আমি কেন সিগারেট খেতাম

[পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালের একটি কাহিনী][১]

প্রশান্ত ত্রিপুরা

আমি সিগারেট ধরি ১৯৮৯ সালে। সময়টা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি ক্রান্তিকাল। ওই সময় দৈবচক্রে কিছু ঘটনায় আমি জড়িয়ে পড়ি, যার জের ধরে একটা পর্যায়ে আমি সিগারেট খাওয়া ধরি। সেই সময় বা পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আমি মূলত দূর থেকেই অনুসরণ করেছি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিগত দু’তিন দশকের ইতিহাসে আমি নিজে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে না পারলেও সেই ইতিহাস ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার জীবনে বিভিন্ন সময় যেসব ছাপ ফেলেছে, সেগুলো আরো অনেকের মত আমিও এখনো বয়ে চলছি। যেমন, সিগারেটের প্রতি আসক্তি আমার এখনো কাটেনি [‘এখনো’ বলতে এখানে ২০০১ সাল বোঝানো হয়েছে]। একান্তই ব্যক্তিগত এ ধরনের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গল্প বলার কোনো কারণ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমার গল্পের পেছনের গল্পটা বলার তাগিদটা ভীষণভাবে বোধ করছি একটি বই হাতে পাওয়ার পর থেকে। আমার গল্পটা শোনার পর আশা করি পাঠক বুঝবেন কেন আমি একান্তই ‘ব্যক্তিগত’ কিছু বিষয়ের অবতারণা করছি।

বেশ অনেক বছর যাবৎ একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হাতে একটি নতুন অস্ত্র তুলে নিয়েছেন: কলম। তিনি হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে এরশাদ সরকারের একটি মিশন সফল করে তোলার প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত দক্ষতা ও দাপটের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করা একজন অফিসার – মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক (তৎকালে কর্নেল)। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন  শিরোনামে তাঁর লেখা একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যা গত ১১ মে ২০০১-এর প্রথম আলো-র শুক্রবারের সাময়িকী বিভাগে পর্যালোচিত অমর একুশে বইমেলা ২০০১-এর নির্বাচিত ১০টি ‘মননশীল বই’-এর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। বইটির কথা জানার পরপরই এটি আমি জোগাড় করতে আগ্রহী হয়ে উঠি।  বইটি হাতে পাওয়ার পর আমি এটাতে চোখ বুলাতে শুরু করেছি মাত্র, তবে তার ভিত্তিতে বলা যায়, বিভিন্ন বিচারে এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। বইটির সার্বিক মূল্যায়নে আমি যাব না, কাজটা আমার চেয়ে যোগ্যতর কেউ নিশ্চয় যথাসময়ে করবেন। এখানে আমি বইটি সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন তুলে ধরব মূলত খাগড়াছড়িতে এটির লেখকের কর্মতৎপরতা একদিনের জন্য প্রত্যক্ষ করার যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে।

জেনারেল ইবরাহিমের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে। ওই বছরের আগে-পরে তৎকালীন কর্নেল ইবরাহিম ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ঘটনার কেন্দ্রীয় নায়ক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার চলমান ‘শান্তি প্রচেষ্টা’র মূর্ত প্রতীক, যা বোঝা যাবে ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ পত্রিকার ১৯৮৯ সালের ২৩ মার্চ সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপানো তাঁর বিশাল ছবি দেখলে (ওই প্রচ্ছদে জেনারেল এরশাদের ছবিও ছিল, তবে খুব ছোট আকারে, ইনসেটে; ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউর পুরো প্রচ্ছদটাই আবার জেনারেল ইবরাহিমের আলোচ্য গ্রন্থের প্রচ্ছদে পুনরুৎপাদিত হয়েছে)। আমি তখন পড়াশোনা করতাম আমেরিকায়, দেশে এসেছিলাম একটা লম্বা ছুটি কাটাতে। খাগড়াছড়ির বাড়িতে বসে এক ধরনের অলস এবং বিচ্ছিন্ন জীবনই আমি কাটাচ্ছিলাম। মাঝে মধ্যে হয়তো এদিক-ওদিক ঘুরতাম। চারপাশে কী ঘটছে বোঝার চেষ্টা করতাম। তখন চলছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক কায়দায় ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার জোর প্রয়াস, ইবরাহিম সাহেব তাঁর বইতে ‘শান্তি প্রচেষ্টা, দ্বিতীয় ধাপ’ হিসেবে  যে সময়কালকে চিহ্নিত করেছেন সেটির অন্তিম বছর। এরশাদ সরকারের লক্ষ্য ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কিছু অংশের সমর্থন নিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ গঠন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানো যে, ‘স্বায়ত্তশাসনে’র দাবি মেটানো হয়েছে।

