Monthly Archives: জুন 2023

রক্তদান প্রসঙ্গে

প্রশান্ত ত্রিপুরা

পটভূমি

‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব’ – একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের এই কথাগুলি শুনে এদেশের বহু কোটি মানুষের রক্ত টগবগ করে উঠেছিল। অগণিত মানুষ স্বেচ্ছায় জীবন দিয়েছিল, যাদের রক্তে ভরে উঠেছিল বাংলাদেশের ‘মুক্তির মন্দির সোপান তল’।

জাতীয়তাবাদ ছাড়াও আরো বহু মতবাদের জন্য বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ রক্ত দিয়েছে, দিচ্ছে। কিন্তু তাতেও অনেকের বেলায় শান্তি বা মুক্তির খোঁজ মিলছে না সেভাবে।  আর একটি মতবাদ আছে – ‘মানবতাবাদ’ – যেটির আওতায় স্বেচ্ছায় রক্তদানের একটি বিশেষ আন্দোলন রয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জুনের ১৪ তারিখ – যা হল রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রে অমূল্য অবদান রাখা বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার (Karl Landsteiner)-এর জন্মদিবস – পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে।

স্বেচ্ছায় রক্ত দানের ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দাতা ও গ্রহিতাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণী ইত্যাদি পরিচয়ের চাইতেও তাদের রক্তের গ্রুপ, স্বাস্থ্যগত অবস্থা ইত্যাদি অধিকতর প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাস্তবে আমরা এখনো এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে ‘একজন মুসলমান কোনো হিন্দুর রক্ত নিতে পারে কিনা’, বা ‘নিচু জাতের কারো রক্ত নিলে একজন ব্রাহ্মণের জাত যাবে কিনা’, এমন প্রশ্ন ওঠে! সেই প্রেক্ষাপটেই কিছু প্রাসঙ্গিক কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবনা এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।[1]  

ভিতরে সবাই কতটা ‘সমান রাঙা’? 

‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘মানুষ জাতি’), কথাটি কাব্যিক বা দার্শনিক বিবেচনায় সত্য হলেও জৈব-রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি ঠিক নয়।  কারণ, বাহ্যিকভাবে সব মানুষের রক্ত লাল হলেও এটা এখন সর্বজনবিদিত যে, সবার রক্ত একই গ্রুপের নয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, A, B, O ইত্যাদি রক্তের গ্রুপ ধরে মানুষকে ভাগ করা গেলেও এই বিভাজনগুলির সাথে প্রচলিত রেইসের ধারণা (‘শ্বেতাঙ্গ’, ‘কৃষ্ণাঙ্গ’, ‘মঙ্গোলিয়ান’ ইত্যাদি) মেলে না। বরং সচরচার সব জাতিতেই সব ধরনের রক্তের লোক পাওয়া যায়, যদিও কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যেমন আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রধানত ‘ও’ গ্রুপের রক্তই রয়েছে।  

এমনিতে নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জেনেছি যে, মানুষে মানুষে যত পার্থক্যই থাকুক, একটি প্রজাতি হিসেবে আমাদের সবার মধ্যে যতটা মিল রয়েছে, সে তুলনায় অমিলের মাত্রা আসলে খুবই কম। আর ‘রক্তের দোষ’ ধরনের কথার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সামাজিক আচরণকে জৈবিক উত্তরাধিকার হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা সমাজে বিদ্যমান থাকলেও অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এটি সমস্যাজনক। কারণ মানুষ তার আচার আচরণ শেখে মূলত  সমাজ ও পরিপার্শ্ব থেকেই। আর এই বিবেচনায় মানুষে মানুষে যত বৈষম্য ও হানাহানি দেখা যায়, সেগুলির মূল নিহিত রয়েছে সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাসে, রক্তধারায় নয়!   

এক ‘অচ্ছুৎ’ প্রাক্তন শিক্ষার্থী কর্তৃক তাঁর ‘উচ্চবর্ণে’র শিক্ষককে রক্ত দেওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনি

মোহন রবিদাস (প্রকৃত নাম) হলেন সিলেটের একটি চা বাগানে বড় হওয়া একজন মানুষ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পর্বের শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন (এখানে বর্ণিত তাঁর কাহিনি তাঁর অনুমতি সাপেক্ষেই প্রকাশ করা হয়েছে)। ছোটবেলায় স্কুলে একজন শিক্ষক নাকি অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য করতেন মোহন রবিদাসকে। সেই শিক্ষক অন্য সব শিক্ষার্থীদের চড় মারতেন, কিন্তু মোহনের বেলায় তা করতেন না। বিষয়টি বুঝতে পেরে শিশু মোহনের খুব মন খারাপ থাকত। সে ইচ্ছে করেই শাস্তিযোগ্য অনেক কাজ করত, তবুও সেই শিক্ষক তাকে ছোঁতেন না, বড় জোর ডাস্টার ছুঁড়ে মারতেন!

ছেলেবেলার দুঃখকে এখনকার পরিণত বয়সের মোহন প্রকাশ করেন এভাবে, ‘আমি ভাবতাম, মার খাওয়ার অধিকারও কি আমার নেই?’ তবে তাঁর কাহিনির শেষটা খুবই চমকপ্রদ ও মর্মস্পর্শী। তাঁর মনে এখন আর কোনো ক্ষোভ বা আক্ষেপ নেই, কারণ ঘটনাচক্রে তিনি একদিন এগিয়ে আসতে পেরেছেন তাঁকে অচ্ছুৎ হিসেবে গণ্য করতেন যে শিক্ষক, তাঁরই জীবন বাঁচাতে, যাঁর চিকিৎসার প্রয়োজনে মোহন স্বেচ্ছায় রক্ত দেন একদিন! সেই শিক্ষকের শরীরের অসুখ সেরেছে হয়ত, কিন্তু তাঁর মন বা সমাজদেহ থেকে জাতিভেদ প্রথার মত দুরারোগ্য ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে, একথা কি আমরা বলতে পারি?       

রক্তদাতাদের ‘জুম্ম’ পরিচয় প্রসঙ্গ

‘জুম্ম ব্লাড ডোনরস এসোসিয়েশন’ বা ‘জুবদা’র যাত্রা নাকি শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে, যখন একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত একজনের জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। তখন কয়েকজন জুম্ম তরুণ উদ্যোগী হয়ে স্বেচ্ছা-রক্তদাতাদের জড়ো করেছিলেন, তবে তাঁদের চেষ্টা সত্ত্বেও সেই আহত ব্যক্তির প্রাণ সে-বার রক্ষা করা যায়নি। তবুও বিফল মনোরথ হয়ে বসে না থেকে সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ‘জুবদা’ নামের সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এই নামটির প্রথম আদ্যাক্ষর এসেছে ‘জুম্ম’ নাম থেকে, যা অনেকেই ব্যবহার করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসমূহের সামষ্টিক পরিচয় বোঝাতে।

আমরা জানি, জুম্ম পরিচয়ের ধারক বাহকরা অনেকে রাজনৈতিক কারণে রক্ত দিয়েছেন। জনসংহতি সমিতির যে সশস্ত্র আন্দোলন হয়েছে, সেটি চলা কালে, বা সেটির জের ধরে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আমার শিক্ষক ও সহপাঠী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গসহ অনেকেই আছেন। আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাতো আছেনই, যাঁকে অনেকেই ‘জুম্ম’ জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে স্মরণ করেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, জাতীয়তাবাদের ছকে ফেললে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আসল পরিচয় আড়াল হয়ে যায়। কারণ যাঁরা গণপরিষদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যসমূহ পড়েছেন, তাঁরা দেখে থাকবেন, তিনি সবার আগে ছিলেন একজন সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী, যিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে বাংলাদেশের শোষিত-নিপীড়িত সকল সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন, বলতেন।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আমি কখনো দেখিনি। তবে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা পড়াশুনা করতে গিয়ে জেনেছি,  যে সময় আমার জন্ম হয়েছিল, তিনি তখন জেল খাটছিলেন কাপ্তাই বাঁধের বিরোধিতা করার কারণে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কয়জন নেতা রয়েছেন যাঁরা সেই সময় জনগণের পক্ষে এমন অবস্থান নিয়েছিলেন? আমাদের দেশে ইতিহাসের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে যদি লারমার মত প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন হত, তাহলে এ পর্যন্ত সংঘটিত অনেক অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত হয়তবা এড়ানো যেত।

পুঁজিবাদ ও রক্তদান 

আমেরিকায় পড়ার সময় স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে গিয়ে আমি একবার বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম। সেটা ১৯৮৩ সালের দিকে কোনো এক সময়কার কথা। আমি ম্যালেরিয়া প্রবণ একটি দেশের মানুষ জানার পর তখন আমার রক্ত নেওয়া হয় নি।  তাতে আমি বিব্রত হয়েছিলাম, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অপমানিত বোধ করেছিলাম যখন আয়োজকরা বলে ওঠে, ‘এখানে ফ্রি কুকি রয়েছে, তা তুমি খেতে পার,’ যেনবা আমি ‘ফ্রি কুকি’র লোভেই রক্ত দিতে চেয়েছিলাম! তবে অনেকদিন পরে সেকথা মনে করে আমি ভাবছি, আসলে আমেরিকা হল পুঁজিবাদের দেশ। সেখানে হয়তবা পুরোপুরি ‘ফ্রি’ কিছু দেওয়া-নেওয়ার চল নেই, বা তা করতে দেওয়া চলে না। তাই ‘কুকি’র ব্যবস্থা ছিল!

মানুষে মানুষে রক্তের বাঁধন আরো শক্ত হোক, আরো ছড়িয়ে পড়ুক

জুবদা যেভাবে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকুক, ছড়িয়ে পড়ুক আরো ব্যাপকভাবে। রাঙামাটিসহ পার্বত্য এলাকাগুলিতে যখন পাহাড় ধসে বহু মানুষ হতাহত হয় (২০১৭ সালে), তখন অনেকেই ছুটে গিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে।  এমন যে কোনো পরিস্থিতিতে আহতদের চিকিৎসার জন্য রক্তের প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা নিশ্চয় জানতে চাই না, যার রক্ত দরকার, সে পাহাড়ি না বাঙালি। এই আদর্শের ভিত্তিতেই জুবদার কার্যক্রম এগিয়ে চলুক। আমরা যারা ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে ধারণ করি আমাদের চেতনায়, সেখানে আমাদের যেসব মূলনীতি রয়েছে – সমতা ও সহমর্মিতা, সহভাগিতা, প্রকৃতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান[2] – এগুলি সমুন্নত থাকুক জুবদা তথা জুম্ম পরিচয়বাহী সকলের কার্যক্রমে।   

‘দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা না করে রক্ত দিন, এখনই দিন, সবসময় দিন’ – এটি ছিল ২০১৭ সালের বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের স্লোগান। যথাযথ উপায়ে রক্ত সংগ্রহ করে যথাসময়ে মজুত রাখা, যথাসময়ে তা কাজে লাগানো – এসব হল দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির একটি মাত্র দিক। এমন বহু প্রস্তুতি নেওয়ার আছে, বাংলাদেশে যেগুলির ঘাটতি সামনে চলে আসে যখনই বিভিন্ন ‘প্রাকৃতিক’ বা স্রেফ মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় নেমে আসে। তবে বারবার সাধারণ জনগণের যৌথ শক্তি অনেক ঘাটতি পুষিয়ে দেয়।

জনতার শক্তির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। স্বেচ্ছাসেবার মনোভাব আরো ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সর্বস্তরে, বিপদের মুহূর্তে জাতি-ধর্ম-শ্রেণী-লিঙ্গ-দল-মত নির্বিশেষে সবাই একে অপরের পাশে দাঁড়াতে থাকুক আরো বেশি করে।

টীকা


[1] বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে জুন ১৪, ২০১৭ তারিখে মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ায় জুম্ম ব্লাড ডোনরস এসোসিয়েশন বা ‘জুবদা’-আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যেসব কথা আমি বলেছিলাম বা বলতে চেয়েছিলাম, সেগুলিরই একটি সম্পাদিত ভাষ্য হল এই লেখা, যেটির পূর্বতন সংস্করণ ইতোপূর্বে একটি ফেসবুক নোট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। জুবদার যেসব সদস্য – যেমন সুদীপ্ত চাকমা মিকাদো, জুম্ম রাজীব চাকমা ও কৌশিক চাকমা – উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোসহ বিভিন্নভাবে আমাকে এই লেখায় হাত দিতে উৎসাহিত করেছিলেন, তাঁদের প্রতি আমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে বলা বাহুল্য, আমার লেখায় প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য তাঁদের কারো কোনো দায় নেই।

[2] এ বিষয়ে আগ্রহী পাঠক চাইলে এই ব্লগে থাকা আমার একটি প্রাসঙ্গিক নিবন্ধ,  ‘আদিবাসী চেতনার সন্ধানে’, পড়ে দেখতে পারেন।