স্মৃতিতে ১৯৭৮ সাল: পুরানো সেই দিনের কথা

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

মহাকালের প্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সাল ছিল স্রেফ আরেকটি বছর। বাংলাদেশের বা বিশ্বের ইতিহাসের প্রেক্ষিতেও বছরটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, যেভাবে রয়েছে ১৯৭১ বা ১৯৪৫ সালের, যথাক্রমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির বছর হিসাবে। কিন্তু আমার তথা সতীর্থদের স্মৃতিতে ১৯৭৮ সালের একটা বিশেষ জায়গা রয়েছে, যেহেতু সে বছরই আমরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, কাগজে কলমে এই পরীক্ষার নাম ‘সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিফিকেট’ বা এসএসসি হলেও আমাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্মের বা আরো আগেকার মানুষদের কাছে এটি ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ বা সংক্ষেপে ‘ম্যাট্রিক’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। আনুমানিক ১৯৬৫ সালের দিকে শিক্ষার এই ধাপটির নতুন নামকরণ হয় ‘সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট’ পরীক্ষা হিসাবে, কিন্তু আমাদের সময়েও ‘ম্যাট্রিক পরীক্ষা’ কথাটি সাধারণভাবে চালু ছিল। 

আমি এসএসসি বা ‘ম্যাট্রিক’ পরীক্ষা দিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, তবে আমার মাধ্যমিক পর্বের শিক্ষাজীবন মূলত কেটেছিল খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে, যেটি আমাদের সময় সরকারি ছিল না। ক্লাস নাইনে ওঠার পর এই স্কুল থেকেই ১৯৭৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসাবে আমি ও আমার সহপাঠীরা নিবন্ধন করেছিলাম আমাদের তৎকালীন কুমিল্লা-কেন্দ্রিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। তবে আমরা ক্লাস টেনে ওঠার পর খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের সরকারিকরণের ফলে সৃষ্ট শিক্ষক সংকটের কারণে আমি আর আমার সহপাঠী পুলক জীবন খীসা চলে গিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে, যেখান থেকে আমরা উভয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেই।  খাগড়াছড়িতে থেকে গিয়েছিল – বা সেখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল – প্রাইমারি স্কুল থেকে সহপাঠী হিসাবে যাত্রা শুরু করা আমার খুব কাছের বন্ধু শান্তি প্রিয় চাকমা, এবং আমার হাই স্কুল পর্বের অন্য আরো অনেক সহপাঠী বন্ধু, যেমন  দীনময় রোয়াজা, রণজ্যোতি চাকমা, প্রমুখ। 

এসএসসি পাসের পর উচ্চ মাধ্যমিক বা ‘ইন্টারমিডিয়েট’ পর্বে আমি আর পুলক উভয়েই একসাথে ঢাকায় গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে, কিন্তু পুলক এক পর্যায়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে চলে যায়, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা আরো বেশ কিছু সতীর্থও ছিল। তবে আমাদের সময়কার পার্বত্য সতীর্থদের অধিকাংশই কলেজের পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিল নিজেদের এলাকাতেই। পরে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনা ও পরীক্ষা শেষে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি পাশ করা সতীর্থদের অনেকের সাথে ঢাকায় কিছুটা সময় একত্রে কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। এক্ষেত্রে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে অবস্থিত ‘ট্রাইবাল হোস্টেল’ ছিল আমাদের অনেকের কিছু সময়ের ঠিকানা, যদিও স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির পর আমাদের অনেকের পথ আলাদা হয়ে যায়। এমনকি আমাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশেও চলে যায়, যাদের সারিতে আমিও যোগ দিয়েছিলাম একটা পর্যায়ে।