কর্নেল ইবরাহিম পরিচিত ছিলেন একজন চৌকস সেনা অফিসার হিসেবে, যিনি এরশাদ সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে কাউন্টার-ইন্সারজেন্সি সংক্রান্ত তত্ত্বের আলোকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের ধরে বেঁধে ‘গুচ্ছগ্রামে’ নিয়ে এসে বসানো, সব ধরনের কর্মতৎপরতায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। আমি যে সময় ছুটিতে বাড়ি যাই, সে সময় তিনি অক্লান্ত জনসংযোগের কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরশাদ সরকারের পরিকল্পনা জনগণের সামনে ‘ব্যাখ্যা’ করার লক্ষ্যে তিনি দিনের পর দিন বিভিন্ন সভার আয়োজন করছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই সভাগুলো ছিল সম্প্রদায় বা শ্রেণীভিত্তিক। আজ ত্রিপুরাদের সঙ্গে, কাল মারমাদের সঙ্গে; সকালে একদল চাকমার সঙ্গে, বিকালে বাঙালি ব্যবসায়ী বা সেটলারদের সঙ্গে। এরকমই একটা সভায় আমি উপস্থিত হয়েছিলাম স্রেফ কৌতূহলবশত। আমার সঙ্গে ছিল আমার কিছু বয়োকনিষ্ঠ বন্ধু।

গিয়ে দেখি সভাটা একটা পাঠদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠিত হয়েছিল খাগড়াছড়ি হাইস্কুলের একটি শ্রেণীকক্ষে। মাস্টার মশাই স্বয়ং কর্নেল ইবরাহিম। উদ্দিষ্ট ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে জড়ো করা বিভিন্ন শ্রেণীর ত্রিপুরা নারী-পুরুষ।  ডায়াসে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কিছু নেতা ছিলেন কর্নেল সাহেবের সহকারীর ভূমিকায়। সরকার কেন কিভাবে সে বছর প্রণীত স্থানীয় সরকার পরিষদ [পরবর্তীকালের ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’] আইনের আওতায় নির্বাচন দিতে চাচ্ছে, নির্বাচন হলে কী লাভ হবে, না হলে কী ক্ষতি হবে, কেন শান্তিবাহিনী এই আইনের বিরোধিতা করছে বা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দিচ্ছে ইত্যাদি বিষয় মাস্টার মশাই বোঝাচ্ছিলেন উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের। অনেকক্ষণ ধরে চলল লেকচার। এরপর দুজন সহকারীকে দুই পাশে দুটো টুলের ওপর দাঁড় করানো হলো, যারা পর্যায়ক্রমে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিগুলো আবার তুলে ধরলেন। সবশেষে এল প্রশ্নোত্তর পর্ব, যা আসলে ছিল পরীক্ষাপর্ব। ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না, প্রশ্ন করছিলেন মাস্টার মশাই নিজে। ‘নির্বাচন হলে কী কী সুবিধা হবে বলুন তো দেখি?’ ইত্যাদি। শুরুতে স্তাবক শ্রেণীর কিছু শ্রোতা তোতাপাখির মতো আউড়ে গেলেন শেখানো বুলিগুলো, কিন্তু একটা পর্যায়ে আর কোনো উত্তরদাতা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছিলেন না। এরপর কর্নেল সাহেব শুরু করলেন দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষার্থী নির্বাচন- যেমন তিনি হয়তো দিয়াশলাই বাক্স ছুঁড়ে মারলেন, যার গায়ে লাগবে তাকে উত্তর দিতে হবে। এ তামাশা চলতে থাকল অনেকক্ষণ।

বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল। ভ্যাপসা গরমে অভুক্ত অবস্থায় সবাই নীরবে এ অপমান সহ্য করে যাচ্ছিল, তবু মাস্টার মশাইয়ের ক্লাস শেষ হচ্ছিল না। যখন পুরো শ্রেণীকক্ষে অস্বস্তিকর একটা নীরবতা নেমে এল, তাঁর চোখে পড়ল শেষ সারির বেঞ্চগুলোর একটিতে বসা আমাদের দিকে। আমার ঠিক পাশে বসা একজনের দিকে তাঁর চোখ পড়ল, তাকে বলা হলো দাঁড়াতে এবং বলতে, ‘এতক্ষণ কী আলোচনা হলো?’ সে বলল। মাস্টার মশাই হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ভুল উত্তরের জন্য নয়, ছাত্রটি উত্তর দিয়েছিল ১০০ ভাগ নির্ভুলভাবে। এটিই হয়ে গেল তার অপরাধ। মাস্টার মশাই রেগে গেলেন এ কথা ভেবে যে, যখন তিনি আহ্বান জানাচ্ছিলেন কে পড়া মুখস্থ করতে পেরেছে দাঁড়িয়ে বলার জন্য, তখন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আমার সঙ্গীটি দাঁড়িয়ে পড়েনি। ‘উত্তর জেনেও চুপ করে বসে ছিলে কেন? অসভ্য কেথাকার!’ মাস্টার মশাইয়ের এ কথা শুনে আমি নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি!’ আমার এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত এবং অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়ায় মাস্টার মশাইসহ পুরো শ্রেণীকক্ষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল।

আমি নিজেও তখন এত উত্তেজিত ছিলাম যে, আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলতে যাচ্ছি, কী করতে যাচ্ছি। চকিতে মাস্টার মশাই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কেন? এক্সকিউজ মি কেন?’ আমি বললাম, ‘অসভ্য বলে আপনার গালি দেয়াটা ঠিক হয়নি।’ তিনি বললেন, ‘উত্তর জেনেও চুপ করে বসে থাকা কেন, এখানে কি তামাশা দেখতে আসা হয়েছে?’ এর উত্তরে আমি যখন বললাম, ‘উত্তর না দেওয়ার অধিকার আমাদের আছে।‘ তিনি বললেন, ‘এখানে অধিকার নিয়ে তর্ক করতে আমরা আসিনি। আপনার ভালো না লাগলে আপনি বেরিয়ে যান।’[২] আমি তৎক্ষণাৎ আর একটি কথাও খরচ না করে শ্রেণীকক্ষ ত্যাগ করে চলে যাই কারো জন্য অপেক্ষা না করে, এবং এরপর ক্লাস আর কতক্ষণ চলেছিল, কী হয়েছিল কিছু জানার চেষ্টা করিনি। আমার কানে সারাক্ষণ শুধু একটি কথাই বেজে চলছিল, ‘এখানে আমরা অধিকার নিয়ে তর্ক করতে আসিনি’, যেটার অনুরণন আমি এখনো শুনতে পাই। আমার তরুণ বন্ধুরা, যারা পরে বলছিল যে তাদেরও উচিত ছিল আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসা, তারা আত্মপীড়নে ভুগছিল তাদের বিলম্বিত উপলব্ধির কারণে, এবং দু’একজন তাদের গ্লানি ও অপমানবোধের তাড়নায় সে রাতেই শান্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার কথা বলতে শুরু করে। আমি অবশ্য তাদের নিবৃত্ত করেছিলাম, যেহেতু যে পথে তাদের আমি ঠেলে দিতে পারতাম, সে পথ কোনদিকে মোড় নেবে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে, এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল না।

আমার সিগারেট ধরার ইতিহাস পুরোটা বলতে গেলে ওপরে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে অন্য একটি ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করতে হয়। কর্নেল সাহেবের ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসার পরও আমি কিছুটা উদ্দেশ্যহীন জীবনই কাটাচ্ছিলাম, সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতাম না বা সে  রকম কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসত না। তবে কিছুদিন পরে, ৪ মে ১৯৮৯ সালে ঘটে যায় ‘লংগদু হত্যাকাণ্ড’। এর পরিপ্রেক্ষিতে [২১ শে মে ১৯৮৯ তারিখে] ঢাকার রাজপথে দেখা যায় একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য।[৩] সেদিন লংগদু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত বিশাল সংখ্যক পাহাড়ি ছাত্রছাত্রী বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে নীরবে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে এবং এরপর সংগঠক ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে। আমিও মিছিলে উপস্থিত ছিলাম এবং তরুণ সংগঠকদের অনুরোধে সংবাদ সম্মেলনেও তাদের সঙ্গে ছিলাম। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর কয়েকজন মিলে দিচ্ছিলেন, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এক পর্যায়ে কোনো একজন সাংবাদিক যখন আমার পরিচয় জানতে চাইলেন, তখন আমি কিছু বলার আগেই আমার পাশে বসা একজন কী ভেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল উক্ত মিছিল আয়োজনকারী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট বা সে জাতীয় কিছু একটা হিসেবে। (উল্লেখ্য,

