ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞান

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

ধর্ম ও জাদুর মত ধারণা নৃবিজ্ঞানে যে ধরনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরার পাশাপাশি এই পোস্টে ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং পার্থক্য নিয়ে নৃবিজ্ঞানী জেমস ফ্রেজারের আলোচনার একটা সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হয়েছে। তবে তা এই পোস্টে সরাসরি তুলে দেওয়ার পরিবর্তে এতে মূলত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান পরিচিতি  শীর্ষক একটি পাঠ্যবইয়ের ধর্ম-বিষয়ক অধ্যায়ের অংশবিশেষ (পাঠ-৩: ধর্ম, জাদু ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক) একটি পিডিএফ ফাইল হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পাঠ্য বইটির লেখকদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম, এবং সেই সুবাদে এটির ভূমিকা আমি লিখেছিলাম (যেটির অংশবিশেষ এই ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে ‘নৃবিজ্ঞান পরিচিতি’ শিরোনামে)। ভূমিকার পাশাপাশি বইটির আরও যে দু’একটি অধ্যায় লেখার দায়িত্ব আমার ছিল, সেগুলির একটি ছিল ধর্ম-বিষয়ক অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের শুরুতে নৃবিজ্ঞানে ধর্মের ধারণা সংক্রান্ত যে আলোচনা রয়েছে, সেটির অংশবিশেষ নিচে তুলে দেওয়া হল:

নৃবিজ্ঞানে সাধারণভাবে ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত সত্তা, ক্ষমতা বা শক্তি সংক্রান্ত বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সামষ্টিক রূপ হিসাবে। ‘অতিপ্রাকৃত’ বলতে বোঝায় সেইসব বিষয় যেগুলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক জগতের বাইরে বা উর্ধ্বে বলে গণ্য করা হয়, যেগুলোর অস্তিত্ব বা সত্যতা নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাসের উপর। প্রতিটা সমাজেই ‘অতিপ্রাকৃত’ জগতের সাথে মানুষের সম্পর্ককে ঘিরে বিভিন্ন বিশ্বাস ও ক্রিয়া-কর্ম লক্ষ্য করা যায়। তবে সকল সংস্কৃতিতে ‘অতিপ্রাকৃত’ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক জগতের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা হয় না। যেমন, ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এমন অনেকের কাছে এসব সত্তা চারপাশের গাছপালা পাহাড়-পর্বত জীবজন্তুর চাইতে কোনো অংশে কম ‘বাস্তব’ নয়।   

উল্লেখ্য, ধর্মের ধারণা সংক্রান্ত আলোচনার যে ছোট অংশ উপরে তুলে দেওয়া হল, এটি এই পোস্টে জুড়ে দেওয়া পিডিএফ ফাইলে নেই, যেখানে মূলত জাদুর ধারণার উপরই আলোকপাত করা হয়েছে, সে সাথে জাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও পার্থক্য বিষয়ে ফ্রেজারের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে। পিডিএফ ফাইলের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃতি হিসাবে দেওয়া হল যদি কোনো পাঠক পুরো ফাইলটা নামিয়ে পড়ে দেখার আগে একটা ধারণা পেতে চান এতে কি ধরনের আলোচনা রয়েছে।

মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে বিশেষ কলাকৌশল প্রয়োগ করে অতিপ্রাকৃত শক্তি বা সত্তাসমূহকে বশে আনা যায়, সেগুলোর সাহায্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইপ্সিত ফলাফল অর্জন করা যায়, তখন এ ধরনের বিশ্বাস ও কলাকৌশলকে নৃবিজ্ঞানীরা ‘জাদু’ হিসাবে চিহ্নিত করেন।

[জেমস ফ্রেজারের] মতে মানব সমাজে জাদুর অস্তিত্ব ছিল ধর্মের উৎপত্তির আগে। জাদুর সাহায্যে অতিপ্রাকৃতকে আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকে ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বলে ফ্রেজার মনে করেন। … আমরা দেব-দেবী বা ইশ্বরের কাছে বিশেষ কিছু চাইতে পারি, কিন্তু এটা ধরে নিতে পারি না যে, যা আমরা চাইব, তা পাবই। পক্ষান্তরে জাদু-বিশ্বাস অনুসারে নির্দিষ্ট কোনো কলাকৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসতে বাধ্য। ধর্মে মানুষ অতিপ্রাকৃতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, কিন্তু জাদুতে সে চেষ্টা করে অতিপ্রাকৃতকে বশে আনার। এদিক থেকে জাদু-বিশ্বাসের মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্য কাজ করে।

জাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞান ধারণাসমূহ ফ্রেজার যে ধরনের অর্থে ব্যবহার করেছেন, সেগুলি বোঝানোর জন্য এখানে আমরা কিছু বাস্তব উদাহরণ বিবেচনায় নিতে পারি। জাদুর একটি উদাহরণ হিসাবে বৃষ্টির আশায় ‘ব্যাঙের বিয়ে’ দেওয়ার রীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভাবুন, কোন্‌ অর্থে এই রীতির পেছনে জাদু-বিশ্বাস ক্রিয়াশীল? আল্লাহ্‌ বা ইশ্বরে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি হয়ত বলবেন, বৃষ্টি নামা না নামা সম্পূর্ণ আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর নির্ভর  করে, কাজেই বৃষ্টি চাইলে ‘মোনাজাত’ করাই শ্রেয়। পক্ষান্তরে একজন বিজ্ঞানী প্রকৃতির বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বৃষ্টির সম্ভাব্যতা নিরূপণ করবেন, এবং, তিনি আস্তিক বা নাস্তিক যাই হোন না কেন, আকাশে বিশেষ কোনো পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি নামানোর কোনো ব্যবস্থা থাকলে তিনি প্রয়োজনে তা কাজে লাগাবেন।

ফ্রেজারের দৃষ্টিকোণ থেকে জাদু একাধারে ‘ভ্রান্ত বিজ্ঞান’ বা ‘প্রকৃত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী’ বিবর্জিত  বিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু জাদুর যদি কোনো ‘কার্যকারিতা’ নাই থাকে, তাহলে সমকালীন বহু মানুষের মধ্যে কেন নানা ধরনের জাদু-তুল্য বিশ্বাস ও আচার আচরণ লক্ষ্য করা যায়? সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দল বেঁধে ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা করা বা বৃষ্টির জন্য সবাই মিলে মোনাজাত করা কোনোটাই আসলে নিরর্থক নয়, যেমনটা মনে হতে পারে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মুখস্থ সূত্র মেনে সমাজ-সংস্কৃতি ও মনস্তত্ত্বকে বুঝতে চাওয়ার স্থূল প্রচেষ্টা থেকে। এসব বিষয়ে নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও একটু বিস্তারিত আলোচনা পড়তে আগ্রহী পাঠক নিচে দেওয়া পিডিএফ ফাইলটা পড়ে দেখতে পারেন।

স্মৃতিতে ১৯৭৮ সাল: পুরানো সেই দিনের কথা

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

মহাকালের প্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সাল ছিল স্রেফ আরেকটি বছর। বাংলাদেশের বা বিশ্বের ইতিহাসের প্রেক্ষিতেও বছরটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, যেভাবে রয়েছে ১৯৭১ বা ১৯৪৫ সালের, যথাক্রমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির বছর হিসাবে। কিন্তু আমার তথা সতীর্থদের স্মৃতিতে ১৯৭৮ সালের একটা বিশেষ জায়গা রয়েছে, যেহেতু সে বছরই আমরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, কাগজে কলমে এই পরীক্ষার নাম ‘সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিফিকেট’ বা এসএসসি হলেও আমাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্মের বা আরো আগেকার মানুষদের কাছে এটি ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ বা সংক্ষেপে ‘ম্যাট্রিক’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। আনুমানিক ১৯৬৫ সালের দিকে শিক্ষার এই ধাপটির নতুন নামকরণ হয় ‘সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট’ পরীক্ষা হিসাবে, কিন্তু আমাদের সময়েও ‘ম্যাট্রিক পরীক্ষা’ কথাটি সাধারণভাবে চালু ছিল। 

আমি এসএসসি বা ‘ম্যাট্রিক’ পরীক্ষা দিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, তবে আমার মাধ্যমিক পর্বের শিক্ষাজীবন মূলত কেটেছিল খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে, যেটি আমাদের সময় সরকারি ছিল না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর এই স্কুল থেকেই ১৯৭৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসাবে আমি ও আমার সহপাঠীরা নিবন্ধন করেছিলাম আমাদের তৎকালীন কুমিল্লা-কেন্দ্রিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। তবে আমরা ক্লাস টেনে ওঠার পর খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের সরকারিকরণের ফলে সৃষ্ট শিক্ষক সংকটের কারণে আমি আর আমার সহপাঠী পুলক জীবন খীসা চলে গিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে, যেখান থেকে আমরা উভয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেই।  খাগড়াছড়িতে থেকে গিয়েছিল – বা সেখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল – প্রাইমারি স্কুল থেকে সহপাঠী হিসাবে যাত্রা শুরু করা আমার খুব কাছের বন্ধু শান্তি প্রিয় চাকমা, এবং আমার হাই স্কুল পর্বের অন্য আরো অনেক সহপাঠী বন্ধু, যেমন  দীনময় রোয়াজা, রণজ্যোতি চাকমা, প্রমুখ। 

এসএসসি পাসের পর উচ্চ মাধ্যমিক বা ‘ইন্টারমিডিয়েট’ পর্বে আমি আর পুলক উভয়েই একসাথে ঢাকায় গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে, কিন্তু পুলক এক পর্যায়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে চলে যায়, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা আরো বেশ কিছু সতীর্থও ছিল। তবে আমাদের সময়কার পার্বত্য সতীর্থদের অধিকাংশই কলেজের পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিল নিজেদের এলাকাতেই। পরে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনা ও পরীক্ষা শেষে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাশ করা সতীর্থদের অনেকের সাথে ঢাকায় কিছুটা সময় একত্রে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। এক্ষেত্রে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে অবস্থিত ‘ট্রাইবাল হোস্টেল’ ছিল আমাদের অনেকের কিছু সময়ের ঠিকানা, যদিও স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির পর আমাদের অনেকের পথ আলাদা হয়ে যায়। এমনকি আমাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশেও চলে যায়, যাদের সারিতে আমিও যোগ দিয়েছিলাম একটা পর্যায়ে।

উপরে উল্লেখ করা পটভূমিতে যখন তিন পার্বত্য জেলার ১৯৭৮ সালের এসএসসির ব্যাচভুক্ত সতীর্থরা প্রথমবারের মত একটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ২০২২ সালের ১লা জানুয়ারি, রাঙ্গামাটিতে, এবং সেই ধারাবাহিকতায় একই ধরনের আরেকটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় খাগড়াছড়িতে, ২০২৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি, আমার সুযোগ ছিল যাচাই করে দেখার, মাঝে বহু বছর সামনাসামনি দেখিনি, এমন সতীর্থদের প্রথম দর্শনে চিনতে পারতাম কিনা! দুর্ভাগ্যবশত এই দুটি অনুষ্ঠানের কোনোটিতেই আমার যোগ দেওয়া হয়নি, কিন্তু আগের বারের মত এবারও পুনর্মিলনী-উত্তর স্মরণিকার জন্য স্মৃতিনির্ভর একটা লেখা সাজাতে বসেছি।[*] এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের আগে একটু ফিরে তাকাতে চাই, ১৯৭৮ সালে খাগড়াছড়িতে তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে – বা আরো বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে – কি ধরনের বাস্তবতা ও প্রবণতা বিরাজ করছিল।  

কোলাজে ব্যবহৃত দুইটি ছবির একটিতে (বেলবটম পরা অবস্থায়) খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের দুই সহপাঠী পুলক জীবন খীসা ও রণজ্যোতি চাকমার সাথে এবং আরেকটিতে (জুনিয়র ক্যাডেট কোরের ইউনিফর্মে) রাঙ্গামাটির দুই সহপাঠী ভগদত্ত চাকমা ও কানন বড়ুয়ার সাথে দেখা যাচ্ছে আমাকে (দু’টি ছবিই ১৯৭৭/৭৮-এ রাঙ্গামাটির একটি স্টুডিওতে তোলা)।

বৈশ্বিক পরিসরে ১৯৭৮ সাল

শুরু করা যাক বৈশ্বিক পরিসরের দিকে নজর দেওয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া কিছু তথ্য পেশ করছি কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিল স্বাগতিক আর্জেন্টিনা, তবে সেই বিশ্বকাপ জয়ী দলে উদীয়মান তারকা মারাদোনা ছিলেন না, যাঁকে কোচ বাদ দিয়েছিলেন কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে! সেই সময় অবশ্য দেশে টিভিতে সরাসরি খেলা দেখার কোনো সুযোগ ছিল বলে মনে পড়ে না, আর থাকলেও জুনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের খেলা চলাকালে আমি যেহেতু খাগড়াছড়িতেই বাড়িতে ছিলাম – যেখানে ইলেকট্রিসিটি বা টিভি কিছু ছিল না – অন্তত টিভিতে খেলা দেখার কোনো উপায় ছিল না। সে সময় খাগড়াছড়িতে বাসায় খবরের কাগজ রাখার রেওয়াজ বা সুযোগও ছিল না, ফলে পত্রিকায় বিশ্বকাপের খবর পড়ার কোনো স্মৃতিও আমার নেই। আমরা অবশ্য রেডিওতে খবর, গান ইত্যাদি শুনতাম, কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে আমার বা আমার বন্ধুদের মধ্যে কোনো মাতামাতি ছিল, এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই।    

১৯৭৮ সালে বিশ্বের অনেক জায়গায় সশস্ত্র সংঘাত চলছিল। যেমন, তখন রোডেশিয়া (যে দেশটা পরে, ‘শ্বেতাঙ্গ’ শাসনের অবসানে, জিম্বাবুয়ে নাম ধারণ করে) জাম্বিয়া আক্রমণ করেছিল, ইজরায়েল হামলা চালিয়েছিল লেবাননে, আর ভিয়েতনাম ক্যাম্বোডিয়া আক্রমণ করেছিল। তখন আফ্রিকায় ‘জায়ারে’ নামে একটা দেশ ছিল, যেখান চলমান বিদ্রোহ দমনে ফ্রান্স ও ইউরোপের আরো কিছু দেশ বেশ ব্যস্ত ছিল। আমাদের আরো কাছের দেশ আফগানিস্তানে শুরু হয়েছিল ব্যাপক সংঘাত, যে পটভূমিতে সেদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন-ঘেঁষা একটা কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। অবশ্য যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসার দু’একটি ঘটনাও ঘটেছিল একই বছর। যেমন ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, আর মার্কিন মধ্যস্থতায় মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি হয়েছিল, যার সূত্রে এই দুই দেশের সরকার প্রধান আনোয়ার সাদাত ও বেগিন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যেহেতু খাগড়াছড়িতে থাকলে আমি রেডিওতে বিবিসির অনুষ্ঠান শুনতাম প্রায়ই, আর রাঙ্গামাটিতে বাসায় পত্রিকা পড়ার সুযোগ ছিল, এসব খবর কিছুটা পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে।   

আমাদের এসএসসি পরীক্ষার বছরের শেষদিকে, ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে, একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল গায়ানার জোন্সটাউনে, যেখানে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত নয় শতাধিক মানুষ, যাদের সবাই বা অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক ছিল  এবং যাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল শিশু, একটা তথাকথিত ‘গণ আত্মহত্যা’র ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল। তখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত এই ঘটনার খবর আমারও নজরে পড়েছিল স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে নেই সেই সময় খবরটা আমার মনে কতটুকু কিভাবে দাগ কেটেছিল।  

১৯৭৮ সালের বাংলাদেশ

ইন্টারনেটে পাওয়া ১৯৭৮ সালের বাংলাদেশ-সম্পর্কিত কিছু তথ্যের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর এদেশে বেড়াতে আসা।  তাঁর সফর দেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল, এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশিত খবর, ছবি ইত্যাদির যেটুকু আমার নাগালে ছিল, সেসবের প্রতি আগ্রহের সাথেই নজর দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। একই বছরের মে মাসে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গ্যা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছিল, কিন্তু এই ঘটনার খবর তখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল কিনা ঠিক মনে পড়ে না, আর হয়ে থাকলেও এটির প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম, এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে প্রথমে জাগদল এবং পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে ব্যক্তিগতভাবে এসব বিষয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না।    

১৯৭৮ সালের বাংলাদেশে সামরিক শাসন বহাল থাকলেও তখন কিছু দিক থেকে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেশ মুখর ছিল মনে হয়। যেমন, জানা যায়, সে বছর দেশে মোট ৩৭টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল, যেগুলির মধ্যে ছিল ‘সারেং বৌ’ ও ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। রেডিওতে নিয়মিত প্রচারিত বিজ্ঞাপনের কল্যাণে দু’টি ছায়াছবিরই কিছু সংলাপ ও গানের সাথে আমার পরিচিতি ঘটেছিল আগেই, এবং পরে অন্তত একটি ছবি – গোলাপী এখন ট্রেনে – ঢাকায় সিনেমা হলে বসে দেখেছিলাম মনে হয়।  আমাদের এসসসি পরীক্ষার বছরে চট্টগ্রাম শহরের ‘ব্যান্ড সঙ্গীত’-এর অঙ্গনও বেশ সক্রিয় ছিল মনে হয়, যেখানে আমার প্রায় সমবয়সী আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৮ সাল নাগাদ পরিচিতি পেতে শুরু শুরু করেন (তাঁর আর আমার জন্মের সাল একই, তবে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে), যদিও তাঁর নাম বা গানের সাথে আমার নিজের পরিচয় ঘটেছে অনেক পরে।  

যে বছরের দিকে আমরা ফিরে তাকাচ্ছি, সেই ১৯৭৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশে চলমান সামরিক শাসনের আঁচ দেশের অন্যত্র যেভাবেই অনুভূত হোক না কেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে তা বেশ প্রকটভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে অন্যত্র – যেমন ‘খাহা: আমাদের স্মৃতির এক তীর্থ’ শীর্ষক আমার একটি পূর্বপ্রকাশিত নিবন্ধে – আমি কিছুটা আলোকপাত করেছি। সেই আলোচনার পুনরাবৃত্তিতে না গিয়ে এখানে শুধু একটা অংশবিশেষ তুলে ধরছি আবার:

যে সময় আমি [খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম] সেই ১৯৭৭ সাল নাগাদ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছিল, এবং নানামুখী সহিংসতার আঁচ আমাদের কিশোর মনেতো বটেই, কিছু ক্ষেত্রে গায়েও, এসে লাগতে শুরু করেছিল। … তখনকার বিভিন্ন প্রতিকূলতার ঘূর্ণাবর্তে আমরা অনেকে নানাভাবে নানাদিকে ছিটকে পড়তে শুরু করেছিলাম। অনেকে হয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু মনে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, অতীতের সেই বৈরী সময়ের ধাক্কা আমরা সামষ্টিকভাবে কতটা সামলে উঠেছি?

ব্যক্তিগত স্মৃতির ১৯৭৮  

এবার অধিকতর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। যে পরীক্ষার সূত্রে আমরা পুরানো সতীর্থরা ‘১৯৭৮ এর ব্যাচ’ হিসাবে পরিচয় দিচ্ছি, আমাদের সেই এসএসসি পরীক্ষা ঠিক কত তারিখে শুরু হয়েছিল, বন্ধুদের কারও কি মনে আছে? আমার নিজের এটা মনে ছিল না, তবে এই লেখায় হাত দেওয়ার পর নিজের পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে তখনকার প্রবেশ-পত্র খুঁজে পেয়েছি, যেখানে স্পষ্ট করে লেখা, কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে “১৯৭৮ সনের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা আগামী ৯ই মার্চ রোজ বৃহস্পতিবার হতে আরম্ভ হইবে।” ঠিক কবে পরীক্ষা শেষ হয়েছিল আমার মনে নেই, তবে  পরীক্ষা শেষে বাড়ি অর্থাৎ খাগড়াছড়ি যাব, এই চিন্তায় যে বেশ বিভোর ছিলাম পরীক্ষা চলার কালেই, তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় আমার ‘শেকড়’ নামক একটা ব্যক্তিগত কবিতা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ৬ই এপ্রিল তারিখে রাঙ্গামাটিতে বসে লেখা ‘ফিরে যাব’ শীর্ষক একটা কবিতায়, যেখানে ফেলে আসা ঝর্ণার কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি এবং সেই ঝর্ণার কাছে থাকা নড়বড়ে ভাঙা সাঁকোতে বসে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। 

এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঠিক কবে রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম, সেই তারিখটি আমার মনে নেই, তবে ফিরে যাওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা – যা ছিল অভিনব ও ঘটনাবহুল – কোনোদিন ভুলব না। তখন রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়ির মধ্যে যাতায়তের ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পথ লঞ্চে পাড়ি দিতাম, যে পথের একটা মধ্যবর্তী জায়গা ছিল মহালছড়ি। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ বর্ষা মৌসুমে মহালছড়ি ছাড়িয়ে চেঙ্গী নদির উজানে যতদূর যাওয়া যায়, যাত্রী নিয়ে যেত। বাকি রাস্তা ঋতুভেদে ‘চান্দের গাড়ি’, নৌকা, পদযুগল ইত্যাদির মাধ্যমে পাড়ি দিতাম আমরা। যাই হোক, এসএসসি পরীক্ষা শেষে যেদিন বাড়ি ফিরছিলাম, আমার সাথে দু’টি ব্যাগ ছিল। আমাদের লঞ্চ মহালছড়ি পৌঁছার পর সেখানে খাবারের বিরতি দিয়েছিল। এরপর আবার লঞ্চে ওঠার পর উজানের শেষ ঘাটে পৌঁছালে আমি খেয়াল করি, মহালছড়িতে খাওয়ার জন্য লঞ্চ থেকে নামার পর আমার সাথে থাকা একটা ব্যাগ ভুলে খাবার দোকানে রেখে এসেছিলাম। ফলে একই লঞ্চে আবার মহালছড়ি ফিরে গিয়েছিলাম ফেলে আসা ব্যাগ পুনরুদ্ধারের আশায়।

মহালছড়ির যে দোকানে আমি খেয়েছিলাম, সেটি ছিল জামাল নামের একজন পরিচিত লোকের। তাঁর কাছে খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারি, আমার ফেলে আসা ব্যাগটা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন থানায় গিয়ে ব্যাগটা উদ্ধার করতে পারি জামাল ভাইয়ের সহায়তায়, কিন্তু এরপর অন্য একটা বিপত্তি সামনে চলে আসে। সেদিনের মত উজানের পথে আর কোনো লঞ্চ ছিল না, আর বেলা থাকতে পায়ে হেঁটে খাগড়াছড়ি যাব, এমন সময়ও আর ছিল না। এই অবস্থায় জামাল ভাই-ই আবার সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তিনি বললেন, কোনো সমস্যা নেই, তিনি থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন ভাইয়ের বাসায় বা তেমন কোথাও। কিন্তু দিনের শেষে যখন তিনি আমাকে সেই বাসায় নিয়ে যান, চাটগাঁইয়া ভাষায় ওখানকার ভাবির সাথে তাঁর আলাপের যেটুকু আমার কানে এসেছিল, তাতে বুঝতে পারি সেই ভাবির আপত্তি ছিল অচেনা কাউকে বাসায় জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে। এই অবস্থায় জামাল ভাই আমাকে আবার নিয়ে আসেন তাঁর কিছুটা জীর্ণ দশার দোকানে। সেখানেই একটা বেঞ্চে আমার রাত কাটানোর ব্যবস্থা হল, এবং জামাল ভাই নিজে ঘুমালেন মাটির মেঝেতে। ঠিক হল, পরের দিন রাঙ্গামাটি থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চের জন্য অপেক্ষা না করে আমি পায়ে হেঁটেই খাগড়াছড়ির পথে রওনা দেব একদম সকালে। তবে আমার সাথে যেহেতু দু’টি ব্যাগ ছিল, এবং একটা ছিল বেশ ভারী, জামাল ভাই একজন মুটে ঠিক করে দিলেন পরের দিন আমার ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এভাবে প্রায় পনের মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার একটা বিরল অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আমার তখনকার অভিজ্ঞতার কথা একবার ফেসবুকে বলার পর জামাল ভাইকে চিনতেন, এমন একাধিক ব্যক্তি তাঁর রান্নার স্বাদের সুখস্মৃতি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। তখন মনে হয় তাঁকে চিনতেন এমন কেউ উল্লেখ করেছিলেন যে, আমাদের সেই জামাল ভাই আর বেঁচে নেই। বলা বাহুল্য, তাঁর উপকারের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