উপরে উল্লেখ করা পটভূমিতে যখন তিন পার্বত্য জেলার ১৯৭৮ সালের এসএসসির ব্যাচভুক্ত সতীর্থরা প্রথমবারের মত একটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ২০২২ সালের ১লা জানুয়ারি, রাঙ্গামাটিতে, এবং সেই ধারাবাহিকতায় একই ধরনের আরেকটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় খাগড়াছড়িতে, ২০২৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি, আমার সুযোগ ছিল যাচাই করে দেখার, মাঝে বহু বছর সামনাসামনি দেখিনি, এমন সতীর্থদের প্রথম দর্শনে চিনতে পারতাম কিনা! দুর্ভাগ্যবশত এই দুটি অনুষ্ঠানের কোনোটিতেই আমার যোগ দেওয়া হয়নি, কিন্তু আগের বারের মত এবারও পুনর্মিলনী-উত্তর স্মরণিকার জন্য স্মৃতিনির্ভর একটা লেখা সাজাতে বসেছি।[*] এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের আগে একটু ফিরে তাকাতে চাই, ১৯৭৮ সালে খাগড়াছড়িতে তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে – বা আরো বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে – কি ধরনের বাস্তবতা ও প্রবণতা বিরাজ করছিল।  

কোলাজে ব্যবহৃত দুইটি ছবির একটিতে (বেলবটম পরা অবস্থায়) খাগড়াছড়ি হাই স্কুলের দুই সহপাঠী পুলক জীবন খীসা ও রণজ্যোতি চাকমার সাথে এবং আরেকটিতে (জুনিয়র ক্যাডেট কোরের ইউনিফর্মে) রাঙ্গামাটির দুই সহপাঠী ভগদত্ত চাকমা ও কানন বড়ুয়ার সাথে দেখা যাচ্ছে আমাকে (দু’টি ছবিই ১৯৭৭/৭৮-এ রাঙ্গামাটির একটি স্টুডিওতে তোলা)।

বৈশ্বিক পরিসরে ১৯৭৮ সাল

শুরু করা যাক বৈশ্বিক পরিসরের দিকে নজর দেওয়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া কিছু তথ্য পেশ করছি কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছিল স্বাগতিক আর্জেন্টিনা, তবে সেই বিশ্বকাপ জয়ী দলে উদীয়মান তারকা মারাদোনা ছিলেন না, যাঁকে কোচ বাদ দিয়েছিলেন কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে! সেই সময় অবশ্য দেশে টিভিতে সরাসরি খেলা দেখার কোনো সুযোগ ছিল বলে মনে পড়ে না, আর থাকলেও জুনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের খেলা চলাকালে আমি যেহেতু খাগড়াছড়িতেই বাড়িতে ছিলাম – যেখানে ইলেকট্রিসিটি বা টিভি কিছু ছিল না – অন্তত টিভিতে খেলা দেখার কোনো উপায় ছিল না। সে সময় খাগড়াছড়িতে বাসায় খবরের কাগজ রাখার রেওয়াজ বা সুযোগও ছিল না, ফলে পত্রিকায় বিশ্বকাপের খবর পড়ার কোনো স্মৃতিও আমার নেই। আমরা অবশ্য রেডিওতে খবর, গান ইত্যাদি শুনতাম, কিন্তু বিশ্বকাপ নিয়ে আমার বা আমার বন্ধুদের মধ্যে কোনো মাতামাতি ছিল, এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই।    

১৯৭৮ সালে বিশ্বের অনেক জায়গায় সশস্ত্র সংঘাত চলছিল। যেমন, তখন রোডেশিয়া (যে দেশটা পরে, ‘শ্বেতাঙ্গ’ শাসনের অবসানে, জিম্বাবুয়ে নাম ধারণ করে) জাম্বিয়া আক্রমণ করেছিল, ইজরায়েল হামলা চালিয়েছিল লেবাননে, আর ভিয়েতনাম ক্যাম্বোডিয়া আক্রমণ করেছিল। তখন আফ্রিকায় ‘জায়ারে’ নামে একটা দেশ ছিল, যেখান চলমান বিদ্রোহ দমনে ফ্রান্স ও ইউরোপের আরো কিছু দেশ বেশ ব্যস্ত ছিল। আমাদের আরো কাছের দেশ আফগানিস্তানে শুরু হয়েছিল ব্যাপক সংঘাত, যে পটভূমিতে সেদেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন-ঘেঁষা একটা কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। অবশ্য যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসার দু’একটি ঘটনাও ঘটেছিল একই বছর। যেমন ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, আর মার্কিন মধ্যস্থতায় মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি হয়েছিল, যার সূত্রে এই দুই দেশের সরকার প্রধান আনোয়ার সাদাত ও বেগিন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। যেহেতু খাগড়াছড়িতে থাকলে আমি রেডিওতে বিবিসির অনুষ্ঠান শুনতাম প্রায়ই, আর রাঙ্গামাটিতে বাসায় পত্রিকা পড়ার সুযোগ ছিল, এসব খবর কিছুটা পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম বলে মনে পড়ে।   

আমাদের এসএসসি পরীক্ষার বছরের শেষদিকে, ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে, একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল গায়ানার জোন্সটাউনে, যেখানে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীভুক্ত নয় শতাধিক মানুষ, যাদের সবাই বা অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক ছিল  এবং যাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল শিশু, একটা তথাকথিত ‘গণ আত্মহত্যা’র ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল। তখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত এই ঘটনার খবর আমারও নজরে পড়েছিল স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে নেই সেই সময় খবরটা আমার মনে কতটুকু কিভাবে দাগ কেটেছিল।  

১৯৭৮ সালের বাংলাদেশ

ইন্টারনেটে পাওয়া ১৯৭৮ সালের বাংলাদেশ-সম্পর্কিত কিছু তথ্যের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর এদেশে বেড়াতে আসা।  তাঁর সফর দেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল, এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশিত খবর, ছবি ইত্যাদির যেটুকু আমার নাগালে ছিল, সেসবের প্রতি আগ্রহের সাথেই নজর দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। একই বছরের মে মাসে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গ্যা শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছিল, কিন্তু এই ঘটনার খবর তখন ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল কিনা ঠিক মনে পড়ে না, আর হয়ে থাকলেও এটির প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম, এমন কোনো স্মৃতি আমার নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে প্রথমে জাগদল এবং পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে ব্যক্তিগতভাবে এসব বিষয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না।    

১৯৭৮ সালের বাংলাদেশে সামরিক শাসন বহাল থাকলেও তখন কিছু দিক থেকে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেশ মুখর ছিল মনে হয়। যেমন, জানা যায়, সে বছর দেশে মোট ৩৭টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল, যেগুলির মধ্যে ছিল ‘সারেং বৌ’ ও ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। রেডিওতে নিয়মিত প্রচারিত বিজ্ঞাপনের কল্যাণে দু’টি ছায়াছবিরই কিছু সংলাপ ও গানের সাথে আমার পরিচিতি ঘটেছিল আগেই, এবং পরে অন্তত একটি ছবি – গোলাপী এখন ট্রেনে – ঢাকায় সিনেমা হলে বসে দেখেছিলাম মনে হয়।  আমাদের এসসসি পরীক্ষার বছরে চট্টগ্রাম শহরের ‘ব্যান্ড সঙ্গীত’-এর অঙ্গনও বেশ সক্রিয় ছিল মনে হয়, যেখানে আমার প্রায় সমবয়সী আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৮ সাল নাগাদ পরিচিতি পেতে শুরু শুরু করেন (তাঁর আর আমার জন্মের সাল একই, তবে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে), যদিও তাঁর নাম বা গানের সাথে আমার নিজের পরিচয় ঘটেছে অনেক পরে।  

যে বছরের দিকে আমরা ফিরে তাকাচ্ছি, সেই ১৯৭৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশে চলমান সামরিক শাসনের আঁচ দেশের অন্যত্র যেভাবেই অনুভূত হোক না কেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে তা বেশ প্রকটভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে অন্যত্র – যেমন ‘খাহা: আমাদের স্মৃতির এক তীর্থ’ শীর্ষক আমার একটি পূর্বপ্রকাশিত নিবন্ধে – আমি কিছুটা আলোকপাত করেছি। সেই আলোচনার পুনরাবৃত্তিতে না গিয়ে এখানে শুধু একটা অংশবিশেষ তুলে ধরছি আবার:

যে সময় আমি [খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম] সেই ১৯৭৭ সাল নাগাদ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছিল, এবং নানামুখী সহিংসতার আঁচ আমাদের কিশোর মনেতো বটেই, কিছু ক্ষেত্রে গায়েও, এসে লাগতে শুরু করেছিল। … তখনকার বিভিন্ন প্রতিকূলতার ঘূর্ণাবর্তে আমরা অনেকে নানাভাবে নানাদিকে ছিটকে পড়তে শুরু করেছিলাম। অনেকে হয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু মনে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, অতীতের সেই বৈরী সময়ের ধাক্কা আমরা সামষ্টিকভাবে কতটা সামলে উঠেছি?

ব্যক্তিগত স্মৃতির ১৯৭৮  

এবার অধিকতর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। যে পরীক্ষার সূত্রে আমরা পুরানো সতীর্থরা ‘১৯৭৮ এর ব্যাচ’ হিসাবে পরিচয় দিচ্ছি, আমাদের সেই এসএসসি পরীক্ষা ঠিক কত তারিখে শুরু হয়েছিল, বন্ধুদের কারও কি মনে আছে? আমার নিজের এটা মনে ছিল না, তবে এই লেখায় হাত দেওয়ার পর নিজের পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে তখনকার প্রবেশ-পত্র খুঁজে পেয়েছি, যেখানে স্পষ্ট করে লেখা, কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে “১৯৭৮ সনের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা আগামী ৯ই মার্চ রোজ বৃহস্পতিবার হতে আরম্ভ হইবে।” ঠিক কবে পরীক্ষা শেষ হয়েছিল আমার মনে নেই, তবে  পরীক্ষা শেষে বাড়ি অর্থাৎ খাগড়াছড়ি যাব, এই চিন্তায় যে বেশ বিভোর ছিলাম পরীক্ষা চলার কালেই, তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় আমার ‘শেকড়’ নামক একটা ব্যক্তিগত কবিতা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত ৬ই এপ্রিল তারিখে রাঙ্গামাটিতে বসে লেখা ‘ফিরে যাব’ শীর্ষক একটা কবিতায়, যেখানে ফেলে আসা ঝর্ণার কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি এবং সেই ঝর্ণার কাছে থাকা নড়বড়ে ভাঙা সাঁকোতে বসে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। 

এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঠিক কবে রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম, সেই তারিখটি আমার মনে নেই, তবে ফিরে যাওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা – যা ছিল অভিনব ও ঘটনাবহুল – কোনোদিন ভুলব না। তখন রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়ির মধ্যে যাতায়তের ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পথ লঞ্চে পাড়ি দিতাম, যে পথের একটা মধ্যবর্তী জায়গা ছিল মহালছড়ি। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ বর্ষা মৌসুমে মহালছড়ি ছাড়িয়ে চেঙ্গী নদির উজানে যতদূর যাওয়া যায়, যাত্রী নিয়ে যেত। বাকি রাস্তা ঋতুভেদে ‘চান্দের গাড়ি’, নৌকা, পদযুগল ইত্যাদির মাধ্যমে পাড়ি দিতাম আমরা। যাই হোক, এসএসসি পরীক্ষা শেষে যেদিন বাড়ি ফিরছিলাম, আমার সাথে দু’টি ব্যাগ ছিল। আমাদের লঞ্চ মহালছড়ি পৌঁছার পর সেখানে খাবারের বিরতি দিয়েছিল। এরপর আবার লঞ্চে ওঠার পর উজানের শেষ ঘাটে পৌঁছালে আমি খেয়াল করি, মহালছড়িতে খাওয়ার জন্য লঞ্চ থেকে নামার পর আমার সাথে থাকা একটা ব্যাগ ভুলে খাবার দোকানে রেখে এসেছিলাম। ফলে একই লঞ্চে আবার মহালছড়ি ফিরে গিয়েছিলাম ফেলে আসা ব্যাগ পুনরুদ্ধারের আশায়।

মহালছড়ির যে দোকানে আমি খেয়েছিলাম, সেটি ছিল জামাল নামের একজন পরিচিত লোকের। তাঁর কাছে খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারি, আমার ফেলে আসা ব্যাগটা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন থানায় গিয়ে ব্যাগটা উদ্ধার করতে পারি জামাল ভাইয়ের সহায়তায়, কিন্তু এরপর অন্য একটা বিপত্তি সামনে চলে আসে। সেদিনের মত উজানের পথে আর কোনো লঞ্চ ছিল না, আর বেলা থাকতে পায়ে হেঁটে খাগড়াছড়ি যাব, এমন সময়ও আর ছিল না। এই অবস্থায় জামাল ভাই-ই আবার সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তিনি বললেন, কোনো সমস্যা নেই, তিনি থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন ভাইয়ের বাসায় বা তেমন কোথাও। কিন্তু দিনের শেষে যখন তিনি আমাকে সেই বাসায় নিয়ে যান, চাটগাঁইয়া ভাষায় ওখানকার ভাবির সাথে তাঁর আলাপের যেটুকু আমার কানে এসেছিল, তাতে বুঝতে পারি সেই ভাবির আপত্তি ছিল অচেনা কাউকে বাসায় জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে। এই অবস্থায় জামাল ভাই আমাকে আবার নিয়ে আসেন তাঁর কিছুটা জীর্ণ দশার দোকানে। সেখানেই একটা বেঞ্চে আমার রাত কাটানোর ব্যবস্থা হল, এবং জামাল ভাই নিজে ঘুমালেন মাটির মেঝেতে। ঠিক হল, পরের দিন রাঙ্গামাটি থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চের জন্য অপেক্ষা না করে আমি পায়ে হেঁটেই খাগড়াছড়ির পথে রওনা দেব একদম সকালে। তবে আমার সাথে যেহেতু দু’টি ব্যাগ ছিল, এবং একটা ছিল বেশ ভারী, জামাল ভাই একজন মুটে ঠিক করে দিলেন পরের দিন আমার ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এভাবে প্রায় পনের মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার একটা বিরল অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আমার তখনকার অভিজ্ঞতার কথা একবার ফেসবুকে বলার পর জামাল ভাইকে চিনতেন, এমন একাধিক ব্যক্তি তাঁর রান্নার স্বাদের সুখস্মৃতি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। তখন মনে হয় তাঁকে চিনতেন এমন কেউ উল্লেখ করেছিলেন যে, আমাদের সেই জামাল ভাই আর বেঁচে নেই। বলা বাহুল্য, তাঁর উপকারের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

জামাল ভাইয়ের সহায়তায় ঠিকমত খাগড়াছড়ি পৌঁছার পর সেখানে এসএসসি পরীক্ষা-পরবর্তী কিছুটা সময় ভালোই কেটেছিল আমার, তবে ‘শেকড়’-এ অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতায় দেখা যায় যে, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর পুরানো দিনের চেনা পরিপার্শ্বের সাথে নতুন করে ‘আলাপ’ জুড়ে দিয়েছিল আমার কিশোর বয়সের কবি সত্তা।  খাগড়াছড়িতে বসে ৭ই জুন ১৯৭৮ লেখা ‘ফিরে পাওয়া’ নামক কবিতায় ধরে রাখা সেই আলাপে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে, যেমন, “এতটা দিন কোথায় ছিলে?”,  “এতটা কি ফুটতো কি ফুল?”; আর আছে যার কাছে প্রশ্নগুলি করা হয়েছে, তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ, “আজ বিকেলে/ নদির তীরে/ তোমায় আবার পেলাম ফিরে।”

অচিরেই অবশ্য খাগড়াছড়ির প্রিয় পরিপার্শ্বকে ছেড়ে আবার আমাকে দূরে চলে যেতে হয়েছিল। খুব সম্ভবত জুন মাসে আমাদের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছিল। তখন মাঝে আরেকবার রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম মনে হয় প্রশংসাপত্র, মার্ক শিট ইত্যাদি জোগাড় করতে। এরপর ১৯৭৮ সালের ৬ই জুলাই তারিখে আবার বাড়ি ছেড়েছিলাম, এবং এবারের গন্তব্য ছিল রাঙ্গামাটি হয়ে ঢাকা। তখন চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে ঢাকা গেলে পথে দু’টি ফেরি পার হতে হত, যথাক্রমে গোমতী ও  মেঘনা। 

ঘটনাক্রমে এসএসসি পরীক্ষা শেষে কলেজ পর্যায়ে ঢাকার কোথাও ভর্তির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার সময়কার কিছু কথা আমি টুকে রেখেছিলাম একটা ‘ল্যাব খাতা’য়। সেখান থেকে কিছু কথা – তখন যে ধরনের বানানে লিখেছিলাম হুবহু সেভাবে – নিচে তুলে ধরা হল।  

খাগড়াছড়ী ৬-৭-৭৮

কাল যাচ্ছি রাঙামাটি। রাঙামাটি থেকে যাবো ঢাকা, ওখানকার ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে। শিগ্‌গীর বোধহয় ফিরবো না। অনেকদিন বাড়ীতে থেকে থেকে আগেকার মতো হয়ে পড়েছি, তাই বোধ হয় বাড়ী ছাড়তে চায় না মন, কোথায় জানি একটু টন্‌টন্‌ ব্যথা অনুভূত হয়।

বৃষ্টি হচ্ছে না বেশ ক’দিন, কাল বোধ হয় জীপ চলবে। কষ্ট এবং তারও চেয়ে বড় জীবনের ঝুঁকি যতই থাকুক, এই বিচিত্র যানগুলোতেই একটুখানি বসার নয়, ঝুলবার মত পরিসর না মেলার জন্যেই অনেক হতভাগাকে আফসোস করতে হয়। …

রাত ৯/১০ টার দিকে বাড়ীতে বিদায় সভা জাতীয় মজার একটা জিনিস উপহার দিলেন বাবা।

-৭-৭৮

আজ ‘রথযাত্রা’। গতকাল রিন্তু [রাজীব ত্রিপুরা, আমার ভাইদের মধ্যে সবার ছোট] বলছিল, ‘কাল তুমি যেতে পারবে না’। কারণ শুধোলাম। ‘কাল যে রথযাত্রা!’ অর্থাৎ রথযাত্রার দিন যে বৃষ্টি হয়ে থাকে এবং এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, সে সম্বন্ধে রিন্তুর মনে কোন সন্দেহ নেই। …

রাত দুটো কি আড়াইটের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। রিন্তুর গাটা একটু গরম লাগছিল। নিজের আর শান্তুর [সনজীব ত্রিপুরা, আমার আরেক ভাই] কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম, রিন্তুর জ্বর এসেছে। মাকে ডাকলাম না। রিন্তুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম। অনেক কথা মনে পড়ছিল, অনেক দৃশ্য চোখে ভাসছিল। বিদায় টিদায় জাতীয় মেয়েলী ব্যাপারে এসব হয় আমার। [আমার এই লেখাটা যদি পরিণত বয়সের হত, তাহলে ‘বিদায় টিদায় জাতীয় মেয়েলী ব্যাপার’ কথাটা অবশ্যই আমার কলম থেকে বেরুত না। কিন্তু এটা এখানে রেখে দিলাম কৈশোরে গড়ে ওঠা নিজের মননের একটা বিশেষ দিকের নমুনা হিসাবে।] …

বাইরে অন্ধকার ছিল। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল, তারপর একটানা বেশ ভারী বর্ষণ। মাঝে মধ্যে সামান্য হাল্‌কা হলেও বৃষ্টি হচ্ছিলই। মেজাজ বিগড়ে গেল। জীপ চলবে না, তাই। তার অর্থ মহালছড়ীতে নৌকোয় করে যাওয়া লাগবে এবং নিশ্চয় ধৈর্য্যের একটা পরীক্ষা দিতে হবে, তারপরও হয়তো ফার্স্ট লঞ্চ মিস করে দ্বিতীয় দফা ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে। রিন্তু জেগে উঠলো এবং গতকাল ও যা বলেছিল তা যে সত্য এবং আমার অবজ্ঞা যে অন্যায় ছিল তা সে জানিয়ে দিল আমাকে। হাতের কাছেই প্রমাণ, সুতরাং তর্ক চলে না।

ঘুম আর আসলো না। বৃষ্টি একটু পাত্‌লা হয়ে এসেছিল, অন্ধকারও ক্রমশঃ।

বৃষ্টি থামার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠলাম, রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। ছোট নদীটার তীরে গেলাম, সাঁকো তৈরীর কাজ প্রায় শেষ। বেশ লাগছিল। বাড়ী ফিরে দেখি মায়ের খাবার তৈরী, খেয়ে দেয়ে তৈরী হলাম। কিন্তু বৃষ্টি আবারও শুরু হয়ে গেছে। খারাপ লাগলো, তবু কিছুই করার নেই।

যাবার জন্য বেরুচ্ছি, সাথে কালু [আমার সমবয়সী এক গৃহকর্মী]। ‘আতয় কামা’ [এক কাকা সম্পর্কের পড়শি]  আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দিলেন। টাকাটায় তাঁর সংসার চলত এক সপ্তার মত। কিন্তু স্নেহের দান, আত্মীয়তার স্বীকৃতি – প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য ছিল না আমার। সবাইকে প্রণাম করে চলে এলাম।

হা-ক্‌চাক [‘লাল মাটি’]-এর বাঁকে এসে শেষবারের মত দেখে নিলাম গ্রামটা, বাড়ীটা, ছোট নদীটা। কে জানে, কত পরে এখানে আসবো আবার!

[আমার দিনলিপিতে এরপর একটা দেশি নৌকায় করে মাইসছড়ি পর্যন্ত যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।] [মাইসছড়িতে পৌঁছার পর আমরা দেখলাম, মহালছড়ি থেকে] লঞ্চ ছাড়ার তখন মাত্র দু’ঘণ্টা বাকী। নৌকো মহালছড়ী পৌঁছুবে তিন ঘণ্টা পরে। তাই প্রায় সবাই নৌকো থেকে নেমে পড়লো। হেঁটে গেলে নাকি লঞ্চ ধরা যাবে।

আমরাও বাকী যারা ছিলাম নৌকোয়, সবাই নেমে পড়লাম ভাড়া চুকিয়ে। কলা-টলা কিছু খেয়ে নিলাম কিনে। তারপর সেই আদিম যুগের মতই চরণযুগলের উপর নির্ভর করে আমরা ১৫-২০ জন লোক যাত্রা শুরু করলাম।

পথের অবস্থা যেরকম, তাতে ধান রোয়া যায়। সুতরাং ৭ মাইল রাস্তা দু’ঘণ্টায় পেরুনোর আশা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।

চলতে চলতে আমরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। আমি প্রাণপণে সামনের দলের সাথে তাল মিলাতে চেষ্টা করলাম, যতদূর সম্ভব জোরে হেঁটে, কখনো দৌড়িয়ে। 

শেষ পর্যন্ত কিন্তু পেছনে পড়ে গেলাম এবং একা একাই রাস্তা চলতে লাগলাম। এক জায়গায় পৌঁছে ভাবলাম, পথ বুঝি আর বেশী নেই। একজন লোককে জিগ্‌গেস করে জানতে পারলাম, আরও তিন মাইলের বেশী। শুনে হাঁটার গতি কমে এলো। গায়ে আর এতটুকু শক্তিও ছিল না। তবু উপায় নেই।

[একটা পর্যায়ে উল্টো দিক থেকে আসা স্বপ্ননিকা নামে আমার এক পূর্বপরিচিত ত্রিপুরা মেয়ের সাথে দেখা হল পথে।]  জানতে পারলাম লঞ্চ সে দেখে এসেছে ঘাটে অর্থাৎ তখনো ছাড়েনি। পথ নাকি মাইল দেড়েক হবে আরও। সুতরাং শক্তি সঞ্চয় করে আবার দৌড়ুতে থাকলাম।

একটা “ধর্মঘর” [ধর্মীয় দায়িত্ব হিসাবে মারমাদের স্থাপিত পথচারীদের বিশ্রামাগার] দেখলাম। তেষ্টায় আর ক্লান্তিতে রাস্তার উপর শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। ধর্মঘরে উঠে পানি খেলাম। পানি খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম আমার হাত-পা কাঁপছে। পানি খেয়ে একটু শক্তি ফিরল বোধ হয়। ভারী পা দুটোকে কোনরকমে চালিয়ে দিলাম।

লঞ্চঘাটের কাছাকাছি গিয়ে লঞ্চের শব্দ শুনলাম। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম। নিজেকে মনে হলো খুব ভাগ্যবান, কারণ হাঁপাতে হাঁপাতে যখন লঞ্চের কাছে পৌঁছলাম, তখন লঞ্চের সিঁড়ি তোলা হচ্ছিল মাত্র, লঞ্চ ছেড়ে দেয় নি।

লঞ্চে উঠেই পাটাতনের উপর ব্যাগটা রেখে হাঁপাতে লাগলাম। কেবিনে জায়গা ছিল না।

খিদে পেলেও ভাত খাওয়ার কোন উপায় ছিল না।

একরাশ ক্লান্তি আর এক পেট খিদে নিয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছুলাম।

আগেই উল্লেখ করেছি, আমার সহপাঠী বন্ধু পুলক আর আমি দু’জনেই ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম উচ্চ মাধ্যমিক পর্বের পড়াশুনার জন্য। তবে পুলক কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে চলে যাওয়ার পর রেসিডেন্সিয়ালের হোস্টেলে থাকা অবস্থায় আমাকে একাই খাগড়াছড়ির জন্য তথা সেখানে ফেলে আসা বন্ধুদের কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হতে হত। সেই সময়কার কিছু অনুভূতি তুলে ধরে এই লেখার সমাপ্তি টানছি ১৯৭৯ সালে ঢাকায় লেখা এবং আমার ‘শেকড়’ নামক সংকলনে অন্তর্ভুক্ত তিনটি কবিতার অংশবিশেষ শিরোনামসহ নিচে তুলে ধরার মাধ্যমে, যে কবিতাগুলির মধ্যে শেষ দু’টি লেখা হয়েছিল যথাক্রমে আমার খাগড়াছড়ির দুই পুরানো সহপাঠী বন্ধু দীনময় ও পুলকের উদ্দেশ্যে:

ওপার

এই মাঠটাকে হঠাৎ, কাজ করতে করতে,

মনে হল বড় বেশি ফাঁকা, ধু ধু –

চলে গেলাম নদিটার ওপাশে,

ওইপারের সবুজ বনে, নীল পাহাড়ে।

সেখানে আমি গত দিনগুলোতে

ফসল ফলিয়েছিলাম,

গতকালও আমি আদিবাসী ছিলাম –

সেখানে জুমচাষ করেছি।

প্রিয় দীন, মনে পড়ে?

দিনটা বৈসুর ছিল, মনে আছে বুঝি?

ঐ যে ঝর্ণার ডাকে বেরিয়েছিলাম?

সবুজ সবুজ সেই পাহাড়িয়া গ্রাম?

হায়, ওই দিনগুলো আজো কেন খুঁজি!

প্রিয় পুলক

জালালকে দেয়া তোমার একটা পুরনো চিঠি

চোখে পড়ল।

হঠাৎ আমার কি মনে হল জান?

মনে হল,

আমরা বুঝি কাছের জিনিসকে অবজ্ঞা করে

দুরের আকাঙ্ক্ষায় ছুটছি।

মনে হল সাগরের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি

ঝর্ণাকে ভুলে গিয়ে,

ঝর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে।

টীকা   


[*] এই লেখাটির মূল ভাষ্য ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৮-এর এসএসসি ব্যাচের পুনর্মিলনী উপলক্ষে পরবর্তীতে পরিকল্পিত একটি স্মরণিকার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। স্মরণিকাটি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়ে থাকার কথা, যদিও তা আমি হাতে পাইনি। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটিতে একই ব্যাচের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের পর যে স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিতে সংকলিত আমার লেখাটিও এই ব্লগে রয়েছে, যেটির শিরোনাম/লিংক হল:  ‘আমার কৈশোরের রাঙ্গামাটি’

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান