনাটির কথা আমার যথাসময়ে জানা হয়ে ওঠেনি এবং পরে জানলেও তা আর হাতে পাইনি। তবে বইটির যে দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়, তা আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি। এটির প্রথম অধ্যায়ে সংকলিত রয়েছে লারমাকে কাছ থেকে দেখেছিলেন এমন অনেকের স্মৃতিচারণধর্মী লেখাসহ তাঁর গুণমুগ্ধ বেশ কয়েকজনের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও মূল্যায়ন। এসবের পাশাপাশি বইটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হল এর দ্বিতীয় অধ্যায়, যেখানে একত্রিত করা হয়েছে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান বিলের উপর যে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছিল (অক্টোবর ১৯, – নভেম্বর ৪, ১৯৭২) তাতে দেওয়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বিভিন্ন বক্তব্য। এর পর রয়েছে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে (এপ্রিল ৭, ১৯৭৩ থেকে নভেম্বর ২১, ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়কালে) দেওয়া তাঁর বিবিধ বক্তব্য। এসব বিবরণী দেখার পর আগে নানান জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে (ও অনেকাংশে খণ্ডিত আকারে) চোখে পড়া তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের সার্বিক প্রেক্ষাপট তথা তাঁর চিন্তাভাবনার ব্যাপ্তি আগের চেয়ে আরো ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে শুরু করেছি। এই পটভূমিতেই লারমা কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের একটা প্রাথমিক উত্তরের খসড়া পেশ করা হল এই অধ্যায়ে।
কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন এম এন লারমা?
আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেব তাঁর সময়কার বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। এক্ষেত্রে আমরা আবার স্মরণ করতে পারি যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, অর্থাৎ তিনি ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের সেই কালপর্বের সন্তান, যখন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ভেঙে বহু নতুন রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতের একেবার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ও সরকারি ভাবে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় জন্ম নেওয়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার পিতা চিত্তরঞ্জন চাকমা ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম প্রজন্মের চাকমাদের একজন, যিনি পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন স্থানীয় পাহাড়িদের মধ্যে যাঁরা সেই অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন চাকমা ছিলেন কিনা আমাদের জানা নেই। হতে পারে, বর্তমান রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলাধীন মাওরুম নামের যে নিজ গ্রামে লারমার পিতা শিক্ষকতা করতেন, সেখানে বসে তিনি বা তাঁর মত আর্থসামাজিক অবস্থানের অন্য পাহাড়িরা তখন সেই ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কোনো তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ অভিঘাত অনুভব করেননি। তবে ১৯৬০-এর দশক শুরু হতে না হতেই পুরো দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা বাতিল করা হয়, যার মাধ্যমে সমতল অঞ্চলের লোকজনের জন্য সেখানে এসে বসতি স্থাপনের দরজা সরকারিভাবেই খুলে দেওয়া হয়, অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে এক বিশাল এলাকা বিলীন হয়ে গিয়ে প্রায় এক লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায়, যাদের একটা বড় অংশই ছিল চাকমা সম্প্রদায়ের। এই উদ্বাস্তু মানুষদের মধ্যে ছিলেন লারমাদের পরিবারও, যাদের মাওরুম গ্রাম তলিয়ে যায় কাপ্তাই হ্রদের নিচে।
যে সময় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হতে যাচ্ছিল, এম এন লারমা ছিলেন বিশের কোঠায় পা দেওয়া এক তরুণ, যিনি ততদিনে সেই যুগের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন (১৯৫৮ সালেই, ম্যাট্রিক পাশ করার বছর, তিনি যোগ দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে)। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনা শেষ করার পরের বছর, ১৯৬১ সালে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে তিনি এগিয়ে আসেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, একই কলেজে ডিগ্রি পর্বের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, নিবর্তনমূলক আইনে তাঁকে আটক করা হয়, যে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে দুই বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। জানা যায়, কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য লেখা তাঁর একাধিক চিঠি তখনকার দু’একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, যদিও এগুলি এখনো এই লেখকের নজরে আসেনি। যাই হোক, ১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধের মত বড় প্রকল্প ছিল বিশ্বব্যাপী আরাধ্য ও নন্দিত ‘উন্নয়ন’-এর দৃষ্টান্ত, যেটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হওয়া বা তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান রাষ্টের বা তখনকার বিশ্বব্যবস্থার মোড়লদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।
উল্লিখিত পটভূমিতে ১৯৬৯ নাগাদ বিএড ও এলএলবি ডিগ্রি পাশ করার পর লারমা যখন ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে, কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার আওতায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন নিজেকে তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণকে, বা গোটা দেশের মেহনতি মানুষদের, যাঁদের কথা তিনি ভাবতেন? তাঁর সেই সময়কার চিন্তাভাবনার কোনো প্রত্যক্ষ নিদর্শন এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি, তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি কী অবস্থান নিয়েছিলেন, কী ধরনের চিন্তাভাবনা গণপরিষদে তুলে ধরেছিলেন, সেসব আমরা ইতোমধ্যেই কিছুটা দেখেছি। এসব বিষয়ের প্রতি আরো একটু কাছ থেকে নজর দেওয়া যাক।
বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট গণপরিষদের সদস্য তথা সদ্যগঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আহ্বায়ক হিসাবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বাক্ষরিত এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবি’ সম্বলিত যে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয় ১৯৭২ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে, সেটির সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল, যেখানে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৭০)। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে এই প্রস্তাব নতুন করে পেশ করার পাশাপাশি অন্য যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, তাতে আমরা জানতে পারি যে, লারমা বা তাঁর দলের দৃষ্টিতে ‘জাতিসমূহের সমস্যা’ সমাধান করেছে, এমন রাষ্ট্রের তালিকায় ছিল ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। উল্লিখিত আবেদনপত্র থেকে এ বিষয়ক বক্তব্যের অংশবিশেষ দেখে নেওয়া যাক (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৭৩-১৭৪):
ভারত তার বিভিন্ন জাতিসমূহের সমস্যাসমূহ সামধান করেছে। … সোভিয়েত ইউনিয়নও তার জাতিসমূহের সমস্যার সমাধান করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সকল জাতিসমূহকে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা দিয়েছে এবং গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে [বিভিন্ন এককে ভাগ করে] জাতিসমূহের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সরকার আমাদিগকে নির্মমভাবে নিপীড়ন করে। …
এখন নিপীড়নকারী পাকিস্তান সরকারের দিন আর নেই। … আমাদের বাংলাদেশ এখন মুক্ত। উপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ভেঙে গেছে। এখন আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চারটি মূলনীতি – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাই-বোনদের সাথে একযোগে এগিয়ে যেতে চাই।
উল্লেখ্য, লারমা তাঁর বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন তখনকার সরকারি ভাষা অনুযায়ী, যদিও একই সাথে তিনি ‘উপজাতি’ ও ‘জাতি’ শব্দগুলি সমার্থকভাবেও ব্যবহার করতেন। এটি উপরে উল্লেখ করা আবেদনপত্রে যেমন দেখা যায়, তেমনি গণপরিষদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যেও খুঁজে পাওয়া যায়। এ ধরনের একটি উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হল (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৮৭):
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় এলাকা। …
এখানে বিভিন্ন জাতি বাস করে। এখানে চাকমা, মগ, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরুং এবং চাক এইরূপ ছোট ছোট দশটি উপজাতি বাস করে। এই মানুষদের কথা আমি বলতে চাই।
…
পৃথিবীর অনেক দেশেই সমাজতন্ত্র হয়েছে [যেগুলিতে] বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। জানি না, আমরা কি অপরাধ করেছি।
লারমা অবশ্য খসড়া সংবিধানে প্রান্তিক জাতিদের কথা না থাকা নিয়ে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি তাঁর দৃষ্টিতে উপেক্ষিত অন্য আরো বিভিন্ন প্রান্তিক শ্রেণী ও গোষ্ঠীর হয়েও একাধিকবার কথা বলেছিলেন গণপরিষদে, যেমনটা আমরা আগেই দেখেছি। তিনি এমনকি নারী অধিকারের পক্ষেও সমান উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্টতই এক বিশেষ সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে লারমা তাঁর প্রজন্মের অন্য অনেকের মতই ঔপনিবেশিক পরিভাষায় খানিকটা অভ্যস্ত ছিলেন বটে – যেমন ‘উপজাতি’র মত শব্দ নেওয়ার বেলায় – তবে তাঁর মধ্যে যথেষ্ট অধিকার সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা ছিল, যার কারণে অন্যরা উপেক্ষা করেছিলেন, এমন কিছু সূক্ষ্ম বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি। যেমন, গণপরিষদে বিতর্কের এক পর্যায়ে একজন সদস্য, নূরুল হক, যখন বলেন যে, “সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে সকল প্রকার জাতির, কৃষক শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের সর্বপ্রকার শোষণ মুক্তি দানের কথা আছে”, এই বক্তব্যের উত্তরে লারমা বলেন, “আমরা করুণার পাত্র হিসাবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসাবে। তাই মানুষ হিসাবে বাঁচবার অধিকার আমাদের আছে” (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৮৮)। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, লারমার আপত্তির একটা অন্যতম কারণ ছিল ‘অনগ্রসর’ শব্দটির ব্যবহার, যদিও এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডল থেকে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক পরিভাষা রপ্ত করে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় প্রয়োগ করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বা তাঁর গঠিত দল জনসংহতি সমিতি কিছু ক্ষেত্রে হয়তবা অসচেতন জাত্যাভিমান দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। … কিন্তু সাধারণভাবে লারমা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর সমসাময়িক অন্য নেতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার দিক থেকে। যেমন জাতীয় সংসদের শুরুর দিকে যখন কোরান তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অধিবেশন শুরুর রেওয়াজ চালু হয়, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ কেন করা হবে না। এমন বক্তব্য তিনি একাধিকবার দেওয়ার পর এক পর্যায়ে তৎকালীন আইন মন্ত্রী কিছুটা ব্যঙ্গের স্বরে তাঁকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছিলেন লারমা কখন এমন প্রশ্ন তুলবেন, এবং তিনি নিজেই হয়ত ত্রিপিটক পাঠ করবেন। উত্তরে লারমা জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে, তিনি ত্রিপিটক পাঠের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসেননি। তিনি যে নীতিগত সমতার দৃষ্টিকোণ থেকেই সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের আহ্বান জানাতেন, তা পরে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৫ই জানুয়ারি, ১৯৭৪-এ সংসদে দেওয়া তাঁর নিম্নরূপ বক্তব্যে : “আজকে এই মহান জাতীয় সংসদে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত, গীতা পাঠ এবং ত্রিপিটক পাঠ হল বটে কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের বাইবেল পাঠ করা কেন হল না?” (পূর্বোক্ত: ২৬১)
আমরা যদি সংসদে দেওয়া লারমার বিভিন্ন বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে দেখি, তাহলে দেখব যে একজন আইন প্রণেতা হিসাবে তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথা ভাবেননি, বরং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সংক্রান্ত বিল থেকে শুরু করে পল্লী বিদ্যুতায়ন, পাকশি কাগজের কল, বেতারে বিরোধী দলীয় মতামত প্রকাশের সুযোগ, দুষ্কৃতকারী কর্তৃক থানা লুট, শ্রমিক প্রশিক্ষণ, বাজেট – এমন বহুবিধ বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত ও যুক্তিতর্ক পেশ করেছিলেন। তিনি এমনকি বন্যজীবজন্তু সংরক্ষণের বিষয়েও সংসদে প্রশ্ন করেছিলেন, এবং তাঁর এই ভূমিকা যে সাময়িক কোনো কৌতূহলের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, বরং এর পেছনে যে প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর মমতা তথা তাঁর বিশেষ পরিবেশসচতনা ছিল, তা জানা যায় তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, এমন দু’একজনের বয়ানে। তাঁর বিশ্ববীক্ষার এই অনালোকিত দিক সম্পর্কে আমি নিজে প্রথম জেনেছিলাম কাকতালীয়ভাবে, যখন একদা জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, আমার এমন এক পরিচিতজন আমাকে তাঁর একটি লেখা পাঠান, যেখানে মূলত প্রয়াত এম এন লারমাকে তিনি যতটা যেভাবে কাছ থেকে দেখেছিলেন, সেই স্মৃতি বর্ণনা করা রয়েছে। সেই সূত্রে জানতে প্রথম জানতে পারি, পার্টির কর্মীদের প্রতি তাঁদের নেতার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামা ছিল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল হতে। সেই লেখায় এও জানতে পারি, নেতাকে লুকিয়ে একবার কিছু কর্মী একটি বন্যপ্রাণী খেয়ে ফেলার ঘটনা জানতে পেরে তিনি প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম গ্রন্থে সংকলিত ‘পরিবেশবাদী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও কিছু স্মৃতি কথা’ শীর্ষক একটি লেখায়ও বিস্তারিত প্রাসঙ্গিক বিবরণ পাওয়া যায় (লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা ২০১৬:৯৭-৯৮)।
যাই হোক, আমরা যদি আবার জাতীয় সংসদের লারমার ভূমিকার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে তিনি পার্বত্য চটগ্রামের দশটি পৃথক ভাষার নাম উল্লেখ করে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিষয়াবলী ও ক্রীড়া (শিক্ষা বিভাগ) মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই ভাষাগুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা। উত্তরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেন, “ক) ১০টি ভাষা উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা আপাতত নাই, এবং খ) “পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হেতু দেশের অন্যান্য অংশের সহিত ইহার সম্পর্ক নিবিড় হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয় এবং একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমেই তাহা সম্ভব হইতে পারে” (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:২৯২)।
জাতীয় সংসদে পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার প্রায় চার দশক পর যে বাংলাদেশে সরকারিভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার বেলায় মাতৃভাষাকে আমলে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, বা আংশিকভাবে হলেও এদেশের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে (যদিও এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ধ্যান-ধারণা এখনো অনেকাংশে ঔপনিবেশিক আমলেরই রয়ে গেছে) তাতে প্রমাণিত হয় যে, লারমা তাঁর সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের অনেকের তুলনায় দূরদর্শী ছিলেন, ‘অগ্রসর’ ছিলেন। সেই তিনি ‘অনগ্রসর’ নামক একটা বর্গের আওতায় তাঁকে নির্বাচিত করা জনগণের অধিকারের কথা বলবেন কেন? জাতি-ধর্ম-শ্রেণী-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই অনেকের চেয়ে অগ্রগামী ও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, যেসব কথার অনেকটা তিনি একাই শুধু বলেছিলেন ১৯৭২ সালের গণরিষদে। তাঁর কথা যদি তখনকার অন্য জনপ্রতিনিধিরা একটু হলেও আমলে নিতেন, কেমন হতে পারত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল তথা বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাস, বা রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি ও স্বরূপ?
টীকা
[১] এই লেখাটি হল ২০২০ সালে প্রকাশিত লেখকের ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ শীর্ষক গ্রন্থে একই শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত একটি অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশবিশেষ।
[২] বলা বাহুল্য, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত, এবং সে হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাঁর নামের উপাধি ‘চাকমা’ হতে পারত বা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনো কারণে তিনি সেই ধারার বাইরে গিয়ে তাঁর গোত্রের নাম ‘লারমা’ নামের উপাধি হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন, যা চাকমা সমাজে আগে বা পরে খুব দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বর্তমান সভাপতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (যিনি জনপরিসরে ‘সন্তু লারমা’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত) হচ্ছেন আরেক বিখ্যাত লারমা, যিনি এম এন লারমার ছোট ভাই, এবং বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্বে আসেন।
তথ্যসূত্র
Anderson, Benedict (1983) Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. London: Verso
মঙ্গল কুমার চাকমা, সম্পা. (২০১৬) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম, রাঙ্গামাটি: এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।
লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা (২০১৬) ‘পরিবেশবাদী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও কিছু স্মৃতি কথা’, মঙ্গল কুমার চাকমা, সম্পা. (২০১৬) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম, রাঙ্গামাটি: এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।