Monthly Archives: মে 2021

নৃবিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারে সমাবর্তন দিবসের ভাবনা

[ব্র্যান্ডাইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য][১]

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

আমি খুবই খুশি ও গর্বিত আজকের এই আনন্দময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা যারা স্নাতক হচ্ছি, সবার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বদলের কৃত্য বা ‘অবস্থান্তরে আচার’ (rite of passage)। 

ব্র্যান্ডাইজে সমাবর্তনের দিনে, মে ১৮, ১৯৮৬। সেদিন সমাবর্তনে অংশ নেওয়া অন্য অনেক শিক্ষার্থীর মত আমিও গলায় লাল ফিতা বেঁধেছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক, এমন বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবিতে।

এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে একটা ভাবনা আমার মাথায় খুব করে ঘুরছে, সেটা এই যে, আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই চলছে কোনো না কোনো ভূমিকা বদলের কৃত্য, পালা বদলের পালা।

সারা পৃথিবী জুড়েই পুরো সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন সব পালা বদলের পালা চলছে, যেগুলি অনেকক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সমাজ বা জাতিসমূহের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

এখানে আমি ভাবছি সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেইসব সমাজের কথা, যারা একাধারে সাংস্কৃতিকভাবে ও বাস্তবিক অর্থে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। 

আমি বিশেষ করে ভাবছি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষদের কথা, যারা অত্যন্ত বেদনাদাময় পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আমি যে অঞ্চলের কথা বলছি, সেখানেই আমি জন্মেছিলাম। সেখানে বেশ কিছু ক্ষুদ্র আয়তনের জাতিগোষ্ঠী রয়েছে – আমি যেগুলির একটির সদস্য – যারা বর্তমানে অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের মুখে রয়েছে।  

ব্র্যান্ডাইজে পড়তে আসার আগে আমি আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই পার্বত্য চট্টগ্রামেই কাটিয়েছিলাম। সেই সময়কালে আমি বেশ কাছ থেকেই হত্যাকাণ্ড, দাঙ্গা এবং ত্রাসের বহু ঘটনা দেখেছি বা জেনেছি। গত গ্রীষ্মে [১৯৮৫ সালে] যখন আমি বাড়ি গিয়েছিলাম, আমি চারপাশে সামরিক বাহিনীর বিশাল উপস্থিতি দেখেছিলাম, এবং যে এলাকায় আমি জন্মেছিলাম ও বেড়ে উঠেছিলাম, সেটিকে মোটেই আর পরিচিত বা নিজের বলে মনে হচ্ছিল না।  নিজেকে আমার খুব বিচ্ছিন্ন লাগছিল।

আসলে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে আরো বহু মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মনে হচ্ছে – বা তারা ভয় পাচ্ছে – যে, বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেষ্টা করছে। এই বিলুপ্তির আশঙ্কা থেকে এসব গোষ্ঠীর অনেক সদস্যই বেছে নিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ।  

আমি নিজে দশম শ্রেণীর পড়াশুনা শেষ করার আগেই আমার অনেক সহপাঠী এবং খেলার সাথী ‘জঙ্গলে’ চলে গিয়েছিল, এমনকি আমার দু’একজন শিক্ষকও তাই করেছিলেন। তাদের অনেকে ইতোমধ্যে প্রাণও হারিয়েছেন বিভিন্ন সংঘাতে, বা আটক হওয়া অবস্থায়।

অতি সাম্প্রতিক কালেও, যেমন দু’সপ্তাহ আগে [১৯৮৬ সালের মে মাসের শুরুর দিকে], আমার জন্মশহরে [অর্থাৎ খাগড়াছড়িতে] জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে আমার নিজের গ্রামের পাশে থাকা দু’টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব সহিংসতার একটা বড় কারণ হল এই যে, সরকারি উদ্যোগে সমতল অঞ্চল থেকে প্রান্তিক কৃষক শ্রেণীর অনেক মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে পাহাড়ি আদিবাসীরা ভয় পাচ্ছে যে তারা সাংস্কৃতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, এবং বাস্তবেও তাদের অনেকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আমার দৃষ্টিতে যেটা পরিতাপের বিষয়, সেটা হল, সরকার আসলে সত্যিকার অর্থে সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত ভূমিহীন মানুষদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে না। অন্যদিকে সরকার পাহাড়ি আদিবাসীদের বাস্তব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও আমলে নিচ্ছে না।  

অবশ্য সাংস্কৃতিক ও জনমিতিক বিলুপ্তির ঘটনা শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামেই ঘটছে, তা নয়। গতকাল রাতে আমি যখন উডি এলেনের একটা মুভি [Hannah and Her Sisters] দেখছিলাম, সেটির একটি চরিত্র যেভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরেছিল, তা আমাকে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছিল: “অনেকে এই ভেবে অবাক হয় যে কিভাবে লাখ লাখ লোককে মেরে ফেলার মত ঘটনা ঘটে [নাৎসিদের পরিচালিত ‘হলোকস্ট’ নামক ইহুদি নিধনযজ্ঞের প্রসঙ্গে কথাটা বলা]। বাস্তবে আসল অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে, এমন ঘটনা আরো বেশি হারে ঘটে না।”

এক অর্থে আসলে এখনো সারা পৃথিবীতেই কোনো না কোনো আকারে গণহত্যার ঘটনা ঘটে চলছে, যেমনটা ইতিহাস জুড়েও ঘটতে দেখা গেছে। এই মুহূর্তে, ঠিক এই জায়াগাতে দাঁড়িয়ে, আমি এই মহাদেশ একদা যাদের আবাসভূমি ছিল, আমেরিকার সেই আদিবাসীদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি।     

নৃবিজ্ঞানে আমার আগ্রহ জন্মেছিল মানবতার এই অন্ধকার দিকটার সাথে মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। আমি নৃবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়েছিলাম এই কারণে যে, আমার মনে হয়েছে, এটা একটা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী আমাকে দেবে, যার সাহায্যে আমি নিজেকে তথা পুরো বিশ্বকে দেখতে পারব। 

আমার বিশ্বাস, নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার আওতায় প্রত্যেকটা সমাজ এবং প্রতিটা মানবগোষ্ঠীর জন্য সমান জায়গা রয়েছে। এই জ্ঞানকাণ্ড চেষ্টা করে নিরর্থকভাবে টিকে থাকা বহু মানুষ বা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অর্থময় করে তুলতে।       

আমার কিছু বন্ধুবান্ধব, এমনকি আমার নিজেরও একটা অংশ, আমাকে এই বলে অভিযুক্ত করে যে, নৃবিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আমার সামাজিক দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছি।[২] তারা বলতে চায় যে, জীবনের সব কিছু বোঝার চেষ্টা না করে আমাদের সবাইকে যার যার ভূমিকায় ‘খেলা’ চালিয়ে যেতে হবে, কেন তা করছি সেটা যদি নাও জানা হয়ে ওঠে। হয়তবা তারা আংশিক ঠিক। কিন্তু আমি এখনো নিজের এই বিশ্বাস ধরে রেখেছি যে, কোনো ক্ষেত্রে বাস্তব তৎপরতার আগে ভালো করে বুঝে ওঠার কাজটা করা জরুরি, এবং এই বিশ্বাস নিয়েই আমি আসন্ন হেমন্ত মৌসুমে বার্কলেতে নৃবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শুরু করার পরিকল্পনা করেছি। 

আমি কোনো এক কবির সেই বিশ্বাসের অংশীদার, যিনি মনে করেন যে, যারা বোঝার চেষ্টা করে এবং অপেক্ষা করে, তারাও আসলে সেবাই করে।[৩]

আমার বক্তব্য শেষ করার আগে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বৃন্দকে, যাঁরা হলেন ডেভিড মারে,  রবার্ট হান্ট, জুডিথ আরভাইন, জর্জ কওগিল এবং নিল গমবার্গ।

আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

~~~

টীকা


[১] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে অবস্থিত ব্র্যান্ডাইজ ইউনিভার্সিটিতে ১৯৮৬ সালের ১৮ই মে অনুষ্ঠিত সবাবর্তনের অংশ হিসাবে বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একজন পূর্বনির্ধারিত বক্তা হিসাবে আমাকে কিছু কথা বলতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী নিজের যে বক্তব্য আগের দিন লিখে রেখেছিলাম, সেটির বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল। মূল ইংরেজি ভাষ্যটি আগেই আমার ইংরেজি ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছে Commencement day reflections on studying anthropology শিরোনামে।

[২] উল্লেখ্য, স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনার শুরুতে আমি বুয়েটে এক বছর তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, এবং এরপর আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার সময় শুরুতে আমার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার সায়েন্সে মেজর করা, এবং সেভাবেই ব্র্যান্ডাইজে দু’বছর পড়াশুনাও চালিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝপথে আমি নৃবিজ্ঞানে মেজর করব বলে ঠিক করি, এবং সেই প্রেক্ষিতে আমার অনেক স্বজন এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।    

[৩] কথাগুলিতে সম্ভবত কবি John Milton-এর ‘On His Blindness’ নামক একটি কবিতার নিম্নলিখিত চরণের প্রতিধ্বনি রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘They also serve who only stand and wait’।