জামাল ভাইয়ের সহায়তায় ঠিকমত খাগড়াছড়ি পৌঁছার পর সেখানে এসএসসি পরীক্ষা-পরবর্তী কিছুটা সময় ভালোই কেটেছিল আমার, তবে ‘শেকড়’-এ অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতায় দেখা যায় যে, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর পুরানো দিনের চেনা পরিপার্শ্বের সাথে নতুন করে ‘আলাপ’ জুড়ে দিয়েছিল আমার কিশোর বয়সের কবি সত্তা।  খাগড়াছড়িতে বসে ৭ই জুন ১৯৭৮ লেখা ‘ফিরে পাওয়া’ নামক কবিতায় ধরে রাখা সেই আলাপে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে, যেমন, “এতটা দিন কোথায় ছিলে?”,  “এতটা কি ফুটতো কি ফুল?”; আর আছে যার কাছে প্রশ্নগুলি করা হয়েছে, তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ, “আজ বিকেলে/ নদির তীরে/ তোমায় আবার পেলাম ফিরে।”

অচিরেই অবশ্য খাগড়াছড়ির প্রিয় পরিপার্শ্বকে ছেড়ে আবার আমাকে দূরে চলে যেতে হয়েছিল। খুব সম্ভবত জুন মাসে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছিল। তখন মাঝে আরেকবার রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম মনে হয় প্রশংসাপত্র, মার্ক শিট ইত্যাদি জোগাড় করতে। এরপর ১৯৭৮ সালের ৬ই জুলাই তারিখে আবার বাড়ি ছেড়েছিলাম, এবং এবারের গন্তব্য ছিল রাঙ্গামাটি হয়ে ঢাকা। তখন চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে ঢাকা গেলে পথে দু’টি ফেরি পার হতে হত, যথাক্রমে গোমতী ও  মেঘনা। 

ঘটনাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা শেষে কলেজ পর্যায়ে ঢাকার কোথাও ভর্তির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার সময়কার কিছু কথা আমি টুকে রেখেছিলাম একটা ‘ল্যাব খাতা’য়। সেখান থেকে কিছু কথা – তখন যে ধরনের বানানে লিখেছিলাম হুবহু সেভাবে – নিচে তুলে ধরা হল।  

খাগড়াছড়ী ৬-৭-৭৮

কাল যাচ্ছি রাঙামাটি। রাঙামাটি থেকে যাবো ঢাকা, ওখানকার ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে। শিগ্‌গীর বোধহয় ফিরবো না। অনেকদিন বাড়ীতে থেকে থেকে আগেকার মতো হয়ে পড়েছি, তাই বোধ হয় বাড়ী ছাড়তে চায় না মন, কোথায় জানি একটু টন্‌টন্‌ ব্যথা অনুভূত হয়।

বৃষ্টি হচ্ছে না বেশ ক’দিন, কাল বোধ হয় জীপ চলবে। কষ্ট এবং তারও চেয়ে বড় জীবনের ঝুঁকি যতই থাকুক, এই বিচিত্র যানগুলোতেই একটুখানি বসার নয়, ঝুলবার মত পরিসর না মেলার জন্যেই অনেক হতভাগাকে আফসোস করতে হয়। …

রাত ৯/১০ টার দিকে বাড়ীতে বিদায় সভা জাতীয় মজার একটা জিনিস উপহার দিলেন বাবা।

-৭-৭৮

আজ ‘রথযাত্রা’। গতকাল রিন্তু [রাজীব ত্রিপুরা, আমার ভাইদের মধ্যে সবার ছোট] বলছিল, ‘কাল তুমি যেতে পারবে না’। কারণ শুধোলাম। ‘কাল যে রথযাত্রা!’ অর্থাৎ রথযাত্রার দিন যে বৃষ্টি হয়ে থাকে এবং এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, সে সম্বন্ধে রিন্তুর মনে কোন সন্দেহ নেই। …

রাত দুটো কি আড়াইটের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। রিন্তুর গাটা একটু গরম লাগছিল। নিজের আর শান্তুর [সনজীব ত্রিপুরা, আমার আরেক ভাই] কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম, রিন্তুর জ্বর এসেছে। মাকে ডাকলাম না। রিন্তুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম। অনেক কথা মনে পড়ছিল, অনেক দৃশ্য চোখে ভাসছিল। বিদায় টিদায় জাতীয় মেয়েলী ব্যাপারে এসব হয় আমার। [আমার এই লেখাটা যদি পরিণত বয়সের হত, তাহলে ‘বিদায় টিদায় জাতীয় মেয়েলী ব্যাপার’ কথাটা অবশ্যই আমার কলম থেকে বেরুত না। কিন্তু এটা এখানে রেখে দিলাম কৈশোরে গড়ে ওঠা নিজের মননের একটা বিশেষ দিকের নমুনা হিসাবে।] …

বাইরে অন্ধকার ছিল। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল, তারপর একটানা বেশ ভারী বর্ষণ। মাঝে মধ্যে সামান্য হাল্‌কা হলেও বৃষ্টি হচ্ছিলই। মেজাজ বিগড়ে গেল। জীপ চলবে না, তাই। তার অর্থ মহালছড়ীতে নৌকোয় করে যাওয়া লাগবে এবং নিশ্চয় ধৈর্য্যের একটা পরীক্ষা দিতে হবে, তারপরও হয়তো ফার্স্ট লঞ্চ মিস করে দ্বিতীয় দফা ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে। রিন্তু জেগে উঠলো এবং গতকাল ও যা বলেছিল তা যে সত্য এবং আমার অবজ্ঞা যে অন্যায় ছিল তা সে জানিয়ে দিল আমাকে। হাতের কাছেই প্রমাণ, সুতরাং তর্ক চলে না।

ঘুম আর আসলো না। বৃষ্টি একটু পাত্‌লা হয়ে এসেছিল, অন্ধকারও ক্রমশঃ।

বৃষ্টি থামার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠলাম, রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। ছোট নদীটার তীরে গেলাম, সাঁকো তৈরীর কাজ প্রায় শেষ। বেশ লাগছিল। বাড়ী ফিরে দেখি মায়ের খাবার তৈরী, খেয়ে দেয়ে তৈরী হলাম। কিন্তু বৃষ্টি আবারও শুরু হয়ে গেছে। খারাপ লাগলো, তবু কিছুই করার নেই।

যাবার জন্য বেরুচ্ছি, সাথে কালু [আমার সমবয়সী এক গৃহকর্মী]। ‘আতয় কামা’ [এক কাকা সম্পর্কের পড়শি]  আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দিলেন। টাকাটায় তাঁর সংসার চলত এক সপ্তার মত। কিন্তু স্নেহের দান, আত্মীয়তার স্বীকৃতি – প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য ছিল না আমার। সবাইকে প্রণাম করে চলে এলাম।

হা-ক্‌চাক [‘লাল মাটি’]-এর বাঁকে এসে শেষবারের মত দেখে নিলাম গ্রামটা, বাড়ীটা, ছোট নদীটা। কে জানে, কত পরে এখানে আসবো আবার!

[আমার দিনলিপিতে এরপর একটা দেশি নৌকায় করে মাইসছড়ি পর্যন্ত যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।] [মাইসছড়িতে পৌঁছার পর আমরা দেখলাম, মহালছড়ি থেকে] লঞ্চ ছাড়ার তখন মাত্র দু’ঘণ্টা বাকী। নৌকো মহালছড়ী পৌঁছুবে তিন ঘণ্টা পরে। তাই প্রায় সবাই নৌকো থেকে নেমে পড়লো। হেঁটে গেলে নাকি লঞ্চ ধরা যাবে।

আমরাও বাকী যারা ছিলাম নৌকোয়, সবাই নেমে পড়লাম ভাড়া চুকিয়ে। কলা-টলা কিছু খেয়ে নিলাম কিনে। তারপর সেই আদিম যুগের মতই চরণযুগলের উপর নির্ভর করে আমরা ১৫-২০ জন লোক যাত্রা শুরু করলাম।

পথের অবস্থা যেরকম, তাতে ধান রোয়া যায়। সুতরাং ৭ মাইল রাস্তা দু’ঘণ্টায় পেরুনোর আশা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।

চলতে চলতে আমরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। আমি প্রাণপণে সামনের দলের সাথে তাল মিলাতে চেষ্টা করলাম, যতদূর সম্ভব জোরে হেঁটে, কখনো দৌড়িয়ে। 

শেষ পর্যন্ত কিন্তু পেছনে পড়ে গেলাম এবং একা একাই রাস্তা চলতে লাগলাম। এক জায়গায় পৌঁছে ভাবলাম, পথ বুঝি আর বেশী নেই। একজন লোককে জিগ্‌গেস করে জানতে পারলাম, আরও তিন মাইলের বেশী। শুনে হাঁটার গতি কমে এলো। গায়ে আর এতটুকু শক্তিও ছিল না। তবু উপায় নেই।

[একটা পর্যায়ে উল্টো দিক থেকে আসা স্বপ্ননিকা নামে আমার এক পূর্বপরিচিত ত্রিপুরা মেয়ের সাথে দেখা হল পথে।]  জানতে পারলাম লঞ্চ সে দেখে এসেছে ঘাটে অর্থাৎ তখনো ছাড়েনি। পথ নাকি মাইল দেড়েক হবে আরও। সুতরাং শক্তি সঞ্চয় করে আবার দৌড়ুতে থাকলাম।

একটা “ধর্মঘর” [ধর্মীয় দায়িত্ব হিসাবে মারমাদের স্থাপিত পথচারীদের বিশ্রামাগার] দেখলাম। তেষ্টায় আর ক্লান্তিতে রাস্তার উপর শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। ধর্মঘরে উঠে পানি খেলাম। পানি খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম আমার হাত-পা কাঁপছে। পানি খেয়ে একটু শক্তি ফিরল বোধ হয়। ভারী পা দুটোকে কোনরকমে চালিয়ে দিলাম।

লঞ্চঘাটের কাছাকাছি গিয়ে লঞ্চের শব্দ শুনলাম। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম। নিজেকে মনে হলো খুব ভাগ্যবান, কারণ হাঁপাতে হাঁপাতে যখন লঞ্চের কাছে পৌঁছলাম, তখন লঞ্চের সিঁড়ি তোলা হচ্ছিল মাত্র, লঞ্চ ছেড়ে দেয় নি।

লঞ্চে উঠেই পাটাতনের উপর ব্যাগটা রেখে হাঁপাতে লাগলাম। কেবিনে জায়গা ছিল না।

খিদে পেলেও ভাত খাওয়ার কোন উপায় ছিল না।

একরাশ ক্লান্তি আর এক পেট খিদে নিয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছুলাম।

আগেই উল্লেখ করেছি, আমার সহপাঠী বন্ধু পুলক আর আমি দু’জনেই ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনার জন্য। তবে পুলক কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে চলে যাওয়ার পর রেসিডেন্সিয়ালের হোস্টেলে থাকা অবস্থায় আমাকে একাই খাগড়াছড়ির জন্য তথা সেখানে ফেলে আসা বন্ধুদের কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হতে হত। সেই সময়কার কিছু অনুভূতি তুলে ধরে এই লেখার সমাপ্তি টানছি ১৯৭৯ সালে ঢাকায় লেখা এবং আমার ‘শেকড়’ নামক সংকলনে অন্তর্ভুক্ত তিনটি কবিতার অংশবিশেষ শিরোনামসহ নিচে তুলে ধরার মাধ্যমে, যে কবিতাগুলির মধ্যে শেষ দু’টি লেখা হয়েছিল যথাক্রমে আমার খাগড়াছড়ির দুই পুরানো সহপাঠী বন্ধু দীনময় ও পুলকের উদ্দেশ্যে:

ওপার

এই মাঠটাকে হঠাৎ, কাজ করতে করতে,

মনে হল বড় বেশি ফাঁকা, ধু ধু –

চলে গেলাম নদিটার ওপাশে,

ওইপারের সবুজ বনে, নীল পাহাড়ে।

সেখানে আমি গত দিনগুলোতে

ফসল ফলিয়েছিলাম,

গতকালও আমি আদিবাসী ছিলাম –

সেখানে জুমচাষ করেছি।

প্রিয় দীন, মনে পড়ে?

দিনটা বৈসুর ছিল, মনে আছে বুঝি?

ঐ যে ঝর্ণার ডাকে বেরিয়েছিলাম?

সবুজ সবুজ সেই পাহাড়িয়া গ্রাম?

হায়, ওই দিনগুলো আজো কেন খুঁজি!

প্রিয় পুলক

জালালকে দেয়া তোমার একটা পুরনো চিঠি

চোখে পড়ল।

হঠাৎ আমার কি মনে হল জান?

মনে হল,

আমরা বুঝি কাছের জিনিসকে অবজ্ঞা করে

দুরের আকাঙ্ক্ষায় ছুটছি।

মনে হল সাগরের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি

ঝর্ণাকে ভুলে গিয়ে,

ঝর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে।

টীকা   


[*] এই লেখাটির মূল ভাষ্য ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৮-এর এসএসসি ব্যাচের পুনর্মিলনী উপলক্ষে পরবর্তীতে পরিকল্পিত একটি স্মরণিকার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। স্মরণিকাটি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়ে থাকার কথা, যদিও তা আমি হাতে পাইনি। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটিতে একই ব্যাচের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের পর যে স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিতে সংকলিত আমার লেখাটিও এই ব্লগে রয়েছে, যেটির শিরোনাম/লিংক হল:  ‘আমার কৈশোরের রাঙ্গামাটি’

জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার স্মৃতিগুলি

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

পাঠক, আপনার কি মনে পড়ে জীবনে প্রথম কখন কোথায় কেমন পরিবেশে ভোট দিয়েছিলেন? আমি নিজে সারা জীবনে খুব বেশিবার ভোট দেইনি, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে এ পর্যন্ত (২০২৪ সালের জানুয়ারি নাগাদ) মাত্র একবারই ভোট দিয়েছি। এই প্রেক্ষাপটে আমার জীবনে ভোট দানের যেসব স্মৃতি রয়েছে, সেগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরেছি এই লেখায়, যেগুলির সাথে পাঠক চাইলে নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে পারেন। আর ভোট দেওয়া নিয়ে স্মৃতিচারণের ফাঁকে দু’এক জায়গায় আমি আগ্রহী পাঠকের জন্য কিছু ভাবনার খোরাকও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

জীবনে আমি কখন প্রথম ভোট দিয়েছিলাম, এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, যে নির্বাচনে আমি সর্বপ্রথম ভোট দিয়েছিলাম, সেটিতে আমি একজন প্রার্থীও ছিলাম, যে ভূমিকায় সর্বাধিক ভোট পেয়ে আমি নির্বাচিত পর্যন্ত হয়েছিলাম! এটা সম্ভবত ছিল ১৯৮২ সালের ঘটনা, যখন আমার বয়স ছিল মাত্র বিশ। অবশ্য সেটা কোনো জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল না, বরং স্রেফ বুয়েটের ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছিল। তখন হল সংসদের নির্বাচনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম বুয়েটে সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ছাত্র ইউনিয়ন-সমর্থিত একটি প্যানেলের পক্ষে ‘বিতর্ক সম্পাদক’ নামক একটা পদে।[1] যাই হোক, এরপর আমার বুয়েটের পড়াশুনা এক বছর পুরো হতে না হতেই  ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গিয়েছিলাম। সেই সূত্রে টানা আট বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটানো আমার শিক্ষার্থীজীবনের সময়, দেশে অনুষ্ঠিত কোনো ধরনের নির্বাচনে আমার আবার ভোট দানের বা অন্য কোনো ভূমিকায় অংশ নেওয়ার প্রশ্ন আর ওঠেনি।

অবশ্য ১৯৮৯ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’-এর (যেগুলি তখন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আমি লম্বা এক ছুটিতে দেশেই অবস্থান করছিলাম। তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সেই নির্বাচন প্রতিহত করার আহ্বান জানালেও জেনারেল এরশাদের সরকার নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর ছিল, এবং সে অনুযায়ী নির্বাচন সম্পন্ন করার পক্ষে চালানো বিভিন্নমুখী সরকারি তৎপরতার অংশ হিসাবে সে সময় খাগড়াছড়িতে এক গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম[2] আয়োজিত এক জনসভায় আমি ঘটনাক্রমে উপস্থিত ছিলাম। সেই সূত্রে, এবং পরবর্তী আরও কিছু কাকতালীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, কিভাবে ১৯৮৯ সালের মে মাসে গঠিত ‘পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’-এর একজন ‘প্রতিষ্ঠাতা’ হিসাবে রাতারাতি আমার নামডাক (!) ছড়িয়ে পড়েছিল, সে ঘটনা এই ব্লগেই প্রকাশিত আমার একটি লেখায় (‘আমি কেন সিগারেট খেতাম’) বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আগ্রহী পাঠক সময় করে পড়ে দেখতে পারেন (যদি না ইতোমধ্যে পড়ে থাকেন)।  

যাই হোক, আমি আমার মার্কিন শিক্ষার্থীজীবনের পাট চুকিয়ে দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছিলাম ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে, যখন জেনারেল এরশাদ সবেমাত্র ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে কাগজে কলমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সেই বছর আমি নিজে প্রথমবারের মত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, সেবার আমি একটি নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়ে বক্তৃতা পর্যন্ত দিয়েছিলাম, শাপলা চত্ত্বরে (মানে খাগড়াছড়ির শাপলা চত্ত্বরে!), যেখানে আমি কথা বলেছিলাম সেবার কাস্তে মার্কায় নির্বাচনে দাঁড়ানো একজন প্রার্থীর পক্ষে। (আমার সমর্থিত প্রার্থী অবশ্য সেবার তেমন সুবিধা করতে পারেননি, যদিও পরবর্তী এক নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।) যতদূর মনে পড়ে, ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক হিসাবে যোগদানের কিছুকাল পরেই, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন একটি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়ানো সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট সম্পন্ন করা আমার এক প্রিয় ব্যক্তির জন্যও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলাম আমি অল্প সময়ের জন্য (সেই প্রার্থী যথাসময়ে নির্বাচিতও হয়েছিলেন)। তবে আমি ছিলাম অন্য এলাকার ভোটার, এবং এমনিতেও সেই নির্বাচনে আমি নিজের এলাকাতেও ভোট দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না।

সব মিলিয়ে, ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা বাদ দিলে, এ পর্যন্ত আমি আর অন্য কোনো জাতীয় নির্বাচনে বা দেশের কোথাও কোনো পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেইনি! এর একটা কারণ হল কাগজে কলমে আমি এখনও খাগড়াছড়ির ভোটার, কিন্তু ১৯৯১ সালের পর কোনো নির্বাচনের সময় সেখানে আমি ছিলাম না। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি চেষ্টা করতে পারতাম না, ভোটার হিসাবে নিজের ঠিকানা বদলের, অথবা নির্বাচনের সময় নিজের এলাকায় উপস্থিত থাকার? অথবা, তার চেয়েও মৌলিক আরেকটা প্রশ্ন হয়ত নিজেকে করতে পারি, নির্বাচনী গণতন্ত্রে – অথবা এর যে সংস্করণ আমাদের দেশে এখন চালু আছে তাতে – আমার কতটা আস্থা আছে? যদি না থাকে, তাহলে এর বিকল্প একটা ব্যবস্থা দাঁড় করানোর পক্ষে, একজন নাগরিক হিসাবে, আমি নিজে কি করেছি? যেহেতু এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আমি দিতে পারছি না, আমি ৭ই জানুয়ারি ২০২৩ তারিখের জাতীয় নির্বাচনে ভোটার হিসাবে বা অন্য কোনো ভূমিকায় অংশ নেওয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো কথা সরাসরি বলছি না। তবে এটা উপলব্ধি করছি, অন্তত নিজের কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, সেটা হল, প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর তেত্রিশ বছর কেটে গেছে। এই প্রেক্ষিতে আমি কি “তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি”  বলে হাহুতাশ করব, নাকি নিজে কতটা কথা রেখেছি (নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবিধ সামষ্টিক পরিসরে), তা নিয়ে নিজের সাথে আগে বোঝাপড়া করব?

উপরে তুলে ধরা প্রশ্নগুলোর প্রেক্ষাপটে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে এই প্রশ্নও করতে পারি, যে, ১৯৯১ সালে যখন আমি জীবনে প্রথমবারের মত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম, এমনকি একজন প্রার্থীর নির্বাচনীয় প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলাম, ঠিক কি ধরনের প্রত্যাশা আমার মনে ছিল? এ প্রসঙ্গে আমার কিছু ভাবনা আমি তুলে ধরেছিলাম ২০১৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি লেখা একটি ‘খোলা চিঠি’-তে (যা প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনা জয়ধ্বনি-তে), যেখান থেকে একটা প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে আবার তুলে দেওয়া হল:

১৯৯১ সালে দেশে ফেরার পর কাগজে কলমে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন দেখে আশাবাদী হয়েছিলাম, হয়ত বাস্তবেও তা অনেকখানিই ঘটবে, গোটা দেশে যেমন, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামেও। কিন্তু এসবতো আপনা থেকেই হওয়ার কথা নয়। জনগণের একটা বড় অংশের দাবি, আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াস একজায়গায় মিললেই কেবল তা সম্ভব। এক্ষেত্রে আপনারা যারা তরুণ আছেন, আপনাদের প্রতি আশার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ – দু’বছর আগে [২০১৩ সালে] – যখন শাহবাগের সেই অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে আবার গত বছর [২০১৪ সালে] একটা বহুল বিতর্কিত ও আলোচিত নির্বাচন হয়ে গেছে, যার জের ধরে দেশে এখনো গভীর রাজনৈতিক সংকট চলছে। আমি জানি না আপনি সেই নির্বাচনে ভোট দিতে চেয়েছিলেন বা পেরেছিলেন কিনা। যদি ভোট দিয়ে থাকেন, সেটা হয়তবা ছিল বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আপনার প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগের অভিজ্ঞতা। কিন্তু ভোট দিয়ে থাকুন বা নাই দিয়ে থাকুন, একটা কথা নিশ্চয় আপনিও ভালো করেই বুঝে গেছেন, নির্বাচন – সেটা যদি অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছও হয় – গণতন্ত্রের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, তার থেকে আমরা এখনো বহুদূরে। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা আমাদের করতেই হবে, এবং এক্ষেত্রে সকল ধরনের সহিংস পন্থা এড়িয়ে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেই, আমাদের খুঁজে নিতে হবে সামনে আগানোর পথ।

জীবনে একবার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (‘ইউকসু’) তথা হল সংসদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দানের যে অভিজ্ঞতা উপরে তুলে ধরেছি, সেসবের বাইরে অন্য আরেকটি পরিসরেও আমার ভোট দানের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়। আমি জাবিতে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যেকার দলাদলি সম্পর্কে আমার স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না, তবে যথাসময়ে বিষয়টা বুঝতে পারি, যদিও ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত ‘শিক্ষক রাজনীতি’ থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখেই চলতে চেষ্টা করতাম আমি। তবে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের মত প্রক্রিয়া থেকে পুরোপুরি দূরে থাকার উপায় বা প্রয়োজন কোনোটাই ছিল না, এবং এসব ক্ষেত্রে ভোটার হিসাবে ঢালাওভাবে কোনো বিশেষ প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার বদলে ব্যক্তি হিসাবেই তাদেরকে ভোট দিতাম। তবে ভোটের ফলাফল দেখে বুঝতাম, বেশিরভাগ শিক্ষকই ভোট দিতেন অন্য বিবেচনা থেকে, এবং এটা দেখে বেশ অবাক লাগত যে, যাঁরা ‘শিক্ষক রাজনীতি’র নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে ভালোভাবে খবর রাখতেন, তাঁরা সচরাচর অনেকটা নির্ভুলভাবেই আগে থেকে বলে দিতে পারতেন, কোন প্রার্থী কয়টা ভোট পাবেন, বা কোন ভোটার কাকে ভোট দেবেন! ভোটাদানে হয়ত কারচুপি হত না কোথাও, কিন্তু সার্বিকভাবে যে পরিবেশে বিভিন্ন পদে শিক্ষকরা নির্বাচিত হয়ে আসতেন, তার পেছনে যথাযথ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কাজ করত, এ কথা বলা যায় না। কথা হল, সমাজের সবচাইতে ‘শিক্ষিত’ স্তরেই যখন গণতন্ত্রের অপরিণত একটা দশা দেখা যায়, সেখানে সার্বিকভাবে স্থানীয় সরকার বা জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বেলায় গণতান্ত্রিক আদর্শের কতটা প্রতিফলন আমরা আশা করতে পারি?