২১ মে ১৯৮৯-এর ছবি (এক ফেসবুক বন্ধুর পোস্ট থেকে নেওয়া), যা আরো বড় একটা ছবি থেকে ক্রপ করে তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। বামদিকে ব্যানারের পেছনে সানগ্লাস চোখে কিছুটা লম্বা চুলের যাকে দেখা যাচ্ছে, সেটা আমি হতে পারি, তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই।

এই মিছিল ও সংবাদ সম্মেলনের দিনটাই ছিল বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আবির্ভাব দিবস, যে সংগঠনের প্রথম রূপ ছিল এডহক ভিত্তিতে গড়ে তোলা একটি কমিটি)।

২১শে মে ১৯৮৯-এর সেই প্রতিবাদ মিছিল বা সংবাদ সম্মেলনের কোনো খবর দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে (জাতীয় দৈনিকসহ) প্রচার পায়নি বটে, কিন্তু সে রাতেই বিবিসি সহ ভয়েস অফ আমেরিকা, আকাশবাণী প্রভৃতি বিদেশি বেতার মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, ‘প্রশান্ত ত্রিপুরার নেতৃত্বে লংগুদু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি মৌন প্রতিবাদ মিছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে…।’ ব্যাপারটি তখন বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে অভিনন্দন জানানো শুরু হয়ে যায়, এবং আমি যথেষ্ট বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম এই অযাচিত ‘খ্যাতি’তে এবং এ কথাও ভেবে যে, না জানি মুল সংগঠকরা এই ভেবে ক্ষুন্ন হয় যে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসে তাদের পরিশ্রমের কৃতিত্ব কেড়ে নিয়েছি। যাই হোক, অভিনন্দনের পাশাপাশি কিছু কিছু মহলে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়ে যায় এবং খাগড়াছড়িতে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ওখানে ফিরলেই সেনাবাহিনী আমাকে আটক করবে। অনেকেই সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন কর্নেল ইবরাহিমের শ্রেণীকক্ষ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কারণে আমি ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি থেকে আমি জরুরি টেলিগ্রাম পাই, ‘এ মুহুর্তে তুমি আমেরিকার প্লেন ধরার ব্যবস্থা করো, তোমার মালামাল ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে।’[৪] যাই হোক, আমার পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ উপেক্ষা করে আমি সিদ্ধান্ত নিই কিছুদিন ঢাকায় বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের এবং প্রায় একমাস আমি একটি ছাত্রাবাসে আমার এক ধূমপায়ী বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাই।[৫] সেই সময়টাতেই শুরু হয় আমার সিগারেট আসক্তি।

আমি আমার নিকোটিন আসক্তির জন্য জেনারেল ইবরাহিমকে দায়ী করার লক্ষ্যে এ প্রবন্ধ লিখতে বসিনি। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং তাঁর ক্লাসরুম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তাঁর অজান্তে নতুন এক ভূমিকায় তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, এমনকি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ‘শান্তিচুক্তি’র পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত এক সেমিনারে একজন নির্ধারিত আলোচক হিসেবে আমি অংশ নিতে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করি অন্যান্য আলোচকের মধ্যে জেনারেল ইবরাহিমও রয়েছেন, এবং আমাদের সেশনগুলো আলাদা হলেও একটা পর্যায়ে দেখলাম তিনি মঞ্চে আমার পাশের একটি চেয়ারে বসে আছেন। পরস্পরের সঙ্গে আমরা কথা বলার চেষ্টা করিনি সেবার। উল্লেখ্য, এর বেশ ক’ বছর আগে একবার একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকি যখন জানতে পারি যে, সেখানে ইবরাহিম সাহেবও (তখন তিনি সম্ভবত ব্রিগেডিয়ার পদে ছিলেন) থাকবেন, কারণ আমার মনের মধ্যে এমন আশংকা বিরাজ করছিল যে, হয়তো তাঁর উপস্থিতিতে কোনো বক্তব্য দিতে গিয়ে আমার অজান্তেই চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ-বেদনা-গ্লানি এসে আমাকে আবেগাপ্লুত করে ফেলতে পারে। অনেকটা একই চিন্তায় চট্টগ্রামের সেই সেমিনারেও আমি আমার সেশন শেষ হওয়ার পর আর সেমিনার কক্ষে থাকিনি।

