Monthly Archives: অগাষ্ট 2021

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজার সমস্যা

অথবা, “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব  ঘটেছে”, এমন ধারণা কেন গোলমেলে

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

পটভূমি

যে বিষয়ের উপর এই লেখায় আলোকপাত করা হয়েছে, সেটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে ভাবতে হয়েছে, কিছুটা পড়াশুনাও করতে হয়েছে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যেমন, যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলাম (১৯৯১-২০০১), ‘বাংলাদেশ: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’ নামক একটি কোর্স পড়াতে গিয়ে বাংলায় লেখা অনেক বইপত্রে এমন কিছু ধ্যানধারণার দেখা পেতাম, যেগুলিকে সমকালীন নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে গোলমেলে মনে হত। এমনই একটা ধারণা মিশে আছে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথাটার মধ্যে, যা নিয়ে আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করি ২০১২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, যখন কোনো ধরনের পূর্ণকালীন চাকরিতে যুক্ত না থাকাতে আমি লেখালেখিতে বেশ সময় দিতে শুরু করি। উদাহরণস্বরূপ,  ২০১২ সালে ৮ই আগস্ট আমি একটা ফেসবুক নোট প্রকাশ করেছিলাম বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ প্রসঙ্গে  শিরোনামে, যে লেখার তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট ছিল আগের রাতে আমি অংশ নিয়েছিলাম, এমন একটা লাইভ টিভি টক শো-তে দর্শকদের মধ্য থেকে আসা একটি প্রশ্ন, “বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কি?” বলা বাহুল্য, এটা এমন এক ধরনের প্রশ্ন, আমার কাছে যেটির সরাসরি উত্তর খোঁজার বদলে আরো জরুরি হল ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ জাতীয় কথাটি ঠিক কোন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, বা এমন ধারণার আওতায় কি ধরনের লেখালেখি ও চিন্তাভাবনা অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, এসব বোঝা।

এদিকে অতি সম্প্রতি এই ব্লগে প্রকাশিত প্রশ্নোত্তরে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গ শিরোনামের একটি পোস্টে কথাপ্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, “‘প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে’ – এমনতর বহু গোলমেলে বা ভ্রান্ত ধারণা হামেশাই দেখা মেলে বাঙালি বিদ্বৎসমাজের উজ্জ্বলতম অংশের মধ্যেই।” আমার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একজন পাঠক (যিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমার ফেসবুক বন্ধু) আমাকে জানান যে, বক্তব্যটি “বাঙালিদের রেসিয়াল আইডেন্টটি বিষয়ক মেটান্যারেটিভের সাথে মেলে না”, যে ধরনের ‘মেটান্যারেটিভ’ বা ‘মহাবৃত্তান্ত’ নীহাররঞ্জন রায়, গোলাম মুরশিদ প্রমুখের লেখায় পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। আর এ বিষয়ে আমার কোনো লেখা আছে কিনা, উক্ত বন্ধু তাও জানতে চান। তখন আমি তাঁকে বলি যে, আমার বহুজাতির বাংলাদেশঔপনবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ শীর্ষক দুইটি বইয়ের প্রতিটিতে একটি করে প্রবন্ধ রয়েছে, যেগুলিতে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট আলোচনা রয়েছে। তবে এই লেখাগুলির কোনোটিই চট করে দেখে নেওয়া যায়, এমন কোনো মাধ্যমে এ যাবত প্রকাশিত হয়নি। তাই সম্ভাব্য পাঠকদের সুবিধার্থে দুটি লেখার মধ্যে যেটা অধিকতর সাম্প্রতিক কালের – শেষোক্ত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ খোঁজার ইতিবৃত্ত” শীর্ষক অধ্যায় – তা থেকে ‘‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ অন্বেষণের স্বরূপ’ শীর্ষক একটি অংশের সম্পাদিত (ও সামান্য সংক্ষেপিত) ভাষ্য নিচে তুলে ধরা হল।[1]      

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ অন্বেষণের স্বরূপ

‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটি একটা জ্ঞানকাণ্ডের পুরানো নাম, আবার সাম্প্রতিক কালে ভিন্ন অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের প্রয়োগে। উল্লেখ্য, ইংরেজিতে ‘এনথ্রপলজি’ নামে পরিচিত শাস্ত্রেরই (বিশেষ করে এর একটি বিশেষায়িত শাখা ‘এথনোলজি’র) একটি পুরানো প্রতিশব্দ হল ‘নৃতত্ত্ব’, যেটির বদলে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নৃবিজ্ঞান’ নামটিই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে ‘নৃতত্ত্ব’ পদটির প্রয়োগের সাথে অনেকক্ষেত্রে মিশে রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের এমন কিছু গোলমেলে ধ্যান-ধারণা, যেগুলি সমকালীন নৃবিজ্ঞানে বাতিল বলে বিবেচিত হলেও এখনো দিব্যি চালু রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের লেখালেখিতে – ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বা ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ধরনের প্রয়োগে – এবং সম্প্রতি নতুন জীবন লাভ করেছে সংবিধানে সংযুক্ত ‘মাইনর রেইস’ (minor race) ও ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ধারণার মাধ্যমে।[2]

অবশ্য একটা পারিভাষিক উদ্ভাবন হিসাবে বাংলা ভাষায় ‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটির সংযোজন খুব বেশি আগের ঘটনা নয়, যা বড় জোর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান (গোলাম মুরশিদ ২০১৩) অনুসারে ‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন ১৯০৫ সালে, ethnology অর্থে, যেটির প্রতিশব্দ হিসাবে পরে ‘জাতিতত্ত্ব’ অধিকতর প্রচলিত হয়ে ওঠে।[3] অন্যদিকে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের প্রয়োগের মাধ্যমে নৃতত্ত্ব পদের যে ভিন্ন ব্যবহার শুরু হয়, তা আরো অনেক পরের – আনুমানিক ১৯৮০’র দশকের – ঘটনা।  একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘নৃতাত্ত্বিক’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় ‘ethnic’ বা ‘racial’ অর্থে, যা চালু হওয়ার ও বহাল থাকার পেছনে প্রধান দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়: একটা হল ‘নৃতত্ত্ব’ নামক জ্ঞানকাণ্ড সম্পর্কে প্রচলিত কিছু পুরাতন ধ্যানধারণা (যেমন, নৃতত্ত্ব মানেই মানুষের বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্ট্য-কেন্দ্রিক অধ্যয়ন, এমন ধারণা) এখনো ব্যাপকভাবে চালু থাকা; এবং অন্যটি হল ‘এথনিসিটি’ ও ‘রেইস’ (race) ধারণার কোনো প্রতিষ্ঠিত বাংলা প্রতিশব্দ না থাকা।[4] এ বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে, যেটির শিরোনাম হল ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ (অজয় রায় ১৯৮৭)। সেই অধ্যায়ের আলোচনার বিষয় ও পরিধি অনুসারে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথার সুনির্দিষ্ট অর্থ দাঁড়ায় রেইস সংক্রান্ত পরিচিতি।

উপরে উল্লিখিত বইটির এক জায়গায় রেইস ধারণার দৈহিক বৈশিষ্ট্য-কেন্দ্রিক সংজ্ঞা উদ্ধৃত করা হয়েছে মিখাইল নেস্তুর্খ (১৯৭৬) নামক একজন সোভিয়েত প্রাইমেটবিদ-নৃবিজ্ঞানীর[5] লেখা একটি গ্রন্থ থেকে, যা একদা বাংলাদেশে খুব সহজলভ্য ছিল। একই জায়গায় পাদটীকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নৃবিজ্ঞানের আলোচনায় আমরা race অর্থে নৃগোষ্ঠী [শব্দটি] ব্যবহার করব’ (অজয় রায় ১৯৮৭:৭১-৭২)।[6] অবশ্য পরবর্তীতে অনেকে (যেমন সেলিম আল দীন) ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘এথনিক গোষ্ঠী’ অর্থে, যদিও এটা স্পষ্ট না তাঁরা সবাই ‘রেইস’ আর ‘এথনিসিটি’ ধারণাকে আলাদা বা সম্পর্কিত করে দেখেন কিনা। যাই হোক, সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে ২০১১ সালে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দটি সংবিধানে সন্নিবেশিত হওয়ার পর, এথনিক গ্রুপ (বা সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্য অনুযায়ী ‘এথনিক সেক্ট’) অর্থেই ‘নৃগোষ্ঠী’ পদের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে আগে থেকেই পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দলিলপত্রে এথনিক গ্রুপ অর্থে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ কথাটিরও প্রচলন ছিল। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিপুলা পৃথিবী গ্রন্থে ‘এথনিক মাইনরিটি’ অর্থে ‘নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু’ কথাটা দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে (আনিসুজ্জামান ২০১৫:৪৯৮)। অন্যদিকে ২০০৬ সালে প্রণীত জাতীয় সংস্কৃতি নীতিতে ‘ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠি’ কথাটি পাওয়া যায় (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০৬:২), এবং এটি দিয়ে কাদের বোঝানো হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যখন দেখা যায় একই দলিলের ৫.৮ নং অনুচ্ছেদে  (পৃ.১৯) ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি’ ও ‘উপজাতীয় জনগোষ্ঠী’ কথাগুলি (যথাক্রমে ‘জনগোষ্ঠি’ ও ‘জনগোষ্ঠী’ বানানে) সমার্থকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। 

‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যুৎপত্তিগতভাবে সমস্যাজনক হলেও এসব যখন বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বা দেশের স্বনামধন্য পণ্ডিতদের নামখচিত গ্রন্থে স্থান পায়, জায়গা করে নেয় বিভিন্ন সরকারি নথিপত্রে, তখন সেটিকে অসতর্কতাজনিত ‘ভুল’ হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং, এমন প্রবণতার পেছনে কাজ করছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে রয়ে যাওয়া  বিভিন্ন গোলমেলে ধারণার ছায়া, যেগুলির অন্যতম হচ্ছে ‘রেইস’। যেমন, বর্তমান সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্যে আমরা minor race শব্দগুচ্ছটি দেখতে পাই, যেটিকে দেখানো হয়েছে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ পদের ভাষান্তর হিসাবে। উল্লেখ্য, ইংরেজি ‘রেইস’ শব্দকে অনেকক্ষেত্রে শুধু ‘জাতি’ হিসাবেও বাংলায় অনুবাদ করা হয়। যেমন, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে ঢাকার সিভিল সার্জন হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী James Wise-এর লেখা Notes on the Races, Castes and Trades of Eastern Bengal নামক একটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ‘পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ’ শিরোনামে (জেমস ওয়াইজ ১৯৯৮-২০০২)। একইভাবে ২০১৪ সালে ‘অনগ্রসর নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা, সমান সুযোগ ও পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন বিষয়ে আইন কমিশনের সুপারিশ’ নামে ইন্টারনেটে পাওয়া একটি ধারণাপত্রে racial discrimination-এর বাংলা করা হয়েছে ‘জাতিগত বৈষম্য’। অর্থাৎ বাংলায় ‘জাতি’ শব্দটির সাথে বিভিন্নভাবে মিশে আছে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত একাধিক ধারণা: race, ethnicity, nation ইত্যাদি। স্পষ্টতই, এসবক্ষেত্রে অনুবাদ সংক্রান্ত ও ধারগাগত কিছু সমস্যা রয়েছে যেগুলির একটি মিলিত ফল হিসাবে টিকে আছে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথাটি।

অবশ্য বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে এখনো ‘রেইস’ ধারণার উপস্থিতি রয়ে গেলেও খোদ পশ্চিমা বিশ্বে, যেখান থেকে ধারণাটি আমদানি করা হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ দৈহিক বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রেইস ধারণা নৃবৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই সমস্যাজনক বলে বিবেচিত হয়েছিল, ফলে সমকালীন নৃবিজ্ঞানে এটি  অচল ও পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে কয়েক দশক হল।[7] বলা বাহুল্য, রেইস সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধ্যানধারণার রাজনৈতিক পরিণতি কেমন বিভীষিকাময় হতে পারে, ‘আর্য’ শ্রেষ্ঠত্ববাদী নাৎসিরা তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখিয়েছিল। আধুনিক মার্কিন নৃবিজ্ঞানের জনক বলে খ্যাত বোয়াস – যিনি জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন – অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু করে তাঁর বিভিন্ন গবেষণাকর্মের মাধ্যমে ‘রেইস’ ধারণার অসারতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতির ধারণার সাথে এটিকে গুলিয়ে ফেলার সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছিলেন (Boas 1940)। পরবর্তীকালে জিন-ভিত্তিক গবেষণার ফলাফলসহ জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন অগ্রগতির ফলে আরো স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘নিগ্রোয়েড’, ‘মঙ্গোলয়েড’, ‘ককেশয়েড’, ‘অস্ট্রালয়েড’ প্রভৃতি রেইস-এর ধারণার বিশেষ কোনো ‘বৈজ্ঞানিক’ ভিত্তি বা উপযোগিতা নেই।  অথচ বাংলা একাডেমি থেকে অপেক্ষাকৃত সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজা হয়েছে এমন পরিত্যাজ্য ধারণার ভিত্তিতে। শুধু তাই নয়, সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক যুগের ‘প্রশাসনিক-নৃতাত্ত্বিক’ বিভিন্ন উৎস (যেমন রিজলি)[8] থেকে আহরিত এমন সব তথ্য উপাত্ত, যেগুলি ছিল তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত উভয়দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এসব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশে এখনো যাঁরা ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজায় ব্যস্ত রয়েছেন, বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’র ধারণা ব্যবহার করছেন, বৈশ্বিক বিদ্যাজাগতিক মানদণ্ডে তাঁরা একশত বছরের মত পিছিয়ে রয়েছেন!

এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলা একাডেমি থেকে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ শিরোনামের অধ্যায়যুক্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড) শীর্ষক গ্রন্থ যে বছর প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৮৭ সালে), তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান বিভাগ সবেমাত্র এক বছরে পা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৃবিজ্ঞান পঠনপাঠনের ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারিত হলেও তা মূলত সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও বিভিন্ন সমকালীন প্রসঙ্গকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। ফলে এদেশের বিদ্বৎসমাজে ‘নৃতত্ত্ব’, ‘নৃগোষ্ঠী’ প্রভৃতি ধারণাকে ঘিরে যে পশ্চাৎপদ জ্ঞান শেকড় গেড়ে আছে, সেটিকে হটানোর ব্যাপারে এখনো খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনি বাংলাদেশে গড়ে ওঠা নৃবিজ্ঞানী সমাজ। তবে সাধারণভাবে অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডেও আসলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক ধ্যান-ধারণা, তত্ত্ব ও পদ্ধতি বহাল তবিয়তে আছে যেগুলি বৈশ্বিক পরিসরে সমকালীন বিদ্যাজগতে বাতিল হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বাংলাদেশে এখনো বহুলভাবে প্রচলিত, এমন কিছু ভ্রান্ত বা সমস্যাজনক ধারণার একটা তালিকা সংক্ষেপে পেশ করছি।

বাঙালিরা একটি সংকর জাতি: এই ধারণার মূলে রয়েছে একদা পৃথিবীতে ‘বিশুদ্ধ’ কিছু রেইস ছিল এমন বিশ্বাস, যা ভ্রান্ত ও সমস্যাজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষ করে নাৎসিরা যে ধরণের বর্ণবাদী তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে এই ধারণা অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে যায় জাতিসংঘের পরিসরে  (Comas 1951; আরো দেখুন, Montagu 1980)। সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই কমবেশি ‘মিশ্র’, কাজেই আলাদাভাবে কোনো বিশেষ জাতিকে ‘সঙ্কর’ হিসাবে চিহ্নিত করা নিরর্থক।

দ্রাবিড়রা হল বাঙালিদের অন্যতম একটি প্রাচীন জাতিগত উৎস: ‘দ্রাবিড়’ আসলে একটি ভাষাগত বর্গ, এবং বাংলার উপর দ্রাবিড় ভাষাসমূহের প্রত্যক্ষ প্রভাব বা প্রাচীনকালে বাংলা অঞ্চলে দ্রাবিড়ভাষীদের ব্যাপক উপস্থিতির কোনো প্রমাণ নেই (Maloney 1984)। (ঠিক কখন কিভাবে ‘দ্রাবিড়’ বর্গে বাঙালিরা নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজতে শুরু করে, তা গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়। তবে এটা অনুমান করা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো প্রভৃতি স্থানে আবিস্কৃত প্রাচীন ‘সিন্ধু সভ্যতা’র মূল ধারক-বাহকরা দ্রাবিড় ছিল, যারা ‘আর্য’দের চাইতেও বেশি ‘সভ্য’ ছিল, এমন ধারণা তৎকালীন শিক্ষিত ভারতীয়দের কল্পনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে কল্পিত আর্য বা আশরাফ উৎসের বদলে ‘দ্রাবিড়’ বর্গে নিজেদের অতীত খুঁজতে শুরু করেন – এখনো খোঁজেন – অনেকে।) 

বাঙালি মুসলমানেরা প্রধানত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর: এই ধারণার মূল সমস্যা হচ্ছে এই যে, পূর্ববঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতি পৌঁছানোর সময় এ অঞ্চলে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক ছিল না; তাছাড়া ‘জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ করেছে’ এই তত্ত্ব সমগ্র উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ইতিহাসসম্মত নয়, যে ধরনের যুক্তি অন্যদের মধ্যে রিচার্ড ইটনের কাজে ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়  (Eaton 1993)।   

বাংলা একটি আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা: ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের রেওয়াজ অনুসারে এই বর্গীকরণ ঠিক হলেও এর ফলে ভিন্ন ‘পরিবার’-ভুক্ত বলে চিহ্নিত বিভিন্ন ‘দেশি’ ভাষা, যেমন সান্তালি (‘সাঁওতাল’), মুন্ডা, কোচ, গারো, খাসি (‘খাসিয়া’) প্রভৃতির সাথে বাংলার, বিশেষত ‘অশুদ্ধ’ বলে বিবেচিত বাংলার তথাকথিত বিভিন্ন ‘আঞ্চলিক’ রূপের, যোগসূত্রসমূহ অনেকাংশে দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় (এ প্রসঙ্গে এই ব্লগে প্রকাশিত ‘কেমন আছে বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলি’ নিবন্ধটি দেখা যেতে পারে।)

উপরে বর্ণিত পর্যবেক্ষণসমূহের প্রতিফলন রয়েছে, এমন একটি উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হল, যা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া (উৎস হিসাবে দেখানো হয়েছে অতুল সুরের লেখা বাঙালি জীবনের নৃতাত্ত্বিক রূপ, যা সরাসরি যাচাই করা হয়ে ওঠেনি):

বাংলার আদিম অধিবাসীরা ছিলেন প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় তাদের বলা হয় আদি-অষ্ট্রাল। আদি-অষ্ট্রাল বলার কারণ হলো, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক গঠনের মিল রয়েছে। দৈহিক গঠনের মিল ছাড়া অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের রক্তের মিলও রয়েছে। এক সময় আদি-অষ্ট্রালদের বসতি উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগে তারা ভারত থেকে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে প্রথম পৌঁছায়। বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ওই গোষ্ঠীর লোক। এদের সঙ্গে মিশে গেছে আগন্তুক দ্রাবিড় ভাষাভাষী জাতি। দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আলপীয়রা আসার আগে। আর আদি-অষ্ট্রাল, দ্রাবিড় ভাষাভাষী ও আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোকদের সংমিশ্রণেই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বুনিয়াদ গঠিত হয়েছিল।

উপরের উদ্ধৃতিতে বর্ণিত ‘নৃতাত্ত্বিক বুনিয়াদ’ যে ভেঙে গেছে, অথবা কোথাও টিকে থাকলেও আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের একটা ভিত্তি হিসাবে যে আর ব্যবহারোপযোগী নয়, এ খবর বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে এখনো হয়তবা ব্যাপকভাবে পৌঁছায়নি!  

শেষ কথা

এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে পাঠককে অনুরোধ করব একটু ভেবে দেখতে, শুরুতে তুলে ধরা একটা বক্তব্য – “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে”, এমন ধারণা কেন গোলমেলে – ভালোভাবে বোঝা গিয়েছে কিনা। যদি কোনো অস্পষ্টতা থেকে থাকে, তাহলে এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু কথা আরেকটু খোলাসা করে বলছি। প্রথমত, প্রধানত ভাষিক ও ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘বাঙালি’ অথবা অনুরূপ যে কোনো পরিচয়ের ইতিহাস খুঁজতে গেলে তা ‘রক্তধারা’র ভিত্তিতে করতে যাওয়া খুবই সমস্যাজনক, যে ধরনের উদ্যোগের পেছনে সচেতনভাবে হোক বা অসচেতনভাবে হোক, নাৎসিদের ‘আর্য’ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সাথে তুলনীয় মতাদর্শ মিশে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, ‘দ্রাবিড়’, ‘অস্ট্রিক’, ‘আর্য’ প্রভৃতি মূলত ভাষিক বর্গ, যেগুলিকে ‘রেসিয়াল’ বা ‘রক্তধারা’-সংশ্লিষ্ট বর্গ হিসাবে দেখা খুবই গোলমেলে। বহু আগেই বোয়াসের মত নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, একই ধরনের ভাষাভাষী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন ভৌগোলিক ও জেনেটিকভাবে নানান উৎস থেকে আসতে পারে, তেমনি জেনেটিকভাবে ঘনিষ্ঠ-সম্পর্কিত কিছু জনগোষ্ঠী নানা কারণে ভিন্ন ভিন্ন ‘ভাষা পরিবার’ভুক্ত ভাষা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়ত, ‘আর্য’ বা শেখ-সৈয়দ-মুগল-পাঠান জাতীয় কল্পিত অভিজাত উৎসের বদলে  বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বাংলা অঞ্চলেই নিজেদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও ‘জাতিগত’ শেকড় খোঁজেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীকে মোটাদাগে অধিকতর গণতান্ত্রিক তথা বাস্তবসম্মত বলা যেতে পারে, তবে এমন দৃষ্টভঙ্গীর সাথে ধারণাগত ও পদ্ধতিগত বিভ্রান্তি মিশে যায় যখন ‘দ্রাবিড়’ (বা ‘প্রাক-দ্রাবিড়’) ও ‘অস্ট্রিক’ গোছের বর্গে সেই শেকড় খোঁজা হয়।

‘দ্রাবিড়’ বর্গের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যার বিষয়টি আগেই সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই সেটির পুনরাবৃত্তির বদলে ‘অস্ট্রিক’ বর্গ সম্পর্কে দু’টি কথা যোগ করেই এই আলোচনা শেষ করব। পাঠকের জানা থাকতে পারে যে, অস্ট্রিক, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রালয়েড প্রভৃতি শব্দের ভিত্তি হল ‘দক্ষিণ (দিকের)’ বোঝায়, এমন লাতিন মূল austro-, australis)। বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গায় চোখে পড়া লেখালেখি থেকে মনে হয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে চলে আসা কিছু গোলমেলে ধ্যানধারণার সূত্রে সাক্ষর বাঙালিদের অনেকের মধ্যে এমন একটা অনুমান কাজ করছে যে, বাঙালিদের একটা প্রধান উৎস হল ‘অস্ট্রিক’ বা ‘অস্ট্রাল’ বর্গের কিছু প্রাচীন জাতি, যাদের গায়ের রঙ ছিল কালো, গড়ন ছিল ছোটখাটো, ইত্যাদি। বাস্তবে ‘অস্ট্রিক’ কথাটি একদা মূলত ভাষিক একটা বর্গ হিসাবেই ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীদের অনেকে। এই বর্গের আওতায় ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’ বিভিন্ন ভাষার সাথে (দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মন ও খ্‌মের ভাষা থেকে শুরু করে উপমহাদেশের খাসি, সান্তালি, মুন্ডা) ‘অস্ট্রোনেশিয়ান’ (অস্ট্রো = দক্ষিণ, নেশিয়া = দ্বীপ) বিভিন্ন ভাষাকে পরস্পরসম্পর্কিত হিসাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই অনুমানের বাস্তব ভিত্তি যাই হোক না কেন, এসব ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের সবাই দেখতে একই ধরনের, বা সবাই ‘রক্তধারা’র দিক থেকে একই উৎস থেকে আসা, একথা বলা যায় না।

সান্তালদের ভাষা আর ক্যাম্বোডিয়ার খ্‌মের (Khmer) ভাষা একই ‘ভাষা-পরিবার’ (‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’)-ভুক্ত বলে বিবেচিত

অন্যদিকে ‘অস্ট্রালয়েড’ বলে আরেকটা বর্গ আছে (যেটাকে ‘নিগ্রোয়েড’, ‘ককেশয়েড’ ও ‘মঙ্গোলয়েড’ বর্গের পাশাপাশি একটা প্রধান ‘রেইস’ হিসাবে একদা চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও এসব ভাগ অধুনা অনেকটাই পরিত্যক্ত হয়েছে), যেটির প্রতিনিধিত্বকারী জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল অস্ট্রেলিয়া আদিবাসীরা, যাদের মধ্যে প্রচুর ভাষিক বৈচিত্র্য থাকলেও ‘অস্ট্রিক’ বা ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’ বিভিন্ন ভাষার সাথে বিশেষ কোনো নিকট সম্পর্ক নেই। কাজেই ‘অস্ট্রাল’ কথাটি যে অর্থেই ব্যবহার করা হোক না কেন, এর পেছনে স্বচ্ছ কোনো ধারণা আছে, একথা বলার কোনো উপায় নেই। কাজেই সব মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি, “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে”, এমন ধারণা অবশ্যই গোলমেলে, এবং অবশ্য-পরিহার্য!                               

টীকা


[1] বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে যে প্রবন্ধটি রয়েছে – ‘জাতির কী রূপ: বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ পর্যালোচনা – সেটির একটি পূর্বতন ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছিল সর্বজনকথা পত্রিকার ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় (নভেম্বর ২০১৪)। শুধু ‘জাতির কী রূপ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটির পিডিএফ কপি আগ্রহী পাঠক নামিয়ে নিয়ে পড়ে দেখতে পারেন।    

[2] তৎসম ‘নৃ’ (যা ‘নর’ ও ‘নারী’ শব্দসমূহের সাথে সম্পর্কিত) অর্থ মানুষ হলেও বাংলা ভাষায় বিদ্যাজগতের বাইরে এই শব্দমূলের বহুল ব্যবহার নেই। ফলে অনেকেই ‘নৃ’-যুক্ত বিভিন্ন শব্দ লিখতে গিয়ে হাইফেন জুড়ে দেন, যেমন ‘নৃ-বিজ্ঞান’। একই ধারাবাহিকতায়  ২০১১ সালে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দটি, যেটির হাইফেন এটির আপেক্ষিক নবীনত্ব নির্দেশ করছে। অবশ্য হাইফেনবিহীন আকারেও শব্দটির প্রচলন ছিল কিছুটা আগে থেকেই। এই লেখায় উভয় বানানই ব্যবহার করা হয়েছে, তবে  হাইফেনযুক্ত রূপটির প্রয়োগ করা হয়েছে মূলতঃ সংবিধানের প্রেক্ষাপটে।  

[3] যেমন চট্টগ্রামে অবস্থিত Ethnological Museum-এর বাংলা নাম ‘জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর’।

[4] ইংরেজি ethnic বা ethnicity শব্দের মূল উৎস হল জাতিবাচক গ্রিক শব্দ ethnos/ethnikos, যে মূল অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে নৃবিজ্ঞানের বিশেষায়িত দুটি ধ্রুপদী ধারা ethnography ও ethnology (জাতিতত্ত্ব)-এর।

[5] প্রাইমেটবিদ (primatologist)-রা জীবজগতে মানুষের সাথে সবচাইতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ‘প্রাইমেট’ বর্গীয় প্রাণীদের অধ্যয়ন করেন (যেমন বিভিন্ন ধরনের বানর, উল্লুক, ওরাং উটান, শিম্পাঞ্জি ও গরিলা)। উল্লেখ্য, মানুষও প্রাইমেট বটে। 

[6]Race শব্দটির অন্য একটি প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘নরগোষ্ঠী’ (সাদাত উল্লহ খান ২০০১), যা ‘নৃগোষ্ঠী’র কাছাকাছি, যদিও পরেরটি লিঙ্গনিরপেক্ষ। ‘এথনিক গোষ্ঠী’ অর্থে ‘নৃগোষ্ঠী’  শব্দটির প্রবর্তক হিসাবে অনেক সময় প্রয়াত সেলিম আল দীন বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের কথা বলা হয় (যেমন ‘নিও-এথনিক থিয়েটার’-এর বাংলা করা হয়েছে ‘নব্য নৃগোষ্ঠীর নাট্যচর্চা’), তবে দাবিটা পুরোপুরি ঠিক যদি নাও হয়, শব্দটিকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তোলার পেছনে তাঁদের নিশ্চয় ভূমিকা ছিল।

[7] দৈহিক বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রেইস–এর ধারণা যে সমকালীন নৃবিজ্ঞানে পরিত্যক্ত হয়েছে, তা বোঝা যাবে দৈহিক নৃবিজ্ঞানের উপর যে কোনো সাম্প্রতিক টেক্সট বই খুলে দেখলে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, Jurmain et al. (2014)

[8] Herbert Hope Risely  ছিলেন একজন ঔপনিবেশিক প্রশাসক, যিনি ১৮৮৫ সালে বাংলার ‘এথনোগ্রাফিক সার্ভে’ পরিচালনা করার দায়িত্ব পান। নাসাঙ্ক (nasal index), শিরাঙ্ক (cephalic index) প্রভৃতি মাপজোকের ভিত্তিতে পরিচালিত এই কাজের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি মেনে নেওয়া হলেও সার্বিকভাবে সেটিকে ‘কালজয়ী’ হিসাবে অভিহিত করেছেন অজয় রায় (১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৮)।

তথ্যসূত্র

অজয় রায় (১৯৮৭) বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড,  সম্পা. আনিসুজ্জামান প্রমুখ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

আনিসুজ্জামান (২০১৫) বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা, ঢাকা।

আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, কাজী দীন মুহম্মদ, মমতাজুর রহমান তরফদার ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সম্পাদক  (১৯৮৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (২০০৬) জাতীয় সংস্কৃতি নীতি-২০০৬, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা [বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর ২৯, ২০০৬]

গোলাম মুরশিদ, সম্পা. (২০১৩ক) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান প্রথম খণ্ড (অ-ঞ), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

—–(২০১৩খ) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান দ্বিতীয় খণ্ড (ট-), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

জেমস ওয়াইজ (১৯৯৮-২০০২) পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ [১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত তিন ভাগে প্রকাশিত; ফওজুল করিম অনূদিত ও  মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত], ইউপিএল, ঢাকা।

মিখাইল নেস্তুর্খ [Mikhail Nesturkh] (১৯৭৬) মানব সমাজ: জাতি প্রজাতি ও প্রগতি, [দ্বিজেন শর্মা অনূদিত] প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।

সাদাত উল্লাহ খান (২০০১) নৃবিজ্ঞান কোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

Boas , Franz (1940) Race, Language and Culture. New York: The Macmillan Company.

Comas, Juan (1951) Racial Myths: The Race Question in Modern Science.  UNESCO, Paris.

Eaton, Richard (1993) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760.  Berkeley: University of California Press.

Jurmain, Robert et al. (2013) Introduction to Physical Anthropology [14th Edition], Belmont, CA: Wadsworth.

Maloney, Clarence T. (1984) Tribes of Bangladesh and Synthesis of Bengali Culture.  In Mahmud Shah Qureshi, ed. Tribal Cultures of Bangladesh, Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi University, Rajshahi.

Montagu, Ashley (1980) The Concept of Race.  Greenwood Press.

প্রশ্নোত্তরে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গ

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

‘বাঙালিরাই বাংলাদেশের প্রকৃত আদিবাসী’ এমন দাবী যাঁরা করেন, তাঁরা কেন আন্তর্জাতিকভাবে পালিত ‘আদিবাসী দিবস’ উদ্‌যাপন করেন না? বইপত্রে যে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অন্যতম ‘উপজাতি ‘ হিসাবে ‘সেন্দুজ’ নামের একটি জনগোষ্ঠীর নাম দেখা যায়, বাস্তবে যাদের খুঁজে পাওয়া যায় না, তাদের নাম বা বিবরণ কোত্থেকে আসলো? এমন কিছু প্রশ্ন দিয়ে সাজানো একটা ফেসবুক নোটের মাধ্যমে একটা কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন আমি করেছিলাম ২০১৪ সালের আগস্টে, ‘আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে। আয়োজনটা কেন করেছিলাম, নোটটির শুরুতেই সেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, এরপর প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী ও পুরস্কারের বিষয় উল্লেখ করার পর মোট বারোটি প্রশ্ন লিখে দিয়েছিলাম। সেই নোটের অংশবিশেষ সম্পাদিত আকারে নিচে তুলে ধরা হল।  সবশেষে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যা হওয়ার কথা, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে অথবা সম্ভাব্য উত্তর কোথায় পাওয়া যেতে পারে, এ বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক সূত্র দেওয়া হয়েছে।

কুইজ আয়োজনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য

নৃবিজ্ঞানে পড়াশুনা, গবেষণা ও শিক্ষকতা করতে গিয়ে আমি দেখেছি, বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য যেসব জাতি রয়েছে, তাদের সম্পর্কে গড়পড়তা ‘শিক্ষিত’ বাঙালিদের জানাশোনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা খুবই কম। আসলে নিজেদের ‘বাঙালি’ পরিচয়ের উৎসসমূহ সম্পর্কেই বেশির ভাগের কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই, এবং যখন ‘বাঙালি’ ছাড়া অন্য জাতিদের প্রসঙ্গ আসে, বা তাদের সাথে বাঙালিদের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে – এ ধরনের বিষয়ে অনেকের হয় কোনো ধারণাই নেই, বা থাকলেও সেগুলি সচরাচর হয় খুবই সেকেলে এবং সমস্যাজনক।  ‘প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে’ – এমনতর বহু গোলমেলে বা ভ্রান্ত ধারণা হামেশাই দেখা মেলে বাঙালি বিদ্বৎসমাজের উজ্জ্বলতম অংশের মধ্যেই।   এদিকে ‘আদিবাসী’ পদটা নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন, বিভ্রান্তি, এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক অবান্তর যুক্তিতর্কও চোখে পড়ে। শেষোক্ত বিষয়ে আমি নিজেও বেশ লেখালেখি করেছি। এখানে নতুন করে নিজের পুরানো বক্তব্যগুলির পুনরাবৃত্তি না করে আমি নজর দেব স্রেফ প্রচারণা বা পুনরাবৃত্তির জোরে শিক্ষিতজনদের মানসে শেকড় গেড়ে আছে, এমন কিছু ধারণার উপর। নজরে নিয়ে আসা এসব ধারণা শুধুমাত্র আদিবাসীদের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং বাঙালিদের আত্নপরিচয়ের প্রেক্ষিতেও প্রাসঙ্গিক।  

বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য যেসব জাতি রয়েছে, তাদেরকে কি নামে ডাকা উচিত, তাদেরকে আদৌ ‘জাতি’ বলা যায় কিনা, তারা এদেশের ‘প্রকৃত আদিবাসী’ কিনা – বাঙালি বিদ্বৎসমাজে এসব বিষয়ে অনেকেই নিয়মিত বিশেষজ্ঞের কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের অনেক ধ্যানধারণাই যে যথার্থ নয়, এ ব্যাপারে অনেকেই সচেতন নন। অর্থাৎ ‘জ্ঞান’ হিসাবে যা জাহির করা হয়, তা যে অনেক ক্ষেত্রে স্রেফ অজ্ঞতাপ্রসূত বা ভ্রমাত্মক, এটিই অনেকে জানেন না। যেমন, বাংলাদেশে যেসব আদিবাসী জাতি (বা তথাকথিত ‘উপজাতি’) রয়েছে, তাদের সবার নাম ঠিকভাবে বলতে ও লিখতে পারেন, এমন খুব কমজনই আমি দেখেছি। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ‘১৩টি উপজাতি’ রয়েছে, বা সেখানে ‘সেন্দুজ’ নামে একটি ‘উপজাতি’ বাস করে – এমন উদ্ভট তথ্য বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রায়ই চোখে পড়ে। যেমন, ‘১৩টি উপজাতি’র হিসাবটা আমি ২০১৩ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে দেখেছিলাম। (তার আগে আমি যখন ইউএনডিপিতে কাজ করতাম, আমার এক উর্ধ্বতন সহকর্মী যখন রাঙামাটির সেনা কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়েছিলেন – আমি সাথে ছিলাম – এক চৌকস অফিসার  পাওয়ারপয়েন্টে ১৩ সংখ্যাটি উল্লেখ করেছিলেন। উপস্থাপনা শেষে সেই অফিসারকে আমি চুপিসারে বলেছিলাম, হিসাবটা ভুল, কিন্তু জানি না এর পর সেটি শোধরানো হয়েছে কিনা।) সাধারণভাবে যেটা দেখি, একই ধরনের অনেক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলছে জনপরিসরে। আমার কুইজের প্রশ্নগুলির মাধ্যমে সেরকম কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে।  

প্রশ্নমালা 

১। বাংলাদেশে যাঁরা যুক্তি দেখান যে, ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দিলে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে, তাঁরা কি এমন একটি দেশের উদাহরণ দিতে পারবেন, যেখানে এমন আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে? আপনার উত্তরের পক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য, প্রমাণ ও যুক্তি তুলে ধরুন।

২। বাঙালিরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী এমন কথা যাঁরা বলেন, অর্থাৎ যাঁরা প্রকারান্তরে দাবী করেন যে বাংলাদেশে ১৫ কোটির বেশি ‘আদিবাসী’ বাস করে, সেসব ‘বুদ্ধিজীবী’রা কেন কোনোদিন জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবস, বর্ষ বা দশক কোনোটাই পালনে এগিয়ে আসেননি?

 ৩। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটি – যেটির সহজ বাংলা অর্থ হতে পারে ‘ছোট মানুষের জাত’ বা ‘ছোট জাতের মানুষ’ – যাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, তাদের সচেতন ও সরব অংশ এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিষয়টি জানার পরও এটি ব্যবহার করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

৪। ‘উপজাতি’ শব্দটির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আপনার মতামত কি? যুক্তিসহ ব্যাখ্যা করুন।

৫। সংবিধানে ব্যবহৃত ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ কথাটির যে ইংরেজি অনুবাদ সরকারিভাবে করা হয়েছে – ‘minor race’ – তা কতটা যথার্থ?

৬।  ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ পদটি কারা কবে কোন অর্থে প্রচলন করেছিলেন? এটি কেন সমস্যাজনক?

৭। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা অধিকাংশই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল’ এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বনভূমি উজাড় হওয়ার প্রধান কারণ জুমচাষ’ – এ ধরনের বক্তব্যের সাথে আপনি কি একমত? আপনার উত্তরের পক্ষে প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যান ও যুক্তিপ্রমাণ দেখান।

৮। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত’ – সমকালীন নৃবিজ্ঞানে এমন বক্তব্য অচল, একথা আপনি জানেন এবং মানেন কি? (বি.দ্র.: আপনার উত্তর যাই হোক, সৎভাবে ও ব্যাখ্যাসহ তা দিলে পূর্ণ নম্বর পেতে পারেন।)

৯। বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিদের মধ্যে কাদের ভাষাসমূহকে প্রচলিত শ্রেণীবিভাগ অনুসারে ‘আর্য’ বর্গভুক্ত গণ্য করা যায়? আপনার জানা এমন পাঁচটি জাতির নাম উল্লেখ করুন।

১০। উৎস অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে যেসব বর্গে ভাগ করা হয়, ‘দেশি’ সেগুলির একটি। এই বর্গের শব্দগুলি যেসব উৎস থেকে এসেছে, সেগুলির সাথে সম্পর্কিত দুইটি ‘ভাষা পরিবার’এর নাম বলুন, এবং প্রতিটি পরিবারের আওতাভুক্ত ৫টি করে সমকালীন ভাষার নাম উল্লেখ করুন।

১১। কে কবে জানি কোথায় লিখেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ‘১৩টি উপজাতি’ বাস করে – সেই তেরোর হিসাবটি এখনো অনেকেই পুনরাবৃত্তি করে চলছেন। এই সংখ্যাটি কিভাবে আসল, সূত্র উল্লেখ করে হিসাবটা মিলিয়ে দিন।

১২। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ‘উপজাতি’দের তালিকায় ‘সেন্দুজ’ নামটি এখনো দেখা যায় বিভিন্ন বইপুস্তক বা পত্রপত্রিকায়। বাস্তবে ঠিক এই নামে কোনো জাতির অস্তিত্ব কোথাও নেই, কখনো ছিল না। এই নামটির উৎপত্তিরহস্য কি? সূত্র উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করুন।

উত্তর

১। ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়াতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে, এমন কোনো দেশের সন্ধানে যাওয়ার আগে আমাদের আগে জানা দরকার, এই স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্ন কখন কোন প্রেক্ষিতে উঠেছে। মূলত জাতিসংঘ বা এর কিছু অঙ্গসংগঠন – বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা বা আইএলও – প্রণীত কিছু দলিলের প্রেক্ষিতেই এ ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ১৯৮৯ সালে প্রণীত আইএলও’র  Indigenous and Tribal Peoples’ Convention, 1989 (No. 169), যা সংক্ষেপে C169 নামে পরিচিত, এবং ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন কর্তৃক গৃহীত UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (সংক্ষেপে UNDRIP)। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত (অর্থাৎ আগস্ট ২০২১ নাগাদ) মাত্র ২৪টি সদস্যরাষ্ট্র C169 অনুস্বাক্ষর (ratify) করেছে, যে তালিকায় এশিয়াতে মাত্র একটি দেশই আছে এখন পর্যন্ত, যেটি হল নেপাল। তবে যে ২৪টি দেশ অনুস্বাক্ষরকারীদের তালিকায় আছে – যাদের মধ্যে রয়েছে লাতিন আমেরিকার ১৫টি, ইউরোপের ৬টি ও আফ্রিকার ১টি দেশ, এবং ফিজি – সেগুলিতে যে ধরনের সমস্যাই থাকুক, ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির কারণে কোথাও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। অন্যদিকে UNDRIP-এর উপর যখন ভোটাভুটি হয়, চারটি রাষ্ট্র – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড – এর বিরোধিতা করেছিল, আর মোট ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত ছিল, যাদের মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অবশ্য পরে তাদের অবস্থান পাল্টায়, এবং কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ঘোষণাটি সমর্থন করবে বলে জানিয়েছে। যাই হোক, C169-এর তুলনায় UNDRIP-এর বিশেষ কোনো আইনি তাৎপর্য নেই, তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার ‘এদেশে কোনো আদিবাসী নেই’ বা এদেশের জন্য C169 প্রযোজ্য নয় ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে আসলেও স্বাধীনতার পরই, ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশ এই কনভেনশনের পূর্ববর্তী সংস্করণ Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107) বা C107-এ স্বাক্ষর করেছিল, কাজেই এ রাষ্ট্র ‘আদিবাসী’ বা ‘উপজাতীয়’ (ট্রাইবাল) জনগোষ্ঠীসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ নাকি ‘উপজাতীয়’ বলা হচ্ছে, তাতে কিছু এসে যায় না! 

২। বাংলাদেশে যাঁরা দাবী করেন যে ‘বাঙালিরাই এদেশের প্রকৃত আদিবাসী’, তাঁরা কেন কেউই এ যাবত আদিবাসী দিবস, বর্ষ বা দশক কোনোটাই পালনে এগিয়ে আসেননি, সেটির উত্তর তাঁরাই ভালো দিতে পারবেন। তবে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিতর্কের কতটুকু ধারণাগত বিভ্রান্তি-প্রসূত, আর কতটুকু ক্ষমতাসীনদের জাত্যাভিমান, সংকীর্ণ স্বার্থ বা অন্য কোনো কারণের সাথে সংশ্লিষ্ট, এসব তলিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আমার একাধিক প্রাসঙ্গিক নিবন্ধ রয়েছে, যেগুলি আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন, যেমন – আরণ্য জনপদের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সনদের ছায়াতলে: বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় পুনর্নির্মাণের দুই দশক, ১৯৯৩-২০১৩, অরণ্য থেকে অন্তর্জালে, রাঙা মাটির পথ থেকে রাজপথে, আদিবাসী চেতনার সন্ধানে

 ৩। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটি দিয়ে বাংলাদেশে যাদের বোঝানো হচ্ছে, তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও কেন অনেকে এটা ব্যবহার করছেন, সেই ব্যাখ্যাটা তাঁদের কাছে চাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, কথাটি কেন আপত্তিকর, এ বিষয়ে যেসব যুক্তি রয়েছে, সেসবের কিছু আমি তুলে ধরেছি আমার এক লেখায়, যা কেউ চাইলে পড়ে দেখতে পারেন: ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ কথাটি কেন আপত্তিকর

৪। ‘উপজাতি’ শব্দটির গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে: ‘ট্রাইব’ ধারণার সমালোচনা-সম্বলিত অনেক ইংরেজি প্রবন্ধ বা বুইপুস্তক নেট ঘাঁটলে পাওয়া যেতে পারে, তবে বাংলায় অনুরূপ লেখালেখি অনেকটা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে। আমার নিজের অনেক লেখায় অন্যান্য বিষয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ‘উপজাতি’ শব্দটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনা করে থাকতে পারি, তবে শুধুমাত্র শব্দটি বা সংশ্লিষ্ট ধারণা ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যা বা আপত্তি নিয়ে আলাদা কোনো নিবন্ধ এখনো লিখিনি। অবশ্য আমার ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ গ্রন্থের ‘পাহাড়ি পরিচয়ের ঔপনিবেশিক ভিত্তি’ শীর্ষক অধ্যায়ে এ বিষয়ক কিছু সুনির্দিষ্ট আলোচনা রয়েছে।

৫। সংবিধানে ব্যবহৃত ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ কথাটির ইংরেজি অনুবাদ সরকারিভাবে ‘minor race’ করা হয়েছে এই অর্থে যে, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়, সেটির শিরোনামে বা বিস্তারিত বিবরণে ব্যবহৃত “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি” কথাগুলির বিপরীতে একই অনুচ্ছেদের ইংরেজি ভাষ্যে লেখা রয়েছে “The culture of tribes, minor races, ethnic sects and communities”। এমনিতে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির একটি প্রকাশনায় ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটিকে race অর্থে ব্যবহার করা হয়েছিল, যে ধরনের সূত্র ধরে অথবা স্বতন্ত্রভাবে অন্যরাও ‘রেইস’ এবং/বা ‘এথনিক গ্রুপ’ অর্থে ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন (এ প্রসঙ্গে আমার বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে সংকলিত ‘জাতির কী রূপ’ প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক আলোচনা রয়েছে; বইটির পৃষ্ঠা ১৭-১৮ দ্রষ্টব্য। এছাড়া আমার ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ গ্রন্থের ‘বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ খোঁজার ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক অধ্যায়টির অংশবিশেষ বা বইটির পৃষ্ঠা ৪৫-৪৯ দেখা যেতে পারে)। এদিক থেকে সংবিধানে যদি ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ কথাটিকে ইংরেজি ‘minor race’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তবে তা খুব চিন্তাভাবনা করে করা হয়েছে, এ কথা বলা যায় না। উল্লেখ্য, সমাজতান্ত্রিক পরিভাষায় যে বিশেষ অর্থে nationality শব্দটি ব্যবহৃত হত (যে অনুযায়ী একাধিক nationality মিলে একটি nation গঠিত হয়), সেই প্রেক্ষাপটে এটিকে বাংলায় ‘জাতিসত্তা’ হিসাবেই অনুবাদ করা হত।

৬।  ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ পদটি ঠিক কারা কবে প্রথম ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন, এবং কোন অর্থে, এটা সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করা গবেষণাসাপেক্ষ বিষয়। তবে বিভিন্ন প্রয়োগ থেকে বোঝা যায়, ‘এথনিক গ্রুপ’ জাতীয় ইংরেজি টার্ম বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়েই বেশি কিছু না ভেবে কেউ হয়ত প্রথম ‘নৃতাত্ত্বিক’ শব্দটি ব্যবহার করেন ‘এথনিক’ এর প্রতিশব্দ হিসাবে। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এটি ভুল ছিল, কারণ ‘নৃতত্ত্ব’ দিয়ে আসলে বোঝায় একটি জ্ঞানকাণ্ড, যেটি অধুনা ‘নৃবিজ্ঞান’ নামেই অধিকতর পরিচিত। এক্ষেত্রে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হবে, এবন কেন, তা নির্ধারণ করা মুশকিল। তথাপি প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকেও দেখা গিয়েছিল ‘নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু’ কথাটি ব্যবহার করতে, যে বিষয় উল্লেখ করা আছে আমার লেখা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে খোলা চিঠি-তে।

৭। জুমচাষ বিষয়ক বিভিন্ন মতামতের ব্যাপারে পাঠক পড়ে দেখতে পারেন ‘আদিবাসী পাহাড়িদের হাত থেকে পাহাড় রক্ষার ভাবনা!’ শিরোনামে এই ব্লগে প্রকাশিত আমার একটি পোস্ট, অথবা ২০০৩ সালে প্রকাশিত আমার পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ শীর্ষক একটি বই।   

৮। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত’ এ ধরনের বক্তব্য সমকালীন নৃবিজ্ঞানে সেভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে আমার বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে সংকলিত ‘জাতির কী রূপ’ প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক আলোচনা রয়েছে (বইটির পৃষ্ঠা ১৭-২০ দ্রষ্টব্য)। এছাড়া ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ গ্রন্থের ‘পাহাড়ি পরিচয়ের ঔপনিবেশিক ভিত্তি’ শীর্ষক অধ্যায়টির শেষাংশ (বইটির পৃষ্ঠা ৭৯-৮০), এবং একই বইয়ের ‘বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ খোঁজার ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক অধ্যায়টির অংশবিশেষ (বইটির পৃষ্ঠা ৪৫-৪৯) দেখা যেতে পারে।

৯। বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিদের মধ্যে যাদের ভাষাগুলিকে প্রচলিত শ্রেণীবিভাগ অনুসারে ‘আর্য’ বর্গের আওতায় ফেলা যেতে পারে বা ফেলা হয়, তাদের মধ্যে রয়েছে চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, হাজং, বর্মন প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠক আমার কেমন আছে বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলো শিরোনামের লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।   

১০। যেসব ভাষা থেকে বাংলার ‘দেশি’ শব্দগুলি এসেছে বা এসে থাকতে পারে, সেগুলিকে মোটা দাগে দুইটি ‘ভাষা পরিবারে’ ফেলা যায়, যেগুলির একটি হল অস্ট্রো-এশিয়াটিক (যার ‘মুন্ডারি’ শাখার আওতায় রয়েছে সান্তালি ও মুন্ডার মত ভাষা, এবং ‘মন-খ্‌মের’ শাখার আওতায় আছে ‘খাসি’), এবং অন্যটি হল ‘টিবেটো-বার্মান’ বা ‘ভোট-বর্মী’, যার আওতায় আছে গারো, ত্রিপুরা (ককবরক), মেইতেই (মণিপুরী), মারমা, ম্রো, চাক, বম ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গেও আমার কেমন আছে বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলো শীর্ষক লেখাটি পড়ে দেখা যেতে পারে।

১১। পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ‘১৩টি উপজাতি’ বাস করে, এমন ভুল হিসাব  ঠিক কারা কখন চালু করেছিল, সেটা ভালো করে গবেষণা করলে হয়ত খুঁজে বের করা যাবে। তবে ভুল হিসাবটা কিভাবে চালু হয়ে থাকতে পারে, এ ব্যাপারে আমার কিছু ধারণা আছে। সেটা হল, অনেক প্রকাশনায় (যেমন আবদুস সাত্তারের আরণ্য জনপদে গ্রন্থে) ‘কুকি’ ও ‘সেন্দুজ’ নামক আলাদা জাতির নাম আছে, যে নামে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো জনগোষ্ঠী নেই। উল্লেখ্য, ‘কুকি’ বর্গের আওতায় লুসাই, বম ও পাংখো – এই তিনটা জনগোষ্ঠীকেই ফেলা যায়। অন্যদিকে ‘সেন্দুজ’ নামে কোনো জনগোষ্ঠী কখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করেনি, এবং নামটাও ভুলে চালু হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে নিচে, ১২ নং প্রশ্নের উত্তরে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে সরকারিভাবে স্বীকৃত ১১টি ‘উপজাতি’ রয়েছে, যারা হল (নামের আদ্যাক্ষরের ক্রমানুসারে) খিয়াং, খুমি, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, পাংখো, বম, মারমা, ম্রো ও লুসাই। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘গুর্খা’, ‘আসাম’ ইত্যাদি নামে পরিচিত আরো দু’একটি সম্প্রদায়ও রয়েছে যারা জনসংখ্যায় খুব কম, এছাড়া একটা সান্তাল (সাঁওতাল) পল্লীও রয়েছে খাগড়াছড়িতে, কিন্তু তাদের কারো কথা বিবেচনা করে ‘১৩টি উপজাতি’র হিসাব চালু হয়েছিল, এটা বলার কোনো কারণ নেই।    

১২। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেন্দুজ’ নামে কোনো জাতি কখনো বসবাস করেনি, এবং এই নামটাও ভুল, তবুও অস্তিত্বহীন এবং  ভুল নামে অভিহিত ‘সেন্দুজ’দের নাম কেন এখনো বিভিন্ন বইপত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘উপজাতি’দের তালিকায় পাওয়া যায়, এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভুল তথ্যগুলির একটা সম্ভাব্য উৎস হিসাবে আমরা আবদুস সাত্তারের আরণ্য জনপদে গ্রন্থটিকে  দেখতে পারি। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের শুরুর দিককার প্রশাসক ক্যাপ্টেন লুইনের একাধিক বইয়ে ‘সেন্দু’ (শুরুতে Shendu ও পরে Shendoo বানানে লেখা) নামের একটি জাতির নাম উল্লেখ করা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির সময় সেন্দুরা সেখানকার বাসিন্দা ছিল না, তবে সীমান্ত সংলগ্ন বিস্তীর্ণ পার্বত্যাঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল। সে সূত্রেই লুইনের বইতে তাদের উল্লেখ ছিল। এদিকে ইংরেজিতে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বহুবচনবাচক ‘s’ যোগ করে লেখা Shendoos শব্দকে ভুলে আবদুস সাত্তার বা অন্য কেউ ‘সেন্দুজ’ হিসাবে প্রথম লিখেছিলেন মনে হয়, যার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। এই ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত খাজা কামরুল হকের লেখা বাংলাদেশের উপজাতি নামের একটা বইয়ে এই ‘সেন্দুজ’দের বিবরণ আছে এভাবে, “সেন্দুজরা [তিন পার্বত্য জেলার] গহীন জঙ্গলে বাস করে। … তাদের গায়ের রং ফর্সা, পায়ের গোড়ালি শক্ত ও মোটা, চোখ কিছুটা ক্ষুদ্র ও নাক চ্যাপ্টা।”

সমাপনী ভাবনা

উপরে তুলে দেওয়া সর্বশেষ প্রশ্নোত্তরের শেষে যে উদ্ধৃতি রয়েছে, তা যদিও বর্ণবাদী, সেটির প্রেক্ষাপটে এখানে ঠাট্টাচ্ছলে একটা কথা যোগ করব আমাদের আলোচনা শেষ করার প্রাক্কালে: পাঠকদের মধ্যে যাঁদের গড়ন ও চেহারা উক্ত বিবরণের কাছাকাছি, তাঁরা একটু সাবধান থাকবেন! নতুবা সরকারের লোকজন যে আপনাদের ধরে নিয়ে বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমিতে ‘বিলুপ্তির কবল থেকে উদ্ধারকৃত বিরল প্রজাতির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসাবে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে না, সে নিশ্চয়তা কি আছে?

একটা বিষয় পরিষ্কার, যা হল এই যে, আদিবাসীদের সম্পর্কে যত ভুল তথ্য ও গোলমেলে ধ্যানধারণা জমা হয়েছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, সেগুলির জঞ্জাল সাফ করতে গেলে অনেক সময় লাগবে, এবং এজন্য কাজে লেগে থাকতে হবে একটা প্রশিক্ষিত ও নিবেদিত গবেষক দলকে।

ভালোবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটি বিষ

সাঙদারি[*]

পটভূমি: দুইটি বিধ্বস্ত জীবন

দু’জন মদ্যাসক্ত ব্যক্তির বর্ণনা দিয়ে আমার এ আলোচনা শুরু করব। (তাদেরকে অনেকে হয়ত চিনতে পারবেন, আশা করি এতে কেউ ক্ষুন্ন হবেন না। ব্যক্তিবিশেষকে হেয় বা বিব্রত করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই, বরং, এ দু’জনের মধ্যে গোটা ত্রিপুরা সমাজের যে একটা করুণ বাস্তবতা প্রতিফলিত, তাই তুলে ধরতে চাই।) প্রথমজনের নাম ধরা যাক ত-ফা। যখনই পথে দেখা হয়, তাকে দেখতে পাই নেশায় টলছে, প্রলাপ বকছে। একবারই তাকে অ-নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখেছিলাম, খুব সকালে। তাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখতে এতই অভ্যস্ত ছিলাম যে এদিন তাকে আমার অস্বাভাবিক লেগেছিল, তার অপ্রতিভ আত্মসচেতন রূপ দেখে এক ধরনের করুণা হয়েছিল তার উপর। অবশ্য এর এক ঘণ্টা পরেই সে তার ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় জনকে ডাকব দ-ফা বলে। তাঁরও প্রায় একই অবস্থা। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন, ‘আতা [দাদা], তুমি মদ ছাড়া থাকতে পার না?’ দ-ফার জবাব, সকালে এক বোতল আর সন্ধ্যায় আর এক বোতল না হলেই নয় তাঁর। পেটে মদ না পড়লে হাত পা কাঁপতে থাকে।

দু’জনই বাইরে খুব নিরীহ। বাংলা ছায়াছবির মাতাল লম্পট বা দুর্বৃত্ত চরিত্রদের সাথে তাদেরকে মেলানো যায় না। তাদের দেখে রাগ হয় না। বরং দুঃখ হয়। রাগ হয় বৈকি, নিজের উপর, সমাজের আর দশজনের উপর। আমাদের চোখের সামনে কিভাবে ত-ফা আর দ-ফার মত লোকেরা মদের কাছে তাদের জীবন, তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত, বিকিয়ে দিল?

আমার স্কুলজীবনের শুরুতে ত-ফা আমার সহপাঠী ছিল। আর দ-ফা ছিলেন আমার শিক্ষক। তাই তাদের এই পরিণতি আমার কাছে আরো বেশি পীড়াদায়ক। আর যখন তাদের সন্তানদের দিকে তাকাই, দেখতে পাই দারিদ্র্য, হতাশা ও অভিভাকত্বহীনতার অসহায় শিকার তারা এবং কেউ উদ্যোগী না হলে সময়ে তারা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই মদের হাতে নিজেদের ছেড়ে দেবে। ত-ফার ছেলে ত-কে আমি একজন ভাল ছাত্র হিসেবে জানতাম। তার মধ্যে সৃজনশীলতার আভাসও দেখেছিলাম – একটা শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার সূত্রে। একদিন খবর নিয়ে জানতে পারি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়েই তার স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। যে দ-ফা একদিন নিজে শিক্ষক ছিলেন, দেখলাম তাঁর দু’জন কনিষ্ঠ সন্তান অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত পায় নি, অথচ তাদের পড়াশুনার বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগে! ত-ফা ও দ-ফার পরিবারের অবস্থা আর বিশদভাবে বলার কিছু নেই। যে কেউই তা কল্পনা করে নিতে পারেন।

ত-ফা ও দ-ফা দু’জনেরই সঙ্গতি ছিল সন্তানদের স্কুলে পড়ানোর। কিন্তু সন্তানদের প্রতি তাদের যতটুকু যত্ন, মনোযোগ ও ভালবাসা দেখানো উচিত ছিল – তা তারা দেখাতে পারে নি, কারণ তাদের শিরায় উপশিরায় ঢুকে গেছে ভালবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটা উপাদান, একটা বিষ – মদ। প্রকৃতপক্ষে ত-ফা ও দ-ফা রীতিমত অসুস্থ। মদের কবল থেকে তাদেরকে উদ্ধার করতে হলে ডাক্তারি চিকিৎসা অপরিহার্য হতে পারে।

এতো গেল মদ্যাসক্তির একটা চূড়ান্ত রূপ। এরকম উদাহরণ প্রায় প্রতিটা ত্রিপুরা গ্রামেই মিলবে। কিন্তু শুধু ত-ফা ও দ-ফাদের মত লোকদের শরীরে নয়, আমাদের গোটা সমাজ দেহে চলছে মদের মারাত্মক বিষক্রিয়া। ত্রিপুরাদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত, তরুণ-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যেভাবে কমবেশি মদ্যাসক্ত, সে অবস্থাকে সামগ্রিক আত্মহননের প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আমাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতাকে রোধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এর জন্য চাই জীবনমুখী, আশাবাদী ও সংগ্রামী চেতনা এবং সংকল্পের ব্যাপক প্রসার। আশার বিষয়, এই চেতনা ও সংকল্প তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিদ্যমান। নিচে তারই একটা উদাহরণ দেওয়া গেল।

মদ্যাসক্তি নিয়ে তরুণদের ভাবনা

এ বছর [১৯৯১] বৈসু উপলক্ষে খাগড়াছড়ির বৈসু উদযাপন কমিটির তরুণ সদস্যরা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। কমিটি একটি রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিল যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা: “মদ্যপান ত্রিপুরা সমাজের অনুন্নতির অন্যতম কারণ”। বিভিন্ন স্কুল কলেজের মোট নয়জন ছাত্রছাত্রী রচনা জমা দিয়েছিল, তারা হল – বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, গীতা দেববর্মন, প্রতিমা রাণী ত্রিপুরা, মণিকা ত্রিপুরা, প্রভাত জ্যোতি ত্রিপুরা, সুচরিতা রোয়াজা, চিত্রা রোয়াজা, পুষ্পেশ্বর ত্রিপুরা ও কিশোর কুমার ত্রিপুরা। তাদের সবার রচনায় যে কটি বিষয়ে জোর ঐকমত্য প্রকাশ পেয়েছে সেগুলোর সারসংক্ষেপ এখানে দেওয়া হল:

১. চিরাচরিত প্রথানুযায়ী ত্রিপুরাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মদ এখনও একটি অপরিহার্য উপাদান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মদের আশীর্বাদ না পেলে একজন ত্রিপুরার চলে না। আবুয়াক সুনাই [শিশু জন্ম উপলক্ষে আয়োজিত কৃত্য] থেকে শুরু করে বিবাহোৎসব, শ্রাদ্ধক্রিয়া – সবখানেই মদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক বলা চলে। কিন্তু মদের ব্যবহার শুধু সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেই আর সীমাবদ্ধ নেই, সব শ্রেণীর ত্রিপুরাদের মধ্যে দৈনিক ভিত্তিতে মদ্যপান চালু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মদকে একটি সম্মানজনক সামাজিক পানীয় হিসেবে আর গ্রহণ করা উচিত নয়।

২. মদের অপব্যবহারের ফলে আসক্তরা যেমন নিজেরা দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি তাদের পরিবারে তথা গোটা সমাজে মদের ক্ষতিকারক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। মদের কারণে বা মদকে উপলক্ষ করে দেখা দেয় পারিবারিক অশান্তি, আত্মীয়-পড়শিদের সাথে বিবাদ, এক কথায় সামাজিক অনৈক্য এবং বিশৃঙ্খলা।

৩. ত্রিপুরাদের নেতৃস্থানীয় ও শিক্ষিত অংশ মদের এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে নিজেরাই নেশায় বিভোর। মদের অভিশাপ থেকে গোটা সমাজকে মুক্ত করতে হলে এদের নিজেদের প্রথম আসক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে।

৪. যে সমস্ত কারণে মানুষ মদ্যাসক্ত হয়  পড়ে – হতাশা, সঙ্গদোষ, সর্বোপরি মদের সামাজিক প্রশ্রয় – সামগ্রিকভাবে এই কারণগুলোর মোকাবেলা করতে হবে।

৫. যে সমস্ত দরিদ্র পরিবার ও বৃদ্ধা বিধবারা মদ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদেরকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে।

৬. তরুণ প্রজন্মের সামনে মদ্যাসক্তিমুক্ত একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার আদর্শ তুলে ধরতে হবে আর তরুণদের সংকল্পবদ্ধ হয়ে এই নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রামে নামতে হবে।

মদ্যাসক্তির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

ত্রিপুরাদের জুমভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় এক সময় হয়ত মদের একটা সমর্থনযোগ্য স্থান বা ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে যে ভাঙন দেখা দিয়েছে, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সবদিক থেকে আমরা যে বিপর্যয়ের মধ্যে আছি, মদ্যাসক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠাতো দূরের কথা, আত্ম-বিধ্বংসী একটা আবর্তে আমরা আরো বেশি করে ডুবে যাচ্ছি।

সমাজতাত্ত্বিক বিচারে অবশ্য মদ্যাসক্তির প্রসার কোনো সমাজের অবনতির মূল কারণ নয়, বরং একটি লক্ষণ মাত্র, যা সচরাচর দেখা যায় বিভিন্ন কারণে সমাজ সংস্কৃতিতে ভাঙন দেখা দেওয়ার ফলে। কিন্তু এটাও ঠিক, মদ্যাসক্তির প্রসার সে ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। এরকম উদাহরণ অনেক আছে। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মূল অধিবাসীদের বংশধর, যারা নেটিভ আমেরিকান নামে পরিচিত, তাদের মধ্যে মদ্যাসক্তি একটা বড় সমস্যা। এ অবস্থা সবসময় ছিল না। আনাস্তাসিয়া ষ্কিলনিক (Anastasia Shkilnyk) নামের এক গবেষক তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত A Poison Stronger Than Love: The destruction of an Ojibwa community শিরোনামের গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন কিভাবে কানাডার একটি পুনর্বাসন পল্লীতে ওজিবোয়ে (Ojibwa) সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা মদ্যাসক্তির মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করছে। এ পল্লীর লোকদের যখন [১৯৬৩ সালে] তাদের পুরানো বসতিগুলো থেকে সরকারি উদ্যোগে নতুন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন থেকেই মদ্যাসক্তির ব্যাপক প্রসার তাদের সমাজে দেখা দেয়। পাশাপাশি দেখা দেয় ব্যাপক হারে আত্মহত্যা, খুন খারাবি, সন্তানদের প্রতি অবহেলা। বাইরের আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে না পারা থেকে যে ক্ষমতাহীনতা ও অসহায়ত্বের বোধ এবং পরনির্ভরশীলতা জন্ম নেয়, সেসবই আত্মঘাতী রূপ নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এটা মন্দের ভাল যে ত্রিপুরাদের অবস্থা এখনও এত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় নি, কিন্তু এখনই সচেতন ও সক্রিয় না হলে আমাদেরও ফেরার পথ থাকবে না।

উপসংহার

ত্রিপুরাদের সমস্যা বহুবিধ। বহুযুগের রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছি। শিক্ষার প্রসার আমাদের মধ্যে ঘটেনি, আমাদের সামাজিক ঐক্য অটুট নেই। কিন্তু এ অবস্থার জন্য ইতিহাস বা ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের মধ্যে আনতে হবে সংগ্রামী মনোভাব, বিপ্লবী চেতনা, আর অনমনীয় সংকল্প যে, আমরা একটা সুস্থ, স্বাভাবিক ও উন্নত সমাজ হিসাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবই যে কোনো মূল্যে। বিকেল হলেই বা বন্ধুবান্ধব জুটলেই নেশায় বুঁদ হয়ে বসে থাকলে নিজেদের বা সমাজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশই আমরা পাব না। সময় হয়েছে জীবনকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসে, আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে, মদ নামক বিষকে সমাজ দেহ থেকে ঝেড়ে ফেলার। আমাদের প্রত্যেককে প্রথমে নিজের সাথে যুদ্ধ করে নবচেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে। আমরা যারা বয়সে তরুণ, যারা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই জীবনমুখী, আশাবাদী ও সংগ্রামী চেতনা দিয়ে, আমাদেরকেই হতে হবে নতুন সমাজের অভিযাত্রায় অগ্রপথিক – সান্তুআ।[**]

পোস্ট স্ক্রিপ্ট 

এ নিবন্ধ লিখে শেষ করার পর খবর এল, সম্প্রতি [খাগড়াছড়ির] গাছবান গ্রামের এক ব্যক্তি অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মারা যায়। আমাদের সমাজে মদ্যাসক্তির বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যে কত জরুরি হয়ে পড়েছে, এই দুঃসংবাদ যেন তাই মনে করিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল। স্মরণ করা যেতে পারে, বৈসুর সময়েও [খাগড়াছড়ির] ঠাকুরছড়ায় এক ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পুকুরে ডুবে মারা যায়। [খাগড়াছড়ি, জুলাই ২১, ১৯৯১] 

~~~

সবশেষে একটা সুখবর

উপরে বর্ণিত সব তথ্য হল ১৯৯১ সালে যেমনটা আমি জানতাম। এরপর বহুবছর হল ত-ফা আর দ-ফা দু’জনেরই জীবনাবসান ঘটেছে। তবে নিবন্ধটি লেখার দেড় যুগ পর একটি বিষয় জেনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম, সেটা হল, ‘ত’ নামের যে ছেলেটি স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিল বলে জানতাম, সে পরবর্তীতে নিজের পায়ে ভালোভাবেই দাঁড়াতে পেরেছিল, যার পেছনে  তার নিজের চেষ্টা আর মায়ের উৎসাহ, দুই-ই ছিল। [এই কথাগুলি টীকা আকারে রয়েছে বর্তমান নিবন্ধের যে ভাষ্য আমার জাতিরাষ্ট্রের কিনারায় গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, সেটির সাথে।]

টীকা


[*]এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তুআ নামের একটি সামিয়িকীর ১ম সংখ্যা-য়, এবং পরে লেখকের প্রবন্ধসংকলন জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে গ্রন্থের অংশ হিসাবে পুনঃপ্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।  উল্লেখ্য, ‘সাঙদারি’ শব্দটি ত্রিপুরা ভাষায় ব্যবহৃত হয় আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই, এমন মানুষদের বোঝাতে। এই ছদ্মনামে আমি [প্রশান্ত ত্রিপুরা] নিজের সম্পাদিত সান্তুআ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলাম, তবে দু’টি প্রবন্ধের পর এই ধারা আর রক্ষা করা হয় নি। (‘সাঙদারি’ ছদ্মনামে প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধটিও এ ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে, যেটি হল: মাণিক্য রাজবংশ, বুরাসা দেবতা এবং খুমপুই-এর কাহিনী।)

[**] ‘সান্তুআ’ শব্দটি, যেটি ককবরকে ব্যবহৃত হয় ‘তীর্থযাত্রীদের পথপ্রদর্শক’ অর্থে, এখানে ব্যবহার করা হয়েছে স্রেফ পথিকৃৎ অর্থে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে খাগড়াছড়ি থেকে প্রথমে শুধু সান্তুআ নামে একটি সাময়িকীর প্রকাশ শুরু হয়েছিল, যেটির একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম আমি। সামিয়িকীটির নামে তৃতীয় বা পরের সংখ্যা থেকে ‘জার্নাল’ শব্দটিও যুক্ত হয়, এবং এই নামে (‘সান্তুআ জার্নাল’) এটি এখনো অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় খাগড়াছড়ি থেকে। তবে এটি সম্পাদনা বা প্রকাশনার সাথে আমি বর্তমানে আর যুক্ত নই। সামিয়কীটির সাথে বর্তমান লেখকের আবেগিক সম্পৃক্ততার বিবরণ আরো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে আমার  ‘সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড় না’ নামের একটি লেখায়।