(৬/১/২৪ তারিখে প্রথম প্রকাশের সময় এই নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘১৯৯১ সালের পর কোনো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেইনি কেন’, যা ৭/১/২৪ তারিখে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে লেখার শুরুর ও শেষের বর্তমান অনুচ্ছেদগুলিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।)

টীকা


[1] বুয়েটে আমি থাকতাম আহসানউল্লাহ হলের উত্তর ব্লকে, যেটির সংসদের ‘বিতর্ক সম্পাদক’ পদে আমার বিপুল ভোটে জয়লাভের পেছনে সে বছর বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আহসানউল্লাহ্‌ হলের পক্ষে অংশ নেওয়ার পর আমার শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হওয়া তথা হলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার যুক্ততা অন্যতম কারণ ছিল মনে হয়। বুয়েটে পড়ার সময় আমার ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সংক্ষিপ্ত সংশ্লিষ্টতা সহ প্রাসঙ্গিক আরও কিছু বিষয় উঠে এসেছে ‘‘ভালোবাসা দিবসে’ তরুণদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি খোলা চিঠি’ শীর্ষক আমার একটি লেখায়, যেখান থেকে একটি উদ্ধৃতি উপরে, এই নিবন্ধের শেষে, রয়েছে।

[2] কর্নেল ইবরাহিম পরে মেজর জেনারেল পদে অবসরে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে দলের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি সক্রিয় রয়েছেন, এবং সম্প্রতি জোট বদল করে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর তথা তাঁর মত আরও অনেক ব্যক্তি তথা প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষিতে একটা ভালো বিশ্লেষণী কাজ হতে পারে, কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিলক্ষিত অনেক প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করে (এবং একইভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কিছু প্রবণতার আলোকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় ইতিহাসের বেশ কিছু দিককে বোঝা যায়)।  

রাজ পুণ্যাহ: খাজনা বনাম বাজনা

প্রশান্ত ত্রিপুরা

বাংলা অঞ্চলে একদা জমিদারদের উদ্যোগে ঘটা করে খাজনা আদায়ের উৎসব অনুষ্ঠিত হত ‘পুণ্যাহ’ নামে। জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর এমন উৎসব স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সবখানে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে বান্দরবান-কেন্দ্রিক বোমাং সার্কেলে, এটি এখনও টিকে আছে। আর অন্য দুই সার্কেলেও (অর্থাৎ রাঙ্গামাটি-কেন্দ্রিক চাকমা সার্কেল ও খাগড়াছড়ি-কেন্দ্রিক মং সার্কেলে) দীর্ঘ কয়েক যুগ বন্ধ থাকার পর সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পুণ্যাহ উৎসব আয়োজিত হয়েছে একাধিকবার।

কেন কাদের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রাজ পুণ্যাহ উৎসব পালিত হয়ে এসেছে বা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে? যে ধরনের ঐতিহ্য ধরে রাখার নামে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকতে পারে, সেই ঐতিহ্যের স্বরূপ কি? সমকালীন প্রেক্ষিতে এটির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য কি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সহায়ক হতে পারে, এমন কিছু তথ্য, সূত্র ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে এই লেখায়।[1] নিচে পর্যায়ক্রমে ‘পুণ্যাহ’ শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকে শুরু করে সমকালীন রাজ পুণ্যাহ উৎসবের আবহ তুলে ধরে, এমন কিছু তথ্য, ছবি ও মতামতের পাশাপাশি তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রচনায় পাওয়া ‘পুণ্যাহ’ বিষয়ক একটি ভাবনা উদ্রেককারী দার্শনিক আলাপের উদ্ধৃতি পেশ করা হল, যেগুলির ভিত্তিতে পাঠক নিজের মত একটা উপসংহার টানতে পারেন উত্থাপিত প্রশ্নগুলির প্রেক্ষিতে।   

পুণ্যাহ: নামের ব্যুৎপত্তি ও বিপত্তি

‘পুণ্যাহ’ শব্দটি এসেছে পুণ্য ও অহ (অহঃ), এ দুটি শব্দের সন্ধি থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হল, ‘পুণ্যকর্ম করার জন্য নির্ধারিত শুভ দিন’, যদিও সামন্ত ও ঔপনিবেশিক শাসনামলে শব্দটি দিয়ে মূলত বোঝানো হত বছরের শুরুতে জমিদারদের আয়োজিত খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠান (রাজশেখর বসু ১৩৮০; বাংলা একাডেমী ১৯৯৬)। খাজনা দেওয়া একটি পুণ্যের কাজ, এই কথাটি একদা নিশ্চয় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করত রাজা-বাদশাদের প্রতিনিধিরা, রাজ-জ্যোতিষীরা! যাই হোক, ব্রিটিশ শাসনের অবসানে জমিদারি ব্যবস্থা উঠে গেলে বাংলা অঞ্চলের সব জায়গা থেকেই পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়।

উল্লিখিত পটভূমিতে ব্যতিক্রম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম, যেখানে অন্তত বান্দরবানে (বোমাং সার্কেলে) শতাধিক বছর ধরে মোটামুটি নিরবচ্ছিন্নভাবেই পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে এই উৎসবে বর্তমানে খাজনা আদায় হয় খুবই কিঞ্চিৎ, এবং কালের পরিক্রমায় পুরো অনুষ্ঠানের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে, যেমনটা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। 

রাজ পুণ্যাহ ও ‘জুম কর’ নামক খাজনার ইতিহাস

ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির সময় এটির আওতায় তিনজন চিফ বা রাজার কর্তৃত্বের আওতায় তিনটি রাজস্ব সার্কেলের সীমানাও নির্ধারিত হয়েছিল, যেগুলি হল বান্দরবান-কেন্দ্রিক বোমাং সার্কেল, রাঙ্গামাটি-কেন্দ্রিক চাকমা সার্কেল ও খাগড়াছড়ি-কেন্দ্রিক মং সার্কেল।[2] ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে এসব সার্কেলে বসবাসরত পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রায় সবার জীবিকার উৎস ছিল জুমচাষ। এই প্রেক্ষিতে পাহাড়িদের জন্য ‘জুম কর’ নামে একটা রাজস্ব ধার্য করা হয়েছিল, যা কিছু ব্যতিক্রম বাদে জুমচাষ করা প্রত্যকে পরিবারকে দিতে হত। এই জুম কর প্রসঙ্গে আমার (অবন্তী হারুনের সাথে মিলে লেখা) পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থ (প্রশান্ত ত্রিপুরা ও অবন্তী হারুন ২০০৩) থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হল।  

বেশ অনেকবছর যাবত মং সার্কেল ও চাকমা সার্কেলে জুম খাজনা আদায় বন্ধ রয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে ব্রিটিশ শাসনামলে ধার্য করা খাজনার পরিমাণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এত নগণ্য যে হেডম্যান ও রাজারা তা আদায়ে আর আগ্রহী নন (সর্বশেষ হারটা জুমিয়া পরিবার পিছু ৬ টাকা ১২ আনা, যা মৌজা হেডম্যান, সার্কেল চীফ ও রাষ্ট্রের মধ্যে নির্দিষ্ট অনুপাতে বণ্টিত হওয়ার কথা)। একমাত্র বোমাং সার্কেলেই খাজনা আদায় হয়, যে উপলক্ষে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব এখনো মোটামুটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় (বর্তমান বোমাং রাজার একজন নিকটাত্মীয় এ প্রসঙ্গে আমাদের জানান যে মূলত ঐতিহ্য রক্ষার্থেই অনুষ্ঠানটি এখনো করা হয়, বাস্তবে নাকি আক্ষরিক অর্থেই ‘খাজনার চাইতে বাজনা বেশি’ – মোট জুম খাজনার পরিমাণ যেখানে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা, সেখানে পুণ্যাহ উৎসবের পেছনে ব্যয় হয় লাখ দুয়েক টাকা!)  [পৃষ্ঠা ৬]

ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে [পার্বত্য চট্টগ্রামের] পাহাড়িদের সবাই কমবেশি জুমচাষের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও এই সংশ্লিষ্টতার ধরন সবার জন্য সমান ছিল না। অর্থাৎ আগে থেকেই পাহাড়িদের মধ্যে শ্রেণী বিভক্তির অস্তিত্ব ছিল যা ব্রিটিশ শাসনের সুবাদে একটা নির্দিষ্ট কাঠামো ও রূপ লাভ করে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা অনুসারে কার্বারি বা গ্রাম [পাড়া] প্রধানদের কোনো ‘জুম কর’ দিতে হয় না এবং রাজা ও হেডম্যানদের বেলায় এই করতো তাদের দিতেই হয় না, উল্টো তারা এর ভাগ পায়। অধিকন্তু কার্বারি ও হেডম্যানরা নিজেদের জন্য সেরা জমিগুলো বেছে নিতে পারে জুমচাষের জন্য। কাজেই এভাবে পাহাড়িদের মধ্যে সুস্পষ্ট শ্রেণী বিভাজনের একটা ভিত্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে রচিত হয়েছিল।

সাধারণ জুমিয়া কৃষকদের উপর করের যে বোঝা ছিল তা যথেষ্টই ভারী ছিল। আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে ধানের যে বাজার দর জানা যায়, [তার ভিত্তিতে দেখা যায়, তখন যদি পরিবার পিছু ৪ টাকা হয়ে থাকে, এর বিনিময়ে যে পরিমাণ ধান কিনতে পাওয়া যেত] তার বর্তমান বাজার দর হবে ১,০০০ (এক হাজার) টাকার উপর। এ থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় করের বোঝাটা [বেশ] ভারী ছিল। এই বোঝা যে সাধারণ কৃষকরা বহন করত তাদের সাথে নিশ্চিতভাবেই একটা শ্রেণীগত বিভাজন ছিল রাজা-হেডম্যান-কার্বারিদের। (বর্তমানে কোনো মৌজায় যদি ১০০টি জুমিয়া পরিবারের কাছ থেকেও ১,০০০ টাকা হারে কর নেওয়ার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আদায়যোগ্য মোট ১,০০,০০০ [এক লক্ষ] টাকা থেকে রাজা ও হেডম্যানের ভাগে পড়ত যথাক্রমে ৪১,৬৬৬ ও ৩৭,৫০০ টাকা।  জুমিয়া কৃষকদের বেগারও খাটতে হত, যে ব্যবস্থা ১৯০০ সালের শাসনবিধিতে আইনগতভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। [পৃষ্ঠা ২৪-২৫]

জুম কর আদায় হত হেডম্যান ও রাজাদের মাধ্যমে (যারা এই করের ভাগ পেত)…পরিবার পিছু একটা নির্দিষ্ট হারে। ১৮৭৪ সালে এই হার ছিল ৪ টাকা (হেডম্যান ১, রাজা ২, সরকার ১), যে বছর মোট ৮,৩৮৭ টাকা রাজস্ব আদায় হয় (Hutchinson 1906:33-34)। পরবর্তীতে জুম কর ৬ টাকায় উন্নীত করা হয় (রাজা ২.৫০, হেডম্যান ২.২৫, সরকার ১.২৫) যা ব্রিটিশ-উত্তরকালে আর [খুব একটা] বাড়ানো হয়নি। জুম কর আদায় করা হলেও ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিল পাহাড়িদেরকে জুমচাষ থেকে সরিয়ে এনে লাঙল ধরিয়ে দেওয়া। লাঙল চাষের খাতে ১৮৭৫ সালেও কোনো রাজস্ব আদায় হয়নি, কিন্তু ১৯০৩-৪ সাল নাগাদ বছরে ২২,০০০ টাকা রাজস্ব আদায় হতে থাকে, ১৪,০০০ একরের বেশি জমি লাঙল চাষের আওতায় চলে আসে। [পৃষ্ঠা ৩০]

রাজ পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের সমকালীন বাজনা ও সাজসজ্জা

ব্যক্তিগতভাবে আমি একবারই একটা রাজ পুণ্যাহ উৎসবের খানিকটা কাছ থেকে দেখেছিলাম, বান্দরবানে। সালটা ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ২০০৯ বা ২০১০ সালের কোনোটা ছিল, যখন আমি ইউএনডিপির পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি প্রকল্পে কর্মরত ছিলাম। যাই হোক, মূল আনুষ্ঠানিকতা আমি সেভাবে কাছ থেকে দেখিনি বা দেখার চেষ্টা করিনি সেবারও, তবে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদের সূত্রে এই উৎসবের আবহ সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, যার কিছুটা এখানেও তুলে ধরছি প্রাসঙ্গিক কিছু বিবরণ ও দু’টি ছবির মাধ্যমে, যেগুলি মূলত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বান্দরবানে অনুষ্ঠিত রাজপুণ্যাহ বিষয়ক।

উপরে উল্লেখ করা অনুষ্ঠান সম্পর্কে  পাহাড়বার্তা নামক একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ২১শে ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে শুরু হওয়া উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যাঁর সাথে অন্যান্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আনুষ্ঠানিকতার শুরু সম্পর্কে উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পাহাড়ী ঐতিহ্যের সানাইয়ের সুর আর সৈন্য-সামন্ত পরিবেষ্টিত তলোয়ার নিয়ে রাজ ভবন থেকে রাজকীয় বেশে নেমে এলেন বোমাং সার্কেলের ১৭তম রাজা বোমাং রাজা উ চ প্রু চৌধুরী।” তবে তখন ফেসবুকে শেয়ার করা একাধিক ভিডিও থেকে দেখেছিলাম বোমাং রাজা যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বাদক দল কোনো স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের বদলে বাজাচ্ছিলেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’ গানটির সুর।

কাগজে কলমে খাজনা আদায়ের জন্য অনুষ্ঠিত রাজ পুণ্যাহ আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাদের একদিকে যেমন বিভিন্ন উৎস (সরকার, বৈদশিক সাহয্য পুষ্ট প্রকল্প) থেকে পাওয়া অনুদানের উপর নির্ভর করতে হয়, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যে বিষয়ে এই পোস্টের সাথে জুড়ে দেওয়া দ্বিতীয় ছবিটা একটা ধারণা দেয়। 

সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, ‘রাজস্ব আদায়ের জন্য’ আয়োজিত ‘ঐতিহ্যবাহী’ রাজ পুণ্যাহ বাস্তবে হয়ে উঠেছে অনুদান-নির্ভর ও বাজার-চালিত একটি পাঁচমিশালি আসর, যেখানে একদিকে বাজে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাজনা, আরেকদিকে মেলা বসে ঐতিহ্যের মোড়কে পরিবেশিত কিছু পণ্যসহ স্থানীয় ভোক্তা ও শহুরে পর্যটকদের জন্য সাজানো নানান বাজারি পসরার।

‘পুণ্যাহ’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় প্রসঙ্গ হিসাবে যে ‘পুণ্যাহ’ উঠে আসতে পারে, তা অপ্রত্যাশিত নয়। তবে তরুণ বয়সে লেখা ‘সৌন্দর্যের সম্বন্ধ’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০৪) যেভাবে তিনি পঞ্চভূতের মধ্যেকার আলাপের ছলে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট লেনদেনের শোষণমূলক রূপ তথা তার উপর দেওয়া সাংস্কৃতিক প্রলেপ বিষয়ে কিছু ভাবনা তুলে ধরেছেন, তা আমাদের নিবন্ধের প্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক (‘পঞ্চভূত’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা টীকায় রয়েছে)।[3]

বর্ষায় নদী ছাপিয়া খেতের মধ্যে জল প্রবেশ করিয়াছে। আমাদের বোট অর্ধমগ্ন ধানের উপর দিয়া সর্‌ সর্‌ শব্দ করিতে করিতে চলিয়াছে।

অদূরে উচ্চভূমিতে একটা প্রাচীরবেষ্টিত একতলা কোঠাবাড়ি এবং দুই-চারিটি টিনের ছাদবিশিষ্ট কুটির, কলা কাঁঠাল আম বাঁশঝাড় এবং বৃহৎ বাঁধানো অশথ গাছের মধ্য দিয়া দেখা যাইতেছে।

সেখান হইতে একটা সরু সুরের সানাই এবং গোটাকতক ঢাক-ঢোলের শব্দ শোনা গেল। সানাই অত্যন্ত বেসুরে একটা মেঠো রাগিণীর আরম্ভ-অংশ বারম্বার ফিরিয়া ফিরিয়া নিষ্ঠুরভাবে বাজাইতেছে এবং ঢাকঢোলগুলা যেন অকস্মাৎ বিনা কারণে খেপিয়া উঠিয়া বায়ুরাজ্য লণ্ডভণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছে।

স্রোতস্বিনী মনে করিল, নিকটে কোথাও বুঝি একটা বিবাহ আছে। একান্ত কৌতূহলভরে বাতায়ন হইতে মুখ বাহির করিয়া তরুসমাচ্ছন্ন তীরের দিকে উৎসুক দৃষ্টি চালনা করিল।

আমি ঘাটে বাঁধা নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলাম– কী রে, বাজনা কিসের?

সে কহিল– আজ জমিদারের পুণ্যাহ।

পুণ্যাহ বলিতে বিবাহ বুঝায় না শুনিয়া স্রোতস্বিনী কিছু ক্ষুণ্ন হইল। সে ঐ তরুচ্ছায়াঘন গ্রাম্য পথটার মধ্যে কোনো এক জায়গায় ময়ূরপংখিতে একটি চন্দনচর্চিত অজাতশ্মশ্রু নববর অথবা লজ্জামণ্ডিতা রক্তাম্বরা নববধূকে দেখিবার প্রত্যাশা করিয়াছিল।

আমি কহিলাম– পুণ্যাহ অর্থে জমিদারি বৎসরের আরম্ভ- দিন। আজ প্রজারা যাহার যেমন ইচ্ছা কিছু কিছু খাজনা লইয়া কাছারি-ঘরে টোপর-পরা বরবেশধারী নায়েবের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিবে। সে টাকা সেদিন গণনা করিবার নিয়ম নাই। অর্থাৎ খাজনা দেনা-পাওনা যেন কেবলমাত্র স্বেচ্ছাকৃত একটা আনন্দের কাজ। ইহার মধ্যে একদিকে নীচ লোভ অপর দিকে হীন ভয় নাই। প্রকৃতিতে তরুলতা যেমন আনন্দ-মহোৎসবে বসন্তকে পুষ্পাঞ্জলি দেয় এবং বসন্ত তাহা সঞ্চয়-ইচ্ছায় গণনা করিয়া লয় না সেইরূপ ভাবটা আর-কি।

দীপ্তি কহিল– কাজটা তো খাজনা আদায়, তাহার মধ্যে আবার বাজনা বাদ্য কেন?

ক্ষিতি কহিল– ছাগশিশুকে যখন বলিদান দিতে লইয়া যায় তখন কি তাহাকে মালা পরাইয়া বাজনা বাজায় না? আজ খাজনা-দেবীর নিকটে বলিদানের বাদ্য বাজিতেছে।

আ­মি কহিলাম– সে হিসাবে দেখিতে পার বটে, কিন্তু বলি যদি দিতেই হয় তবে নিতান্ত পশুর মতো পশুহত্যা না করিয়া উহার মধ্যে যতটা পারা যায় উচ্চভাব রাখাই ভালো।

পঞ্চভূতের মধ্যেকার যে আলাপ উপরে তুলে দেওয়া হল, তার প্রেক্ষিতে আমার দৃষ্টিতে লেখাটির বিশেষত্ব এই যে, এতে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা তাঁর জমিদার সত্তাকে একভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, তবে খাজনার সাথে জড়িত শোষণমূলক ব্যবস্থার আলোচনাকে একমাত্রিক কোনো দিক থেকে তিনি বিচার করেননি। এই যে বিবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিষয়কে বোঝার চেষ্টা, তা সমকালীন রাজ পুণ্যাহ উৎসবের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আরো ভালো করে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

টীকা


[1] এই ব্লগ পোস্ট হচ্ছে ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ প্রকাশিত ‘রাজপুণ্যাহ নিয়ে কিছু কথা’ শীর্ষক আমার একটি ফেসবুক নোটের সম্পাদিত ভাষ্য।  

[2]এক কালের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা তিনটি রাজস্ব ‘সার্কেলে’ বিভক্ত ছিল, যেগুলির দায়িত্বে ছিলেন তিন চিফ বা রাজা। এই সার্কেলগুলির সীমানা আর বর্তমান তিন পার্বত্য জেলার সীমানার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যেমন, বোমাং সার্কেলে আওতায় রয়েছে পুরো বান্দরবান পার্বত্য জেলার আওতাধীন সব মৌজা ছাড়াও রাঙ্গামাটি জেলার কিছু অংশ। একইভাবে চাকমা সার্কেলের আওতায় রয়েছে রাঙ্গামাটি জেলার বাদবাকি মৌজাসমূহ এবং সে সাথে খাগড়াছড়ি জেলাধীন আরো কিছু এলাকা। অবশিষ্ট এলাকা পড়েছে মং সার্কেলে, যার পুরোটাই খাগড়াছড়ি জেলার মধ্যে পড়েছে। 

[3] পঞ্চভূত নামক একটি সংকলনের অন্তর্গত ‘সৌন্দর্যের সম্বন্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতে এই উদ্ধৃতি রয়েছে। যে উৎস থেকে উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রবন্ধের শুরুতে এটির রচনাকাল হিসাবে দেখানো হয়েছে ভাদ্র ১৩০০। তবে অন্য একটি উৎস থেকে জানা যায়পঞ্চভূত  গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০৪ সালে। সেখানে এও যোগ করা হয়েছে যে, পঞ্চভূত বলতে ভারতীয় দর্শনে বোঝানো হয় ক্ষিতি (বা পৃথিবী), অপ (বা জল), তেজ (বা অগ্নি), মরুৎ (বা বায়ু) ও ব্যোম (বা আকাশ), যেগুলির সমষ্টি হল এ জগৎ এবং সে হিসেবে মানুষও পঞ্চভূতেরই সমাহার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি এই পাঁচটি উপাদানকে নাম দিয়েছিলেন ক্ষিতি, স্রোতস্বিনী, দীপ্তি, সমীর ও ব্যোম। এই পাঁচ পাত্রপাত্রী মিলে একটি তর্কসভা গড়ে তোলা হয়েছে, যার কেন্দ্রে আছেন ভূতনাথ, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং!

তথ্যসূত্র

  • প্রশান্ত ত্রিপুরা ও অবন্তী হারুন (২০০৩) পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ, ঢাকা: সেড (SEHD: Society for Environment and Human Development)
  • বাংলা একাডেমী (১৯৯৬) বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান [দ্বিতীয় সংস্করণ]। ঢাকা: বাংলা একাডেমী।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৩০৪) সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, পঞ্চভূত  [ইন্টারনেটে পাওয়া The Complete Works of Rabindranath Tagore-এর Essays অংশের অন্তর্গত]
  • রাজশেখর বসু (১৩৮০) চলন্তিকা: আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান। কলিকাতা: এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড।
  • Hutchinson, R. H. S. (1906) An Account of the Chittagong Hill Tracts. Calcutta: The Bengal Secretariat Book Depot.

তিরিশ বছরের একটি সম্পর্কের কাহিনী

প্রশান্ত ত্রিপুরা

ডিসেম্বর ১৮, ২০২৩

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তারিখে, আমার জীবনের একটা বিশেষ সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।[১] এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ভালোবাসা ও স্বপ্ন, কিন্তু এতে কখনো কোনো সংশয় বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব যে এসে পড়েনি, তা নয়। এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছে কিভাবে তিরিশ বছর আগের এই দিনে নির্ঘুম এক রাত কাটানোর পর সাত সকালে আমি আমার তৎকালীন সহকর্মী তথা পরবর্তীকালের স্ত্রী আইনুনের মোহাম্মদপুরস্থ তাজমহল রোডের পারিবারিক বাসায় হাজির হয়েছিলাম অনাহূতভাবে। উল্লেখ্য, আমাদের সহকর্মী পরিচয়টাই তখন মুখ্য ছিল, অন্তত আমাদের আশপাশের অন্য সবার কাছে, যার প্রেক্ষিতে আইনুনদের যৌথ পরিবারের বাসায় আমার সেই আকস্মিক প্রাতঃকালীন উপস্থিতি একাধারে অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব ছিল। তবে তাদের বাসায় যেহেতু আগে থেকেই আমার আসা যাওয়া ছিল, একটু ব্যতিক্রমী সময়ে সেখানে গেলেও সেদিন সকালের নাশতাসহ সাদর আপ্যায়ন ঠিকই পেয়েছিলাম। সে যাই হোক, এখানে যে গল্পটা বলতে বসেছি, তা আইনুনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নয়! বরং আমি বলতে বসেছি একটি শব্দের সাথে আমার সম্পর্কের কথা, যে শব্দটি একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণের একটা প্রান্তিক অংশের কাছে আশা-ভরসা-স্বপ্ন তথা যৌথতা ও আন্দোলনের আধার হয়ে উঠতে শুরু করেছিল ১৯৯৩ সাল নাগাদ। আমি বলছি ‘আদিবাসী’ শব্দটির কথা, যেটির সাথে উল্লিখিত বছরের আগে আমার নিজের সুপরিচিতি বা ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা ছিল না (এ প্রসঙ্গে পরিশিষ্ট-১-এ সংযুক্ত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।

অনেকে হয়ত জানেন, ১৯৯৩ সাল ছিল জাতিসংঘ-ঘোষিত International Year of the World’s Indigenous People, যেটির বাংলা করা হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’। সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার যে অবস্থান নিয়েছিল – ‘বাংলাদেশের উপজাতীয়রা এদেশের আদিবাসী নয়’ (যে ধরনের বক্তব্য সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতেও পরিচিত মনে হতে পারে অনেকের কাছে) – সেটির বিপরীতে গিয়ে তৎকালীন দু’জন আওয়ামি লীগ দলভুক্ত তথা বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ঢাকায় বেসরকারিভাবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ডিসেম্বর ১৮, ১৯৯৩ তারিখে[২] আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেটিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর।[৩]

উপরে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমি ছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন প্রভাষক। উল্লিখিত ভূমিকায় আমার শিক্ষকতার বয়স হয়েছিল মাত্র দু’বছর, কাজেই নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বটা বেশ গুরুই মনে হয়েছিল আমার কাছে। তদুপরি জাতিসংঘের মত পরিসরে ঠিক কোন অর্থে ও কোন উদ্দেশ্যে ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’[৪] কথাটার প্রচলন শুরু হয়েছিল, বাংলা ‘আদিবাসী’ শব্দটি একই অর্থ বহন করে কিনা, এসব বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো পূর্বধারণা ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটেই খেটেখুটে নিজের প্রবন্ধটা শেষ করেছিলাম একেবারে শেষ মুহূর্তে, সেমিনারের নির্ধারিত দিনের ভোরে। (আজকের মত তখন আঙুলের ডগায় ইন্টারনেট, গুগল, মোবাইল ফোন প্রভৃতি কিছুই ছিল না। কাজেই আমার কাছে অপেক্ষাকৃত নতুন ছিল এমন একটি বিষয়ে নানান সূত্র যাচাই করে অল্প সময়ে লেখা দাঁড় করানো সহজ ছিল না।)

মনে পড়ে, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, ১৯৯৩ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারারাত জেগে মোহাম্মদপুর টাউন হলে সেখানকার এক পেশাদার টাইপিস্টকে দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ’ শীর্ষক আমার প্রবন্ধটি টাইপ করিয়েছিলাম।[৫] এরপর ১৮ তারিখ ভোরে কাজ শেষ করে সাত সকালে হাজির হয়েছিলাম আইনুনদের বাসায়, যেখানে প্রাতঃরাশ সেরে আমি সরাসরি চলে গিয়েছিলাম সেমিনারে অংশ নিতে। সেদিন যে প্রবন্ধ আমি পাঠ করেছিলাম, সেটি এক অর্থে ফরমায়েশি লেখা হলেও এর জন্য আমার কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ পাওয়ার, বা ক্ষমতাসীন কাউকে তুষ্ট করার, কোনো ব্যাপার ছিল না। আর তখন বয়সে ছিলাম তরুণ। মনের ভেতরে ছিল টাটকা কিছু ধ্যানধারণা, স্বপ্ন ও আশাবাদ। তাই দেশের আদিবাসী জনগণের প্রতি অনুভূত একাত্মতাবোধকে বুকে ধারণ করে নিজের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান অনুযায়ী যে ধরনের প্রবন্ধ আমার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল, তাই আমি তৈরি করেছিলাম সানন্দে, ভালোবাসার স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে যে স্বপ্নকে সামনে রেখে আমি লেখাটা লিখেছিলাম, সেটি আরো অনেকেই ধারণ করতেন, এবং এখনো করেন বলেই আমার বিশ্বাস। হতে পারে এমন মানুষেরা সংখ্যায় কম। আর সাধারণভাবে যাদের কথা আমরা আলোচনা করছি, সেই আদিবাসীদের সংখ্যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনমিতিকভাবে এতই কম যে, তাদেরকে প্রতিনিয়ত ‘ক্ষুদ্র’ বিশেষণে আখ্যায়িত করে, তাদের ‘নগণ্য’ বিবেচনা করে, নিজেদের গুরু-ত্বতে আশ্বস্ত অনুভব করার লোকের অভাব নেই এদেশে। তার উপর জাতীয় নির্বাচনের মত বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে তেমন প্রেক্ষিতে আদিবাসীদের সাংখ্যিক তথা রাজনৈতিক ‘নগণ্য’তা সরচারচর অনেক প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে বেশিরভাগ জায়গাতেই। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে সুদূর পরাহত কোনো স্বপ্ন নিয়ে ভাবার অবকাশ খুব একটা থাকে না কারও। তবুও যেমনটা আমি ১৯৯৩ সালের লেখায় বলেছি, ‘আদিবাসী’দের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে শুধু তাদের স্বার্থে নয়, বরং দেশের তথা বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ মাত্রায় ধরে রাখার একটা দীর্ঘমেয়াদী বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি রচনার তাগিদেই। আসুন, সে আলাপ আমরা করে যেতে থাকি সময় সুযোগ পেলেই, আগামী তিরিশ, পঞ্চাশ বা একশ’ বছর পরের সম্ভাব্য বিশ্বকে কল্পনায় রেখে (এ প্রসঙ্গে পাঠক পরিশিষ্ট-২ দেখে নিতে পারেন)।

পরিশিষ্ট-১: নিজের লেখালেখিতে ১৯৯৩ সালের আগে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার একমাত্র নমুনা  

‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উপলক্ষে ১৯৯৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর উপস্থাপনার জন্য যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তার আগে নিজের পুরানো কোনো শখের লেখালেখিতে বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো প্রবন্ধে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম, এমন বিশেষ কোনো নমুনা খুঁজে পাইনি একটা ব্যতিক্রম বাদে। ব্যতিক্রমটার কথা আমি উল্লেখ করেছি ‘অরণ্য থেকে অন্তর্জালে, রাঙা মাটির পথ থেকে রাজপথে’ শীর্ষক আমার একটি নিবন্ধে, যেখান থেকে একটা  প্রাসঙ্গিক বিবরণ নিচে তুলে দেওয়া হল।

আমি ‘আদিবাসী’ শব্দটা নিয়ে ছোট বেলায় কখনো খুব বেশী মাথা ঘামিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে কিশোর বয়সে লেখা নিজের একটা কবিতায় আমি এটা খুঁজে পেয়েছি। ‘ওপার’ নামের এই কবিতার শুরুটা এরকম:

এই মাঠটাকে হঠাৎ, কাজ করতে করতে
মনে হল বড় বেশি ফাঁকা, ধু ধু –
চলে গেলাম নদিটার ওপাশে,
ওই পারের সবুজ বনে, নীল পাহাড়ে।

সেখানে আমি গত দিনগুলিতে
ফসল ফলিয়েছি,
গতকালও আমি আদিবাসী ছিলাম –
সেখানে জুমচাষ করেছি।

[ঢাকা, ১৯৭৯]

যে সময় আমি কবিতাটা লিখেছিলাম, তখন [উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের শিক্ষার্থী হিসাবে] আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, এই দুটি ভূমিকার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া, যেভাবে সময় ও পরিপার্শ্ব ঠিক করে দিয়েছিল। সে অনুযায়ী [১৯৮০ সালে] উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বুয়েটে ঢুকলাম তড়িৎ প্রকৌশলী হওয়ার চিন্তায়।  সেখানে একটা ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া, রাত জেগে পোস্টার লেখা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে বছরখানেক জড়িত থাকার পর হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম একটা বৃত্তি, তাও আবার এমন একটা দেশে, যেটির কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে স্লোগান দিতাম! … বিদেশে পাড়ি দিলাম কম্পিউটার বিজ্ঞানী হবার চিন্তা করে…কিন্তু আট বছর পরে ফিরে এলাম অর্ধপক্ক এক নৃবিজ্ঞানী হিসাবে [যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ‘আদিবাসী’ বা ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’-এর ধারণা নিয়ে সরাসরি খুব একটা মাথা ঘামাইনি!]।

পরিশিষ্ট-২: ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার তথা এই ধারণার তাৎপর্য সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক ভাবনা

‘আদিবাসী’ শব্দ তথা ধারণাকে ঘিরে বেশ অনেকদিন ধরে যেসব বিভিন্নমুখী আলোচনা ও বিতর্ক দেখে গেছে, তার প্রেক্ষিতে নতুন করে আমিও বেশ লেখালেখি করেছিলাম ২০১৩ সালে। সেই বছর লেখা একটি নিবন্ধে (যা ‘আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে: বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনর্নির্মাণের দুই দশক (১৯৯৩-২০১৩)’ শিরোনামে এই ব্লগে রয়েছে) যে কথাগুলি দিয়ে আমি উপসংহার টেনেছিলাম, তা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। তাই কথাগুলি নিচে আবার তুলে ধরা হল।

[১৯৯৩ সালে] যে প্রত্যাশা নিয়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের পক্ষে ওকালতি করতে শুরু করেছিলাম আমরা অনেকে, তার কিছু দিক ভালভাবেই পূরণ হয়েছে এর মধ্যে। যেমন,  আদিবাসীদের মধ্যে এই পরিচয় স্বেচ্ছায় ও সগৌরবে ধারণের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সেসাথে এ নামে যারা পরিচিত, বা পরিচিত হতে আগ্রহী, তারা যে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় কিছু অধিকার পাওয়ার দাবীদার, এ নিয়ে বিভিন্ন পরিসরে সচেতনতা বেড়েছে।  এক্ষেত্রে অবশ্য অনেকের মধ্যে প্রত্যাশার পরিধিও হয়তবা একটু বেশিই বেড়েছে, যেনবা ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি পেলেই সকল ধরনের বঞ্চনা থেকে সহসা মুক্তি মিলবে। অন্যদিকে, আদিবাসী ধারণার বিরোধীরাও বসে ছিল না, বা বসে নেই, এবং কিছু ক্ষেত্রে তারাও তাদের অবস্থান সংহত করতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে মোটা দাগে আদিবাসী ধারণার প্রতি বিরোধিতার দ্বিবিধ কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন, একদল আছে যারা মনে করে আদিবাসীদের অনেক বেশী ছাড় দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে, এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তাদেরকে আদিবাসী হিসাবে মেনে নেওয়া হলে তাতে নানাভাবে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে। আরেকদল আছে যারা মনে করে, ‘আদিবাসী’ (বা ইনডিজেনাস) ধারণা আসলে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস সঞ্জাত অপরাধবোধ লাঘবের জন্য উদারনৈতিক পশ্চিমাদের একটি ফন্দি, যা শেষ পর্যন্ত বর্তমান ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্বার্থই বেশি রক্ষা করে। …

‘আদিবাসী’ শব্দটির উপর কথিত সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণমাধ্যম ও উন্নয়ন ডিসকোর্সে এটির ব্যাপক ব্যবহার (ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’ এবং তার সমার্থক হিসাবে বাংলা ‘আদিবাসী’) অনেকটাই অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কারা শব্দটি ব্যবহার করছে, তার চাইতেও বড় কথা কোন্‌ অর্থে এবং কী উদ্দেশ্য তারা তা করছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ‘আদিবাসী’ শব্দটা ব্যবহার করলেই যেমন ধরে নেওয়া যাবে না যে সে সংশ্লিষ্ট নামে অভিহিত কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার, সংস্কৃতি বা ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন, তেমনি শব্দটি ব্যবহারে কেউ আপত্তি করলেই এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, সে উক্ত জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে চায় না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা, আইন, সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রভৃতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেগুলিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আছে কি নেই, এমন বাহ্যিক বিষয়ের চাইতেও সেগুলির অন্তঃসারের দিকে নজর দিতে হবে। …

রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদিবাসীরা সব ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে, তা নয়। তেমনটা রাতারাতিতো হবেই না, দীর্ঘ মেয়াদেও কতটুকু হবে, তা দেখার বিষয়। এখানে সংশয়ের দুটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথমত, আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ যতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে দেওয়া আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা-নির্ভর প্রকল্প-ধর্মী উদ্যোগের মধ্যে সীমিত থাকবে, ততদিন সেগুলির তেমন কোন ব্যাপ্তি ও গভীরতা আশা করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে, আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের পেছনে একটা প্রধান কারণ হচ্ছে ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার বর্তমান দাপট, এবং ‘জাতিসংঘ’ হচ্ছে মূলত জাতিরাষ্ট্রসমূহের একটি সংগঠন, যা কাজ করে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও আপোসের মধ্য দিয়ে। কাজেই এমন একটি সংগঠনের ছায়ায় আদিবাসীদের অস্তিত্বের সংকটের মৌলিক সুরাহা কতটা হবে, তা তলিয়ে দেখার বিষয়।  তার মানে আবার এই না যে, ‘আদিবাসী’ ধারণাকে সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার মনে করে সম্পূর্ণ পরিহার করে চলতে হবে, যেমনটা বিভিন্ন ঘরানার মতাদর্শিক অবস্থান থেকে অনেকে বলে থাকেন।

চলমান বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, বিতর্ক ও প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে আদিবাসী ধারণাকে বর্তমানে আমি নিজে যেভাবে তুলে ধরতে চাই, তা হল এই, এটি যেমন সর্বরোগহর কোন দাওয়াই নয়, তেমনি নয় কোন চেতনানাশক বড়ি, বা কোন বিষবৃক্ষের গুপ্ত বীজ। আদিবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আদিবাসী হিসাবে পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তাদেরকে সর্বাগ্রে ঘর গোছাতে হবে, এবং অভিন্ন কিছু লক্ষ্য, পন্থা ও ক্ষেত্রকে ঘিরে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।  পাশাপাশি তাদেরকে মিত্র বাছার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হতে হবে, এবং সচরাচর বৈরী বলে বিবেচিত, এমন পরিসরেও সহায়ক শক্তির খোঁজে চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। আর ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার থাকা না থাকাকে বিভিন্ন উদ্যোগ, নীতি, কর্মসূচী প্রভৃতির মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি না ধরে, শেষোক্ত বিষয়গুলির অন্তঃসারের উপর অনেক বেশী মনোযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যারা ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রবক্তা হবেন, তাঁদেরকে দেশ ও বিশ্বের সামনে এ ধারণার সার্বজনীন আবেদন তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে দেশ বা বিশ্ব আদিবাসীদেরকে কি দিতে পারে, সেটার চাইতেও বেশি জোর দিতে হবে, ‘আদিবাসী’ ধারণার ধারক-বাহক-প্রবক্তারা দেশ বা বিশ্বকে কি  দিতে পারে, এ বিষয়ের উপর। এ প্রসঙ্গে আমার ‘আদিবাসী চেতনার সন্ধানে’ নামের একটি লেখায় যেমনটা বলেছি, ‘আদিবাসী’ শব্দটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ‘বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি অন্তত তিনটি আদর্শ, যেগুলোর জোরালো অস্তিত্ব ছিল বা রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে। এই আদর্শগুলো হল- প্রকৃতি সংলগ্নতা, সমতা ও সহভাগিতা।

টীকা


[১] এই লেখাটির প্রথম অংশটা হল ‘পঁচিশ বছর আগের একটি সম্পর্কের কাহিনী’ শিরোনামে ১৭/১২/২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি ফেসবুক পোস্ট-এর হালনাগাদকৃত ও সম্পাদিত তথা টীকাযুক্ত ভাষ্য, যেটির সাথে ‘পরিশিষ্ট’ হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আমার পূর্বপ্রকাশিত আরও দু’একটি প্রাসঙ্গিক লেখা থেকে নেওয়া কিছু উদ্ধৃতি।

[২] ১৯৯৩ তারিখে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদ্‌যাপনের জন্য যে তারিখ বেছে নেওয়া হয়েছিল, তার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল: সেটা এই যে, ১৯৯০ সালের ১৮ই ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ১৯৯৩ সাল পালিত হবে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ হিসেবে। সেই ধারাবাহিকতাতেই পরে এসেছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক, আদিবাসী দিবস ইত্যাদি।

[৩] উল্লেখ্য, মূল প্রবন্ধ লেখার দায়িত্বের পাশাপাশি কাগজে কলমে আমাকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উদ্‌যাপনের জন্য গঠিত একটি পরিচালনা পরিষদের সদস্য করা হয়েছিল, এবং অধিকন্তু ‘স্মরণিকা ও প্রকাশনা উপ-কমিটি’র আহ্বায়কও করা হয়েছিল (এই উপ-কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন সঞ্জীব দ্রং, প্রতিম রায় পাম্পু, মংনু চিং, আসিফ মুনীর, রেমন্ড আরেং, প্রমুখ)। মজার ব্যাপার হল, ১৮/১২/২০১৩ তারিখের অনুষ্ঠানের জন্য পরিকল্পিত স্মরণিকাটি যথাসময়ে প্রকাশিত হলেও এতে আমার নিজের প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি যেহেতু নিজের লেখাটি আমি শেষ করেছিলাম দেরিতে! (এই পোস্টে সেই স্মরণিকার প্রচ্ছদের ছবির পাশাপাশি সেখানে তৎকালীন সংসদের বিরোধী দলের নেত্রীর যে বাণী প্রকাশিত হয়েছিল, তাও তুলে ধরা হল। সে সাথে স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক ‘উদ্‌যাপন কমিটি’ ও ‘পরিচালনা পরিষদ’-এর সদস্যদের তালিকাও জুড়ে দেওয়া হল।)

[৪] এখন ইংরেজিতে বহুবচনযুক্ত ‘Indigenous Peoples’ কথাটা অধিকতর প্রচলিত হলেও ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ-ঘোষিত বর্ষটির নামে একবচনে ‘Indigenous People’ কথাটাই ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু এটি উল্লেখ করলাম যাতে মনোযোগী পাঠকদের কেউ না ভেবে বসেন যে, আমি ভুলে একবচনে ‘ইন্ডিজেনাস পিপল’ কথাটা লিখেছি।    

[৫] তিরিশ বছর আগের সেই প্রবন্ধটি আগ্রহী পাঠক এই ব্লগেই পড়ে নিতে পারেন: ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ও বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ’


কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িরা পর্যায়ক্রমে যে দুটি রাষ্ট্রের সীমানায় চলে এসেছিল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, সেগুলির আওতায় ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ (cf. Anderson 1983) তৈরির প্রকল্পে ব্যবহৃত কোনো প্রধান পরিচয়ই – যথাক্রমে ‘মুসলমান’ ও ‘বাঙালি – তাদের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, পাহাড়িদের মত জনগোষ্ঠীরা কেমন রাষ্ট্র চেয়েছিল, বা চাইতে পারে? উল্টোদিক থেকে বলা যায়, আধুনিক যে কোনো জাতি-রাষ্ট্র তার নির্ধারিত ছকের বাইরে গিয়ে কি বহুজাতির তথা সর্বজনের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে? এ ধরনের প্রশ্নই আমরা বর্তমান অধ্যায়ে[১] বিবেচনা করব বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিত এক বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম ও স্বপ্নের প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে।

এম এন লারমা কে ছিলেন, এবং কেন তাঁর সম্পর্কে জানা দরকার

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৩৯ – নভেম্বর ১০, ১৯৮৩),  যিনি তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীদের মধ্যে ‘এম এন লারমা’[২] নামেও পরিচিতি, সাক্ষর শ্রেণীর গড়পড়তা বাংলাদেশিদের মধ্যে কতটা পরিচিত, বা ঠিক কী হিসাবে পরিচিতি, তা একটি গবেষণাসাপেক্ষ বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়েন ও রাজনীতির খোঁজ রাখেন, এবং যাঁদের বয়স কমপক্ষে পঞ্চাশ, তাঁরা হয়তবা কমবেশি সবাই তাঁর নাম শুনেছেন। কিন্তু এদের কত ভাগ তাঁর জীবনবৃত্তান্ত, রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশের যে প্রান্তিক বলয়ে (বিবিধার্থে) তাঁর বিচরণ ছিল, যে সময়ে ও যে ধরনের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন, এবং তাঁর জীবদ্দশায় গোটা দেশ যে ধরনের উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গেছে, এসব প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে সহজেই বোঝা যায় তাঁর সম্পর্কে জনপরিসরে পর্যাপ্ত ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য কেন কখনই সহজলভ্য ছিল না, যে শূন্যতা এখনো রয়ে গেছে।     

আমার মনে হয়, পাহাড়ি সমাজের বাইরে বড় জোর বাম রাজনীতিকদের অনেকের মধ্যে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বা আদিবাসীদের নিয়ে পড়াশোনা করা লোকজনদের মধ্যে, এম এন লারমা সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকেবহাল লোকজনের দেখা মিলবে। এর বাইরে তাঁকে হয়তবা স্রেফ ‘শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা’, একজন ‘উপজাতীয় নেতা’ ইত্যাদি পরিচয়ে অনেকে জানতেন, এবং দল-মত-শ্রেণী নির্বিশেষে বাঙালিদের অধিকাংশ তাঁকে হয়তবা সন্দেহের চোখেই দেখতেন, বা এখনো নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই স্মরণ করেন। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সমাজে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বিরল উচ্চতার একজন ক্ষণজন্মা নেতা হিসাবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হলেও ব্যক্তিপূজার ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়নের চেষ্টা যে খুব বেশি হয়েছে, সে কথা বলা যায় না। তবে সরাসরি সেই শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে এই অধ্যায় রচিত হয়নি, যেহেতু কাজটি করতে হলে যে ধরনের জানাশোনা থাকা দরকার, তা এই লেখকের নেই। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান অধ্যায়ে মূলত পরিবেশিত হয়েছে প্রাথমিক একটি আলোচনা, যেখানে এম এন লারমা সম্পর্কে জানার তাগিদ আমি নিজে কখন কেন বোধ করেছি, এযাবত কতটুকু কিভাবে তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি, সেসব কথা বলার পাশাপাশি তাঁর যথাযথ ঐতিহাসিক মূল্যায়নের জন্য যে ধরনের প্রশ্ন তোলা জরুরি, সেগুলিই কিছুটা সামনে আনার চেষ্টা করেছি লারমাকে নিয়ে আমার ফেসবুক-কেন্দ্রিক লেখালেখির সূত্র ধরে, এবং সেসবের সাথে হাতের কাছে থাকা কিছু প্রাসঙ্গিক উৎস থেকে সংগৃহীত আরো কিছু নতুন তথ্য ও পর্যবেক্ষণ যোগ করে।   

নিজের পুরানো লেখালেখির ঝুড়িতে লারমা-কেন্দ্রিক আমার প্রথম যে লেখা খুঁজে পাই, তা হল একটি অসমাপ্ত ফেসবুক নোটের খসড়া, যা ২০১২ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখে (লারমার মৃত্যুদিবসে) লিখেছিলাম, কিন্তু তখন আর প্রকাশ করিনি এটা ভেবে যে, তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট না জেনে, পড়াশুনা না করে, কোনো লেখা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। যাই হোক, পরের বছর, ২০১৩ সালে, লারমার মৃত্যুদিবসে সেই অসমাপ্ত খসড়াটিই আমি প্রকাশ করি প্রাসঙ্গিক আরো কিছু ভাবনা ও আলাপ সমেত সাজানো বৃহত্তর কলেবরের একটি ফেসবুক নোটের অংশ হিসাবে। ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: যাঁর স্বপ্নের নাগাল পাওয়া চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত সেই লেখাটির কিছু নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হল:

[১০ই নভেম্বর, ২০১৩] নিজেরই এককালীন অনুসারী বা সহযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসমূহের স্বাধিকারের স্বপ্নকে যিনি একটা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন।  তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমার এই ছোট লেখা…।

এম, এন, লারমাকে কোনদিন চোখে দেখিনি। তবে তিনি যে একজন দূরদর্শী, বিরল ও প্রজ্ঞাবান নেতা ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর এককালের অনুসারীরা এখন বহুধাবিভক্ত হলেও অন্তত তাঁর নাম উচ্চারিত হলে সবাইকে নতমস্তক হতে দেখি। সন্দেহ নেই, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলী তাঁকে এক ভিন্ন আসনে উন্নীত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তিন দশক হতে চলল।  এখনো তিনি বৈষম্য-বঞ্চনা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষের রুখে দাঁড়ানোর ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অফুরান প্রেরণার উৎস। অন্যভাবে বলা যায়, এম, এন, লারমা এখন একটা কীংবদন্তি, একটা প্রতীক। কিন্তু এর বাইরে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা, দর্শন, আদর্শ – এসব নিয়ে আজকের প্রজন্ম কতটা জানে? তরুণ প্রজন্মের কথা বাদ দেই। আমি নিজেকেই একই প্রশ্ন করে দেখলাম, আসলে প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ ধারণা খুব একটা নেই।

ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের এখনো অনেক কিছুই জানার আছে, বোঝার আছে এম, এন, লারমা সম্পর্কে। সে উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করে পড়াশুনার চেষ্টা এখনো করা হয়ে ওঠেনি আমার, তবে … বিভিন্ন উৎস থেকে ব্যক্তি এম, এন, লারমার জীবন আর তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও সংগ্রাম সম্পর্কে যতই জানতে পারছি, ততই অন্য অনেকের মতই আমার মধ্যেও তাঁর প্রতি মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধা বাড়ছে। তবে সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাসের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমি জানি, তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা নিতে হলে আমাদেরকে ব্যক্তিপূজার ঊর্ধ্বে উঠে তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে। [আর তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি এ পর্যন্ত, তাতে আমার এও মনে হয়েছে যে,] মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম ও স্বপ্ন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের জন্যই নয়, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চান, এমন সবার জন্যই খুব জরুরি। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন সঙ্গত কারণেই। তবে এই গর্বকে সমুন্নত রাখতে হলে, আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে আত্মঘাতী সহিংসতা ও সংঘাতের বৃত্ত থেকে।

উপরে উল্লিখিত ফেসবুক নোটটি প্রকাশের ঠিক এক বছর পর, ২০১৪ সালের ১০ই নভেম্বর, ‘মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কে ছিলেন?’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফেসবুক নোটে আমি নতুন একটা প্রশ্ন ওঠানোর চেষ্টা করি, যেটা ছিল, লারমাকে একজন ‘আদিবাসী নেতা’, বা ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক’ গোছের কোনো খোপে আটকে ফেলা কতটা যুক্তিযুক্ত। একই সাথে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে পেশ করা খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনার সময় মৌলিক কিছু বিষয়ে কিভাবে লারমা একাই বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন, সেটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলাম। লেখাটির কিছু নির্বাচিত অংশ নিচে তুলে ধরা হল:  

বাংলাদেশ বহু জাতি ও বহু ভাষার দেশ। কিন্তু এদেশের সংবিধানে এখনো এই বাস্তবতার যথার্থ প্রতিফলন নেই। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে যথাযথ আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই যোগ করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের নাগরিকেরা বাঙালী হিসাবে পরিচিত হবে’, এমন একটি ধারা, যেটির বিরুদ্ধে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের মাত্র একজন সদস্য প্রতিবাদ করেছিলেন।  উপেক্ষিত সেই নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী কন্ঠ যাঁর ছিল, তিনি ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।

[…] 

১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করার সময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেগুলির যেসব নমুনা আমরা পাই, তাতে তাঁকে ‘আদিবাসী’ বা ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী’ ধরনের কোনো খোপে আটকে ফেলার জো নেই।  যেমন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবিধানে সুনির্দিষ্ট একটা বিধান রাখার দাবিতে সোচ্চার হয়ে তিনি বলেছিলেন, “আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বরা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি আমরা উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোন অর্থ হয় না।…এই সংবিধানের মাধ্যমে আমরা যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি সেই সমাজতন্ত্রের নামে আমরা আবার যদি উচ্চ শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও সেই ক্ষমতা অপব্যবহারকারীদেরই দেখতে পাই তাহলে ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যারা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তারা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে গিয়েছেন।” [গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪; ১৯ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলোচনার অংশ হিসাবে দেওয়া লারমার বক্তব্যের অংশবিশেষ]

সারাদেশের খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সংবিধানে হয়নি, এমন বিরল আক্ষেপও ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর কন্ঠেই: “আমার বিবেক, আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে কথা পুরোপুরি এই খসড়া সংবিধানে নেই। … আজ আমি দেখতে পাচ্ছি পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী,  বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই মনের কথা এ সংবিধানে লেখা হয়নি। আমি বলছি, আজকে যাঁরা রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন, তাঁদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি” [গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯; ২৫ অক্টোবর ১৯৭২ তারিখে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলোচনার অংশ হিসাবে দেওয়া লারমার বক্তব্যের অংশবিশেষ] 

উপরের কথাগুলিতে সমগ্র বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষ নেওয়া যে বড় মাপের নেতার আভাস আমরা পাই, তিনি কবে কিভাবে খণ্ডিত অবয়বে (যেমন প্রধানত একজন ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী’ নেতা হিসাবে) পরিচিত হয়ে উঠলেন?

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে নিয়ে আমার আগের বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টের ধারাবাহিকতায় আমি পরেও একই মাধ্যমে একাধিক লেখা প্রকাশ করেছি তাঁর সম্পর্কে, যেগুলির কোনোটিতে আগে তোলা কিছু প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেছি, আবার কোনোটিতে হয়তবা নতুন কোনো দৃষ্টিকোণ যোগ করার চেষ্টা করেছি। যেমন, ২০১৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে (অর্থাৎ লারমার জন্মদিনে) দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টে অন্য আরো কিছু কথার সাথে আমি যোগ করেছিলাম,   

‘জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক’ গোছের কোনো খোপ যে লারমার প্রকৃত ঐতিহাসিক জায়গা নয়, তা তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজ নিলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। যেমন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদে তিনি যেসব বক্তব্য পেশ করেছিলেন, সেখান থেকে একটা অংশ এখানে উদ্ধৃতি দিচ্ছি [বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯; ২৫ অক্টোবর ১৯৭২]:

“আজকে যারা কল-কারখানার চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ, প্রতিটি জিনিস তৈরি হচ্ছে, সেই লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের মনের কথা এখানে নাই।

তারপর আমি বলব, সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে এই যে, আমাদের মা-বোনদের কথা নেই। নারীর যে অধিকার, সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।”

এইকভাবে ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে, অর্থাৎ আবারও লারমার জন্মদিনে, ফেসবুকে আরেকটি লেখা পোস্ট করেছিলাম, যেখানে শুরুতে তাঁর নাম উল্লেখ করিনি আমার সম্ভাব্য পাঠকদেরকে কৌতূহল জাগানোর কৌশল হিসাবে। সেই পোস্টটির একটা সংক্ষেপিত ভাষ্য নিচে তুলে ধরা হল:

তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায়। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে আটক করেছিল পুলিশ। তাঁর প্রকৃত ‘অপরাধ’ ছিল তখনকার রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সমাজের একটা অভিজাত অংশ পেছনে ছিল, এমন একটি বিরাট ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের বিরোধিতা করা। … তখন অন্য কেউ সেই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

যাঁর কথা বলছি, তিনি ছিলেন জনসম্পৃক্ত একজন মানুষ, যিনি সাধারণ জনগণের কথা ভাবতেন, এবং দুইবার (১৯৭০, ১৯৭৩) জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। …

একজন রাজনীতিবিদ ও জননেতা হিসাবে [লারমার] সব পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত কি ঠিক ছিল? যেমন, তিনি নাকি বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও এ নিয়ে আমার নিজের বিশেষ জানা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে এসব প্রশ্নের বিচার করবে ইতিহাস। আমার নিজের যে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই, তা হল, যাঁর কথা বলছি, তাঁর চিন্তাচেতনা জুড়ে সব সময়ই সবার শীর্ষে ছিল সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও আর্থসামাজিক মুক্তি। আর একথা শুধু তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকার প্রেক্ষিতে নয়, বরং আরো বৃহত্তর পরিসরে দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রযোজ্য ছিল।

উপরে আমার ফেসবুক-কেন্দ্রিক যেসব লেখা থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা-বিষয়ক আমার বিবিধ ভাবনা, উপলব্ধি, প্রশ্ন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলির রচনাকালে আমার হাতের কাছে তেমন কোনো সহায়ক গ্রন্থ ছিল না, যেগুলির একটি হতে পারত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম শিরোনামে প্রকাশিত একটি স্মারক গ্রন্থ (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬)। উল্লেখ্য, এটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে, কিন্তু প্রকাশনাটির কথা আমার যথাসময়ে জানা হয়ে ওঠেনি এবং পরে জানলেও তা আর হাতে পাইনি। তবে বইটির যে দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়, তা আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি। এটির প্রথম অধ্যায়ে সংকলিত রয়েছে লারমাকে কাছ থেকে দেখেছিলেন এমন অনেকের স্মৃতিচারণধর্মী লেখাসহ তাঁর গুণমুগ্ধ বেশ কয়েকজনের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও মূল্যায়ন। এসবের পাশাপাশি বইটির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হল এর দ্বিতীয় অধ্যায়, যেখানে একত্রিত করা হয়েছে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদে সংবিধান বিলের উপর যে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছিল (অক্টোবর ১৯, – নভেম্বর ৪, ১৯৭২) তাতে দেওয়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বিভিন্ন বক্তব্য। এর পর রয়েছে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে (এপ্রিল ৭, ১৯৭৩ থেকে নভেম্বর ২১, ১৯৭৪ পর্যন্ত সময়কালে) দেওয়া তাঁর বিবিধ বক্তব্য। এসব বিবরণী দেখার পর আগে নানান জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে (ও অনেকাংশে খণ্ডিত আকারে) চোখে পড়া তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের সার্বিক প্রেক্ষাপট তথা তাঁর চিন্তাভাবনার ব্যাপ্তি আগের চেয়ে আরো ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে শুরু করেছি। এই পটভূমিতেই লারমা কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের একটা প্রাথমিক উত্তরের খসড়া পেশ করা হল এই অধ্যায়ে।   

কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন এম এন লারমা?

আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেব তাঁর সময়কার বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। এক্ষেত্রে আমরা আবার স্মরণ করতে পারি যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, অর্থাৎ তিনি ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের সেই কালপর্বের সন্তান, যখন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ভেঙে বহু নতুন রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।  ব্রিটিশ ভারতের একেবার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ও সরকারি ভাবে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় জন্ম নেওয়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার পিতা চিত্তরঞ্জন চাকমা ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রথম প্রজন্মের চাকমাদের একজন, যিনি পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন স্থানীয় পাহাড়িদের মধ্যে যাঁরা সেই অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন চাকমা ছিলেন কিনা আমাদের জানা নেই। হতে পারে, বর্তমান রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলাধীন মাওরুম নামের যে নিজ গ্রামে লারমার পিতা শিক্ষকতা করতেন, সেখানে বসে তিনি বা তাঁর মত আর্থসামাজিক অবস্থানের অন্য পাহাড়িরা তখন সেই ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কোনো তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ অভিঘাত অনুভব করেননি। তবে ১৯৬০-এর দশক শুরু হতে না হতেই পুরো দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা বাতিল করা হয়, যার মাধ্যমে সমতল অঞ্চলের লোকজনের জন্য সেখানে এসে বসতি স্থাপনের দরজা সরকারিভাবেই খুলে দেওয়া হয়, অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে এক বিশাল এলাকা বিলীন হয়ে গিয়ে প্রায় এক লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যায়, যাদের একটা বড় অংশই ছিল চাকমা সম্প্রদায়ের।  এই উদ্বাস্তু মানুষদের মধ্যে ছিলেন লারমাদের পরিবারও, যাদের মাওরুম গ্রাম তলিয়ে যায় কাপ্তাই হ্রদের নিচে।

যে সময় কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হতে যাচ্ছিল, এম এন লারমা ছিলেন বিশের কোঠায় পা দেওয়া এক তরুণ, যিনি ততদিনে সেই যুগের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন (১৯৫৮ সালেই, ম্যাট্রিক পাশ করার বছর, তিনি যোগ দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে)। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনা শেষ করার পরের বছর, ১৯৬১ সালে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে তিনি এগিয়ে আসেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, একই কলেজে ডিগ্রি পর্বের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, নিবর্তনমূলক আইনে তাঁকে আটক করা হয়, যে অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে দুই বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। জানা যায়, কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য লেখা তাঁর একাধিক চিঠি তখনকার দু’একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, যদিও এগুলি এখনো এই লেখকের নজরে আসেনি।  যাই হোক, ১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধের মত বড় প্রকল্প ছিল বিশ্বব্যাপী আরাধ্য ও নন্দিত ‘উন্নয়ন’-এর দৃষ্টান্ত, যেটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হওয়া বা তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান রাষ্টের বা তখনকার বিশ্বব্যবস্থার মোড়লদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।

উল্লিখিত পটভূমিতে ১৯৬৯ নাগাদ বিএড ও এলএলবি ডিগ্রি পাশ করার পর লারমা যখন ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে, কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার আওতায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন নিজেকে তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণকে, বা গোটা দেশের মেহনতি মানুষদের, যাঁদের কথা তিনি ভাবতেন? তাঁর সেই সময়কার চিন্তাভাবনার কোনো প্রত্যক্ষ নিদর্শন এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি, তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি কী অবস্থান নিয়েছিলেন, কী ধরনের চিন্তাভাবনা গণপরিষদে তুলে ধরেছিলেন, সেসব আমরা ইতোমধ্যেই কিছুটা দেখেছি। এসব বিষয়ের প্রতি আরো একটু কাছ থেকে নজর দেওয়া যাক।

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট গণপরিষদের সদস্য তথা সদ্যগঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আহ্বায়ক হিসাবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বাক্ষরিত এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবি’ সম্বলিত যে আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয় ১৯৭২ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে, সেটির সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল, যেখানে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৭০)।  খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে এই প্রস্তাব নতুন করে পেশ করার পাশাপাশি অন্য যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল, তাতে আমরা জানতে পারি যে, লারমা বা তাঁর দলের দৃষ্টিতে ‘জাতিসমূহের সমস্যা’ সমাধান করেছে, এমন রাষ্ট্রের তালিকায় ছিল ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। উল্লিখিত আবেদনপত্র থেকে এ বিষয়ক বক্তব্যের অংশবিশেষ দেখে নেওয়া যাক  (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৭৩-১৭৪):          

ভারত তার বিভিন্ন জাতিসমূহের সমস্যাসমূহ সামধান করেছে। … সোভিয়েত ইউনিয়নও তার জাতিসমূহের সমস্যার সমাধান করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সকল জাতিসমূহকে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা দিয়েছে এবং গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে [বিভিন্ন এককে ভাগ করে] জাতিসমূহের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে।

পাকিস্তান সরকার আমাদিগকে নির্মমভাবে নিপীড়ন করে। …

এখন নিপীড়নকারী পাকিস্তান সরকারের দিন আর নেই। … আমাদের বাংলাদেশ এখন মুক্ত। উপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ভেঙে গেছে। এখন আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চারটি মূলনীতি – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাই-বোনদের সাথে একযোগে এগিয়ে যেতে চাই।

উল্লেখ্য, লারমা তাঁর বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন তখনকার সরকারি ভাষা অনুযায়ী, যদিও একই সাথে তিনি ‘উপজাতি’ ও ‘জাতি’ শব্দগুলি সমার্থকভাবেও ব্যবহার করতেন। এটি উপরে উল্লেখ করা আবেদনপত্রে যেমন দেখা যায়, তেমনি গণপরিষদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যেও খুঁজে পাওয়া যায়।  এ ধরনের একটি উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হল (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৮৭):

পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় এলাকা। …

এখানে বিভিন্ন জাতি বাস করে। এখানে চাকমা, মগ, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরুং এবং চাক এইরূপ ছোট ছোট দশটি উপজাতি বাস করে। এই মানুষদের কথা আমি বলতে চাই।

পৃথিবীর অনেক দেশেই সমাজতন্ত্র হয়েছে [যেগুলিতে] বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। জানি না, আমরা কি অপরাধ করেছি।

লারমা অবশ্য খসড়া সংবিধানে প্রান্তিক জাতিদের কথা না থাকা নিয়ে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি তাঁর দৃষ্টিতে উপেক্ষিত অন্য আরো বিভিন্ন প্রান্তিক শ্রেণী ও গোষ্ঠীর হয়েও একাধিকবার কথা বলেছিলেন গণপরিষদে, যেমনটা আমরা আগেই দেখেছি। তিনি এমনকি নারী অধিকারের পক্ষেও সমান উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্টতই এক বিশেষ সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে লারমা তাঁর প্রজন্মের অন্য অনেকের মতই ঔপনিবেশিক পরিভাষায় খানিকটা অভ্যস্ত ছিলেন বটে – যেমন ‘উপজাতি’র মত শব্দ নেওয়ার বেলায় – তবে তাঁর মধ্যে যথেষ্ট অধিকার সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা ছিল, যার কারণে অন্যরা উপেক্ষা করেছিলেন, এমন কিছু সূক্ষ্ম বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি। যেমন,  গণপরিষদে বিতর্কের এক পর্যায়ে  একজন সদস্য, নূরুল হক, যখন বলেন যে, “সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে সকল প্রকার জাতির, কৃষক শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের সর্বপ্রকার শোষণ মুক্তি দানের কথা আছে”, এই বক্তব্যের উত্তরে লারমা বলেন, “আমরা করুণার পাত্র হিসাবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসাবে। তাই মানুষ হিসাবে বাঁচবার অধিকার আমাদের আছে” (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:১৮৮)। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, লারমার আপত্তির একটা অন্যতম কারণ ছিল ‘অনগ্রসর’ শব্দটির ব্যবহার, যদিও এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডল থেকে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক পরিভাষা রপ্ত করে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় প্রয়োগ করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বা তাঁর গঠিত দল জনসংহতি সমিতি কিছু ক্ষেত্রে হয়তবা অসচেতন জাত্যাভিমান দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। … কিন্তু সাধারণভাবে লারমা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর সমসাময়িক অন্য নেতাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার দিক থেকে। যেমন জাতীয় সংসদের শুরুর দিকে যখন কোরান তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের মাধ্যমে অধিবেশন শুরুর রেওয়াজ চালু হয়, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ কেন করা হবে না। এমন বক্তব্য তিনি একাধিকবার দেওয়ার পর এক পর্যায়ে তৎকালীন আইন মন্ত্রী কিছুটা ব্যঙ্গের স্বরে তাঁকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছিলেন লারমা কখন এমন প্রশ্ন তুলবেন, এবং তিনি নিজেই হয়ত ত্রিপিটক পাঠ করবেন। উত্তরে লারমা জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে, তিনি ত্রিপিটক পাঠের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসেননি। তিনি যে নীতিগত সমতার দৃষ্টিকোণ থেকেই সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের আহ্বান জানাতেন, তা পরে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৫ই জানুয়ারি, ১৯৭৪-এ সংসদে দেওয়া তাঁর নিম্নরূপ বক্তব্যে : “আজকে এই মহান জাতীয় সংসদে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত, গীতা পাঠ এবং ত্রিপিটক পাঠ হল বটে কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের বাইবেল পাঠ করা কেন হল না?” (পূর্বোক্ত: ২৬১)

আমরা যদি সংসদে দেওয়া লারমার বিভিন্ন বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে দেখি, তাহলে দেখব যে একজন আইন প্রণেতা হিসাবে তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথা ভাবেননি, বরং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সংক্রান্ত বিল থেকে শুরু করে পল্লী বিদ্যুতায়ন, পাকশি কাগজের কল, বেতারে বিরোধী দলীয় মতামত প্রকাশের সুযোগ, দুষ্কৃতকারী কর্তৃক থানা লুট, শ্রমিক প্রশিক্ষণ, বাজেট – এমন বহুবিধ বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত ও যুক্তিতর্ক পেশ করেছিলেন। তিনি এমনকি বন্যজীবজন্তু সংরক্ষণের বিষয়েও সংসদে প্রশ্ন করেছিলেন, এবং তাঁর এই ভূমিকা যে সাময়িক কোনো কৌতূহলের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, বরং এর পেছনে যে প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর মমতা তথা তাঁর বিশেষ পরিবেশসচতনা ছিল, তা জানা যায় তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, এমন দু’একজনের বয়ানে।  তাঁর বিশ্ববীক্ষার এই অনালোকিত দিক সম্পর্কে আমি নিজে প্রথম জেনেছিলাম কাকতালীয়ভাবে, যখন একদা জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, আমার এমন এক পরিচিতজন আমাকে তাঁর একটি লেখা পাঠান, যেখানে মূলত প্রয়াত এম এন লারমাকে তিনি যতটা যেভাবে কাছ থেকে দেখেছিলেন, সেই স্মৃতি বর্ণনা করা রয়েছে। সেই সূত্রে জানতে প্রথম জানতে পারি, পার্টির কর্মীদের প্রতি তাঁদের নেতার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামা ছিল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল হতে। সেই লেখায় এও জানতে পারি, নেতাকে লুকিয়ে একবার কিছু কর্মী একটি বন্যপ্রাণী খেয়ে ফেলার ঘটনা জানতে পেরে তিনি প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম গ্রন্থে সংকলিত ‘পরিবেশবাদী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও কিছু স্মৃতি কথা’ শীর্ষক একটি লেখায়ও বিস্তারিত প্রাসঙ্গিক বিবরণ পাওয়া যায় (লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা ২০১৬:৯৭-৯৮)।

যাই হোক, আমরা যদি আবার জাতীয় সংসদের লারমার ভূমিকার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে তিনি পার্বত্য চটগ্রামের দশটি পৃথক ভাষার নাম উল্লেখ করে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিষয়াবলী ও ক্রীড়া (শিক্ষা বিভাগ) মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই ভাষাগুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা। উত্তরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলেন, “ক) ১০টি ভাষা উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা আপাতত নাই, এবং খ) “পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হেতু দেশের অন্যান্য অংশের সহিত ইহার সম্পর্ক নিবিড় হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয় এবং একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমেই তাহা সম্ভব হইতে পারে” (মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬:২৯২)।

জাতীয় সংসদে পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার প্রায় চার দশক পর যে বাংলাদেশে সরকারিভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার বেলায় মাতৃভাষাকে আমলে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, বা আংশিকভাবে হলেও এদেশের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে (যদিও এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ধ্যান-ধারণা এখনো অনেকাংশে ঔপনিবেশিক আমলেরই রয়ে গেছে) তাতে প্রমাণিত হয় যে, লারমা তাঁর সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের অনেকের তুলনায় দূরদর্শী ছিলেন, ‘অগ্রসর’ ছিলেন। সেই তিনি ‘অনগ্রসর’ নামক একটা বর্গের আওতায় তাঁকে নির্বাচিত করা জনগণের অধিকারের কথা বলবেন কেন? জাতি-ধর্ম-শ্রেণী-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই অনেকের চেয়ে অগ্রগামী ও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, যেসব কথার অনেকটা তিনি একাই শুধু বলেছিলেন ১৯৭২ সালের গণরিষদে। তাঁর কথা যদি তখনকার অন্য জনপ্রতিনিধিরা একটু হলেও আমলে নিতেন, কেমন হতে পারত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল তথা বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাস, বা রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি ও স্বরূপ?


টীকা

[১] এই লেখাটি হল ২০২০ সালে প্রকাশিত লেখকের ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ  শীর্ষক গ্রন্থে একই শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত একটি অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশবিশেষ।

[২] বলা বাহুল্য, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত, এবং সে হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাঁর নামের উপাধি ‘চাকমা’ হতে পারত বা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনো কারণে তিনি সেই ধারার বাইরে গিয়ে তাঁর গোত্রের নাম ‘লারমা’ নামের উপাধি হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন, যা চাকমা সমাজে আগে বা পরে খুব দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বর্তমান সভাপতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (যিনি জনপরিসরে ‘সন্তু লারমা’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত) হচ্ছেন আরেক বিখ্যাত লারমা, যিনি এম এন লারমার ছোট ভাই, এবং বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্বে আসেন।    

তথ্যসূত্র

Anderson, Benedict (1983) Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism.  London: Verso

মঙ্গল কুমার চাকমা, সম্পা. (২০১৬) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম, রাঙ্গামাটি: এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন। 

লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা (২০১৬) ‘পরিবেশবাদী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও কিছু স্মৃতি কথা’, মঙ্গল কুমার চাকমা, সম্পা. (২০১৬) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জীবন ও সংগ্রাম, রাঙ্গামাটি: এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।

অতীত নামের ভিনদেশ ঘুরে দেখা

পাহাড়িদের কথিত আরাকানি উৎস তথা ইতিহাস প্রসঙ্গে দু’টি কথা[1]

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

 “The past is a foreign country: they do things differently there.” (‘অতীত একটা ভিনদেশ, সেখানে লোকজনের আচার-ব্যবহার আলাদা।’) এই সুপরিচিত উক্তিটি ব্রিটিশ কথাসাহিত্যক L P Hartley-র The Go-Between নামের (১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশিত) একটি উপন্যাসের প্রথম বাক্য।[2] সেই অতীতের বিবরণ বা অতীত অধ্যয়নকে আমরা ইতিহাস বলি।  নৃবিজ্ঞানে শেখানো হয়, ভিন্ন কোন জাতির সংস্কৃতি অধ্যয়ন করতে গেলে ethnocentrism বা স্বজাতিকেন্দ্রিকতার বাইরে গিয়ে ‘অন্য’দের সাথে মিশে তাদের চোখ দিয়ে জগতকে দেখতে হবে।

অতীতের বেলায় আক্ষরিক অর্থে অন্য একটি সমাজে গিয়ে বাস করার সুযোগ নেই। তবে সেখানেও গবেষকদের জন্য একই ধরনের শর্ত প্রযোজ্য। যাই হোক, বাস্তবে এ শর্ত মানা সহজ নয়। কারণ, দেখা যায়, বর্তমানের চশমা দিয়েই আমরা সচরাচর অতীতের দিকে তাকাই। সেই চশমা আবার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পাল্টায়। কাজেই ইতিহাসে ধ্রুব সত্য বলে কোন কিছু নেই। তাই বলে ইতিহাস মানে অতীত নিয়ে যে যখন খুশি, যা খুশি লিখবে, তাও নয়। এটা হতে পারে যে আজ যে ইতিহাস পড়ছি, সেটা সাম্প্রতিক ইতিহাসের বিজয়ীদের পক্ষে, সবলের স্বার্থে লেখা। তার মানে এই নয় যে বিজিতদের কন্ঠস্বর, দুর্বলদের কথা,  বা নিম্নবর্গের মানুষদের দুঃখ-বেদনার শোকগাঁথা বা তাদের কামনা-বাসনা-স্বপ্নের বিবরণ, এসব একেবারেই হারিয়ে যায়। আধুনিক কালে এগুলির পাঠোদ্ধারের দিকে প্রভূত মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে গুজব থেকে কিংবদন্তী, সাদামাটা প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, অনেক কিছুই ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হয়ে উঠতে পারে। তবে সে উপাদানগুলো থেকে ইতিহাসের পাঠোদ্ধারের কিছু স্বীকৃত পদ্ধতি, এবং প্রাসঙ্গিক তাত্ত্বিক কাঠামো আছে। এগুলোকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের মানুষদের ইতিহাস চেতনাকে যথাযথভাবে অনুধাবন করা, এবং তাকে একটা সংগ্রামী গতিবেগ দেওয়ার কাজে সহায়তা করা, এগুলো বেশ পুরানো  চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশের মত জায়গায় ক্ষমতাবান শ্রেণী ও গোষ্ঠীগুলো গায়ের জোরে অনেক অসত্য বা অর্ধসত্যকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বিনা দ্বিধায়। আর এমন প্রেক্ষাপটে বিদ্যাজাগতিক শৃঙ্খলাকে পাশ কাটিয়ে ইতিহাসের খণ্ডিত ও আংশিক পাঠেই অনেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে বর্তমানেতো একটু গুগল সার্চ দিলেই অনেক তথ্য পাওয়া যায়, খুব দ্রুত অতীত বা অদেখা কোনো এলাকা, অজানা কোনো জাতি সম্পর্কে একটা বিবরণ দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এসব বিবরণ অনেকক্ষেত্রেই খুবই সমস্যাজনক হতে পারে, হয়ে থাকে। যেমন, সম্প্রতি (অর্থাৎ এই নিবন্ধ প্রথম লেখার সময়, বা ২০১২ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে) চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চল সম্পর্কে পত্রপত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদিতে বিভিন্ন জনের লেখার কিছু নমুনা দেখে খানিকটা হতাশ হলাম (এ বিষয়ক সুনির্দিষ্ট আলোচনা রয়েছে নিচে ১ম টীকায় উল্লিখিত দু’টি নিবন্ধে, যেগুলি হল, On the supposed Arakanese origin of the Indigenous Peoples of the CHT এবং চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চল কি আসলেই মগের মুল্লুক?)। মনে হল, তথ্যের প্রায় অসীম ভাণ্ডার আমাদের হাতের মুঠোয় থাকলেও, সেগুলো থেকে অর্থপূর্ণ ঐতিহাসিক বয়ান তৈরি করার জন্য কিছু মৌলিক বিদ্যাজাগতিক প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার বিকল্প নেই। 

যদিও বেশ কিছু উত্তর-আধুনিক ধারা আমাদের প্ররোচিত করেছে আংশিক সত্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে, পাশাপাশি তাগিদ দিয়ে চলছে আমাদের মধ্যে সংশয় ও সন্দিগ্ধতাকে সদাজাগ্রত রাখতে, আমার কাছে মনে হল ‘বিজ্ঞান’, ‘সত্য’ ইত্যাদি সম্পর্কে আধুনিকতাবাদী যে দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে ছিল, তার আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে আমার শিক্ষক ছিলেন, এরকম একজন ইতিহাসমনস্ক ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, প্রয়াত অশোক কুমার দেওয়ান (১৯২৬-১৯৯১) চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইতে যেসব কথা লিখেছেন, সেগুলো আমার কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ মনে হয়েছে।

অশোক কুমার দেওয়ান ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তাঁর নাতিদীর্ঘ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার বইয়ের শুরুতেই লিখেছেন, “ইংরেজ অধিকারের পর থেকে চাকমা জাতির ইতিহাসে তথ্যের আর কোন ঘাটতি নেই, কিন্তু তার পূর্ববর্তীকালের বর্তমানে প্রচলিত ইতিহাসের অনেকাংশই কাল্পনিক এবং ভ্রমাত্মক।” এর একটু পরে তিনি যোগ করেছেন, “ইংরেজ শাসকগণ গোড়া থেকেই একটি অমূলক ধারণা পোষণ করেছিলেন যে, চাকমা জাতি আরাকান থেকে আগত তদ্দেশীয় একটি খণ্ড জাতি, অবশ্য সে ধারণার মূলে বাহ্যতঃ কতগুলি কারণও ছিল। কালে কালে সেই ধারণা স্বজাতীয়গণের মধ্যেও গভীর বিশ্বাসের রূপ নেয়।”  তিনি আক্ষেপ করে বলেন যে, “আমাদের মধ্যে এখনও প্রকৃত ইতিহাস চেতনার ও ইতিহাসের প্রতি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব আছে। আমরা এখনও Mythology-কে ইতিহাস বলে বিশ্বাস করি, জনশ্রুতিকে অভ্রান্ত  ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করি, পরীক্ষা ছাড়াই অপরের দেওয়া তত্ত্ব ও তথ্যকে নির্বিচারে মেনে নেই।” চাকমা জাতির ইতিহাস সংক্রান্ত তাঁর নিজের সমীক্ষা শেষ করে তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, তাতে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও যথার্থ ইতিহাসমনস্কতার ছাপ আছে।  তিনি চাকমাদের ইতিহাস সম্পর্কে প্রচলিত বিভিন্ন ধারণার অসারতা যুক্তি দিয়ে দেখানোর পর লিখছেন, “দিগভ্রান্ত পথিকের ন্যায় দীর্ঘ ক্লান্তিকর পরিব্রাজন শেষে এতদিনের পরিক্রান্ত পথটিকে যদি নিতান্ত ভুল বলে প্রতীয়মান মনে হয় তবে বিষাদ ক্লিষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সত্য রূঢ় ও অপ্রিয় হলেও কখনও অসুন্দর নয়, অশুভ নয়।”  সবশেষে তিনি একটা আশাবাদ ব্যক্ত করে তাঁর বই শেষ করেছেন, “আশা করি, ধূলি লুন্ঠিত ইতিহাসের জঞ্জাল স্তূপ পরিস্কার করে আগামী দিনের নবীন স্থপতিরা নূতন করে ইতিহাসের … ভিত্তি রচনায় ব্রতী হবেন। দিগভ্রষ্ট পূর্বসূরীগণ যে পথ দিয়ে এগিয়েছেন সে পথ পরিত্যাগ করে নূতন ভাবে আবার ইতিহাসের পথের রেখা খুঁজে নিতে হবে। … অলীক স্বপ্ন দিয়ে গড়া মায়ার ভুবনে কৃত্রিম স্ফটিকে নির্মিত মনোহর ভবনে বাস করার চাইতে বাস্তব পৃথিবীর কঠিন মাটিতে পত্র পল্লব ছাওয়া পর্ণকুটিরে বাস করা অনেক শ্রেয়।”[3] মূলত চাকমাদের প্রেক্ষিতে কথাগুলো বলা হলেও পাহাড়ি-বাঙালি, রোহিঙ্গ্যা-রাখাইন, হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টান সবার জন্য, বা বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার সব দেশের প্রেক্ষিতেই, কথাগুলো সমানভাবে প্রযোজ্য, যদি আমরা সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও মৈত্রী চাই।

টীকা


[1] এই লেখাটি ২০১২ সালের ৬ই নভেম্বর  ‘অতীত নামের অচিনপুর ঘুরে দেখা: ইতিহাস প্রসঙ্গে দুটি কথা’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফেসবুক নোটের হালনাগাদকৃত ভাষ্য। উল্লেখ্য, ফেসবুক নোটটি আমি লিখেছিলাম সেই সময়কালে লেখা, এবং যথাক্রমে New Ageপ্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত, দু’টি লেখা তুলে ধরা কিছু ভাবনা ও অভিমতের অংশ হিসাবে। লেখা দু’টির প্রথমটি ছিল Misleading article about the supposed Arakanese origin of the non-Bengali ethnic groups of the CHT (২রা নভেম্বর ২০১২ New Age-এ প্রকাশিত, যা আমি লিখেছিলাম একই পত্রিকায় প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের কথিত আরাকানি উৎস নিয়ে লেখা একটি নিবন্ধ পাঠের প্রতিক্রিয়া হিসাবে। আমার সেই লেখাটি নতুন করে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে On the supposed Arakanese origin of the Indigenous Peoples of the CHT শিরোনামে)। দ্বিতীয় লেখাটিও, যা ২০১২ সালের ১৪ই নভেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলো-তে, আমার ব্যক্তিগত ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে মূল শিরোনাম অপরিবর্তিত রেখেই (চট্টগ্রাম-আরাকান অঞ্চল কি আসলেই মগের মুল্লুক?)।  

[2] প্রসঙ্গত, Hartley-র বই থেকে নেওয়া উদ্ধৃতির প্রথমাংশ (‘The past is a foreign country’) পরবর্তীতের প্রকাশিত একাধিক গ্রন্থের (এমনকি দু’একটি ছায়াছবিরও) শিরোনামের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। এগুলির একটি হল ইতিহাসবিদ David Lowenthal-এর লেখা একটি বই, The Past is a Foreign Country (১৯৮৫ সালে প্রকাশিত)। অতীত একটা ভিনদেশ শীর্ষক মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্প সংকলনের (২০১৬ সালে বেহুলাবাংলা কর্তৃক প্রকাশিত) শিরোনামেও একই উৎসের প্রভাব থাকতে পারে।     

[3] অশোক কুমার দেওয়ানের কাজ নিয়ে বিশদতর আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠক আমার এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন:  বাস্তবতার পর্ণকুটিরে স্বজাতির ইতিহাস খোঁজা: অশোক কুমার দেওয়ানের চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার প্রসঙ্গে কিছু কথা

অচিন পাখির ডাক

ভালবাসা নামের একটা অচিন পাখি
শিস দিয়েছিল জানালার বাইরে।
ঘুমের ঘোরে আমি তার ডাক শুনেছিলাম।

মেঘ ভেজা দিনের উন্মুখ শরীরে
দ্বিধান্বিত আঙুল ছোঁয়াই আমি।
নিভৃত নিকুঞ্জে বসে অন্তঃপুরে কান পাতি,
অন্তরার অস্পষ্ট রেশ কুড়োতে চাই
প্রতিটি রেণুর নীরব রণনে।

কখন মেঘ সরে গিয়ে রোদ উপচে পড়েছে
বাতাসের পিচ্ছিল কাঁধে।
জানালায় স্বচ্ছ সবুজ সার্সী বসিয়ে
তাতে দূর অতলান্তের ছবি আঁকি।

একবার, শুধু একবার, অশান্ত সমুদ্রের সারথী হয়ে
শৈল উপকূলে আছড়ে পড়তে চাই।
বজ্র আর বিজলীর সমারোহে আমার
নূতন কক্ষপথ খুঁজে নিতে চাই।

[বার্কলে। জুলাই ১১, ১৯৯০]

আমার নানা রঙের মার্কিন গ্রীষ্মাবকাশগুলি

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

পটভূমি

‘সামার’ বা গ্রীষ্ম হচ্ছে বছরের উষ্ণতম ঋতু, যার সময়সীমা পৃথিবীর অনেক দেশেই হিসাব করা হয় তিন মাস করে, উত্তর গোলার্ধে জুন থেকে আগস্ট, আর দক্ষিণ গোলার্ধে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এমনিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে গ্রীষ্ম হল বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য (বা মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত) দুই মাসের একটি ঋতু। তবে এই নিবন্ধে সাধারণভাবে আমরা ‘গ্রীষ্ম’ কথাটিকে শুরুতে উল্লেখ করা তিন মাসের ‘সামার’-এর সমার্থক হিসাবেই ব্যবহার করব, এবং ‘গ্রীষ্মাবকাশ’ বলতে বোঝাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যাজাগতিক বর্ষপঞ্জিতে অনুসৃত ‘সামার ভ্যাকেশন’, যার মেয়াদও সচরাচর তিন মাসের হয়ে থাকে মে মাসের শেষ দিক বা জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু করে আগস্টের শেষ দিক বা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিক পর্যন্ত । এই লেখায় সুনির্দিষ্টিভাবে আমি নজর দিচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কাটানো আমার আটটি সামার ভ্যাকেশনের প্রতি, যেগুলির প্রথমটি ছিল ১৯৮৩ সালে, এবং শেষটি ১৯৯০ সালে। অনেক আগের এই গ্রীষ্মাবকাশগুলি ছিল নানা রঙের, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা ও আনন্দ-বেদনায় ভরা, যেগুলির কিছু গল্প নিচে পেশ করছি।*

তবে নিজের গল্প বলার আগে একটু বলে রাখি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন মাসের সামার ভ্যাকেশনের রেওয়াজ সূচিত হয়েছিল মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, এবং এটি সাধারণভাবে অধিকাংশ মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুসৃত হতে থাকে বিংশ শতাব্দীতে। এর আগে সে দেশের কৃষিনির্ভর অঞ্চলগুলিতে বছরে দুইটি বড় ছুটি পেত শিক্ষার্থীরা, তবে সেগুলি ছিল এখনকার সামার ভ্যাকেশনের তুলনায় বেশ ছোট। এ ছুটিগুলির একটি ছিল বসন্তকালে, যখন অনেক শিক্ষার্থী পারিবারিক খামারে সহায়তা করত ফসলের চারা লাগানোর কাজে, এবং আরেকটি ছিল হেমন্তে, যখন ছুটি পাওয়া শিক্ষার্থীরা ফসল তোলার কাজে হাত লাগাত! অন্যদিকে নিউইয়র্কের মত বড় শহরগুলিতে গ্রীষ্মকালের বড় অংশ জুড়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকত, যদিও অবস্থাপন্ন পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে পল্লী এলাকায় বা বিদেশে ছুটি কাটাতে যেত গরম আবহাওয়া এড়াতে। এর বাইরে সেই সময় আমেরিকার কোথাও লম্বা সামার ভ্যাকেশনের কোনো রেওয়াজ ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে পাবলিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সমতুল্য কাঠামো তথা ছন্দে নিয়ে আসার উদ্যোগের অংশ হিসাবে সামার ভ্যাকেশনের প্রথা চালু হয়, যা বিংশ শতাব্দী নাগাদ অধিকাংশ মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুসৃত হতে থাকে।[1]     

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে সমকালীন মার্কিন ধাঁচের দীর্ঘ (তিন মাসের) গ্রীষ্মাবকাশ কখনই ছিল না, এবং অদূর ভবিষ্যতেও দেখা যাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ বা সম্ভাবনা নেই। বরং এদেশে সাম্প্রতিক কালে মাত্র দু’এক সপ্তাহের ‘গরমের ছুটি’ও খুব বিরল হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগতভাবে ছোটবেলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের (বুয়েটে) প্রথম বর্ষ পর্যন্ত বাংলাদেশে কাটানো শিক্ষাজীবনে লম্বা কোনো ‘গ্রীষ্মের ছুটি’র কোনো স্মৃতি আমার নেই। তবে একবারের কথা মনে পড়ে যখন – তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম – বেশ লম্বা, সম্ভবত এক মাসের বেশি, একটা ছুটি পেয়েছিলাম। তখন অবশ্য একগাদা হোমওয়ার্কও দেওয়া হয়েছিল, যে কারণে ছুটিটার কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তবে দেশে কাটানো আমার শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ধাপগুলিতে (হাই স্কুল ও কলেজ পর্বে, বা বুয়েটের প্রথম বর্ষে) আনুষ্ঠানিকভাবে যদি গ্রীষ্মের ছুটি পেয়েও থাকি, সেগুলি তেমন লম্বা ছিল না বা সেগুলি নিয়ে আমার বিশেষ কোনো স্মৃতি নেই।

মূলত আমেরিকায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্বের লেখাপড়ার সময়ই (আগস্ট ১৯৮২- ডিসেম্বর ১৯৯০) আমি তিন মাস মেয়াদের ‘সামার ভ্যাকেশন’ পেয়েছিলাম পর পর আটটি বছর। এই সময়গুলিতে পড়াশুনা থেকে পুরোপুরি দূরে থাকার অবকাশ ছিল, যে সময়টা শিক্ষার্থীরা পরিবারের সাথে, অথবা ভ্রমণে, অথবা বিভিন্ন ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জনের কাজে লাগাবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। আমিও তাই করেছিলাম নিজের মত করে। তবে নানান দিক থেকে আমার এসব গ্রীষ্মাবকাশের প্রতিটাই ছিল ভিন্ন ধরনের, যেগুলি একের পর এক কোনো না কোনো নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে। সব মিলিয়ে আমার মার্কিন শিক্ষাজীবনের আটটি সামার ভ্যাকেশন আমার স্মৃতিতে বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। এই সময়গুলির কিছু গল্প আমি বিক্ষিপ্ত বা খণ্ডিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় বলেছি, কখনো ফেসবুক পোস্টে, কখনও এই ব্লগে বা অন্যত্র প্রকাশিত কোনো স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে। মূলত এমন বিভিন্ন টুকরো গল্প দিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।    

মধ্যরাতের সাবওয়ে যাত্রী হিসাবে কাটানো এক গ্রীষ্মাবকাশ, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৩

আমার জীবনের যে আটটি বছর আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছিলাম, সেই সময়কার স্মৃতিতে নিউ ইয়র্ক একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে একাধিক কারণে। প্রথমত, নিউ ইয়র্ক ছিল আমার তরুণ বয়সের ‘স্বপ্নের দেশ’ আমেরিকায় পৌঁছে দেখা আমার প্রথম মহানগরী। আমি যখন ১৯৮২ সালের আগস্টে প্রথমবারের মত আমেরিকায় যাই, একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসাবে, আমার মূল গন্তব্য ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও আমি প্রথম গিয়েছিলাম নিউ ইয়র্কে, যেখানে ‘কুইন্স’ নামের একটি এলাকায় কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলাম আমার বন্ধু সুলতানের সাথে। সে আমার এক বছর আগেই একটা স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিল ব্র্যান্ডাইজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং তার পরামর্শ মোতাবেক একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার পর আমিও একই স্কলারশিপ পেয়ে যাই পরের বছর। যাই হোক, ১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে সে নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছিল একটা সামার জবের সুবাদে, এবং সেই সূত্রেই আমিও আমেরিকায় প্রথমে নিউ ইয়র্কেই যাই, যেখানে সুলতানের সাথে একই বাসায় থেকেছিলাম কয়েকটা দিন, এবং এরপর আমরা একত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই।

এরপর ১৯৮৩ সালের সামার ভ্যাকেশনের সময় সুলতান আর আমি দু’জনেই আবার চলে এসেছিলাম নিউ ইয়র্কে, যেখানে আমি কাজ করতাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে থাকা একটি ভবনে। আমার কাজ ছিল একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে, এবং আমি কাজ করতাম বিকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত। কাজের ফাঁকে আমি খেতে যেতাম একটা বার্গার কিং রেস্তোরাঁয়, যেখানে সচরাচর একটা ‘হোয়াপার’ (Whopper) আর মিল্ক শেক ছিল আমার ডিনার। আমার মনে আছে, প্রথমবার আমি Whopper নামটি উচ্চারণ করেছিলাম ‘হপার’ বলে, ফলে কাউন্টারের পেছনে থাকা কর্মী বুঝতে পারছিলেন না আমি কি চাচ্ছিলাম, পরে বুঝতে পেরে বলেছিলেন, ‘ওহ্‌, হোয়াপার!’

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ‘টুইন টাউয়ার্স’, ৩০ জুন ১৯৮৩ তারিখে আমার নতুন কেনা ক্যামেরায় তোলা ছবি।

প্রসঙ্গত, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে যে ‘সামার জব’ আমি করেছিলাম ১৯৮৩ সালে, সে ধরনের কাজ আমি এবং আমার আরও বেশ কয়েকজন সহশিক্ষার্থী পেয়েছিলাম যে স্কলারশিপ নিয়ে আমরা পড়তাম, সেটির পৃষ্ঠপোষকদের সৌজন্যে। তবে আমার বন্ধুদের কেউ একই ভবনে কাজ করত না। সেখানে আমার সহকর্মীদের অধিকাংশ ছিলেন পোলিশ ইমিগ্র্যান্ট, যাদের সান্নিধ্যে আমি একটা পোলিশ গালি রপ্ত করেছিলাম। এছাড়া কিছু লাতিন আমেরিকান (যেমন এল সালভাদর থেকে আসা) সহকর্মীও ছিলেন। যাই হোক, কাজটা যেহেতু পেয়েছিলাম আমাদের স্কলারশিপ কর্মসূচির পৃষ্ঠপোষকদের মাধ্যমে, এই যোগসূত্রের কল্যাণে মজুরি ভালোই পেতাম, ঘণ্টাপ্রতি আট ডলার করে, যা ছিল তখনকার নিম্নতম মজুরির দ্বিগুণ। ফলে দ্রুত আমার হাতে নিজের কিছু বিশেষ শখ পূরণের মত অর্থ চলে এসেছিল। এ শখগুলির একটি ছিল ফটোগ্রাফি, এবং সে অনুযায়ী আমি তিনশ ডলার দিয়ে একটা ‘নাইকন এফজি’ ক্যামেরা কিনেছিলাম তখন, সাথে দু’শ ডলার দামের একটি জুম লেন্স। সেই ক্যামেরা দিয়েই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ‘টুইন টাউয়ার্স’-এর যে ছবি এই লেখার সাথে প্রকাশ করা হয়েছে, তা তুলেছিলাম ১৯৮৩ সালের ৩০শে জুন (তারিখটা লিখে রেখেছিলাম আমার সংগ্রহে রয়ে যাওয়া ছবিটার পেছনে)।

‘আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি’: আমেরিকায় প্রথম যাওয়ার পর নিউ ইয়র্কের কুইন্স অঞ্চলের ‘করোনা’ নামক একটি মহল্লায় অবস্থিত যে বাসায় আমি সুলতানের সাথে ছিলাম কয়েকটা দিন, সেই বাসার মূল বাসিন্দা ছিলেন তিনজন বাংলাদেশি বড় ভাই, যাদের সাথে একই বাসায় সুলতানের পাশাপাশি আমিও ছিলাম ১৯৮৩ সালের গ্রীষ্মাবকাশে। সেই বাসার মূল বাসিন্দাদের একজন ছিলেন তারিন ভাই, আর বাকি দু’জনের একজন ছিলেন চট্টগ্রাম থেকে অভিবাসিত খোকন ভাই, এবং তৃতীয়জন ছিলেন রনি ভাই। তাঁদের সাথে, এবং সুলতানের সাথেও, আমার অবশ্য মূলত উইকেন্ডেই কিছুটা আলাপ হত, সময় কাটানো হত। যাই হোক, একদিনের কথা মনে পড়ে, যখন বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে যাওয়া তারিন ভাইয়ের এক বন্ধু – বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক নারী, যাঁর বিভিন্ন পরিচয়ের একটি ছিল একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে – বেশ কয়েকটা গান গেয়েছিলেন সেই বাসায় ঘরোয়াভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। তখন আমিও তাঁর সাথে ভূপেন হাজারিকার দু’একটা গান গেয়েছিলাম দ্বৈতকণ্ঠে। একটি ছিল, ‘আমি এক যাযাবর’, যে গানের দু’টি কলি হল, ‘আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, আবার তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী’।

আমার প্রথম মার্কিন গ্রীষ্মের স্মৃতির সাথে জড়ানো আরেকটি বিশেষ গান: ১৯৮৩ সালের সামার ভ্যাকেশনের সময় কুইন্সের যে বাসায় ছিলাম, সেখানে তারিন ভাইদের একটা গান শোনার ‘স্টিরিও সিস্টেম’ ছিল, যেখানে সেই যুগে প্রচলিত ক্যাসেট টেইপের পাশাপাশি আরো পুরানো আমলের রেকর্ড (এনালগ বা ভিনাইল রেকর্ড) বাজানোর ব্যবস্থা ছিল। সেই বাসায় প্রথম শোনা একটা মিষ্টি গানের কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে – Save All Your Kisses For Me – যেটি প্রথমবার কেউ শুনলে শুরুর কথাগুলির সুবাদে এটিকে স্রেফ আরেকটি ‘লাভ সং’ বলে মনে হতে পারে শ্রোতার। তবে গানটির একেবারে শেষের লাইনটি (‘Though you are only three’) শোনার পর বোঝা যায় যে, গানে উচ্চারিত সব ভালবাসার কথা (যেগুলো বলছে কাজে বেরুচ্ছে এমন একজন লোক) যার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, সে আসলে বাসায় থেকে যাওয়া তিন বছরের শিশু সন্তান!

গভীর রাতে সাবওয়েতে দেখা পাওয়া ও আমার মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া এক বাংলাদেশি: ম্যানহাটানের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল সাবওয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম রাত দেড়টার দিকে। আমি মাঝরাতে কাজ শেষ করে অন্যান্য দিনের মতি লোয়ার ম্যানহাটান থেকে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল পর্যন্ত সাবওয়েতে এসে আরেকটা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় খেয়াল করি প্ল্যাটফর্মে আমার অদূরে দাঁড়ানো দু’জন লোক নিচু গলায় কথা বলছিলেন, বাংলায়। তাঁদের টুকরো আলাপ কানে আসাতে মনে হল, একজন বাংলাদেশের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বা সে জাতীয় কোন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সংশ্লিষ্টতা বা প্রত্যক্ষদর্শিতার বয়ানে। আমি দু’জনের কারো দিকে না তাকিয়েই তাঁদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিলাম। এ অবস্থায় হঠাৎ তাঁদের একজনের সাথে আমার চোখাচোখি হতেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘এক্সকিউজ মি, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’ আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এমন প্রশ্নের জন্য। জানালাম, আমি বাংলাদেশি। তিনি তাঁর বিস্মিত ও মুগ্ধ সঙ্গীকে বোঝালেন, ‘আমিতো এক সময় ইন্টেলিজেন্সে ছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম উনি আমাদের কথা ফলো করছিলেন।’ তাঁদের গন্তব্যও ছিল কুইন্স, তবে স্টপেজ ছিল আমারটার পরে। আমরা ট্রেনে উঠে কাছাকাছি বসে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের বাংলা কথোপকথন শুনে ‘তোমাদের ভাষাতো বেশ মজার’ ভাব নিয়ে দাঁত কেলিয়ে তাকাচ্ছিল, এমন এক অল্পবয়সী ‘সাদা’ আমেরিকান সহযাত্রীকে সেই প্রাক্তন ইন্টেলিজেন্স অফিসার যেভাবে শাসালেন, তাতে শুধু ছেলেটা না, আমি নিজেও ভড়কে গিয়েছিলাম। আমার স্টপেজ আসার পর যখন তিনি বললেন ‘চলেন আমাদের সাথে, আমাদের বাসায় বেড়াতে’ (তখন বাজে রাত ২টার বেশি), আমি কোনোমতে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিলাম দ্রুত। তাঁরা দুজন আমার পেছনে নেমে পড়লে কি করতাম, জানি না।

বাংলাদেশে কাটানো তিনটি গ্রীষ্মাবকাশ, ১৯৮৪ – ১৯৮৬ 

১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬, এই তিন বছরের প্রত্যেকবারই আমি গ্রীষ্মাবকাশের সময় দেশে চলে এসেছিলাম, যার পেছনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্রধান কারণ ছিল আমার জীবনের সবচাইতে কষ্টের ও দুর্ভাগ্যজনক এক ঘটনা, আমার আমেরিকা যাওয়ার পর এক বছর পেরুতে না পেরুতেই মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়া, এবং সেই অসুখে তাঁর অকালমৃত্যু। এর আগে, ১৯৮২ সালে যখন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা দেই, যে মায়ের কাছে বিদায় নিয়েছিলাম, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু ১৯৮৩ সালের কোনো এক সময় জানতে পারি যে মায়ের ক্যান্সার ধরা বড়েছে, এবং এই অবস্থায় ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মে যখন বাড়ি আসি, তা ছিল মূলত ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে পর্যুদস্ত হয়ে পড়া প্রায় মরণাপন্ন অসুস্থ মাকে দেখতে।

খাগড়াছড়ির পুরানো পৈতৃক বাড়িতে, ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মাবকাশে।

সেবার গ্রীষ্মাবকাশ শেষে আবার যখন আমেরিকায় ফিরে গিয়েছিলাম, আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে মায়ের সাথে এই ইহজগতে আর কোনোদিন দেখা হবে না। এসব কথা আমি কিছুটা লিখেছি আমার ফেলে আসা দিনগুলির আলোর দিশারীরা নামক একটি লেখায়, যেখানে প্রসঙ্গক্রমে ১৯৮২ সালের গ্রীষ্মে (যখন আমি দেশেই ছিলাম এবং বুয়েটে পড়ছিলাম) আমাকে লেখা মায়ের একটি চিঠির অনেকটুকু তুলে ধরা হয়েছে। সেই চিঠির একটা অংশ নিচে আবার তুলে দিচ্ছি:   

এই গ্রীষ্মের দিনগুলো কেমন যেন নীরবতা অনুভব করি। বিরাট একটা বাড়ী, চারিদিকে বাগান। প্রকৃতির ছন্দে ছন্দে, বৈশাখের মুখরতা আর আম কাঁঠালের সমারোহ। এই বৈশাখ প্রতিটি বছর ঘুরে আসবে, বৃদ্ধি পাবে গাছে গাছে ফুল ফল, অথচ আমাদের বাড়ীর পরিবেশ কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আঙিনা ভরা পাড়া প্রতিবেশীদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেখে তোমাদের শৈশবের কথা মনে ভেসে উঠে। আবার কখনোবা নিজের মনকে এই বলে বুঝিয়ে [সান্ত্বনা] পেয়ে থাকি যে, হ্যাঁ, আমার ছেলেরা সবাই সুযোগ্য সন্তান, তাই তারা আর কেন ঘরকুনো হয়ে বসে থাকবে? কেউবা আবিস্কারের দিকে পা বাড়াচ্ছে, কেউবা যাচ্ছে দিগ্বিজয়ী হতে। তোমাদের গৌরবে, আমাদের মুখোজ্জ্বল হবে। এই আশা রেখে আজকের লেখা শেষ করছি।

১৯৮২ সালের গ্রীষ্মাবকাশ শেষে যে আশঙ্কা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম আমি – যে, মা হয়তবা আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন না – তাই সত্য হয়েছিল, যখন সে বছরেরই অক্টোবরে আমেরিকায় বসে আমি তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাই। এই প্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মাবকাশে যখন আমি আবার দেশে আসি, সে সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মা-বিহীন পরিবারের সাথে খাগড়াছড়িতে সময় কাটানো।

১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে, লন্ডনের হাইগেইটে কার্ল মার্ক্সের সমাধিস্থলে ছবি তোলায় ব্যস্ত আমার দুই বন্ধু সুমন ও কৌশিক।

অবশ্য সে বছর দেশে আসার পথে কিছুটা সময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ঘুরে দেখেছিলাম আমার দুই বন্ধু সুমন ও কৌশিকের সাথে, যাদের বাড়ি ছিল কলকাতায়, কিন্তু তারাও আমার মতই একই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছিল। তারা দু’জনেই আমার চাইতে বেশি সময় ধরে ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছিল নিজ নিজ বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসার পথে, তবে তাদের সাথে যেটুকু সময় লন্ডন ও প্যারিসে একত্রে ঘুরেছিলাম, তখনকার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতার একটি ছিল দু’জন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির – যথাক্রমে কার্ল মার্ক্স ও জাঁ পল সার্ত্রের – ‘কবর জিয়ারত’ করা! (এখানে যে ছবিটা দেওয়া হয়েছে, তা আমি তুলেছিলাম লন্ডনের হাইগেইট নামক জায়গার কবরস্থানে মার্ক্সের সমাধিস্থলের সামনে, যেখানে দাঁড়িয়ে সুমন ও কৌশিক মার্ক্সের ভাস্কর্যের ছবি তোলার সময় আমি তুলেছিলাম তাদের দু’জনের ছবি!)  

১৯৮৬ সালে আমার শিক্ষাজীবনের নতুন পর্ব (স্নাতকোত্তর, বার্কলে-তে) শুরু করার প্রাক্কালেও একটা গ্রীষ্মাবকাশ আমি কাটিয়েছিলাম বাড়িতে, পরিবারের সাথে। এখানে উল্লেখ্য, আমি যখন ১৯৮২ সালে বুয়েট ছেড়ে আমেরিকায় নতুন করে স্নাতক পর্বের পড়াশুনা শুরু করি, আমার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার সাইন্সে মেজর করা, এবং সে অনুযায়ী দুই বছর পড়াশুনাও চালিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন ১৯৮৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমি ঠিক করি, কম্পিউটার সাইন্সে নয়, আমি মেজর করব এনথ্রপলজি বা নৃবিজ্ঞানে। চাইলে আমি ‘ডাবল মেজর’ও করতে পারতাম, কিন্তু কম্পিউটার বিজ্ঞানী হওয়ার ভাবনা থেকে পুরোপুরি সরে এসে একজন ‘নৃবিজ্ঞানী’ হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আমি পড়াশুনা চালিয়ে যাই ১৯৮৪-এর গ্রীষ্মাবকাশ পরবর্তী বছরগুলিতে। তবে এক্ষেত্রে শুরুতে আমার স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না, নৃবিজ্ঞানে স্নাতক পর্বের পড়াশুনা সম্পন্ন করার পর একই বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা শেষে পেশাগতভাবে কি করব। এ প্রসঙ্গে ‘আমার আট আনার শিক্ষকসত্তা: একটি কৈফিয়ত’ শীর্ষক আমার একটি লেখায় আমি বলেছি, ১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মাবকাশ শেষে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলেতে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি পর্বের পড়াশুনা শুরু করতে যাওয়ার সময় পেশাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে নিজের ভাবনার অস্পষ্টতা নিয়ে ‘আমার রীতিমত ঝগড়াই লেগে গিয়েছিল মার্কিন এক ভিসা অফিসারের সাথে।‘

যতদূর মনে পড়ে, সে সময় মার্কিন ভিসা অফিস ছিল মতিঝিলের আদমজি কোর্ট বিল্ডিং নামের একটা ভবনে। আমি ভেবেছিলাম আমার ভিসার ইন্টারভিউটা হবে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু ভিসা অফিসার যখন জানতে চাইলেন, বার্কলের পড়াশুনা শেষ করে আমি কী করব, আমি সরলভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক জানি না”। আমার উত্তর শুনে সেই ভিসা অফিসার বলে বসেন, “আমার মনে হয় তুমি আমেরিকায় থেকে যাবে।” এতে আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করি, “তোমার কেন এটা মনে হচ্ছে? আমি কি তোমাকে বলেছি যে আমি দেশে ফিরব না?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের দেশ থেকে যারা আমাদের দেশে পড়তে যায়, তাদের শতকরা ৯৫ ভাগই দেশে ফেরে না!” পাল্টা জবাবে আমিও তাঁকে উদ্ধত ভাষায় বলেছিলাম, “তোমার কেন মনে হল যে আমি সেই ৯৫ শতাংশের মধ্যে পড়ি?” যাই হোক, এসব কথা কাটাকাটিতে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে ওঠা ভিসা অফিসারকে আমি এরপর নিজের মাথা যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা রেখে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এনথ্রপলজি যেহেতু বাংলাদেশে অনেকটা অপরিচিত বিষয়, এটি পেশাগতভাবে কী কাজে আসবে, তা নিয়ে সেই মুহূর্তে আমি সত্যিই নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু পরে এ নিয়ে ভাবার সময় পাব, ইত্যাদি। আমার ব্যাখ্যা তাঁর কাছে কতটুকু সন্তোষজনক মনে হয়েছিল জানি না, তবে শেষ পর্যন্ত আমার ভিসা তিনি আর আটকাননি।

মার্কিন ভিসা অফিসারের সাথে আমার উপরে বর্ণিত কথা কাটাকাটি হয়েছিল ১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে।

মূলত ক্যালিফর্নিয়ায় কাটানো আমার তিনটি গ্রীষ্মাবকাশ: ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯০

ইউনিভার্সিটি অফ বার্কলে, ক্যালিফর্নিয়াতে যে বছর চারেক আমি স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী ছিলাম (আগস্ট ১৯৮৬ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০), সেই সময়কালের অন্তর্ভুক্ত মোট তিনটি গ্রীষ্মাবকাশ –  যথাক্রমে ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে – আমি কাটিয়েছিলাম মূলত বার্কলেই। তবে ১৯৮৭ সালের সামার ভ্যাকেশনের অংশবিশেষ আমি কাটিয়েছিলাম ম্যাসাচুসেটসে, যেখানে ফিরে গিয়েছিলাম আমার বন্ধু সুলতান আমাকে সামার জব হিসাবে একটা প্রোগ্রামিং কাজ পাইয়ে দেবার উদ্যোগ নিয়েছিল বিধায়।

১৯৮৭ সালের জুনে, ম্যাসাচুসেটসে আমার সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের ‘লুন মাউন্টেন’ নামক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে তোলা ছবি।

উল্লেখ্য, যেহেতু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্বের মাঝপথে নৃবিজ্ঞানে পাড়ি দেওয়ার আগে কম্পিউটার সাইন্স মেজর হিসাবেই আমি পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিলাম, সুলতানের ইচ্ছা এবং আশা ছিল যে, আমাকে আবার সেই ‘ছেড়ে আসা’ পথে ফিরাতে পারবে! তবে কিছুদিন ‘C’ (কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর একটা ভাষা) শেখার পাশাপাশি তার সাথে অফিসে আসা যাওয়া করার পর একটা পর্যায়ে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ওখানে আমার মন টিকবে না, তাই আবার বার্কলেতে ফিরে গিয়ে সেখানেই সামার ভ্যাকেশনের বাকিটা কাটিয়েছিলাম।

পরের বছর (অর্থাৎ ১৯৮৮ সাল) পুরো সামারই কাটিয়েছিলাম বার্কলেতে, এবং আমার মার্কিন শিক্ষার্থী জীবনের শেষ বছর, ১৯৯০ সালেও, তাই করেছিলাম। সেই সময়কার আমার কিছু ভাবনা বা প্রবণতার কথা আমি সাধারণভাবে বলেছি আমার ‘ফেলে আসা কিছু পথের গল্প’ শীর্ষক একটা লেখায়, যেখান থেকে একটা প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে দেওয়া হল:  

বার্কলেতে থাকাকালে হয়তবা মনে মনে নিজের মধ্যে একটা ‘বিটনিক’ সত্তা কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম, যার জের ধরে একসময় ‘On the Road’ শিরোনামে একটা ডায়েরি রাখতে শুরু করেছিলাম। … উল্লেখ্য, প্রথাবিরোধিতার দিক থেকে ‘বিটনিক’দের সাথে সম্পর্ক ছিল ‘হিপি’দের, যাদের (অবশিষ্টাংশের)  নিয়মিতই দেখতে পেতাম বার্কলে তথা সান ফ্রান্সিস্কো বে এরিয়াতে, যে এলাকায় বিট প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিক ও হিপিদের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক স্থান ও সাংস্কৃতিক নমুনাও ছড়িয়ে ছিল। তবে ১৯৮০-র দশক নাগাদ হিপিদের বিপরীতে নবীনতর এক প্রজন্মের উত্থান ঘটেছিল আমেরিকায়, যাদেরকে বলা হত ‘ইয়াপি’ (Hippie-র বিপরীতে Yuppie, যে কথাটা এসেছে Young Urban Professional-এর সংক্ষিপ্তরূপের ভিত্তিতে)। আত্মকেন্দ্রিক বলে বিবেচিত যে তরুণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে এই তকমা দেওয়া হয়েছিল, তাদের কাছে গাড়ি-বাড়ি (কনডোমিনিয়াম)-আর্থিক সাফল্য ইত্যাদিই ছিল প্রধান আরাধ্য।

আমি নিজে অবশ্য হিপি বা ইয়াপি, কোনোটাই হতে চাইনি, যদিও নিজের মধ্যে একটা ‘বিটনিক’ সত্তা কল্পনা করে থাকতে পারি, যেভাবে তরুণতর বয়সে ‘বিপ্লবী’ হওয়ার ভাবনাও সামান্য হলেও মাথায় আনাগোনা করেছিল হয়তবা। বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত আমি কোনোটিই হইনি – না বিপ্লবী, না বিটনিক। এর বদলে পেশাগতভাবে হয়ে যাই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, যদিও এই ভূমিকায়ও শেষ পর্যন্ত থাকিনি আর।[2]   

উল্লেখ্য, বার্কলেতে থাকা অবস্থায় নানা কারণে পিএইচডির পড়াশুনা থেকে আমার মন উঠে যেতে শুরু করেছিল। এর একটা প্রমাণ মেলে বার্কলেতে কাটানো ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মাবকাশের শেষ পর্যায়ে এসে কবিতার আকারে নিজের ডায়েরিতে টুকে রাখা কিছু কথায়, যেখানে দেখা যায়, নিজের শিক্ষার্থী জীবনকে আমি এক ধরনের ‘শৃঙ্খলিত’ বা ‘কয়েদির জীবন’ হিসাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম, যদিও একই সাথে নিজের সম্পর্কে এই উপসংহারও আমি টেনেছিলাম যে, ‘জেল ভেঙে পালাব, সেরকম কয়েদি আমি নই’![3]

আরেক গ্রীষ্ম চলে গেল অন্তরালে।

এখন আবার নৈমিত্তিক মহড়ার পালা,

জ্ঞানের ধ্বজা উড়িয়ে প্রত্যহ এই শৃঙ্খলের স্বাদ নেওয়া।

কোথায় কখন কি ফেলে এসেছি –

অনির্দিষ্ট এক অনুভূতির হাত ধরে

প্রত্যহ আঁকার চেষ্টা করি নূতন বৃত্ত,

সেই কক্ষপথের খোঁজে,

যা আমাকে নিয়ে যাবে এই অস্থিরতার মীমাংসায়।

তবু বারবার কেন ফিরে আসি

শৃঙ্খলের চৌকো সীমানায়?

দেশে কাটানো ১৯৮৯ সালের গ্রীষ্ম, যা ছিল বিবিধ অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় ভরা

পিএইচডির পড়াশুনা থেকে মন উঠতে শুরু করা অবস্থায় আমি ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি থেকে পুরো এক সেমিস্টারের শিক্ষাছুটিতে দেশে এসে নিজের ‘জীবনের উদ্দেশ্য’ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। সে সূত্রে সে বছরের সামার ভ্যাকেশনটাও দেশেই কাটিয়েছিলাম। এভাবে টানা যে আট মাসের মত সময় আমি দেশে ছিলাম, তখন কাকতালীয় কিছু ঘটনার সূত্রে ২১ শে মে ১৯৮৯ তারিখে রাতারাতি আমি সদ্যগঠিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একজন ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বনে গিয়েছিলাম, বা সেভাবেই আমার নাম প্রচারিত হয়েছিল। একই সময়কালেই আমি সিগারেটও খাওয়া ধরি, যে প্রেক্ষাপটে তখনকার ঘটনাপ্রবাহের একটা প্রাসঙ্গিক বিবরণ আমি তুলে ধরেছি এই ব্লগে ‘আমি কেন সিগারেট খেতাম’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি লেখায়।

১৯৮৯ সালের ২১ শে মে তারিখে, ঢাকার রাজপথে, রাঙ্গামাটির লংগদুতে সে মাসের ৪ তারিখে সংঘটিত এক গণহত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত মৌন প্রতিবাদ মিছিলে।

উল্লেখ্য, সেই সময় ঢাকা থেকে আর যেন খাগড়াছড়িতে না ফিরে যাই, বরং দ্রুত যেন আমেরিকায় ফিরে যাই আবার, আমার পরিবারের এমন উপদেশ উপেক্ষা করে আমি বেশ কিছুদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে এক ধরনের নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলাম। সেই অবস্থায় আমি প্রায়ই বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন দেখতাম ঘুমের ঘোরে, যেগুলির দু’একটি আমি টুকে রেখেছিলাম আমার দিনলিপিতে। এই ব্লগে প্রকাশিত ‘দুঃস্বপ্নের প্রলম্বিত প্রহরে পরাবাস্তবতার আলাপ’ শীর্ষক আমার একটি লেখায় এভাবে লিপিবদ্ধ দু’টি দুঃস্বপ্নের বিবরণ রয়েছে, যেগুলির একটি এখানে আবার তুলে ধরলাম:

আমি আমেরিকায়। একটা ক্লাসরুমে। মনজিমার পাশে বসে আছি [মনজিমা ছিল আমার বার্কলের এক বন্ধু] । কি নিয়ে আমরা কথা বলি। কি যেন আকূতি ছিল আমার মধ্যে। এই আসছি বলে হঠাৎ চলে আসি আমি ভিন্ন এক জগতে…।

পার্বত্যভূমি। সবাই পালাচ্ছে। আর্মি অপারেশন। থেমে থেমে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। পালাতে থাকা লোকদের উল্টোদিকে এগুচ্ছি হামাগুড়ি দিয়ে আমি। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ হচ্ছে সামনের দিক থেকে। সেনারা এগিয়ে আসছে।

আমাকে কি এখন গুলি করবে ওরা? আমি কি ফিরতে পারব?

বিরতি।

আমার ঘুম ভেঙে যায়।

[গোয়ালপাড়া, চট্টগ্রাম। ৫ জুন ১৯৮৯]

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯৮৯ সালের গ্রীষ্ম আমার জন্য অনেকাংশেই দুঃস্বপ্নের ছিল হয়তবা, কিন্তু ‘দুঃস্বপ্ন ফুরালে আবার কবিতা লিখব’, আমার এমন বিশ্বাসের কথাও আমি তখন টুকে রেখেছিলাম আমার ডায়েরিতে। একইভাবে আমি আমার ‘নির্বাসিত শব্দমালা’-কে আহ্বান জানিয়েছিলাম, ‘শতাব্দীর বঞ্চনার বিস্ফোরণোন্মুখ ক্ষোভে’ শামিল হতে, ‘আহত আবেগের পরিচর্যা ছেড়ে নিষ্পেষিত মানবতার শৃঙ্খলিত আন্দোলন’ এসে দেখতে। নিজের মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করা কথাগুলিকে প্রকাশ করতে গিয়ে আমি আরো লিখেছিলাম,

হে আমার অপাঙ্‌ক্তেয় শব্দমালা –
পাহাড়ি ঢলের মত তোমরা নেমে এসে
চেতনার সামস্ত আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে যাও।

কালবৈশাখীর হাওয়ায় হাওয়ায় তোমরা
মিশে যাও,
ছুটন্ত মেঘেদের ঘর্ষণে তোমরাও
গর্জে ওঠো,
চমকে তোলো পৃথিবীকে!

খরতপ্ত পাহাড়ে প্রান্তরে
তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়,
সম্ভাবনার সমস্ত দিগন্ত খুলে
সমস্ত জীবনকে জাগিয়ে যাও।

এইতো সময়!

আমার মার্কিন শিক্ষাজীবনের শেষ গ্রীষ্ম, ১৯৯০

১৯৮৯ সালের আগস্টে আমি বার্কলেতে ফিরে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে আর মন টেকেনি আমার। তাই একটা পর্যায়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার পিএইচডির পড়াশুনা শেষ না করেই দেশ ফিরে আসব, যে সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছিলাম ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে। ফলে ১৯৯০ সালের সামার ভ্যাকেশন ছিল আমার মার্কিন শিক্ষা জীবনের শেষ গ্রীষ্মাবকাশ। এই ছুটিটা আমি মূলত কাটিয়েছিলাম আমার কাছে মানসিকভাবে ‘সেকেন্ড হোম’ হয়ে ওঠা বার্কলেতে, তবে তখন ক্যালিফর্নিয়ার অন্য দু’একটা জায়গায়ও বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য সফর ছিল জুন মাসে, যখন লস এঞ্জেলেসে গিয়েছিলাম আমার বন্ধু ওরহানের সাথে, প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী খুবই দর্শনীয় একটা হাইওয়ে দিয়ে পালা করে গাড়ি চালিয়ে। এলএ-তে গিয়ে আমরা উঠেছিলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়, যার সাথে মিলে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম মাত্র চার মাস আগে মুক্তি পাওয়া নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেখতে, যাঁকে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল এলএ-র এক বিশাল স্টেডিয়ামে।

আমার শেষ মার্কিন গ্রীষ্মাবকাশের সময় ডায়েরিতে কবিতার আকারে ইংরেজিতে টুকে রাখা কিছু ভাবনা ও অনুভূতির দু’একটা আমি প্রকাশ করেছি আমার ইংরেজি ব্লগে। এখানে এমন দু’টি ব্লগ পোস্টের শিরোনাম/লিংক দিয়ে রাখলাম, কেউ যদি পড়ে দেখতে চান: The Dreamscape of a Postmodern Fugitive; Of Tatars Down the Memory Lane। উল্লেখ্য, উভয় পোস্টেরই শিরোনামগুলি পরে সংযোজিত, এবং এগুলি প্রথমে আমি প্রকাশ করেছিলাম ফেসবুকে। মনোযোগী পাঠক হয়ত খেয়াল করবেন, যে ধরনের দুঃস্বপ্ন আমাকে দেশে তাড়িত করেছিল ১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মে, তেমন কিছুর উপস্থিতি পরের বছর বার্কলেতে কাটানো গ্রীষ্মাবকাশে টুকে রাখা আমার প্রথমোক্ত পোস্টেও রয়েছে। যাই হোক, বার্কলেতে কাটানো আমার ১৯৯০ সালের গ্রীষ্মের অন্য আরেকদিনের অনুভূতি – কবিতার আকারে বাংলায় টুকে রাখা কিছু কথা – নিচে আংশিকভাবে তুলে ধরলাম (পুরো কবিতাটি ‘অচিন পাখির ডাক’ শিরোনামে এই ব্লগে দিয়েছি আলাদা করে):   

ভালবাসা নামের একটা অচিন পাখি

শিস দিয়েছিল জানালার বাইরে।

ঘুমের ঘোরে আমি তার ডাক শুনেছিলাম।

একবার, শুধু একবার, অশান্ত সমুদ্রের সারথী হয়ে

শৈল উপকূলে আছড়ে পড়তে চাই।

বজ্র আর বিজলীর সমারোহে আমার

নূতন কক্ষপথ খুঁজে নিতে চাই।

[বার্কলে। জুলাই ১১, ১৯৯০]

উপরে উল্লিখিত আমার ‘নূতন কক্ষপথ’ খোঁজার কাজই আমি একভাবে শুরু করেছিলাম ১৯৯১ সালের জানুয়ারি থেকে, যখন আমেরিকার পাট পুরোপুরি চুকিয়ে দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসি। এরপর ইতোমধ্যে [২০২৩ সালের আগস্ট নাগাদ] আরো তেত্রিশটি গ্রীষ্ম এসেছে আমার জীবনে, যেগুলির প্রায় সবটিই আমি দেশেই কাটিয়েছি। এদিকে দেশে নতুন করে কাটানো এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এ যাবত পনের বছর আমি বিচরণ করেছি শিক্ষাঙ্গনেই – তবে নতুন এক ভূমিকায়, শিক্ষক হিসাবে – কিন্তু সে অর্থে ১৯৯০ সালের পর আর কোনো ‘গ্রীষ্মাবকাশ’ কাটানো হয়নি কখনই।    

টীকা

*এই লেখাটি শুরুতে ‘আমার মার্কিন শিক্ষাজীবনের আটটি গ্রীষ্মাবকাশ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।


[1] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে সামার ভ্যাকেশনের ইতিহাসের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি তুলে ধরেছি, সেটি সাজানো হয়েছে অনলাইনে পাওয়া যায় এমন একাধিক নিবন্ধ থেকে (আমি যেগুলি পড়েছি), যেমন,  The Myth Behind the Origins of Summer Vacation, by Timothy Taylor, 28 August 2013; A Brief History Of: Summer Vacation, by Alex Altman, June 19, 2008 (in Time); The History of Summer Vacation, by Sean Cunningham, 30 June 2022 (in historynet.com).

[2] কখন কোন প্রেক্ষিতে কেন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম, এ ব্যাপারে কিছুটা ‘ব্যাখ্যা’ আমি দিয়েছি আমার পূর্বোল্লিখিত একটা লেখায়, যেটি হল, আমার আট আনার শিক্ষকসত্তা: একটি কৈফিয়ত

[3] ‘গ্রীষ্মাবকাশ শেষে’ শিরোনামে প্রকাশিত পুরো কবিতাটা কেউ পড়ে দেখতে চাইলে আমার ব্লগে সেটা পাবেন: গ্রীষ্মাবকাশ শেষে

বাঁ-হাতি নামক সংখ্যালঘুদের নিয়ে কিছু কথা

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনের দুই সুপরিচিত তারকা তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসানের মধ্যে কি কি মিল রয়েছে, এমন প্রশ্ন করা হলে অনেকেই হয়ত উভয়ের প্রতিভার কথা, টাইগারদের একাধিক স্মরণীয় বিজয়ে তাঁদের একক বা যৌথ অবদানের কথা, দলনেতা হিসাবে উভয়ের ভূমিকা, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলবেন। কিন্তু একটা বিশেষ দিবসের প্রাক্কালে (টীকা দ্র:) পরিবেশিত এই লেখার[১] শুরুতেই আমি তাঁদের কথা উল্লেখ করেছি অন্য এক বিশেষ মিলের কারণে, সেটা হল, তাঁরা উভয়েই ক্রিকেট খেলেন বাম হাতে। দু’জনেই বাঁ-হাতি বা ‘ন্যাটা’ ব্যাটার, আর যাঁরা ক্রিকেটের খোঁজ রাখেন, তাঁরা জানেন বিশ্বের অন্যতম সেরা আলরাউন্ডার সাকিব বোলিংও করেন বাম হাতে।

ক্রিকেটে বাঁ-হাতিদের কদর রয়েছে, কিন্তু জীবনের অন্য অনেকক্ষেত্রে এমন কথা সাধারণভাবে বলা যায় না। বরং যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বহু সমাজেই বাঁ-হাতি মানুষেরা নানান অপবাদ ও বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছে, যে প্রবণতা এখনো অনেক জায়গাতেই নানাভাবে বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, বাঁ-হাতি হওয়ার প্রবণতা নিয়ে জন্মানো অনেক শিশুকেই পরিবার তথা সমাজ জোর করে ডান হাতি বানিয়ে দেয় (সচরাচর প্রতি দশজনে একজনের মত শিশু জন্মগতভাবে বাঁ-হাতি হয়)। আমাদের দেশে খাওয়া দাওয়ার বেলায় খুব কম বাঁ-হাতি শিশুকেই তার সহজাত প্রবণতা অনুসরণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমনকি লেখার মত কাজেও বাঁ-হাতি প্রবণতার শিশুদের জোর করে ডান হাতে লিখতে অভ্যস্ত করা হয় অনেকক্ষেত্রে। এরপরও সংখ্যায় কম – বা ‘সংখ্যালঘু’ – যে বাঁ-হাতি ছেলেমেয়েরা বাম হাতেই লেখার মত কাজ চালিয়ে যায়, তাদেরকে নানান বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা নিয়ে ‘সংখ্যাগুরু’ ডানহাতিরা অনেকে খবরও রাখে না, বা খুব একটা ভাবে না।

উপরে উল্লেখ করা জানা বিষয়টি একদিন (২০১৬ সালের এপ্রিলে) নতুন করে উপলব্ধি করি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে, যেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষকের ভূমিকায় আমি আমার পড়ানো একটি কোর্সের সমাপনী পরীক্ষা নিচ্ছিলাম। ক্লাসরুমে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন তিরিশ জনের মত শিক্ষার্থী, যাঁদের একজনকে এক পর্যায়ে হঠাৎ লেখা থামিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকা অবস্থায় দেখতে পাই। আমি যখন জানতে চাইলাম তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, সেই শিক্ষার্থী জানালেন, তিনি দেখছিলেন রুমে কোথাও বাঁ-হাতিদের ‘ডেস্ক’ বা লেখার বোর্ড লাগানো কোনো চেয়ার আছে কিনা, যেহেতু তিনি লেখেন বাম হাতে, কিন্তু পরীক্ষা দিতে বসেছিলেন ডানহাতিদের ডেস্কযুক্ত একটা চেয়ারে বসে, যার ফলে তাঁর লিখতে অসুবিধা হচ্ছিল। দেখা গেল, পুরো শ্রেণিকক্ষের কোথাও একটিও বাঁ-হাতিদের লেখার ব্যবস্থাযুক্ত চেয়ার নেই।[২] তখন আমি তাঁকে পরীক্ষার বাকি সময়টা শিক্ষকের টেবিলের উপর খাতা রেখে লেখার প্রস্তাব দিলাম। তিনি অবশ্য এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না, এবং তাঁর আসনে বসেই – শরীরটা অনেকটাই ‘বাঁকা’ করে ঘুরিয়ে বসে – পরীক্ষা দেওয়ার কাজ চালিয়ে গেলেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটির তুলনায় একটু ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এবারও ঘটনাক্রমে একটি কোর্সের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে, তবে তা ছিল ভিন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (আইইউবি), যেখানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম, এবং যে শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষা চলছিল, সেখানে বাঁ-হাতিদের ডেস্ক লাগানো চেয়ারও ছিল কিছু।  তথাপি দেখতে পেলাম, বাঁহাতি এক শিক্ষার্থী এমন একটি চেয়ারে বসে লিখছিলেন যেখানে লাগানো ডেস্কটা ছিল ডানহাতিদের জন্য (উপরে দেখানো ছবিটার মত, যা নেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট থেকে)। তিনি চেয়ারে কোনাকুনিভাবে বসে যেভাবে লিখছিলেন, তাতে মনে হল, তাঁর একটু অসুবিধাই হচ্ছিল। তাই আমি ক্লাসরুমে থাকা একটি খালি চেয়ার দেখিয়ে দিলাম, যেটির ডেস্কটা ছিল বাঁহাতিদের জন্য। কিন্তু আমাকে অবাক করে সেই শিক্ষার্থী বললেন, ডানহাতিদের জন্য বানানো ডেস্ক ব্যবহার করতে তিনি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন যে, বাঁহাতিদের জন্য বানানো ডেস্কওয়ালা চেয়ারে বসে লিখতেই তাঁর অসুবিধা হয়। তখন মনে হল, ‘মেজরিটি’ বা ‘সংখ্যাগুরু’দের জন্য বানানো দুনিয়ায় খাপ খাওয়াতে গিয়ে ‘মাইনরিটি’ বা ‘সংখ্যালঘু’রা আরো কত কিছুতেই না এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে, নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগও অনেকক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারে না তারা!

আমার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অভিজ্ঞতার কথা উপরে বলেছি, তা নিয়ে ঘটনার পরের দিনই আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস আপডেট দিয়েছিলাম। সেটির প্রেক্ষিতে আমার এক ফেসবুক বন্ধু, যিনি পেশায় সাংবাদিক ছিলেন, তখন লিখেছিলেন, “আমার যমজ ছেলেদের একজন বাম হাতে লেখে। আমিও ছোট বেলায় বাম হাতে লিখতাম। পরে কাকার চড় খেয়ে ডান হাতে লিখতে শুরু করি। লেখা এবং খাওয়া ছাড়া প্রায় সব কাজ আমি বাম হাতে করি।” এরপর তিনি যোগ করেন যে, তাঁর যে ছেলেটা বাঁ-হাতি, সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছিল এবং তাকে তিনি বাম হাতেই লিখতে অভ্যস্ত করেছেন। তার সন্তান বড় হয়ে বাঁ-হাতি হিসাবে কোনো অসুবিধায় পড়লে যেন তা মোকাবেলা করতে পারে, এ ব্যাপারে “এখন থেকে তাকে কিছু টিপস দিতে হবে” বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এখানে একটু উল্লেখ করতে চাই যে আমার ছেলে আইচুকও একজন বাঁ-হাতি, যার বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা আমাকে বাঁ-হাতিদের ব্যাপারে অধিকতর সংবেদনশীল হতে সহায়তা করেছিল। ও কিছুটা বড় হওয়ার পর যখন আমরা বুঝলাম যে সে জন্মেছে বাঁ-হাতি বৈশিষ্ট্য নিয়ে, তার মা আর আমি তাকে জোর করে ডানহাতি বানানোর চেষ্টা করিনি। অবশ্য এক্ষেত্রে তার মায়ের একটা বড় ভূমিকা ছিল, যে আইচুককে বুঝিয়েছিল যে সে বাম হাতে খাওয়াদাওয়া করলে অনেক জায়গায় – যেমন বিয়ে বাড়িতে – লোকে তাকে অন্য চোখে দেখতে পারে, এমনকি নেতিবাচক মন্তব্যও করতে পারে, যেগুলি উপেক্ষা করা শিখতে হবে তাকে। এসব জায়গায় অবশ্য আমরাও খেয়াল রাখতাম, সে যেন অযাচিত উপদেশ বা প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়। আর সাধারণভাবে আমাদের কাছের লোকজনকে, এবং তার স্কুলের শিক্ষকদের, আমরা বোঝাতে পেরেছিলাম যে আইচুককে বাম হাতে খেতে বা লিখতে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা আমরা সচেতনভাবেই নিয়েছিলাম, এবং এ নিয়ে খুব অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি তেমন কোথাও।   

অবশ্য শুধু যে অন্যদের বোঝাতে হয়েছে তা নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজেকেও কিছু ক্ষেত্রে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে হয়েছে, আরও ধৈর্যশীল হতে হয়েছে। যেমন, আইচুক যখন ছোট ছিল, কিছু ব্যাপারে তাকে আনাড়ি মনে হত আমার। আমার মনে পড়ে, শার্টের বোতাম লাগানোর মত কাজ করতেও তাকে বেগ পেতে হত। পরে বুঝতে পারি, শার্টগুলিতো বানানোই হয় ডানহাতিদের জন্য! এমন শার্টের বোতাম লাগাতে গেলে একজন বাঁ-হাতি শিশুকে আপাতদৃষ্টিতে অপটু মনে হতেই পারে, কিন্তু আসল সমস্যা যে শার্টের ডিজাইনের বা সমাজের, তা নিয়ে আমরা কতজন ভাবি?

ডানহাতিদের দুনিয়ায় খাপ খাওয়াতে গিয়ে যেসব বাধা বা বিড়ম্বনা পেরুতে হয় একজন বাঁ-হাতি শিশুকে, সে অভিজ্ঞতা কিছু ক্ষেত্রে তাকে বাড়তি সচেতনতা দেয়। কাজেই এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না যে একদিন আইচুকের কাছ থেকেই আমি কথাপ্রসঙ্গে জেনেছিলাম যে ‘অশুভ’ অর্থে ব্যবহৃত ইংরেজি sinister শব্দটি এসেছে লাতিন থেকে, যে ভাষায় এটির আদি অর্থ ছিল ‘বাম’! এরকম শব্দ – বা বিভিন্ন বাগধারা – খুঁজলে অনেক ভাষাতেই পাওয়া যায়, যেগুলি থেকে বোঝা যায় কিভাবে যুগে যুগে বিভিন্ন সমাজে বাঁ-হাতিদের প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে সামষ্টিকভাবে।  যেমন, ইংরেজিতে ফরাসি থেকে আসা একটি শব্দ আছে gauche – যা দিয়ে বোঝায় ‘আনাড়ি’ বা ‘অপটু’ – যদিও শব্দটার মূল অর্থ ছিল বাম! বাংলায় ঘুষ ধরনের লেনদেন বোঝাতে বলা হয় ‘বাম হাতের কারবার’। আর অভিধান ঘেঁটে দেখলাম, ‘ন্যাটা’ বা ‘নেটা’ শব্দটি হিন্দি ‘লওটা’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত, যেটির অর্থ হচ্ছে ‘উল্টা’। যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে গড়ে একজন করে বাঁ-হাতি প্রবণতা নিয়ে জন্মায়, ডানহাতি ‘সংখ্যাগুরু’দের দৃষ্টিকোণ থেকে বাঁ-হাতিদের আচরণ ‘উল্টা’ মনে হতেই পারে, কিন্তু যদি আমরা দেখার দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাই, তাহলে একজন বাঁ-হাতি মানুষের বাম হাতে লেখা, ছবি আঁকা, এমনকি খাওয়াদাওয়া করা, স্বাভাবিক, নয় কি?[৩]


টীকা

[১] এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছে ১৩ই আগস্ট পালিত ‘আন্তর্জাতিক বাঁ-হাতি দিবস’-কে সামনে রেখে, যে দিবস উদ্‌যাপনের রেওয়াজ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে।

[২] এ বিষয়টির ব্যাপারে পরে আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, এবং তাঁরা বলেছিলেন যে শ্রেণিকক্ষগুলিতে বাঁ-হাতি শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজাইন করা ডেস্ক-যুক্ত চেয়ার রাখার ব্যাপারে তাঁরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। পরে এই ব্যবস্থা কবে বা কতটুকু নেওয়া হয়েছিল, তা আর আমার জানা হয়ে ওঠেনি।     

[৩] সারা বিশ্বে ইতিহাস জুড়ে বহু বিখ্যাত বাঁ-হাতি মানুষের দেখা মিলেছে, যাদের মধ্যে এরিস্টটল থেকে শুরু করে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মহাত্মা গান্ধী, বা হাল আমলের বিল গেইটস, দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ও বারাক ওবামা, এমন অনেকে রয়েছেন। এমন তালিকায় আইনস্টাইনের নামও দেখা যায় অনেক জায়গায়, তবে তিনি আসলে সত্যিই (বা পুরোপুরি) বাঁ-হাতি ছিলেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।