Tag Archives: নৃবিজ্ঞান পড়া

নৃবিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারে সমাবর্তন দিবসের ভাবনা

[ব্র্যান্ডাইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য][১]

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

আমি খুবই খুশি ও গর্বিত আজকের এই আনন্দময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা যারা স্নাতক হচ্ছি, সবার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বদলের কৃত্য বা ‘অবস্থান্তরে আচার’ (rite of passage)। 

ব্র্যান্ডাইজে সমাবর্তনের দিনে, মে ১৮, ১৯৮৬। সেদিন সমাবর্তনে অংশ নেওয়া অন্য অনেক শিক্ষার্থীর মত আমিও গলায় লাল ফিতা বেঁধেছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক, এমন বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবিতে।

এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে একটা ভাবনা আমার মাথায় খুব করে ঘুরছে, সেটা এই যে, আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই চলছে কোনো না কোনো ভূমিকা বদলের কৃত্য, পালা বদলের পালা।

সারা পৃথিবী জুড়েই পুরো সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন সব পালা বদলের পালা চলছে, যেগুলি অনেকক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সমাজ বা জাতিসমূহের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

এখানে আমি ভাবছি সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেইসব সমাজের কথা, যারা একাধারে সাংস্কৃতিকভাবে ও বাস্তবিক অর্থে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। 

আমি বিশেষ করে ভাবছি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষদের কথা, যারা অত্যন্ত বেদনাদাময় পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আমি যে অঞ্চলের কথা বলছি, সেখানেই আমি জন্মেছিলাম। সেখানে বেশ কিছু ক্ষুদ্র আয়তনের জাতিগোষ্ঠী রয়েছে – আমি যেগুলির একটির সদস্য – যারা বর্তমানে অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের মুখে রয়েছে।  

ব্র্যান্ডাইজে পড়তে আসার আগে আমি আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই পার্বত্য চট্টগ্রামেই কাটিয়েছিলাম। সেই সময়কালে আমি বেশ কাছ থেকেই হত্যাকাণ্ড, দাঙ্গা এবং ত্রাসের বহু ঘটনা দেখেছি বা জেনেছি। গত গ্রীষ্মে [১৯৮৫ সালে] যখন আমি বাড়ি গিয়েছিলাম, আমি চারপাশে সামরিক বাহিনীর বিশাল উপস্থিতি দেখেছিলাম, এবং যে এলাকায় আমি জন্মেছিলাম ও বেড়ে উঠেছিলাম, সেটিকে মোটেই আর পরিচিত বা নিজের বলে মনে হচ্ছিল না।  নিজেকে আমার খুব বিচ্ছিন্ন লাগছিল।

আসলে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে আরো বহু মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মনে হচ্ছে – বা তারা ভয় পাচ্ছে – যে, বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেষ্টা করছে। এই বিলুপ্তির আশঙ্কা থেকে এসব গোষ্ঠীর অনেক সদস্যই বেছে নিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ।  

আমি নিজে দশম শ্রেণীর পড়াশুনা শেষ করার আগেই আমার অনেক সহপাঠী এবং খেলার সাথী ‘জঙ্গলে’ চলে গিয়েছিল, এমনকি আমার দু’একজন শিক্ষকও তাই করেছিলেন। তাদের অনেকে ইতোমধ্যে প্রাণও হারিয়েছেন বিভিন্ন সংঘাতে, বা আটক হওয়া অবস্থায়।

অতি সাম্প্রতিক কালেও, যেমন দু’সপ্তাহ আগে [১৯৮৬ সালের মে মাসের শুরুর দিকে], আমার জন্মশহরে [অর্থাৎ খাগড়াছড়িতে] জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে আমার নিজের গ্রামের পাশে থাকা দু’টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব সহিংসতার একটা বড় কারণ হল এই যে, সরকারি উদ্যোগে সমতল অঞ্চল থেকে প্রান্তিক কৃষক শ্রেণীর অনেক মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে পাহাড়ি আদিবাসীরা ভয় পাচ্ছে যে তারা সাংস্কৃতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, এবং বাস্তবেও তাদের অনেকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আমার দৃষ্টিতে যেটা পরিতাপের বিষয়, সেটা হল, সরকার আসলে সত্যিকার অর্থে সমতল অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত ভূমিহীন মানুষদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে না। অন্যদিকে সরকার পাহাড়ি আদিবাসীদের বাস্তব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও আমলে নিচ্ছে না।  

অবশ্য সাংস্কৃতিক ও জনমিতিক বিলুপ্তির ঘটনা শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামেই ঘটছে, তা নয়। গতকাল রাতে আমি যখন উডি এলেনের একটা মুভি [Hannah and Her Sisters] দেখছিলাম, সেটির একটি চরিত্র যেভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরেছিল, তা আমাকে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছিল: “অনেকে এই ভেবে অবাক হয় যে কিভাবে লাখ লাখ লোককে মেরে ফেলার মত ঘটনা ঘটে [নাৎসিদের পরিচালিত ‘হলোকস্ট’ নামক ইহুদি নিধনযজ্ঞের প্রসঙ্গে কথাটা বলা]। বাস্তবে আসল অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে, এমন ঘটনা আরো বেশি হারে ঘটে না।”

এক অর্থে আসলে এখনো সারা পৃথিবীতেই কোনো না কোনো আকারে গণহত্যার ঘটনা ঘটে চলছে, যেমনটা ইতিহাস জুড়েও ঘটতে দেখা গেছে। এই মুহূর্তে, ঠিক এই জায়াগাতে দাঁড়িয়ে, আমি এই মহাদেশ একদা যাদের আবাসভূমি ছিল, আমেরিকার সেই আদিবাসীদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাচ্ছি।     

নৃবিজ্ঞানে আমার আগ্রহ জন্মেছিল মানবতার এই অন্ধকার দিকটার সাথে মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে। আমি নৃবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়েছিলাম এই কারণে যে, আমার মনে হয়েছে, এটা একটা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী আমাকে দেবে, যার সাহায্যে আমি নিজেকে তথা পুরো বিশ্বকে দেখতে পারব। 

আমার বিশ্বাস, নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার আওতায় প্রত্যেকটা সমাজ এবং প্রতিটা মানবগোষ্ঠীর জন্য সমান জায়গা রয়েছে। এই জ্ঞানকাণ্ড চেষ্টা করে নিরর্থকভাবে টিকে থাকা বহু মানুষ বা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অর্থময় করে তুলতে।       

আমার কিছু বন্ধুবান্ধব, এমনকি আমার নিজেরও একটা অংশ, আমাকে এই বলে অভিযুক্ত করে যে, নৃবিজ্ঞান পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আমার সামাজিক দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছি।[২] তারা বলতে চায় যে, জীবনের সব কিছু বোঝার চেষ্টা না করে আমাদের সবাইকে যার যার ভূমিকায় ‘খেলা’ চালিয়ে যেতে হবে, কেন তা করছি সেটা যদি নাও জানা হয়ে ওঠে। হয়তবা তারা আংশিক ঠিক। কিন্তু আমি এখনো নিজের এই বিশ্বাস ধরে রেখেছি যে, কোনো ক্ষেত্রে বাস্তব তৎপরতার আগে ভালো করে বুঝে ওঠার কাজটা করা জরুরি, এবং এই বিশ্বাস নিয়েই আমি আসন্ন হেমন্ত মৌসুমে বার্কলেতে নৃবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শুরু করার পরিকল্পনা করেছি। 

আমি কোনো এক কবির সেই বিশ্বাসের অংশীদার, যিনি মনে করেন যে, যারা বোঝার চেষ্টা করে এবং অপেক্ষা করে, তারাও আসলে সেবাই করে।[৩]

আমার বক্তব্য শেষ করার আগে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বৃন্দকে, যাঁরা হলেন ডেভিড মারে,  রবার্ট হান্ট, জুডিথ আরভাইন, জর্জ কওগিল এবং নিল গমবার্গ।

আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

~~~

টীকা


[১] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে অবস্থিত ব্র্যান্ডাইজ ইউনিভার্সিটিতে ১৯৮৬ সালের ১৮ই মে অনুষ্ঠিত সবাবর্তনের অংশ হিসাবে বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একজন পূর্বনির্ধারিত বক্তা হিসাবে আমাকে কিছু কথা বলতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী নিজের যে বক্তব্য আগের দিন লিখে রেখেছিলাম, সেটির বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল। মূল ইংরেজি ভাষ্যটি আগেই আমার ইংরেজি ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছে Commencement day reflections on studying anthropology শিরোনামে।

[২] উল্লেখ্য, স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনার শুরুতে আমি বুয়েটে এক বছর তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, এবং এরপর আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার সময় শুরুতে আমার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার সায়েন্সে মেজর করা, এবং সেভাবেই ব্র্যান্ডাইজে দু’বছর পড়াশুনাও চালিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝপথে আমি নৃবিজ্ঞানে মেজর করব বলে ঠিক করি, এবং সেই প্রেক্ষিতে আমার অনেক স্বজন এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।    

[৩] কথাগুলিতে সম্ভবত কবি John Milton-এর ‘On His Blindness’ নামক একটি কবিতার নিম্নলিখিত চরণের প্রতিধ্বনি রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘They also serve who only stand and wait’।

আমার আট আনার শিক্ষকসত্তা: একটি কৈফিয়ত

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতা আছে, The Road Not Taken নামে, যা প্রবাসে শিক্ষার্থী থাকাকালে একসময় আমি আবৃত্তি করতাম, একা। আমার কাছে কবিতাটির আবেদনের মূলে ছিল এর সহজ কিন্তু বিশেষ দ্যোতনায় ভরা ভাষা, এবং মানসপটে অনায়াসে এঁকে নেওয়া যায়, এমন কিছু চিত্রকল্প।[১] কবিতাটি আগে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের অনেকের নিশ্চয় মনে পড়বে নিচে তুলে দেওয়া এটির শুরুর ও শেষের দু’টি করে পঙক্তি:

Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both

I took the one less traveled by,
And that has made all the difference.

জীবনে চলার পথে প্রত্যেক মানুষকেই এমন কিছু মোড়ের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়, যেখানে সামনে এগুনোর একাধিক অজানা পথ থেকে একটি বেছে নিতে হয়। যে সময় আমি ফ্রস্টের এই কবিতাটি আওড়াতাম, আমিও ছিলাম এমন একটি মোড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে কী করব? কোথায় থাকব? এমন প্রশ্নের মুখে নিজেকে আমি বলতাম, প্রবাসে থিতু হওয়ার বদলে দেশে ফিরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হওয়াটা আমার কাছে কম কাম্য হবে না। কিন্তু কল্পনাবিলাসী মনে শিক্ষক হিসেবে যে জায়গায় নিজেকে দেখতাম, তা ঠিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছিল না। এক্ষেত্রে জাবির বদলে অন্য কোথায় নিজেকে কল্পনা করতাম, তা পরে বলছি, কিন্তু আগে একটু নজর দেব জীবনের অন্য একটি মোড়ে, যেখানে ছিলাম ১৯৯১ সালে, যখন আমি জাবিতে শিক্ষকতা শুরু করি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে আমি যোগ দিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর। সেই পদক্ষেপ একাধিকভাবে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, এবং জাবির সাথে সংশ্লিষ্টতা এখনো আমার পেশাগত আত্নপরিচয়ের অংশ হয়ে আছে। কিন্তু সেখানে আমার শিক্ষকতার মেয়াদ এক দশক পেরুতেই কাকতালীয় কিছু ঘটনার সূত্রে আমি ভিন্ন একটি পেশাগত কক্ষপথে চলে যাই, যখন ২০০১ সালের শেষ দিকে জাবি থেকে ‘লিয়েন’ নিয়ে কেয়ার বাংলাদেশে যোগ দেই। তখন শুরুতে আমি ভেবেছিলাম কর্মক্ষেত্রের সেই পরিবর্তনটা হবে সাময়িক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাবিতে আর ফেরা হয়নি আমার। এদিকে জাবি ছাড়ার এক যুগ পর,  ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, আমি নতুন করে শিক্ষকতায় ফিরে আসি, যদিও তা ছিল খণ্ডকালীন ভূমিকায়, এবং এর পাঁচ বছর পর (২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে) এই ভূমিকা থেকে আবার সরে আসি। [২]

উক্ত পটভূমিতেই নিজের ‘আট আনার শিক্ষকসত্তা’ নিয়ে আমার এই লেখা। এটিকে আমি কৈফিয়ত বলছি এ কারণে যে, বিভিন্ন সময়ে আমার একাধিক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, আমার ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক’ পরিচয়টাই তাদের কাছে বেশি বড়, এবং দু’একজন আমাকে সরাসরিই বলেছেন, জাবির চাকরি একেবারে ছেড়ে আসা আমার ঠিক হয়নি। এই যেমন ২০১৬ সালের কোনো এক সময় (সম্ভবত মে মাসে) নৃবিজ্ঞানের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী (যিনি জাবিতে পড়াশুনা করেছিলেন আমি চলে আসার পর, তবে আমার সম্পর্কে কিছুটা জানতেন ফেসবুকসহ একাধিক সূত্রে) একটি অনুষ্ঠানে মুখোমুখি আলাপ হওয়ার পর আমাকে বলে বসেন, “আপনাকে কিন্তু কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনিতো শিক্ষকতাতেই ফিরে এলেন আবার, তাহলে জাবি ছেড়েছিলেন কেন?” এ ধরনের অভিজ্ঞতার সূত্রে আমার মনে হয়েছে, যাঁরা সত্যি জানতে চান কেন আমি জাবির শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তাঁদের জন্য একটা লিখিত কৈফিয়তে হাত দেওয়া যেতেই পারে। সেই চিন্তা থেকেই এই লেখা, যেটিকে সময়-সুযোগ মিললে পূর্ণতর একটি রূপ দেওয়া যেতে পারে কালের আয়নায় নিজেকে ও নিজের পরিপার্শ্বকে দেখার একটি চেষ্টার অংশ হিসেবে।

আমাকে যাঁরা নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক-গবেষক হিসেবে চিনেছেন, কিন্তু আমার জীবনের অন্যান্য অধ্যায় সম্পর্কে জানেন না, তাঁদের অনেকে শুনলে অবাক হতে পারেন যে পেশাগত ক্ষেত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান বা শিক্ষকতা বেছে নেব, এমন কোনো স্বপ্ন বা সম্ভাবনা সামনে রেখে কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শুরু হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ক্ষেত্রে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি হেঁটেছিলাম আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সুপরিচিত ও অনেকের কাছে বিশেষভাবে কাম্য একটি মূল সড়ক ধরে, সেখানে টাঙিয়ে রাখা কিছু স্বপ্নকে সামনে রেখে, যেগুলির ত্রিসীমানায় ‘নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক’ বা স্রেফ ‘শিক্ষক’ নামক কোনো নিশানা আদৌ ছিল না!

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজের ছোটবেলার শিক্ষকদের কথা এখনো অগাধ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি (এ বিষয়ক আমার একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা রয়েছে এই ব্লগে, ফেলে আসা দিনগুলির আলোর দিশারীরা, যা আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন)। তবে প্রত্যন্ত এলাকাসমূহে গেলে শিশুদের অনেককে যেভাবে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, বড় হলে তারা শিক্ষক হবে, আমার নিজের শৈশব বা কৈশোরে তেমন কোনো সাধ ছিল না। বরং আমার মনে পড়ে, খাগড়াছড়িতে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় এক শিক্ষক যখন জানতে চেয়েছিলেন, ‘বড় হয়ে কী হবে?’, আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘পাইলট’। কেন এই উত্তর দিয়েছিলাম, বা আগে কখনো এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম কিনা, এসব এখন মনে নেই, তবে বয়স বাড়ার পর সত্যিই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না।

এদিকে ক্লাস সেভেনে থাকতেই আমি কবিতাও লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু ততদিনে আমার পরিচয় ‘ভালো ছাত্র’ নামক সামাজিকভাবে আরোপিত একটা ছকে বাঁধা পড়তে থাকে। কাজেই ক্লাস নাইনে উঠে যে ‘বিজ্ঞান শাখা’ নেব, সেটা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল একাধিক অর্থে আমার শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই (ক্লাসে আমি ফার্স্ট ছিলাম, এবং আমার বাবা ছিলেন পাহাড়ি সমাজে গড়ে ওঠা ‘বাবু’ শ্রেণির একজন প্রতিনিধি)।[৩] এর পরের প্রশ্নটা ছিল, উচ্চ মাধ্যমিকের পর “ডাক্তারি পড়বে নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং?” কেন জানি আমার ঝোঁকটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দিকেই বেশি ছিল। তাই যথাসময়ে ভর্তি হলাম বুয়েটে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম বিশজনের মধ্যে আমার জায়গা ছিল, ফলে বিভাগ নির্বাচনটাও করতে পেরেছিলাম ‘মনের মত’ করে। কিন্তু এখানেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির গতানুগতিক মাপকাঠিই আমার পছন্দ ঠিক করে দিয়েছিল। কোনটির ‘ডিমান্ড’ বেশি? ইলেকট্রিক্যাল? ঠিক আছে, সেটিই নেওয়া যাক।

বুয়েটে থাকার সময় অবশ্য আমি পড়াশুনার চাইতেও সাহিত্যচর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ছাত্র রাজনীতির প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম, এবং আমার ধারণা সেখানে থেকে গেলে আমার হয়তবা ভালো ফলাফল নিয়ে বা যথাসময়ে পাশ করে বেরুনো হত না। (এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বুয়েটে থাকাকালে আমি সাংগঠনিকভাবে ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলাম। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছে লেখা আমার একটি খোলা চিঠি ছাপা হয়েছিল সংগঠনটির সামিয়কী জয়ধ্বনি-তে, ২০১৫ সালে।) যাই হোক, বুয়েটে প্রথম বর্ষের পড়াশুনার ফাঁকেই মধ্যবিত্ত মাপকাঠিতে অনেক দূরের স্বপ্ন, এমন একটা ব্যাপার আমার নাগালে চলে আসে দৈবক্রমে।  আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশুনা করছিল, এমন এক বন্ধুর পরামর্শে আমি সেখানে আবেদন করেছিলাম, এবং আমিও সেখানে তার মতই চার বছরের একটা ফুল স্কলারশিপ পেয়ে যাই। সেই সূত্রে ১৯৮২ সালের আগস্টে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে দেশ ছাড়ি।

আমেরিকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’বছর পর্যন্ত মূলত কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী হিসেবেই আমি স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাই। আরো তিনটার মত কোর্স নিলেই বিষয়টি কাগজে কলমে আমার ‘মেজর’ হত। কিন্তু মাঝপথে গিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় এনথ্রপলজিতে, এবং অনেকটা আক্ষরিক অর্থেই একদিন ঘুম থেকে উঠে আমি ঠিক করি, এই নতুন বিষয়েই আমি মেজর করব। আমার দু’একজন বন্ধু অবশ্য আমাকে ‘ডাবল মেজর’ করার পরামর্শ দিয়েছিল, এবং একজন আমাকে পেশাগতভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর লাইনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল আমি নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশুনা শুরু করার পরও। কিন্তু ততদিনে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম এনথ্রপলজিতেই পড়াশুনা চালিয়ে যাব, এবং এ বিষয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য আমেরিকার সেরা হিসেবে বিবেচিত বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বেছে নেই ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে।

বার্কলেতে পড়াশুনা শুরু করার সময় অবশ্য আমার স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না এনথ্রপলজিতে পিএইচডি শেষ করে কী পেশা বেছে নেব। আসলে আমার এনথ্রপলজি পড়তে শুরু করার পেছনে পেশাগত বিবেচনার চাইতেও বেশি কাজ করেছিল আমার মনে জন্ম নেওয়া কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক তাড়না (এ বিষয়ে খানিকটা ইঙ্গিত রয়েছে নৃবিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারে সমাবর্তন দিবসের ভাবনা শীর্ষক আমার একটি লেখায়, যা মূলত স্নাতক পর্ব সম্পন্ন করার পর বিভাগীয় পর্যায়ের ‘কমেন্সমেন্ট’ অনুষ্ঠানে দেওয়া আমার বক্তৃতার লিখিত রূপ)। যাই হোক, কর্মক্ষেত্রগত একটা সুদূর সম্ভাবনা হিসেবে আমেরিকাতে শিক্ষকতার পথ খোলা ছিল, কিন্তু আমি যে সে দেশেই থেকে যাব, এমন কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তখন পর্যন্ত আমার ছিল না। অন্যদিকে বাংলাদেশে তখনো তুলনামূলকভাবে অপরিচিত ছিল এনথ্রপলজি, কাজেই এই বিষয়ে ডিগ্রি নিলে তা এখানে পেশাগতভাবে ঠিক কী কাজে আসবে, এ নিয়ে আমার নিজের কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

উপরে উল্লিখিত অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে একবার আমার রীতিমত ঝগড়াই লেগে গিয়েছিল মার্কিন এক ভিসা অফিসারের সাথে। তখন আমি স্নাতক পর্ব শেষ করে দেশে এসেছিলাম বার্কলেতে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শুরু করার প্রাক্কালে। যতদূর মনে পড়ে, সে সময় মার্কিন ভিসা অফিস ছিল মতিঝিলের আদমজি কোর্ট বিল্ডিং নামের একটা ভবনে। আমি ভেবেছিলাম আমার ভিসার ইন্টারভিউটা হবে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু ভিসা অফিসার যখন জানতে চাইলেন, বার্কলের পড়াশুনা শেষ করে আমি কী করব, আমি সরলভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক জানি না”। আমার উত্তর শুনে সেই ভিসা অফিসার বলে বসেন, “আমার মনে হয় তুমি আমেরিকায় থেকে যাবে।” এতে আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করি, “তোমার কেন এটা মনে হচ্ছে? আমি কি তোমাকে বলেছি যে আমি দেশে ফিরব না?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের দেশ থেকে যারা আমাদের দেশে পড়তে যায়, তাদের শতকরা ৯৫ ভাগই দেশে ফেরে না!” পাল্টা জবাবে আমিও তাঁকে উদ্ধত ভাষায় বলেছিলাম, “তোমার কেন মনে হল যে আমি সেই ৯৫ শতাংশের মধ্যে পড়ি?” যাই হোক, এসব কথা কাটাকাটিতে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে ওঠা ভিসা অফিসারকে আমি এরপর নিজের মাথা যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা রেখে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এনথ্রপলজি যেহেতু বাংলাদেশে অনেকটা অপরিচিত বিষয়, এটি পেশাগতভাবে কী কাজে আসবে, তা নিয়ে সেই মুহূর্তে আমি সত্যিই নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু পরে এ নিয়ে ভাবার সময় পাব, ইত্যাদি। আমার ব্যাখ্যা তাঁর কাছে কতটুকু সন্তোষজনক মনে হয়েছিল জানি না, তবে শেষ পর্যন্ত আমার ভিসা তিনি আর আটকাননি।

মার্কিন ভিসা অফিসারের সাথে আমার উপরে বর্ণিত কথা কাটাকাটি হয়েছিল ১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে। আমার তখনো জানা ছিল না যে আগের বছরই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়েছে। পরে, বার্কলেতে পড়াশুনা শুরু করার দেড়-দুই বছরের মাথায়, এই তথ্য আমি জানতে পারি ভিজুয়াল এনথ্রপলজি বিষয়ক একটি নিউজলেটারের মাধ্যমে। পরে সেই সূত্রে পাওয়া ঠিকানায় আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম জাবি নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে, এবং এরপর ১৯৮৯ সালে আমি সেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে সাময়িকভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি, যখন আমি বার্কলের পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে এক সেমিস্টারের বিরতি নিয়ে দেশে চলে আসি। এ ব্যাপারে জাবির যে শিক্ষক বা শিক্ষকদের সাথে আমার আলাপ হয়েছিল, তাঁরাও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু কেন জানিনা সেবার শেষ পর্যন্ত ইপ্সিত ভূমিকায় জাবিতে আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি আমার। এর বদলে আমাকে বলা হয়েছিল, আমি পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে চাইলে তখনই সেই ব্যবস্থা করা যাবে, কারণ সেসময় জাবি নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতা ছিল। কিন্তু আমার যেহেতু অচিরেই আবার বার্কলেতে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, আমি এই প্রস্তাবে সম্মত হইনি, ফলে জাবির সাথে সে যাত্রা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

যাই হোক, ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা সাত মাসের বেশি সময় দেশে কাটিয়ে আমি আবার বার্কলেতে ফিরে গিয়েছিলাম (দেশে কাটানো সময়টা আমার জন্য ছিল খুবই ঘটনাবহুল, যে বিষয়ে কিছু বিবরণ রয়েছে আমি কেন সিগারেট খেতাম শিরোনামে এই ব্লগে প্রকাশিত আমার একটি লেখায়)। কিন্তু এরপর বছরখানেকের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি, নানা কারণে আমেরিকায় থাকতে বা পিএইচডির পড়াশুনা চালিয়ে যেতে আমার আর একদম ভালো লাগছিল না (কারণগুলি এখানে বিস্তারিতভাবে নাইবা বললাম, তবে এটুকু বলি যে সেগুলির একটি ছিল নৃবিজ্ঞানের ‘উত্তরাধুনিক’ টানাপোড়েন থেকে সৃষ্ট একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট, যা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল)।[৪] কাজেই একটা পর্যায়ে উভয় মোহ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমি, এবং সে অনুযায়ী ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসি আমেরিকায় আবার ফিরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় না রেখেই। অন্যদিকে তখন পেশাগত ভবিষ্যত নিয়েও আমার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না।

দেশে ফিরে আসার পর জাবিতে শিক্ষকতার সুযোগ সম্পর্কে নতুন করে খোঁজখবর নেওয়া যেত, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার তেমন কোনো আগ্রহ তখন ছিল না, যেহেতু বিদ্যাজগতের উপর এক ধরনের মোহভঙ্গ নিয়েই আমি আমেরিকা থেকে চলে এসেছিলাম। যাই হোক, দেশে ফেরার পর সরাসরি আমি চলে গিয়েছিলাম খাগড়াছড়িতে, এবং বাড়িতে বসে পাল্টে যাওয়া ও অনেকটা অচেনা হয়ে ওঠা পরিপার্শ্বকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তবে মাঝে একবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বেড়াতে গিয়েছিলাম এক মাসের জন্য, এবং সাধারণভাবে এক ধরনের অনিশ্চিত ও বন্ধনহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। অবশ্য সীমিত পরিসরে কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডে আমি অংশ নিতে শুরু করেছিলাম, এবং এক পর্যায়ে সান্তুআ  নামে নতুন চালু হওয়া একটি সাময়িকীর একজন উদ্যোক্তা ও সম্পাদক হিসেবে খুব উৎসাহের সাথে এর পেছনে যথেষ্ট সময় দিয়েছিলাম।[৫]

উপরে বর্ণিত জীবনযাত্রার আওতায় বেশ কয়েকটা মাস কেটে যাওয়ার পর একদিন আমি খবর পাই যে জাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের দু’একজন শিক্ষক নাকি আমার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিলেন, কারণ তখনও তাঁদের শিক্ষক স্বল্পতার সমস্যা চলছিল। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ কোনো এক সময় জাবি নৃবিজ্ঞান বিভাগের তখনকার ছাত্র মনিশ চাকমার মাধ্যমে অধ্যাপক নূরুল আলম আমার কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন যেন আমি তাঁদের সাথে দেখা করি। সে অনুযায়ী আমি জাবিতে যাই, এবং সেখানকার নৃবিজ্ঞান বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কিছুদিনের আলাপ-পরিচয় ও দু’টি সেমিনার শেষে ঠিক হয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সেখানে আমি অনতিবিলম্বে যোগ দেব।[৬] এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর জাবিতে কাজে যোগ দেই আমি। যোগদানের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ক্লাস নেওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছিল আমাকে, তবে দ্রুত নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম আমি। তখন আমার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে যাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে আমি আবার আমেরিকায় ফিরে যাব, তাঁদের দু’একজন আমার জাবিতে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্তে বিস্ময় বা আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। এমন প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে নিজেকে আমি বুঝিয়েছিলাম, “যারা এভাবে ভাবে, তাদের সাথে আসলে আমার চিন্তাচেতনা মেলে না। তাই আমাকে নিজের মত করেই ভাবতে হবে, পথ চলতে হবে।”

জাবিতে যখন আমি কাজে যোগ দেই, তখন সেখানকার নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম ব্যাচের মাস্টার্স কার্যক্রম ছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে, তাই এই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আমি ক্লাসে পড়াইনি। তাদের কথা আমি এখানে উল্লেখ করছি এ কারণে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাচের একজন ছিল আইনুন নাহার, যে ১৯৯২ সালে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় এবং এক পর্যায়ে সহকর্মী হওয়ার পাশাপাশি আমার জীবনসঙ্গীও হয়ে যায়। উল্লেখ্য, পরে আমরা এক অর্থে সহশিক্ষার্থীও হয়ে উঠি, যখন কিছুটা আগে পরে একই বছর আমরা দু’জনেই ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশুনা শুরি করি (সেখানে আমি গিয়েছিলাম সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে, আর আইনুন প্রথমে আরেকটা মাস্টার্স করতে, যা সফলভাবে সম্পন্ন করার পর অচিরে সেও সেখানকার পিএইচডি শিক্ষার্থী হয়ে যায়)। সাসেক্সের প্রাথমিক পর্বের কাজ সেরে আইনুন আর আমি উভয়েই কাছাকাছি সময়ে দেশে ফিরে আসি মাঠভিত্তিক গবেষণার কাজে। আমার মাঠকর্মের মূল ক্ষেত্র ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা, আর আইনুনের বেলায় তা ছিল চট্টগ্রামের পটিয়ার একটি গ্রাম। মাঠকর্ম চলাকালে (১৯৯৬ সালের শেষদিক থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সালের প্রায় পুরোটা জুড়ে, যখন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র প্রস্তুতিপর্ব চলছিল জোরেশোরে) অধিকাংশ সময় আমরা চট্টগ্রাম শহরের একটি আস্তানা থেকে নিজ নিজ ‘মাঠে’ যাতায়াত করতাম।

আইনুনের মাঠকর্ম ঠিকমত এগুলেও নানা কারণে আমি নিজের কাজে যথাযথভাবে মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। যাই হোক, এই অবস্থায় একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিবেচনা থেকে আমি মাঠকর্মের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সাসেক্সের পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, এবং ঘটনাচক্রে ভিন্ন কারণে আইনুনও সিদ্ধান্ত নেয় যে মাঠকর্ম শেষে সরাসরি সাসেক্সে ফিরে না গিয়ে সে একটা বিরতি নেবে পিএইচডির কাজে। ফলে উভয়ে আমরা আবার জাবিতে কাজে যোগ দেই কাছাকাছি সময়ে। আমাদের এই সিদ্ধান্ত আমাদের সহকর্মী ও আত্মীয়দের অনেককেই যুগপৎ হতাশ ও বিস্মিত করেছিল, বিশেষ করে আমি দ্বিতীয়বারের জন্য পিএইচডি প্রোগ্রাম ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে। প্রাসঙ্গিক সব কার্যকারণের বিবরণ বা ব্যাখ্যায় এখানে যাব না, তবে পটভূমিটা সংক্ষেপে বলে নিলাম এ কারণে যে এটির একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে পরবর্তীতে আমার জাবি ছেড়ে কেয়ার বাংলাদেশে কাজে যোগ দেওয়ার পেছনে।

কখন কোন প্রেক্ষাপটে আমি কেয়ার বাংলাদেশে যোগ দিয়েছিলাম, তার একটা আংশিক ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে ‘আবার কিসের উন্নয়ন’ শিরোনামে আমার বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে সংকলিত একটি নিবন্ধের শেষে জুড়ে দেওয়া একটা টীকায়।[৭] সেখানে যেমনটা বলা আছে, কেয়ার বাংলাদেশ কী ধরনের সংগঠন, বা কী কাজ করে, এসব ব্যাপারে শুরুতে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কাজেই সংগঠনটির পক্ষ থেকে যখন তাদের নতুন তৈরি করা একটি পদে যোগদানের প্রস্তাব আমাকে দেওয়া হয়, প্রথম দফায় আমি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বা বিস্তারিত খোঁজখবর না নিয়ে। এটা জেনেছিলাম যে পদটি ছিল রাঙামাটি-ভিত্তিক, তবে কাজের ধরন এমন যে ঢাকায়ও এক সপ্তাহ অন্তর আসতে হবে। এটুকু তথ্যই যথেষ্ট ছিল কাজটির ব্যাপারে আমাকে অনাগ্রহী করে তুলতে, কারণ সে সময় আমি জাবি ক্যাম্পাসে থাকতাম স্ত্রী-সন্তানসহ, যাদের ছেড়ে ঢাকার বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এর কিছুকালের মধ্যেই আইনুনের সামনে একটা সুযোগ চলে আসে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডির কাজ শেষ করার (সাসেক্সের পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে যে মাঠ গবেষণা সে সম্পন্ন করেছিল, সেটিকে ভিত্তি করে)। তখন ঠিক হয় যে আইনুন সুযোগটা নেবে, আর আমি জাবিতে কর্মরত অবস্থায় ক্যাম্পাসে থেকে আমাদের ছেলে আইচুকের দেখাশুনা করব। কিন্তু আইনুন জার্মানিতে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারি, তিন বছরের সামান্য বেশি বয়সের একটা শিশুর দেখাশুনা করা একা আমার জন্য সহজ হবে না।

জাবি ক্যাম্পাসে থেকে শিশুসন্তানের একক অভিভাবকের ভূমিকায় হিমশিম খাচ্ছিলাম, এমন অবস্থায় কাকতালীয়ভাবে কেয়ার থেকে আবার আমার সাথে যোগাযোগ করে বলা হয় যে, আগেরবার যে পদে তারা আমাকে চেয়েছিল, সেটি তখনো শূন্য পড়ে ছিল, এবং তারা খুব করে চায় এটিতে আমি যোগ দেই। এ ব্যাপারে আমাকে রাজি করানোর জন্য সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তা সরাসরি জাবি ক্যাম্পাসেই চলে এসেছিলেন। তাঁরা আমাকে কিছুটা বোঝাতে সমর্থ হন যে বিবেচ্য পদের কাজ ভিন্ন ধরনের হলেও আমার জন্য তা উপভোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হবে। যাই হোক, এটিতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমি চূড়ান্ত সম্মতি দিয়ে দেই মূলত একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক একটা সুবিধার কথা ভেবে। সেটা ছিল এই যে, আমার বড় ভাই তখন কর্মসূত্রে সস্ত্রীক অবস্থান করছিল রাঙামাটিতে। তাদের নিজেদের দুই ছেলেই তখন পড়াশুনা করছিল ঢাকায়, এবং আইনুন জার্মানি চলে যাওয়ার পর আমার দাদা ও বৌদি এমনিতেই আমাকে দু’একবার বলেছিল আইচুককে যেন তাদের কাছে পাঠিয়ে দেই। এই অবস্থায় কেয়ারে যোগদানের প্রস্তাব দ্বিতীয়বার পাওয়ার পর আমার মনে হল, রাঙামাটিভিত্তিক পদটিতে যোগ দিলে আইচুককে দাদা-বৌদির তত্ত্বাবধানে রাখা যাবে, আবার আমি নিজেও যথেষ্ট সময় দিতে পারব। কাজেই আমি জাবি থেকে লিয়েন নিয়ে কেয়ারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেই। তখন ভেবেছিলাম, সর্বোচ্চ যে মেয়াদে আমি লিয়েন ছুটি নিতে পারতাম, সেই তিন বছরের মধ্যে আইনুনের পিএইচডির কাজ শেষ হয়ে আসবে, এবং এরপর আমি আবার জাবিতে ফিরে যাব। কিন্তু পরে যখন সেই সময়টা আসল, ততদিনে কেয়ারের কাজে আমি এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলাম, এবং সেখানে আমার তখনকার কিছু ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর প্রশয়ে নিজের ভূমিকাকে এতটাই অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে শুরু করি যে, আমি জাবির পদ একেবারে ছেড়ে দিয়ে কেয়ারেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

লিয়েনের সর্বোচ্চ সময়সীমা শেষে আমার কেয়ারে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অন্যান্য বিবেচনা যে ছিল না, তা অবশ্য নয়। এগুলির মধ্যে একটির কথা এখানে বলছি, যেটা ছিল আর্থিক নিরাপত্তার তাগিদ (প্রসঙ্গটা উল্লেখ করছি কিছুটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনভাতা নিয়ে নিকট অতীতে হয়ে যাওয়া অনেক আলোচনা ও বিতর্কের কথা মাথায় রেখে)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আমার মাসিক আয় আগে যা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, কেয়ারে যোগ দেওয়ার পর তা এক লাফে অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এখানে এটাও বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমি জাবিতে থাকার সময় আইনুন আর আমার যৌথ আয়ে আমাদের সংসার মোটামুটি চলে যেত ঠিকই, কিন্তু দশ বছর কাজ করার পরেও আমাদের সঞ্চয় বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। কাজেই কেয়ারে কাজ করার সূত্রে যে স্বচ্ছলতার সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল সেটি ধরে রাখা মন্দ হবে না। কেয়ারের মত প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ মেয়াদের কর্মসংস্থানের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বটে, কিন্তু দরকার পড়লে আমার জন্য আবার পদ বা কর্মক্ষেত্র পাল্টানো কঠিন হবে না, এমন বিশ্বাস আমার ছিল। সে যাই হোক, এ কথা আমি বলছি না যে আমার জাবিতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে আর্থিক বিবেচনাটাই প্রধান কারণ ছিল। বরং, আগেই যেমনটা একভাবে বলেছি, কেয়ারে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব আমি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পালন করতাম, এবং আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে আমার শুরু করা কাজগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলি মাঝপথে ছেড়ে আসতে আমার মন চায়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, একদা তরুণ বয়সের কল্পনাবিলাসী আদর্শবাদের অংশ হিসেবে যে ধরনের শিক্ষকতার ভূমিকায় নিজেকে আমি একদা কল্পনা করেছিলাম, কেয়ারে কাজ করার সুবাদে তেমন ভূমিকায় থাকা বহু মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেই এই লেখার ইতি টানছি।

আমার লেখার শুরুতেই যেমনটা উল্লেখ করেছি, জীবনের একটা বিশেষ মোড়ে দাঁড়িয়ে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আওড়ানো আমার পূর্বতন সত্তার কল্পনায় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হওয়ার স্বপ্ন একবার হলেও উঁকি দিয়েছিল। ঠিক কোন মোড়ে আমি ছিলাম, এবং কোথায় কোন ধরনের শিক্ষকতার কথা আমি ভেবেছিলাম? এ ব্যাপারে পাঠককে একটা ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমার ডায়েরিতে ১৯৮৪ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর টুকে রাখা ভাবনার কিছু টুকরা নিচে তুলে ধরছি:

[নতুন সেমিস্টারের] first day of instruction গেল আজ।

কোর্স বাছাইয়ের ব্যাপারে এই কিছুদিন আগেও নিশ্চিত ছিলাম আমি কি কি নেব না নেব। আজকে আবার দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়েছি।

[স্নাতক পর্বের পড়াশুনা শেষ করার পর] কি করতে চাই আমি?

আমার মনে হয় আমেরিকায় একজন computer scientist হওয়ার চেয়ে বড়পাড়ায় একজন স্কুলমাস্টার হলেও আমি কম সুখী হব না, যদি আমি আমার ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসকে স্বচ্ছ এবং সুদৃঢ় করে নিতে পারি।

আমার অতীতকাতর ও কল্পনাবিলাসী মনে যে ‘বড়পাড়া’য় স্কুলমাস্টার হিসেবে নিজেকে দেখতে প্রস্তুত ছিলাম আমি, সেটি হল খাগড়াছড়িতে যে গ্রামে আমি বেড়ে উঠেছিলাম, সেটির অদূরবর্তী একটি ত্রিপুরা গ্রাম, যেখান থেকে হাটে লাকড়ি বেচতে যাওয়া অনেক নারী-পুরুষকে প্রতিদিন দেখতাম ছোটবেলায়।[৮] আমার তরুণ বয়সের সেই ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নকে নাগালে আনার চেষ্টা কখনো করা হয়ে ওঠেনি – আমার মধ্যবিত্ত সত্তার দোদুল্যমান চিত্তে সেই সাহস হয়নি আর – তবে কেয়ার বাংলাদেশে কাজে যোগ দেওয়ার পর একটা সুযোগ পেয়েছিলাম ‘বড়পাড়া’র সমতুল্য বেশ কিছু প্রত্যন্ত জনপদে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে হাতে নেওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড কাছ থেকে দেখার, এবং এসব কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত কর্মীবৃন্দ ও বিভিন্ন সংগঠনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার। পরে ইউএনডিপিতে কাজ করার সুবাদেও এ ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছি।[৯] কাজেই জাবি ছাড়ার পর এক যুগ শিক্ষকতা থেকে দূরে থাকলেও শিক্ষাখাত থেকে কখনো দূরে ছিলাম না আমি, বরং কেয়ার ও ইউএনডিপিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা দেশের অন্যত্র প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে শিক্ষাখাতের হালচাল, সমস্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে বুঝতে সহায়তা করেছে।

নিজের অভিজ্ঞতা আমার মধ্যে এই বিশ্বাস আরো জোরালো করেছে যে, দেশের প্রান্তিক মানুষদের পাশে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে দাঁড়াতে চাই, তাহলে তাদের শিক্ষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ব্যাপক ও সুদৃঢ়ভাবে, এবং তা করতে হলে তাদের মধ্যে উদ্যমী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এই বিশ্বাস আমি আরো জোর গলায় প্রচার করতাম যদি একদা যেভাবে বড়পাড়া গ্রামের একজন শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করেছিলাম, তা সত্যিই বাস্তবে রূপ দিতাম কয়েক বছরের জন্য হলেও। যেহেতু সেই পথে আমি যাইনি, যদি আমি এখনো একজন পূর্ণকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই থেকে যেতাম, আমার মধ্যে একটা অপূর্ণতার বোধ ঠিকই থেকে যেত, ফলে নিজেকে ষোল আনা শিক্ষক হিসেবে ভাবতে পারতাম না। তাই আমার কল্পনার নায়কেরা এখনো ছুটে যায় বড়পাড়ার মত গ্রামে, শিক্ষকতার ব্রত নিয়ে। অন্তত এমনই দু’টি চরিত্র আমি এঁকেছি লেখার চিঠিগুলি: একটি স্বপ্নের গল্প  শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি গল্পে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আদলে শুরু করা এবং ‘নখা ত্রিপুরা’ নামের একটি চরিত্রের বয়ানে বলা সেই গল্পের শেষাংশ থেকে নেওয়া ছোট একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে আমি শেষ করছি আমার বর্তমান কৈফিয়ত (উল্লেখ্য, গল্পের শুরুতে জানা যায়, ২০৬২ সালের দিকে পৃথিবীর মানুষেরা লড়ছে ‘মড়া চোখের ভিনগ্রহী’দের সাথে। সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মঙ্গলগ্রহ অভিমুখী একদল অভিযাত্রীর মধ্যে একজন হল নখা, যে গল্পের শেষভাগে নিজেকে খুঁজে পায় বর্তমান সময়ে।):

এই পর্যায়ে আমি সত্যিই জেগে উঠি। আমি বুঝতে পারি, এতক্ষণ আসলে স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম আমি। [খাগড়াছড়ির] বড়পাড়া গ্রামে যে বাসায় আমি উঠেছি, সেখানে আমার সোলার পাওয়ারে চলা ল্যাপটপ খুলে [একটা] ছবি দেখে নিলাম। […] আমার একসময় পরিকল্পনা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হব, সেভাবেই পড়াশুনা করছিলাম খুলনায়, কিন্তু মাঝখানে অনেক কিছু ঘটে যায়। […] একসময় আমি ঠিক করি বড়পাড়া গ্রামে শিক্ষকতা করব।

~~~

টীকা

[১] কবিতাটি ও এর উপর আলোচনা ইন্টারনেটে অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। এরকম একটি প্রাসঙ্গিক সূত্র Poetry Foundation > Poem Guide: The Road Note Taken অনুযায়ী (যা আমার চোখে পড়েছে এই লেখা শেষ করার পর) ফ্রস্ট নাকি কবিতাটি লিখেছিলেন পরিহাসের ছলে, এক কবিবন্ধুর উদ্দেশ্যে!

[২] খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম পাঁচ বছর (২০১৩-২০১৮), যখন সেখানে Economics and Social Sciences বিভাগের BSS in Anthropology প্রোগ্রামের আওতায় আমি বেশ কিছু কোর্স পড়িয়েছিলাম যেগুলির মধ্যে ছিল, Language, Society and Culture; History of Anthropological Thought; Economy and Society; Introduction to Anthropology; এবং Biological Anthropology. ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও Independent University, Bangladesh বা IUB-তেও নৃবিজ্ঞান বিষয়ক দু’তিনটা কোর্স পড়িয়েছিলাম বছরখানেকের জন্য (২০১৭-২০১৮)।

[৩] বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, তবে কর্মজীবনের শুরুতে অল্প সময়ের জন্য তিনি খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন।

[৪] এ বিষয়ের উপর সাধারণভাবে আলোকপাত করা আমার একটি নিবন্ধ রয়েছে, যেখানে ‘ব্যক্তিগত’ প্রসঙ্গও একটুখানি উল্লেখ করা আছে উপসংহার অংশে। বিস্তারিত দেখুন, প্রশান্ত ত্রিপুরা (১৯৯৯) ইতিহাসের মুখোমুখি: নৃবিজ্ঞানের উত্তর-ঔপনিবেশিক সংকট, নৃবিজ্ঞান পত্রিকা [নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত জার্নাল], সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ১১-২৪ (নিবন্ধটির একটা সম্পাদিত ভাষ্য একই শিরোনামযুক্ত একটি অধ্যায় হিসাবে সন্নিবেশিত হয়েছে ২০২০ সালে প্রকাশিত আমার ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ  নামক বইয়ে)।

[৫] কেন কোন প্রেক্ষাপটে আমরা সান্তুআ-র প্রকাশনা শুরু করেছিলাম, আমাদের উদ্দীষ্ট পাঠক কারা ছিল, এসব বিষয়ে একটা ধারণা পেতে আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন, সান্তুআ, যদিও হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড়ো না নামক আমার একটি লেখা।

[৬] আমার নিয়োগ প্রক্রিয়া (যা  ‘এড হক’ ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছিল প্রাথমিকভাবে) আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার আগে জাবি নৃবিজ্ঞান বিভাগে আমাকে দু’টি সেমিনার দিতে হয়েছিল। আমার একটা পুরানো ডায়েরি অনুসারে এগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল জুন ১৩ ও ১৫, ১৯৯১ তারিখে, যখন আমি কথা বলেছিলাম যথাক্রমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ ও ‘Decolonizing anthropology’ প্রসঙ্গে।

[৭] প্রশান্ত ত্রিপুরা (২০১৫) বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, সংবেদ, ঢাকা গ্রন্থের টীকা নং ৪১ (পৃষ্ঠা ১৫২) দ্রষ্টব্য। উল্লেখ্য, কেয়ারে কাজ করার আগে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ও বিদ্যাজাগতিক পড়াশুনার সূত্রে ‘উন্নয়ন’ বিষয়ে আমার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠেছিল, তা তুলে ধরা আছে ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত Culture, Development and Identity in the Chittagong Hill Tracts শিরোনামের একটি প্রবন্ধে, যেটির লিংকসহ নির্বাচিত অংশবিশেষ রয়েছে Thoughts on Culture, Identity and Development নামক আমার ব্লগ পোস্টে।

[৮] আমার তরুণ মনের উল্লিখিত কল্পনাবিলাসের বিপরীতে বড়পাড়া গ্রামের বর্তমান বাস্তব অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা – যা কিছুটা দূর থেকেই শুনেছিলাম – আমি তুলে ধরেছিলাম ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত আমার একটি ফেসবুক নোটে, যেটির শিরোনাম ছিল ‘কালু’।

[৯] কেয়ার বাংলাদেশে কাজ করার সময় (২০০১-২০০৯) প্রথম পাঁচ বছর আমি সম্পৃক্ত ছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত CHT Children’s Opportunities for Learning Enhanced নামের একটা প্রকল্পের সাথে, যা সংক্ষেপে ‘চলেন’ (CHOLEN) নামে পরিচিত ছিল। এরপর ইউএনডিপির Chittagong Hill Tracts Development Facility-তে কাজ করার সময় (২০০৯-২০১২) আমার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল Support to Basic Education in the Chittagong Hill Tracts নামের একটা প্রকল্পের সাথে। উভয় সংগঠনেই অবশ্য আমার দায়িত্বের আওতায় অন্যান্য প্রকল্পও ছিল, এবং আমার মূল কাজ ছিল সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সমন্বয়কারীদের তত্ত্বাবধান করা, তবে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকাণ্ডে আমার একটা বাড়তি মনোযোগ সবসময় ছিল।