তবে পরে বুঝতে পারি, আমার জেনারেল সাহেবকে এড়িয়ে চলার নীতিটা হয়তোবা ভুল ছিল। আমার এই উপলব্ধি হয় যখন রাতে সেমিনার-পরবর্তী নৈশভোজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমাকে বলেন যে, জেনারেল ইবরাহিমের বক্তব্য শুনে একটা বিষয়ে নাকি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। ওই শিক্ষক আমাকে বলেন যে, তিনি বরাবরই বিশ্বাস করে এসেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগামে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। কিন্তু জেনারেল সাহেব নাকি সুন্দরভাবে সংশ্লিষ্ট সকল দিক তুলে ধরেছিলেন; তিনি নাকি স্বীকার করেছিলেন, ‘হ্যাঁ, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কিছু ‘ভুল’ করেছে, কিন্তু সব পক্ষই বিভিন্ন ভুল করেছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার স্বার্থে সেখানে সেনাবাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে, সব মিলিয়ে তা ছিল অপরিহার্য ও যথার্থ।’ ওই সহকর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জেনারেল ইবরাহিমের সফল ভূমিকা আমাকে ভাবাতে শুরু করে। ‘সুশীল সমাজে’ ঠাঁই করে নেয়া একজন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সেনাধ্যক্ষের প্রকৃত চেহারাটা জনসমক্ষে উন্মোচন করাটা কি সত্যিই অভদ্রজনোচিত হবে?’ ‘ওদেরও দোষ ছিল আমাদেরও দোষ ছিল’, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক নিপীড়নের প্রকৃত ইতিহাসকে আড়ালে ঠেলে দেয়ার প্রক্রিয়া চোখের সামনে ঘটতে দেখলে নীরব থাকাটা কি নৈতিক হবে? (চট্টগ্রামে একই মঞ্চে বসা অবস্থায় জেনারেল যে আমাকে ‘চিনতে’ পারেননি, সেটা আমি পরে বুঝতে পারি, যখন তিনি আমাকে তাঁর পরিচালনাধীন একটি  প্রতিষ্ঠান আয়োজিত একটি আলোচনানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তাঁর আমন্ত্রণ পত্রের ওপর হাতে লিখে দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রামের সেমিনারে আমাদের পরিচয় হয়েছিল।’)

আমার অবাক লেগেছে প্রথম আলো-র ‘নির্বাচিত ১০টি মননশীল বই’-এর তালিকায় জেনারেল ইবরাহিমের বইয়ের অন্তর্ভুক্তি দেখে। তবে যখন ভেবে দেখি, চিন্তা চেতনায় স্পষ্টতই স্বৈরাচার বিরোধী এমন একজন সহকর্মী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক) যেখানে জেনারেল সাহেবের বক্তব্যের পরিপ্রক্ষিতে এই যুক্তি মেনে নিতে শুরু করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর প্রয়োগ করা সামরিক দমন নীতি অপরিহার্য ছিল, তখন বুঝতে পারি যে, একইভাবে আরো বহু জায়গায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে এই জাঁদরেল ব্যক্তিটি ‘সুশীল সমাজে’ সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। ‘মননশীল’ বইটির দুয়েক পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল এমন কিছু বাক্য যেগুলো আসলেই চিন্তার খোরাক জোগায়। যেমন জেনারেল ইবরাহিম লিখেছেন, ‘বাঙালীদেরও দোষ ছিল, শান্তিবাহিনীরও দোষ ছিল’ (পৃষ্ঠা-২১৮)। ঠিক সেই ধরনের কথা, যেগুলো বলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত সেমিনারে আসর মাত করেছিলেন। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই যেখানে একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, সেখানে রাষ্ট্রের ‘ভুল’ আর অন্য পক্ষের হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া কোনো সংগঠনের ‘ভুল’ কি এক পাল্লায় মাপা সম্ভব? আমি জানি না, জেনারেল ইবরাহিম কোথাও স্বীকার করেছেন কিনা, হ্যাঁ, আমি নিজেও কিছু ভুল করেছি। ভুল করেছি অনেক পাহাড়ি মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকৈ উচ্ছেদ করে ‘গুচ্ছগ্রামে’ বসিয়ে, ভুল করেছি সেটলারদের মানব-ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, ভুল করেছি এরশাদ সরকারের হুকুম সোৎসাহে তামিল করে।’ আমার ধারণা তিনি করেননি, করবেন না, এবং সুশীল সমাজে’র কেউ হয়তোবা তাঁকে সেটা করার আহ্বান জানাবেন না। কিন্তু আমি এই লেখার মাধ্যমে সে আহ্বান জানাচ্ছি তাঁকে, এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সব ব্যক্তি ও পক্ষকে।

আমি আগেই বলেছি, জেনারেল ইবরাহিমের মোটামুটি বড় কলেবরের বইটির মাত্র কিছু পৃষ্ঠা আমি এ যাবৎ পড়ে দেখেছি। প্রথম আলো-তে বইটির পর্যালোচনা যিনি করেছেন, আলতাফ পারভেজ, তাঁর আলোচনায় জেনারেল ইবরাহিম সম্পর্কে এক ধরনের মুগ্ধতা এবং বইটি সম্পর্কে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে। তিনি নাকি বইটি শেষ করেছেন ‘এক বৈঠকে’। এমন মুগ্ধতা, এমন উচ্ছ্বাস, আমি মনে করি, অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেন কথাগুলো বলছি তা বোঝানোর জন্য আমি বইটির একেবারে শেষ পৃষ্ঠা থেকে একটা অংশ তুলে ধরতে চাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জেনারেল ইবরাহিম তাঁর ছয়টি মূল্যায়নের শেষটি তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘সুদূর জাপান থেকে শুরু করে কোরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, বার্মা বা মায়ানমার এসব দেশ হয়ে মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ উপচে পড়েছে উত্তর পূর্ব-ভারতে। এরই মধ্যকার একটি ক্ষুদ্র অংশ উপচে পার্বত্য চট্টগ্রামে। যদিওবা বহির্বিশ্ব তথা সভ্যতার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক চট্টগ্রামের মাধ্যমে, তথাপি মনের ভিতরে যেই মন, সেই মনে একটা টান থেকে যায় গভীরতর ও গহীনতর অরণ্য ও উচ্চতর পর্বতমালার জনগোষ্ঠীর দিকে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ও পূর্বে বসবাসরত। এই ক্ষুদ্র কথাটি ভুলে গেলে ভুল হবে।’ সুললিত, প্রায় কাব্যিক ভাষায় লেখা এই উদ্ধৃত অনুচ্ছেদের প্রতিটি লাইন জুড়ে রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ভরা অনেক শব্দ ও বাক্যাংশ, যেগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার মতো। জেনারেল ইবরাহিমের কথাটি মোটেও ‘ক্ষুদ্র’ নয়। জানি না ওপরের উদ্ধৃত বাক্যগুলোতে বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণার যে স্পষ্ট প্রতিফলন আমি দেখতে পাই, তা অন্য কোন পাঠক দেখতে পান কিনা, আলতাফ পারভেজ দেখতে পেয়েছেন কিনা।

এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রথম আলো-র ‘নির্বাচিত ১০ মননশীল বই’-এর তালিকায় অন্য যে লেখকদের নাম রয়েছে, তাঁদের একজন মোহাম্মদ রফিক। তাঁর ‘সব শালা কবি হবে’ কবিতাটির গল্প আমি শুনেছিলাম অনেকের থেকে বেশ পরে। কবিতাটি সরাসরি না পড়লেও জেনেছি কার উদ্দেশ্যে এটি লেখা ছিল। প্রথম আলো-তে মোহাম্মদ রফিকের ঠিক পাশেই এরশাদের একজন এককালীন একনিষ্ঠ অনুসারী-সহযোগীর ছবি ছাপা হয়েছে, ব্যাপারটা কি নেহায়েতই কাকতালীয়? নাকি এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের ‘সুশীল সমাজ’ পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা গোটা দেশে বহু বছর ধরে যে সামরিক স্বৈরশাসন বলবৎ ছিল তাকে মেনে নিতে, বৈধতা দিতে শুরু করেছে? সকল ‘মননশীল’ পাঠকের প্রতি এই প্রশ্ন রেখে আমি শেষ করছি আমার ‘মনের ভেতরের মনে’ লুকিয়ে থাকা একান্তই ব্যক্তিগত কিছু গল্পের পেছনের গল্প বলার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।

<>

পরিশিষ্ট

[উপরে তুলে ধরা মূল লেখার অংশবিশেষ ২০১৩ সালের মে-তে একটি ফেসুবক নোট আকারে প্রকাশের সময় যে ‘পরিশিষ্ট’ সংযোজিত হয়েছিল, সেটিই নতুনভাবে সম্পাদিত করে নিচে জুড়ে দেওয়া হল আবার।]

ঢাকায় মে ১৯৮৯-তে অনুষ্ঠিত পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মৌন প্রতিবাদ মিছিলের আগের দিনটিকে, অর্থাৎ ২০শে মে ১৯৮৯ তারিখকে, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বা পিসিপির প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। উল্লেখ্য, সেবার আমার নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিলটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক পরিসরে ‘ভুল’টি সংশোধনের বিশেষ কোনো চেষ্টা করিনি। তবে পরবর্তীতে আমি আবিষ্কার করি যে দু’একটি প্রকাশনায় (যেমন প্রদীপ্ত খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১১২) পিসিপির একজন অন্যতম ‘প্রতিষ্ঠাতা’ হিসাবে আমার নাম রয়েছে। মজার ব্যাপার হল, ২০১৩ সালের মে-তে যখন কিছু পাহাড়ি তরুণ পিসিপির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান করার জন্য চাঁদা চাইতে আমার কাছে এসেছিলেন, তখন তাঁরা কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলেন যে, আমি পিসিপির একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম বলেই তাঁরা জানেন। এছাড়া অবিভক্ত ‘পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠালগ্নে বা শুরুর দিকে সংগঠনটির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, এমন একাধিক ব্যক্তি সংগঠনটির একজন অন্যতম ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বা তুলনীয় ভূমিকার একজন হিসাবে আমার নাম উল্লেখ করেছেন, বা এখনো করেন, এটা আমার নজরে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন প্রজন্মের জন্য আমার নিজের বয়ানটাও আবার সামনে আনা দরকার বলে আমার মনে হয়েছে। এমন তাগিদ থেকেই ২০০১ সালে প্রথম আলো-তে প্রকাশিত আমার প্রতিক্রিয়ার অংশবিশেষ আগেও প্রকাশ করেছিলাম, এবং এবার পুরোটা এই ব্লগে তুলে ধরেছি।

পুনশ্চ: আমার ‘সিগারেট ধরার কাহিনী’ প্রথম প্রকাশের এক যুগ পর আমি ধূমপান ছেড়েছি!

আমি এখন আর সিগারেট খাই না। সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে নিকোটিন নির্ভরতা থেকে পুরোপুরি সরে আসতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। (২০১৩ সালে ফেসবুকে প্রথম বলা এই কথা ২০২০ সালের মে-তেও – অর্থাৎ এই লেখা বর্তমান ব্লগে দেওয়ার সময় – সমভাবে প্রযোজ্য। উল্লেখ্য, সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি নিজেকে বলেছিলাম, ১৯৮৯ সালে দৈবচক্রে যেভাবে একটা ‘বিষ’ সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি আমি, অতীতের সেই জের নিজের দেহমনে কেন আমি বহন করে চলব? তাতে করে কি একভাবে ইতিহাসের এক বিরুদ্ধ পক্ষকেই নিজের উপর ছড়ি ঘোরাতে দিচ্ছি না এখনো?  এই ভাবনা আমার সিগারেট ছাড়ার ইচ্ছাকে অনেক জোরালো করে দিয়েছিল, এবং কয়েক মাস চেষ্টার পর ২০১৩ সালের জানুয়ারি নাগাদ আমি নিকোটিন-নির্ভরতা থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে সমর্থ হই!) সবাই মিলে চেষ্টা করলে ইতিহাসের রেখে যাওয়া অনেক সামষ্টিক প্রভাব, বিচ্যুতি বা দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠাও নিশ্চয় অসম্ভব নয়?

টীকা

[১] এই পোস্টে প্রথম আলো-তে জুন ১৯, ২০০১ তারিখে প্রকাশিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক নিপীড়নের ইতিহাসকে বৈধতাদানের প্রয়াস’ শীর্ষক আমার একটি প্রতিক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে শুধুমাত্র শিরোনামটুকু পাল্টে দিয়ে, এবং সাথে ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘পরিশিষ্ট’সহ কিছু টীকা যোগ করে। ‘পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালের একটি কাহিনী’ শিরোনামটি এর আগে ব্যবহৃত হয়েছে একই লেখার ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষ্য জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে নামক একটি প্রবন্ধ সংকলনে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে। এর আগে একই লেখার সংক্ষিপ্ততর একটি ভাষ্য একটি ফেসবুক নোট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল মে ২০, ২০১৩ তারিখে। উক্ত নোটের শেষে জুড়ে দেওয়া কিছু অতিরিক্ত তথ্যেরই অংশবিশেষ ‘পরিশিষ্ট’ হিসাবে পরে যুক্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালে প্রথম আলো-র একুশে বইমেলা থেকে বাছাই করা ১০টি ‘মননশীল বই’-এর তালিকায় জেনারেল ইবরাহিমের বই দেখে যে প্রতিক্রিয়া আমি কাগজটিতে পাঠিয়েছিলাম, সেটির শিরোনামের শুরুতে ‘আমি কেন সিগারেট খাই’ কথাটি ছিল (পরে শিরোনামের এই অংশসহ মূল লেখার আরো কিছু জায়গা ছেঁটেই আমার প্রতিক্রিয়াটি একটু দেরিতে ছাপা হয়েছিল)। সেই প্রেক্ষাপটেই এই ব্লগ পোস্টের শিরোনামে ‘আমি কেন সিগারেট খেতাম’ কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য মূল লেখার পাণ্ডুলিপি বা প্রথম আলো-তে প্রকাশিত ভাষ্য কোনোটি আর আমার সংগ্রহে নেই। এক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াটির যে পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হল, বা যে সংক্ষেপিত ভাষ্যগুলি এর আগে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলির উৎস হিসাবে ব্যবহার করেছি পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা এক সময় বের করতেন এমন একটি কাগজের একটি সংখ্যা থেকে (স্বাধিকার, ২০ জুলাই ২০০১, বুলেটিন নং ১৮, বর্ষ ৭, সংখ্যা ২), যেখানে প্রথম আলো-তে প্রকাশিত আমার প্রতিক্রিয়াটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল আমার অজান্তে (কাগজটি ঠিক কারা কোত্থেকে বের করতেন, বা এখনো চালু আছে কিনা, তা আমার জানা হয়ে ওঠেনি।)

প্রথম আলো-র আর্কাইভ ঘেঁটে দেখার আগ্রহ ও সুযোগ আছে, এমন কোনো পাঠক থাকলে তাঁর জ্ঞাতার্থে আরেকটা তথ্য যোগ করব। সেটা হল, দৈনিকটির ১৯ জুন ২০০১ সংখ্যায় আমার প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হওয়ার পরের সপ্তাহে আরেকটা পাল্টা প্রতিক্রিয়া, এবং তার প্রেক্ষ্ণিতে আমার বা অন্য কারো নতুন একটা জবাব, এভাবে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি শুক্রবার বেশ কিছু চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, যেগুলির রচয়িতাদের মধ্যে ছিলেন গ্রন্থ পর্যালোচনাকারী আলতাফ পারভেজ, জেনারেল ইবরাহিম নিজে, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। আমার নিজের সম্ভবত আরো দু’টি চিঠি ছাপা হয়েছিল এভাবে।

[২] আমি পরে নিজের একটা পুরানো ডায়েরি খুঁজে পেয়েছি যেখানে একটি পাতায় ১৯৮৯ সালের মে ১ তারিখ দিয়ে লেখা আছে, “অসভ্য বলে গালি শুনতে আসিনি।” আর কিছু লেখা নেই। এটা নিঃসন্দেহে কর্নেল ইবরাহিমের সাথে আমার উত্তেজিত বাদানুবাদের একটি রেকর্ড ছিল। তার মানে ধরে নেওয়া যায় ওই ঘটনার তারিখ ছিল মে ১, ১৯৮৯।

[৩] তারিখটি আগে ২০শে মে হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু পরে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে প্রতিবাদ মিছিলটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২১শে মে তারিখে।

[৪] আমার যতদূর মনে পড়ে, মূল টেলিগ্রাম বার্তাটা ছিল অনেকটা এরকম, “Fly USA. Luggage coming.” তরুণ প্রজন্মের যাঁরা টেলিগ্রাম কী ছিল সেভাবে জানেন না, তাঁদের জ্ঞাতার্থে এখানে যোগ করা যেতে পারে যে, এটি ছিল টেলিগ্রাফ বা তার-সংযোগ নির্ভর বৈদ্যুতিক সংকেত-ভিত্তিক বার্তা বিনিময়ের একটি ব্যবস্থা। এই সেবাটি পোস্ট অফিসেই পাওয়া যেত, এবং বার্তাগুলি হত খুব সংক্ষিপ্ত, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্যের, যেগুলিতে আর্টিকল, টেন্স বা প্রিপজিশনের মত ‘বাহুল্য’ থাকত না।

[৫] ঢাকায় বসে কাটানো ধূমপান শুরুর সেই দিনগুলিতে আমি ডায়েরিতে আমার কিছু অনুভূতি, স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের কথাও লিখে রেখেছিলাম, যেগুলির দু’একটি ছিল কবিতার আকারে। এরকম দু’টি ‘কবিতার’ একটি – ‘নির্বাসিত শব্দমালা’ – একাধিক জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে, এবং আরেকটি – ‘দুঃস্বপ্ন ফুরালে আবার লিখব কবিতা’ – আমি প্রকাশ করেছি ফেসবুকে ও এই ব্লগে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান