Monthly Archives: ডিসেম্বর 2020

‘শিক্ষকমহ’ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

শিক্ষকদের শিক্ষক তথা আমার বাবার শিক্ষক ‘বিকেজে’[১]

শিরোনামে ব্যবহৃত ‘শিক্ষকমহ’ শব্দটা ব্যাকরণসম্মত কিনা জানি না, কিন্তু এটিকে আমি ব্যবহার করতে চাই ‘পিতামহ’ শব্দের আদলে, শিক্ষকদের শিক্ষক অর্থে। যাঁর জন্য এই উপাধি হাজির করেছি – ‘বিকেজে’ বা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর – তিনি এটি গ্রহণ করবেন কিনা তাও বলতে পারছি না। তবে এটি যদি ব্যুৎপত্তিগতভাবে যথার্থ নাও হয়, এটিকে তিনি বা অন্য কেউ নিশ্চয় আপত্তিকর মনে করবেন না। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নিজেই ভাষিক পরীক্ষানিরীক্ষার একজন পথিকৃৎ, তাই তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে নিয়ে দু’টি কথা বলতে গিয়ে একটা উদ্ভাবিত উপাধি ব্যবহারের ঝুঁকি নিলাম। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত রয়েছেন বা ছিলেন, এমন বহুজনকে আমি চিনি, যাঁদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আমার নিজের বেলায় অবশ্য তাঁকে এই ভূমিকায় পাইনি কখনও, তবে একদিন একটা চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারি, যা হল এই যে, তিনি ছিলেন আমার বাবারও একজন শিক্ষক! বিষয়টা পরে খুলে বলছি, তবে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আমার বাবা নিজেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে, এবং এমনিতেও তাঁকে (এবং মাকেও) আমি আমার প্রথম জীবনের শিক্ষকদের অন্যতম হিসেবে দেখি। কাজেই সব মিলিয়ে কেন আমার মাথায় ‘শিক্ষকমহ’ উপাধিটা এল, তা নিশ্চয় এখন বোঝা যাচ্ছে।    

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা ‘জাবি’তে আমার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুবাদে। সেখানে তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতেন নৃবিজ্ঞান বিভাগে, যেটির প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান ছিল। জাবিতে যোগদানের পর আমি লক্ষ্য করি, সেখানে তিনি বিকেজে নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। এক সময় আমি নিজেও অভ্যস্ত হয়ে উঠি এই নাম ব্যবহারে। তাঁর দু’একজন শিক্ষার্থী বোখাজা নামও ব্যবহার করতেন।  তবে আরো অনেকের মত সামনাসামনি আমিও তাঁকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতাম, এখনও করি, যদিও আমি নিশ্চিত নই এটি নিয়ে তাঁর কোনো আপত্তি আছে বা কখনো ছিল কিনা। যাই হোক, বিকেজে অনেকদিক থেকেই ব্যতিক্রম ছিলেন, যেমন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সব শিক্ষার্থীদের তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, যে রীতি তাঁর অনেক শিক্ষার্থী – যাঁরা পরে শিক্ষক হয়েছেন – অনুসরণ করেন। আমিও বর্তমানে তা করি [২০১৬ সালে, যখন এই প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয়, আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলাম], তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় সেটা কখনো করিনি।

আমি জাবিতে যোগদানের পর থেকেই বিকেজের সাথে নিয়মিত দেখাসাক্ষাত হত আমার, জাবিতে যেমন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরিচালিত ‘সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রে’। সেখানে বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠিত হত, যেগুলিতে আমি যোগ দিতাম সুযোগ পেলে। সেই কেন্দ্র থেকে দুটি গবেষণা সাময়িকীও প্রকাশিত হয়ে আসছে নিয়মিত, একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে [যথাক্রমে সমাজ নিরীক্ষণJournal of Social Studies], যেগুলির পরিচয় এখানে নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। দু’টিতেই আমার একটি করে লেখা বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালে, আমি জাবিতে যোগ দেওয়ার এক বছরের মধ্যে, যেগুলি ছিল যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজিতে আমার শিক্ষকজীবনের প্রথম প্রকাশনা।  উল্লেখ্য, উভয় প্রবন্ধই ছিল সংশ্লিষ্ট সাময়িকীগুলির নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যার জন্য লেখা। যেমন,  ইংরেজিতে রচিত প্রবন্ধটা ছিল Journal of Social Studies-এর Ethnicity and Nationalism-বিষয়ক বিশেষ সংখ্যার জন্য লেখা। প্রসঙ্গত, বিশেষ সংখ্যার প্রথম লেখা হিসেবে জায়গা পাওয়া আমার প্রবন্ধটি অনেক পাঠকের নজর কেড়েছিল, যাঁদের একজন ছিলেন ভেলাম ভ্যান সেন্দেল, যিনি পরে নিজেই উদ্যোগী হয়ে আমাকে দিয়ে এটির বাংলা অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর সম্পাদিত বাংলার বহু জাতি নামের একটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে।[২] আমি এসব তথ্য উল্লেখ করছি বোরহান উদ্দিন খানের প্রতি আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক ঋণের উদাহরণ হিসেবে। আর এই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের বইমেলায় যখন বহুজাতির বাংলাদেশ  নামে আমার একটি প্রবন্ধসংকলন প্রকাশিত হয়, বইটির কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের নাম উল্লেখ করেছি।[৩] অবশ্য এজন্য তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে পারিনি, যে ত্রুটি আরো বেড়েছে বইটির একটি সৌজন্য সংখ্যা এখনো তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে না পারার কারণে; আর যদি তা করতে পারার আগেই এই লেখাটি তাঁর নজরে পড়ে, সেজন্য অগ্রিম মার্জনা চেয়ে রাখছি।   

শেষ করব বিকেজেকে কোথায় কিভাবে আমার বাবা (প্রয়াত ব্রজেন্দ্র নাথ ত্রিপুরা) শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, সে গল্প বলে, যেটি আগেই প্রকাশিত হয়েছে আমার একটি ফেসবুক নোটের অংশ হিসেবে। গল্পটা বেশ মজার, যা বাবা প্রথম বলেছিলেন আমার স্ত্রী আইনুন নাহারকে, যার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন বিকেজে। বাবা চট্টগ্রামের স্যার আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নাকি সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন (বাবা বয়সে বিকেজের থেকে মাত্র বছর দুয়েক ছোট ছিলেন, তবে তাঁর নিজের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল বেশ দেরিতে – সেটা আরেক কাহিনী – তাই এক্ষেত্রে বিকেজে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন)। সে সূত্রে বিকেজে সম্পর্কে বাবা যে গল্পটা বলেছিলেন, খুব সংক্ষেপে সেটা হল এরকম: স্যার আশুতোষ কলেজে গিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নাকি বাংলায় লেকচার দিতে শুরু করেছিলেন (যা নিশ্চয় একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিল), তাতে তাঁর সম্পর্কে কলেজে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তিনি নিশ্চয় ইংরেজিতে কাঁচা! এ সম্পর্কে বাবা যোগ করেছিলেন, ‘পরে আমরা জানতে পারি, তিনি আসলে একজন সুলেখক, এবং বুঝতে পারি যে তাঁর বাংলায় লেকচার দেওয়াটা ছিল ইচ্ছাকৃত।’ এ বিষয়ে বিকেজের নিজের কোনো সুনির্দিষ্ট স্মৃতি বা ব্যাখ্যা থাকলে তা সহসা জানা যাবে আশা করছি।

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বহু লেখাই আমার এখনো পড়া হয়নি, তবে বিক্ষিপ্তভাবে কিছুটা পড়েছি – প্রবন্ধ থেকে শুরু করে শিল্পসমালোচনা, এমনকি কবিতা ও গল্প – যদিও তিনি কোনো স্মৃতিচারণ লিখেছেন বা লিখছেন কিনা, তা আমার জানা নেই। তেমন কিছু পেলে তা আগ্রহ নিয়েই পড়ব, তবে এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে থাকা তাঁর একাধিক গ্রন্থের একটি থেকে এখানে প্রাসঙ্গিক এমন একটা উদ্ধৃতি তুলে ধরে এই সংক্ষিপ্ত লেখার ইতি টানছি।  উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে তাঁর ‘অপ্রতিরোধ্য রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ থেকে:[৪]

কলোনীর লাঞ্ছিত, অবমানিত রবীন্দ্রনাথ … কলোনীর ফ্রেমের বাইরে নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন। এই উপস্থাপিতকরণের মধ্যে আছে গন্তব্যের বহুমুখিতা এবং মনুষ্যত্ব; কিন্তু সেইসঙ্গে আছে ভাবালুতা…। মনুষ্যত্ব তাঁর কাছে এক সংশয়বাদীর অবস্থান : এই বোধ কি ধরা পড়ে না তাঁর অন্তিম পর্যায়ের কাজ থেকে? তাঁর বিশ্বাসের মধ্যে কোথাও কি একটা অবিশ্বাস কাজ করে, সেজন্য তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেন, উত্তর পান না নিষ্ঠুর ইতিহাস থেকে। ইতিহাস হয়তো নিষ্ঠুর, মনুষ্যত্বের রাস্তা হয়তো রক্তাক্ত। রবীন্দ্রনাথ জেনেই সেদিকে হাঁটছেন ধীর এবং অবিচল পায়ে, আশি বছর ধরে, যদি পোঁছানো যায় বহুমুখী গন্তব্যে।

বিকেজে নিজেও আশিটা বছর ধরে পথ হেঁটে চলছেন, পেরিয়ে এসেছেন ইতিহাসের বহু রক্তাক্ত বাঁক। অনিশ্চিত এক মোড়ে দাঁড়ানো আজকের বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সামনে কি কোনো বহুমুখী গন্তব্য দেখতে পান তিনি?  কি ধরনের প্রশ্ন এখনো খেলা করে তাঁর নিজের মনে?

বিদায় শিক্ষকমহ[৫]

[বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর] স্যারের সাথে আমার নিজের শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, তাঁরই ছোটভাই নৃবিজ্ঞানী হেলালউদ্দিন খান আরেফিনের মৃত্যুর দিন। সেই মৃত্যুসংবাদ শোনার পর পরই [আমার স্ত্রী] আইনুন আর আমি গিয়েছিলাম আরেফিন ভাইয়ের বাসায়, এবং আমার মনে আছে স্যারকে আমি হাত ধরে লিফটে করে উপরে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন তাঁর সাথে খুব বেশি কথা হয়নি, তবে বলেছিলাম একদিন তাঁর বাসায় যাব। সেই কথা আর রাখা হয়নি। আমরা জানতাম তিনি অসুস্থ, এবং আইনুন আর আমি অনেকবার আলাপ করেছি, স্যারকে একদিন দেখতে যাব। [তাঁর মৃত্যুর] মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগেও একই কথা ভেবেছিলাম আমরা, কিন্তু সেই দেখতে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।  

আমার নিজের অন্য একটা তাগিদ ছিল স্যারকে দেখতে যাওয়ার। বহুজাতির বাংলাদেশ, জাতিরাষ্ট্রের কিনারায় ও  ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ শিরোনামে আমার যে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে [যথাক্রমে ২০১৫, ২০১৮ ও ২০২০ সালে], সেগুলির প্রত্যেকটিতেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে আমি স্যারের নাম উল্লেখ করেছি (দুইটিতে সরাসরি, একটিতে পরোক্ষভাবে), কেননা এগুলিতে প্রকাশিত একাধিক নিবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত জার্নালে [অর্থাৎ সমাজ নিরীক্ষণ বা Journal of Social Studies-এ]। এই বইগুলির একটি সেট তাঁকে দেব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। সেটাও আর হল না।

টীকা ও তথ্যসূত্র


[১] পোস্টের এই অংশটি ‘শিক্ষকমহ’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকাস্থ সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত সাময়িকী সমাজ নিরীক্ষণ-এর ১৩৬ নং (জানুয়ারি-মার্চ ২০১৬) সংখ্যায়, যা ছিল সাময়িকীটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ৮০তম জন্মদিবসের নিবেদন হিসাবে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা। এতে মোট ২০টি নিবন্ধ রয়েছে, যেগুলির লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আইনুন নাহার, ডালেম চন্দ্র বর্মন, মেঘনা গুহঠাকুরতা, হেলালউদ্দিন খান আরেফিন প্রমুখ। সংখ্যাটির শেষে পরিশিষ্ট অংশে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কিছু রচনা সহ তাঁর প্রকাশিত বইসমূহের বিস্তারিত তালিকাও রয়েছে।   

[২] প্রশান্ত ত্রিপুরা, পাহাড়ি গোষ্ঠীপরিচয়ের ঔপনিবেশিক ভিত্তি, ভেলাম ভান সেন্দেল ও এলেন বল সম্পাদিত বাংলার বহু জাতি: বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতির প্রসঙ্গ,ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ, দিল্লি, ১৯৯৮ [মূল ভাষ্য: Prashanta Tripura, The Colonial Foundation of Pahari Ethnicity, Journal of Social Studies, No. 58, 1992 (শিরোনামে দেওয়া লিংক অনুসরণ করে মূল ইংরেজি লেখাটির পিডিএফ কপি ডাউনলোড করা যাবে)]

[৩] প্রশান্ত ত্রিপুরা, বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস, সংবেদ, ঢাকা, ২০১৫

[৪] বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অপ্রতিরোধ্য রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য প্রবন্ধ ,আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ১৩

[৫] লেখার এই অংশটি বিকেজের মৃত্যুর দিন (২৩শে মার্চ, ২০২০) ‘বিদায় শিক্ষকমহ’ শিরোনামে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।   

আমার করোনানামা

বিষময় ২০২০ সালের নির্বাচিত দিনলিপি

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

যে বছরকে বাংলাভাষীদের অনেকে ‘বিষ বিষ সাল’ বলতে অভ্যস্ত হয়েছে, সেটির শেষে আমি হিসাব করে দেখলাম, বিষয় বা প্রেক্ষাপট হিসাবে করোনাভাইরাস তথা কোভিড ছিল, ২০২০ সালে ফেসবুকে এমন পোস্ট আমি সব মিলিয়ে দিয়েছি ৭৭টির মত। এসব পোস্টের সম্মিলিতি কলেবর দাঁড়িয়েছে ছাব্বিশ হাজারের অধিক শব্দ, যেগুলিকে চাইলে রীতিমত একটা বইয়ের আকার দেওয়া যায়। আপাতত অবশ্য তেমন কোনো চিন্তা করছি না। এর বদলে নিজের বিবিধ পোস্ট থেকে নির্বাচিত কয়েকটি বা সেগুলির অংশবিশেষ তুলে ধরেছি নিচে।

উল্লেখ্য, আমার টাইমলাইনে ২০২০ সালের অধিকাংশ করোনা-সংশ্লিষ্ট পোস্ট দেওয়া হয়েছিল মার্চ থেকে মে মাসে। এই তিন মাসের মোট পোস্ট সংখ্যা ছিল ষাটের উপর, এবং এককভাবে এপ্রিল মাসের হিসাব রয়েছে সবার উপর, এরপর মার্চের। মে নাগাদ পোস্ট সংখ্যা কিছুটা কমে আসলেও তা দুই অংকের ঘরেই ছিল, তবে অন্য মাসগুলিতে করোনা-সংশ্লিষ্ট পোস্টের সংখ্যা সীমিত ছিল ০ (ফেব্রুয়ারি, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে) থেকে ৫ এর মধ্যে।

আমার ২০২০ সালের করোনা-সংশ্লিষ্ট বিবিধ পোস্ট থেকে যেগুলি সংক্ষেপিত/সম্পাদিত আকারে নিচে তুলে ধরেছি, সেগুলিকে কালানুক্রমিভবে পেশ করার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে নতুন শিরোনাম বা প্রাসঙ্গিক টীকা জুড়ে দিয়েছি। যেসব পোস্ট পাবলিক ছিল, এবং এখনো তাই আছে, সেগুলির হাইপারলিংকও দেওয়া থাকল, যদি কেউ মূল পোস্ট পড়ে দেখতে চান। 

করোনাভাইরাস বনাম ‘রেসেক্লাও’ বা বিবিধ সামাজিক বিদ্বেষের বিষ, জানুয়ারি ২৯, ২০২০

বাংলাদেশে বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব ঝুঁকি কতটা, তা আমার জানা নেই। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, করোনাভাইরাস নিয়ে চারিদিকে উদ্বেগ ও আতঙ্ক যে আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে আরেক ধরনের ভাইরাসের ভূমিকা রয়েছে, যেটির নাম হল ‘রেসেক্লাও’ (এ নামটি খুব একটা পরিচিত নয়, যেহেতু এটি মূলত আমিই ব্যবহার করেছি, আমার একটি গল্পে, ‘রেসিজম’, ‘সেক্সিজম’ ইত্যাদি শব্দের আদ্যাক্ষরের ভিত্তিতে)। উল্লেখ্য, এই ভাইরাসে আক্রান্ত লোকজন সহজেই অন্যদের মাঝে তা ছড়িয়ে দিতে পারে সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নানান মাধ্যমে। যেমন, আজ সকালে ফেসবুক খোলার পর একজনের একটা পোস্ট দেখে একটু ধাক্কা খেলাম।  চীনে বানর এবং সাপের মাংস করোনাভাইরাসের উৎস হয়ে থাকতে পারে, এমন একটি শোনা কথা যাচাই বাছাই ছাড়াই পুনর্ব্যক্ত করার পর তিনি যোগ করেছেন, “আমাদের দেশেও কোনো কোনো জনগোষ্ঠির মানুষ বন‌্যপ্রাণী ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে। যেহেতু এটি ছোঁয়াচে, তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।” কথাগুলো পড়ে ধাক্কা খেলাম এই কারণে যে, যিনি এগুলি বলেছেন, তিনি একজন অধ্যাপক, এবং বর্তমানে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কোনো এক টিভি চ্যানেলের একটি আলোচনানুষ্ঠানের লিংক শেয়ার করতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। ওতে একটু ক্লিক করে দেখলাম, একজন ‘ভাইরোলজিস্ট’ বলছেন, চীনের উহানে যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে সাপের মাধ্যমে, বাদুড়ের কাছ থেকে! একটুখানি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, এটি একটি অনুমান মাত্র, যার পেছনে কোনো প্রমাণ নেই!

[উপরে তুলে ধরা পোস্ট ছাড়া মার্চ মাসের আগে ফেসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে আমি আর কোনো পোস্ট দেই নি। অন্যদিকে মার্চে এসে আমি ‘করোনাভাইরাস-নামা’ শিরোনামে কিছুটা দীর্ঘ কলেবরের মোট ছয়টি পোস্ট ফেসবুকে দিয়েছিলাম। একই সাথে এ ধরনের কোনো শিরোনাম ছাড়াই প্রাসঙ্গিক আরো বেশ কিছু স্ট্যাটাস আপডেট বা অন্য ধরনের পোস্ট দিতে শুরু করেছিলাম, যেগুলির হার এপ্রিলে গিয়ে আরো বেড়ে গিয়েছিল। ততদিনে এটা নিশ্চয় বুঝে গিয়েছিলাম যে,  করোনাভাইরাস তথা কোভিড প্রসঙ্গে বা সেগুলির প্রেক্ষাপটে  এত বেশি ঘন ঘন পোস্ট দিতে হবে যে, সেগুলিকে আলাদা করে ‘করোনাভাইরাস-নামা’ শিরোনামে পেশ করা অনেকটাই নিরর্থক হয়ে যাবে।)

বাংলাদেশে সরকারিভাবে করোনা-রোগী শনাক্ত হওয়ার পর, মার্চ ১০, ২০২০ (করোনাভাইরাস-নামা ১ এর অংশবিশেষ)

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিনজন রোগী পাওয়া গেছে, এই সরকারি ঘোষণার পর রাতারাতি ভিন্ন আরেকটি ছোঁয়াচে রোগ, যা আগে থেকেই কিছুটা ছিল, দেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা হল জন উদ্বেগ ও আতঙ্ক। অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেও কিছুটা হলেও এই উদ্বেগের শিকার হয়েছি। যেমন, গতকাল বিকেলে আমার অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকেই মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে শুরু করে, মাঝে মধ্যে ঠান্ডা এলার্জির কারণে আমার যে হাঁচিকাশি হয়, যা গতকাল সকালেও দেখা দিয়েছিল, সেসব যদি চলতে থাকে, এবং বিমানবন্দরে বা বিমানে সহযাত্রীরা নিশ্চয় ভয় যেতে পারে! এদিকে আবার একটা ইনফেকশনের কারণে আমার একটা চোখ একটু ছোট হয়ে ছিল, কাজেই সব মিলিয়ে ‘বিদেশি’ চেহারার আমাকে যদি কেউ করোনাভাইরাস রোগী বলে সন্দেহ করতে শুরু করে, তাহলে কী হবে? এসব ভাবনার জের ধরে শেষ পর্যন্ত সফরটাই বাতিল করে দিয়ে অফিস থেকে আধাবেলা ছুটি নিয়ে ছুটলাম চোখের ডাক্তারের কাছে।

যে চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সেখানে করোনাভাইরাস-জনিত বাড়তি সতর্কতার বিভিন্ন নমুনা চোখে পড়ছিল – কর্মীদের অনেকের মুখে মাস্ক, কাউন্টারের পাশে এক জায়গায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও টিসু বক্স, ফ্লোরও মোছা হচ্ছিল জোরে শোরে।  … যখন একই হাসপাতালের ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গেলাম, দেখলাম, দু’জন ব্যক্তি এসে সেখানে হেক্সাসলের খোঁজ করলেন, এবং তাঁদের বলা হল, ‘নেই’।

চক্ষু হাসপাতালের কাজ শেষে সস্ত্রীক গেলাম একটা সুপারমার্কেটে কিছু কেনাকাটা করতে। সেখানে দেখলাম, অনেকের ট্রলিতেই টয়লেট টিস্যু, সাবান ইত্যাদি বোঝাই। এরকম একটি ট্রলি নিয়ে ঘোরা মুখোশ পরিহিত এক লোককে দেখলাম আমার স্ত্রী আইনুনের সাথে কথা বলতে।  আমি চিনতে পারি নি। পরে আইনুন আমাকে বলল, “ও কিন্তু [অমুক]”, অর্থাৎ  আমাদেরই এক বন্ধু!

কভিড-বিষয়ক কিছু মার্কিন কার্টুন, মার্চ ১১, ২০২০ (করোনাভাইরাস-নামা ৩ এর অংশবিশেষ)

গতকাল এক কার্টুন চোখে পড়ল, যেটির ক্যাপশনটা দেখে এক চোট না হেসে পারি নি: “অদ্ভুত ব্যাপার, আমার ফেসবুক বন্ধুরা যারা একমাস আগেও সংবিধান বিশারদ ছিল, এখন দেখি সবাই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে!”

[ট্রাম্প বিষয়ক একটি কার্টুন প্রসঙ্গে যোগ করা আমার মন্তব্য:] করোনাভাইরাসের বিপদকে যথাসময়ে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন আশা করতে শুরু করেছেন অনেক ট্রাম্প-বিরোধী! দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।

করোনাভাইরাস-নামা ৪: করোনাভাইরাসের ‘বাড়ি ফেরা’, মার্চ ১৩, ২০২০ (করোনাভাইরাস-নামা ৪)

চীনের বাইরে যে শতাধিক দেশে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে,  সেগুলির মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর দিক থেকে এই মুহূর্তে সবার শীর্ষে রয়েছে ইতালি। বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক আলোচনা ও আতঙ্কের জন্ম দেওয়া এই ভাইরাস প্রথম চীনের উহান শহরে শনাক্ত করা হলেও মানুষ থেকে মানুষে সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আকারে এটির উৎপত্তি ঠিক কখন কোথায় হয়েছিল, সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ সহ চূড়ান্ত কোনো গবেষণা-লব্ধ সিদ্ধান্তে এখনো আসেন নি বিজ্ঞানী সমাজ।

তবে ইতালিতে করোনাভাইরাসের আগমন ছিল ব্যুৎপত্তিগত অর্থে এর ‘বাড়ি ফেরা’! কথাটা বলছি এ কারণে যে, ‘করোনা’ এবং ‘ভাইরাস’ – উভয় শব্দই ল্যাটিন থেকে এসেছে।  ল্যাটিন ভাষায় ‘ভাইরাস’ শব্দের আদি অর্থ হল ‘বিষ’ বা ‘বিষাক্ত তরল’, এবং ‘করোনা’র অর্থ হল মুকুট। যে করোনাভাইরাস নিয়ে বর্তমানে গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন, অণুবীক্ষণে সেটির গায়ে মুকুটের চূড়ার মত দেখতে অনেক কাঁটা দেখা যায়, সে অনুযায়ীই নামটা এসেছে!

এদিকে করোনাভাইরাস-বাহী হতে পারে, এমন লোকজনের সবাইকে যথাসময়ে চিহ্নিত করে প্রয়োজন অনুসারে তাদেরকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ করে রাখার ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু রয়েছে কিনা, এ নিয়ে উদ্বেগ-বিতর্কের মধ্যেই বাংলাদেশিদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, শেষোক্ত শব্দের বাংলা কী? অনেকে হয়ত জানেন, বাংলাদেশে একটা পারিভাষিক উদ্ভাবন হিসাবে ‘সঙ্গরোধ’ শব্দটি চালু রয়েছে ‘কোয়ারেন্টাইন’-এর প্রতিশব্দ হিসাবে। তবে এটি ব্যাপক পরিচিতি পায় নি এখনও, তাই বিভিন্ন মাধ্যমে ইংরেজি শব্দটাই ব্যবহৃত হচ্ছে।

কিন্তু ব্যুৎপত্তিগতভাবে উল্লিখিত ইংরেজি শব্দেরও আদি উৎস ইতালি! সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘চল্লিশ দিন’ বোঝাতে ব্যবহৃত হত, এমন ইতালিয়ান শব্দ/শব্দগুচ্ছ থেকেই এসেছে ‘কোয়ারেন্টাইন’ কথাটি। সে সময় ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক মৃত্যু ঘটানো প্লেগের কারণে ইতালিতে আসা জাহাজগুলিকে চল্লিশ দিন ধরে বন্দরে ভিড়ানো থেকে বিরত রাখা হত, আর সেভাবেই এসেছে ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দটি। তবে চল্লিশ দিনের হিসাবটা স্রেফ চিকিৎসা-শাস্ত্রীয় বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়েছিল, নাকি এর পেছনে কোনো ধর্মীয় পরম্পরার প্রভাবও ছিল, তা জানা হয়ে ওঠে নি আমার। 

কভিডকালে সামনে আসা বিবিধ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ফাটল, মার্চ ১৭, ২০২০ (করোনাভাইরাস-নামা ৫ এর অংশবিশেষ)

টিভিতে খবরের চ্যানেলগুলি ঘুরে দেখছিলাম। বিবিসি বা সিএনএন-এ একটি দৃশ্যে চোখ আটকে গেল, আমেরিকার কোথাও একটি দোকানের সামনে লম্বা লাইন, যার পেছনটা ভবনের বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত চলে এসেছে। কিসের লাইন জানেন? না, টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা তেমন যেসব পণ্যের কথা আপনার আমার মাথায় প্রথম আসতে পারে, তেমন কিছুর জন্য ছিল না এই লাইন। এটি ছিল একটি বন্দুকের দোকানের লাইন!

করোনাভাইরাসের আতঙ্ক যে বিশ্বজুড়ে অনেকের মধ্যেই অন্ধ স্বার্থপরতাও ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তার বহু নমুনা আগেই দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু আণুবীক্ষণিক ভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করার কাজে বন্দুক কী কাজে আসতে পারে, সেটা প্রথমে মাথায় আসে নি। তবে একটু পরেই হুঁশ হল, যতই আমরা করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হই বা এটি থেকে বাঁচার বিভিন্ন উপায় হিসাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া থেকে শুরু করে নানান ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই না কেন, করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় হুমকিটা যতটা না স্বাস্থ্যগত, তার চাইতেও অনেক বেশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক।

করোনাভাইরাস শুধু বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরীক্ষার মুখে ফেলে নি, বরং আমাদের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির ফাটলগুলিও সামনে নিয়ে আসছে। অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে ‘যুদ্ধ’ চলছে বিশ্বজুড়ে, সেটিতে নামার পাশাপাশি এই ফাটলগুলির দিকেও সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের।

লুঙ্গি পরে (অর্থাৎ ঘরে বসে) অফিস করার কাল; মার্চ ২৪, ২০২০-এর একটি স্ট্যাটাস আপডেট

করোনা-আতঙ্ক প্রশমিত করার লক্ষ্যে ফেসবুক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা, মার্চ ২৭, ২০২০

বন্ধুরা কেমন আছেন? শুভ সকাল। আজ সকাল বেলা মনে ঘুরতে থাকা কিছু ভাবনা, এবং ঠাণ্ডা মাথায় কষে দেখা কিছু হিসাব নিকাশ, আপনাদের সামনে পেশ করতে চাচ্ছি, যেগুলি আমাদের মনে চেপে বসা ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ককে হয়ত প্রশমিত করবে।

যে অভূতপূর্ব সময় আমরা সবাই বিশ্বজুড়ে পার করছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহবন্দী অবস্থায়, তাতে আমাদের সবার মাথাতেই এখন একটি বিষয়ই ঘুরছে কোনো না কোনো আকারে। আমরা কমবেশি সবাই নিজেদের দৈনন্দিন রুটিন ও আচরণেও পরিবর্তন এনেছি, বা আনতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু যেভাবে অনেকক্ষেত্রে আমরা সবাই হুজুগে মেতে উঠেছি, এবং ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছি এই বুঝি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নিজেদের বা প্রিয়জনদের জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে, তা কতটা যৌক্তিক? ভয় কোনো যুক্তি মানে না ঠিক, কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের সেনসেশনাল খবর, সমস্যাজনক মতামত, ভুল তথ্য, দুর্বল বিশ্লেষণ প্রভৃতির হাতে আমরা নিজেদের সঁপে দেব কেন?

স্বাভাবিক অবস্থায় আমি টিভির খবর দেখি না, এমনকি পত্রপত্রিকার খবরও পড়ি না, এবং যদি দেখি বা পড়িও, অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদ পরিবেশনাগুলির নানান ত্রুটি ধরে ফেলতে পারি। কিন্তু করোনাভাইরাস-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর আমিও টিভি চ্যানেলগুলির খবর গিলতে শুরু করেছিলাম। আজও ভোরে ঘুম ভাঙার পর টিভির খবর দেখে আর ফোনে ফেসবুক ব্রাউজ করে সময় পার করছিলাম। এমন সময় মনে প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা, বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সার্বিক চিত্রটা এখন পর্যন্ত কেমন? প্রশ্নটা মনে জাগার পর নিজেই নেট ঘেঁটে পাওয়া কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে বসে গেলাম।

অনবরত হাত ধোয়া, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করা ইত্যাদির পাশাপাশি নানান অপতথ্য ও অমূলক আশঙ্কার জঞ্জালও সরাতে হবে, এবং আমাদের ভাবতে হবে, লকডাউন ইত্যাদির পর্ব পার হলে সামনে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করতে পারে, সেজন্য আমরা কে কতটা প্রস্তুত। আমাদের খুব কমজনেরই করোনাভাইরাসে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু আমরা অনেকেই করোনা-পরবর্তী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঝড়ে পড়ে যেতে পারি, যদি আমরা প্রস্তুত না থাকি। এই ঝড়ের ঝাপটা কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের পাশাপাশি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরাও ইতোমধ্যে টের পাচ্ছেন!

কাজেই চলুন, যে অভূতপূর্ব নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবী যাচ্ছে, সে সময়টা কাজে লাগিয়ে আমরা ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের নিয়ে, এবং আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে একটু ভাবি। আপনি যদি মনে করেন, সেটা আপনার কর্ম নয়, তাহলে নিদেন পক্ষে ছবি আঁকতে পারেন, গান শুনতে পারেন, বা মনকে শান্ত করার জন্য ঘরে বসে অন্য যা করা সম্ভব আপনার পক্ষে, করতে পারেন। আপনার আজকের দিনটা, এবং আগামী দিনগুলি, শুভ হোক, শান্তিময় হোক।

করোনাকালে ঢাকায় গৃহবন্দী জীবনের নবম দিন, এপ্রিল ৩, ২০২০

বাংলাদেশে আমাদের অনেকের গৃহবন্দী জীবনের  ৯ম দিন চলছে আজ।

ঠিক এক সপ্তাহ আগে একটা পোস্ট দিয়ে আমি সেখানে কভিড-১৯ রোগের বৈশ্বিক্ক বিস্তার সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলাম,  করোনাভাইরাসের ভয়ে কুঁকড়ে থাকার কারণ নেই। এই বক্তব্যের সমর্থনে কিছু পরিসংখ্যানসহ পেশ করা বক্তব্য অনেককেই আশ্বস্ত করেছিল হয়তবা। তবে আপাতদৃষ্টিতে গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতি বেশ পাল্টে গেছে। বিশেষ করে আক্রান্তদের সংখ্যা এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে দশ লক্ষের উপরে চলে গেছে, এবং মৃত্যুর সংখ্যাও দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৫৩,০০০-এর উপর চলে গেছে। সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে, এমন দেশের তালিকায়ও নতুন ১১টি নাম যুক্ত হয়েছে।  …

স্পষ্টতই, বৈশ্বিক প্রবণতা দেখে বোঝা যায়, সার্স-কভি-২ ভাইরাসের বিস্তার সহসা বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, এবং আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুহার দুই-ই লাফিয়ে লাফিয়েই হয়ত বাড়তে থাকবে আরো কয়েক সপ্তাহ।

বলা বাহুল্য, আমাদের আরো দু’একটা সপ্তাহ অন্তত ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে, পরিস্থিতি আয়ত্তে থাকবে কিনা তা বোঝার জন্য।  সেই সময় পর্যন্ত আগের সপ্তাহে বলা কথাই আবার বলব। ভয়ে কুঁকড়ে থাকার বা আতঙ্কে দিশাহারা হওয়ার কোনো কারণ নেই, তবে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে, এবং এই সতর্কতা নিতে হবে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হল, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুব দ্রুত বাড়ুক বা না বাড়ুক, বেশিদিন ঘরে বসে থাকার মত ধৈর্য যেমন অনেকের নেই, তেমন জনগণের একটা ব্যাপক অংশের নেই প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য। যতই দিন যাবে, শেষোক্ত বিষয়টাই বেশি বড় হয়ে দেখা দেবে, এবং নিম্ন আয়ের ও হতদরিদ্র মানুষদের কাছে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত তথা সমাজের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষদের স্বতঃপ্রণোদিত সহায়তা যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে সবচাইতে বড় কাজ। এটি ঠিকমত না করা হলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে, তার ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে কথা ও কাজে দায়িত্বশীল থাকতে হবে, এবং চোখ-কান-মন খোলা রেখে সামনে পা ফেলতে হবে।  অন্যদিকে, আবারো বলছি, ভয়ে কুঁকড়ে থাকার কোনো কারণ নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তার পেছনে একটা বড় কারণ হল সে দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গতিধারা। সে দেশের নেতৃবৃন্দ প্যানডেমিকের জন্য শুধুই চীনের দিকে দোষারোপের আঙুল তুলতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিল যে,  তাদের তর্জনির পেছনে তিনটি আঙুল নিজেদের দিকেই তাক করা ছিল, যেগুলির একেকটি হয়তবা নিচের মত বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করছিল:

১) জনস্বাস্থ্য খাতে যথাযথ বিনিয়োগ না থাকা;

২) অতিমাত্রায় ঔষধ সেবন ও নানা ধরনের কৃত্রিম উপাদান সম্বলিত খাবার-দাবারে অভ্যস্ততার কারণে জনগণের একটা বড় অংশের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়া;  

৩) বিচক্ষণ ও ঐক্যমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব।

একটি ‘ভালো কুসংস্কার’ নিয়ে দুটি কথা, এপ্রিল ১০, ২০২০

একটা ভালো ‘কুসংস্কার’-এর কথা বলি? বেশ আগে আমার গবেষণার অংশ হিসাবে ত্রিপুরা জুমিয়া কৃষকদের কাছে জেনেছিলাম যে, বাদুড়ের গুহা আছে, এমন পাহাড়ে নাকি তাঁরা জুমচাষ করতেন না। এটা কি ‘কুসংস্কার’?

এবার ‘কাকতালীয়’ একটা যোগসূত্রের কথা বলি, যা বন্ধুরাও হয়ত অনেকেই জেনেছেন সম্প্রতি। সার্স, মার্স থেকে শুরু করে কভিড-১৯-এর ভাইরাস সহ মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠা আরো একাধিক ভাইরাসের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায়শই কোনো না কোনো প্রজাতির বাদুড়ের হদিস পেয়েছেন। একই সাথে তাঁরা নতুন করে এটাও উপলব্ধি করছেন, নিত্যনতুন বৈশ্বিক মহামারী ঠেকাতে হলে অন্য সকল প্রাণীর আবাসস্থল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করতেই হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহু প্রজন্ম ধরে আদিবাসীদের বিভিন্ন ‘কুসংস্কার’ কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণেই অবদান রেখে এসেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে!

অতএব, হে দেশি সাহেববৃন্দ, আপনারা যাঁরা দু’কলম ইংরেজি ও তিন পাতা ‘বিজ্ঞান’ মুখস্থ করেই প্রান্তিক হয়ে ওঠা নিজেদের তুতো ভাইবোনদের ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ বলতে শিখেছেন, একটু ভাবুন, অন্যের বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলতে গিয়ে আপনি নিজেই নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বা দৃষ্টিভঙ্গীর সংকীর্ণতা জাহির করছেন কিনা। অথবা নিজেকে প্রশ্ন করুন, অন্যদের বিশ্বাসকে ‘কুসংস্কার’ বলে খারিজ করার আপনার অভ্যাসটাও এক ধরনের কুসংস্কার নয় কি?

[বি.দ্র.: এই পোস্টের পটভূমি হিসাবে কাজ করেছে করোনাকালের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় হামে শিশুদের মৃত্যুর খবরের প্রেক্ষিতে বিষয়টির পেছনে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর ‘কুসংস্কার’কে প্রধানত দায়ী করে দেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য।]

একটুখানি ‘ফুড ফর থট’, এপ্রিল ১১, ২০২০

বেশ অনেকদিন পর একটা কলা খেলাম আজ সকালে, ব্রেকফাস্টের অংশ হিসাবে। অন্যসময় হলে এটা এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হত না যা নিয়ে ফেসবুকে লিখতে বসে যাব। কিন্তু এখন যে করোনা কাল! সচরাচর বাসার কাছ থেকেই কলা কিনতাম আমি, অনেক সময় সকালে হাঁটার ফাঁকে। তিন সপ্তাহ হল এসব বন্ধ। … জরুরি কোনো গ্রোসারি আইটেম লাগলে সপ্তাহে একবার ফোন করে আনিয়ে নেওয়া হয় এলাকার একটি মীনা বাজার থেকে। কিন্তু এতদিন কলা কেনার কথা আর ভাবা হয় নি।

ডাক্তাররা বলেন, করোনা-কালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চাঙা রাখা দরকার। আর এজন্য নিয়মিত শাকসবজি ফলমূল খেতে হবে। আমরা অবশ্য আগেও তাই করতাম, এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। … বাসায় অন্যান্য ফলের স্টক যাই থাকুক, লেবু অনেক আছে এখনো। তাই ভিটামিন সি-এর অন্যান্য উৎস ফুরিয়ে গেলেও চিন্তা নেই খুব একটা।

অনেকদিন পর আজ কলা খেতে গিয়ে মনে পড়ল, একবার পড়েছিলাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে নাকি ব্রিটেনে কলার সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ট্রপিক্যাল এই ফলটি বিভিন্ন কলোনি থেকে আনা হত জাহাজে করে। কিন্তু কলাকে ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল এর পুষ্টিগুণের জন্য নয়, বরং তার মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে। ব্রিটেনের ধুসর পরিবেশে খাবার টেবিলে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফলটি একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করত। সেটি না থাকলে ব্রিটিশদের মনে সূক্ষ্ম নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারত, তাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারত, এই বিবেচনায় নাকি কলার সরবরাহ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকেরা কলার মত ফলের সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখা নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা জানি না। করোনা-সংকটে যেভাবে দেশ জুড়ে দু’বেলা ডাল ভাত খাওয়াটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে অনেকের জন্য, তাতে কলা-আনারস জাতীয় দ্রুত পচনশীল ফলের সরবরাহ হয়তবা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। কিন্তু আজ সকালে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখে বিষয়টাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি। রাঙ্গামাটির কোনো এক জায়গায় আনারসভর্তি অনেকগুলি নৌকার ছবি দেখলাম। সেই অঞ্চলের আনারস-চাষী ও আনারস-ব্যবসায়ীরা কী করবে এগুলি যদি বাজারে না দেওয়া যায়? একই দুর্ভাবনা নিশ্চয় কলাসহ অন্যান্য বহু ফসল ও শাকসবজির সাথে যুক্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীদের বেলায়ও চলছে।

বছর দুয়েক আগে ‘স্লো ফুড’ আন্দোলন নিয়ে কিছুটা পড়াশুনা করেছিলাম ‘কৃষক সমাজ’ বিষয়ক একটা কোর্স পড়াতে গিয়ে। যেসব খাবার খাব, সেগুলি নিজের এলাকার হবে, উৎপাদক ভোক্তাদের পরিচিত হবে, বিনিময় হবে শোষণমুক্ত, খাবার দাবার হবে বিষমুক্ত, এমন অনেক ভাবনা জড়িয়ে আছে এই আন্দোলনের সাথে। করোনা-সংকট কি একটা সুযোগ নয় এমন ভাবনাকে দীর্ঘ মেয়াদে ও আরো ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার?

সংস্কৃত পণ্ডিতের ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা আমি!, এপ্রিল ১৭, ২০২০

গল্পের সেই লোকটার কথা মনে পড়ছে, যার বিদ্যাবুদ্ধি কম, তাই বাসায় সংস্কৃত জানা এক পণ্ডিত আসাতে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে সবার কথোপকথন ভালো করে শোনার চেষ্টা করতে গিয়ে তার মনে হল, পণ্ডিত যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তা অনেকটা বাংলার মতই, শুধু  অধিকাংশ শব্দের সাথে তিনি অনুস্বর জুড়ে দিচ্ছিলেন। তাই খাটের তলা থেকে বেরিয়ে লোকটি বলে উঠল, অনুস্বরং দিলেং যদিং সংস্কৃতং হং, তবেং কেনং আমিং খাটেরং তলেং রং? 😀

বাবা-জেঠাদের মুখে শোনা গল্পটা নতুন করে মনে পড়ে গেল করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে ঠিক তিন সপ্তাহ আগে (মার্চ ২৭ তারিখে) দেওয়া আমার একটি ফেসবুক পোস্টের কথা স্মরণ করে। সেই পোস্টে আমি কভিড-১৯ রোগের বৈশ্বিক বিস্তার সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলাম,  করোনাভাইরাসের ভয়ে কুঁকড়ে থাকার কারণ নেই। এই বক্তব্যের সমর্থনে আমার দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে অনেক ফেসবুক বন্ধুকেই আশ্বস্ত করেছিল। তবে গত তিন সপ্তাহে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। যেমন, ইতোমধ্যে সরকারি হিসাব অনুসারে সারা বিশ্বে আক্রান্তদের সংখ্যা চারগুণ বেড়ে বাইশ লক্ষের কাছাকাছি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও অনেকগুণ বেড়ে দেড় লক্ষের কাছাকাছি চলে এসেছে। সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে, এমন দেশের তালিকায়ও প্রায় দেড় ডজন নতুন নাম যুক্ত হয়েছে।  সবচেয়ে বড় কথা, তিন সপ্তাহ আগে সরকারি হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা দুই অঙ্কে সীমিত ছিল, এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল এক হাতে গোণার মত, সেই চিত্র এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে।

আর আতঙ্ক, হতাশা, ক্ষোভ ইত্যাদি? এগুলির কোনো পরিসংখ্যান দেখার চেষ্টা করি নি, কিন্ত এসবও নিশ্চয় আরো বহুগুণ বেড়েছে।

এই অবস্থায় বন্ধুদের আশ্বস্ত করার মত কী বলতে পারি, কিছু বলার চেষ্টা করা উচিত কিনা, ভাবছি। এটুকু বুঝতে পারছি, যাই বলি না কেন, অন্তত পরিসংখ্যান বা বিজ্ঞানের ভাষায় তা বলার চেষ্টা করা ঠিক হবে না, কারণ তাতে বিষয়টা বাংলা শব্দে অনুস্বর যোগ করে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার মতই হবে। এমন না যে বিজ্ঞান আমার একেবারে জানা নেই – অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আমার লেখাপড়া ছিল, এমনকি কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পরেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পড়াশুনা করেছি – তবুও কভিড-১৯-এর রোগতাত্ত্বিক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই, এটুকু বুঝি। কিন্তু অনেক আগেই দেখেছিলাম, সার্স-কোভি-২ ভাইরাস বাংলাদেশে এসে পৌঁছানোর বেশ আগে থেকেই অনেক তথাকথিত বিশেষজ্ঞ এটির ঝুঁকি সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা গণমাধ্যমে বলতে শুরু করেছিলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা আসলে অনেক বিষয় নিজেরা না জেনেই শোনা কথার ভিত্তিতে বলছেন। তাও এমনভাবে তা বলছেন, যাতে তাঁদের অনেকের মধ্যে ‘রেসেক্লাও’ নামক এক ধরনের ‘জীবাণু’র স্পষ্ট সংক্রমণ বোঝা যাচ্ছিল। সেই কারণেই এক পর্যায়ে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে অনুস্বর যুক্ত স্বরে দু’একটা স্ট্যাটাস দিতে শুরু করেছিলাম! 

তবে আজ ‘সংস্কৃত’ বলার চেষ্টা ছেড়ে যে ধরনের ভাষা আমার কিছুটা হলেও জানা আছে, সেটি ব্যবহার করে  আগে বলা  কিছু কথাই আবার তুলে ধরছি বন্ধুদের বিবেচনার জন্য। আমি বলেছিলাম, “করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় হুমকিটা যতটা না স্বাস্থ্যগত, তার চাইতেও অনেক বেশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক। … করোনাভাইরাস শুধু বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরীক্ষার মুখে ফেলে নি, বরং আমাদের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির ফাটলগুলিও সামনে নিয়ে আসছে। অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে ‘যুদ্ধ’ চলছে বিশ্বজুড়ে, সেটিতে নামার পাশাপাশি এই ফাটলগুলির দিকেও সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে আমাদের।”

কেমন পৃথিবী আমরা চাই আগামীর শিশুদের জন্য?, এপ্রিল ১৮, ২০২০

খেলাধুলা করব, কিন্তু গায়ে ধুলাবালি লাগবে না, এটা কি আমরা কখনো ভেবেছিলাম? না। খেলাধুলা কথাটিই তা বলে দেয়। কিন্তু কেউ যদি এখন এসে বলে, আগামীর শিশুরা শুধু খেলবে,  কোনো অবস্থায় কখনো তাদের গায়ে ধুলা লাগতে দেওয়া যাবে না,  আমরা কি অবাক হব?

আমাদের ছোটবেলায় কেউ যদি বলত, পানি কিনে খাওয়া লাগে, বা দুধের চেয়ে পানির দাম বেশি, নিশ্চয় হেসে উড়িয়ে দিতাম সে কথা। এখন বাইরে বেরুলে, বোতলজাত পণ্যের আকারে পাওয়া যায়, এমন পানি হাতে না থাকলে আমরা অনেকে অস্বস্তিতে পড়ি। তাই কেউ যদি এসে বলে, কিছুদিন পর  শ্বাস নেওয়ার বাতাস সিলিন্ডারে করে বয়ে বেড়াতে হবে, আমরা কি অবাক হব?

আমরাই কি শেষ প্রজন্ম, যারা প্রাকৃতিক বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব?

প্রশ্নটা অবান্তর কিনা জানি না, তবে উত্তরটা যাই হোক, সৌভাগ্যবশতঃ এখনো সেই সময় আসে নি। তাই চলুন, আমরা যারা ভাগ্যবান, যাদের ফুসফুসে করোনাভাইরাস ঢোকে নি, ভালো করে একটু দম নেই।

আমরা অনেকেই অনেকদিন ধরে দিকবিদিক ছুটে বেড়িয়েছি। এখন সারা পৃথিবী থমকে আছে। এখনই সময় ভাবার, আবার যখন আমরা ছুটতে শুরু করব, কোন পথে যাব? যে পথে শিশুদের জীবনে খেলা থাকবে, কিন্তু ধুলা থাকবে না; মানুষ শ্বাস নেবে, কিন্তু বাতাস তাকে ছোঁবে না; মানুষ মানুষের সাথে মিশবে, কিন্তু কেউ কারো হাত ধরবে না, কেউ কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরবে না? সেই পথ যদি এড়াতে চাই, কী আমাদের করতে হবে? চলুন, ভালো করে দম নিয়ে একটু ভাবা যাক এসব নিয়ে। শুভ দিন!

ত্রাণ দাতাদের ‘মুখোশ’ নেই কেন?, এপ্রিল ২৫, ২০২০

“আজ ফেসবুক খুলতেই একটি ছবি চোখে পড়ল যেখানে দেখানো হয়েছে চাল বিতরণ করা হচ্ছে ত্রাণ হিসেবে। ছবিটির এক কোণায় একজন ‘দুস্থ’ গ্রহিতাকে দেখা যাচ্ছে বস্তা হাতে, আর দৃশ্যপটের প্রায় পুরোটা জুড়ে আধ ডজন হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক ক্যামেরার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন, যাদের সবার হাত একটি বালতির উপর, যেখান থেকে গ্রহিতার বস্তায় চাল পড়ছে।” কথাগুলি ঠিক তিন বছর আগে দেওয়া আমার একটি ফেসবুক পোস্টের, যেখানে উল্লেখ করা ছবিটা তোলা হয়েছিল মৌসুমি খাদ্য সংকট দেখা দেওয়া সাজেকে। এবার করোনা-দুর্যোগের সুবাদে সারা দেশের প্রেক্ষাপটেই এ ধরনের অগণিত ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে ঘুরছে অনেকদিন ধরে।

ত্রাণ-গ্রহিতাদের সহজেই চেনা যায়, এমন ছবি দেখানো তাদের মর্যাদার জন্য হানিকর, এ ধরনের সমালোচনা ওঠার পর অনেককে দেখেছি বিষয়টা আমলে নিতে। এমন অনেকে ফেসবুকে নিজেদের চালানো ত্রাণ কার্যক্রমের ছবি দেওয়ার পাশাপাশি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন, “সঙ্গত কারণেই ত্রাণ গ্রহিতাদের মুখের ছবি দেখানো হল না।” এটা ভালো। তবে নিজেদের নাম-পরিচয়-ছবি আড়ালে রাখার ব্যাপারে ত্রাণ কার্যক্রমের উদ্যোক্তাদের অনেককেই খুব বেশি সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না। তেমনটা হলে আরো ভালো হত না কি?

দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বা আড়াল বজায় রাখার ব্যাপারে যে কিছু প্রাচীন ধর্মীয় উপদেশ রয়েছে, তা অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন, বা না ভুললেও মানছেন না। উল্লেখ্য,  ইসলামে নাকি বলা হয়, “ডান হাতে দান করলে বাম হাতও যেন না জানে”। বাইবেলেও লেখা আছে, “when you give to the needy, do not let your left hand know what your right hand is doing” (Matthew 6:3)।  

আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে অবশ্য দানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে দানের কাজটি ঘটা করেই করা হয়, যেমন বৌদ্ধদের কঠিন চীবর দান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ ধরনের ক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার সম্পর্ক অন্যরকম থাকে। যেমন, ‘ভিক্ষু’  (যা ‘ভিক্ষুক’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত), ‘ফকির (বাবা)’ বিভিন্ন নামে অভিহিত ব্যক্তিত্বদের ধর্মীয় মর্যাদা সচরাচর থাকে দাতাদের উপরে!

পক্ষান্তরে আমাদের চিরচেনা ত্রাণ গ্রহিতাদের অধিকাংশই হলেন তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র রেখা’ নামক কবিতায় বর্ণিত সেইসব মানুষেরা, যাঁদের মর্যাদার শেষ চিহ্নটুকু  কেড়ে নিয়েছেন ‘প্রগাঢ় হিতৈষী’রা, তাঁদের এঁকে দেখানো একটি ‘দারিদ্র রেখা’র মাধ্যমে! করোনা-সংকট এসে সেই রেখাটাকে হয়তবা আরো উপরে তুলে এনেছে, এই যা, কিন্তু অভাব-গ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা কি সবাই একটু ‘মুখোশ’ পরে নিতে পারি না, শুধুমাত্র করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের জন্য নয়, বরং সামাজিক অসমতার পুরানো ভাইরাস থেকে নিজেদেরও রক্ষার জন্য? দাতা-গ্রহিতার সম্পর্ক যে মানুষে মানুষে ক্ষমতা, বিত্ত ও মর্যাদার অসমতাকেই তুলে ধরে, আরো পোক্ত করে, তা বুঝতে আমাদের কারো নিশ্চয় সমাজবিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই?

আরেক মৃত্যুর মিছিল, এপ্রিল ২৭, ২০২০

করোনাভাইরাস-বিষয়ক সর্বশেষ বৈশ্বিক পরিসংখ্যান দেখার জন্য একটু ঢুঁ মেরেছিলাম Worldometer নামের একটি ওয়েবসাইটে। সেখানে অন্য সময় খেয়াল করি নি, এমন একটি পাতা চোখে পড়ল, যেখানে দেখাচ্ছিল, সারা দুনিয়ায় দৈনিক, প্রতি মুহুর্তে, বা অন্যান্য মেয়াদে, কতজন মানুষ জন্মাচ্ছে, কতজন মারা যাচ্ছে ইত্যাদি। পাতাটার নিচের দিকে একটু নামতেই হঠাৎ একটা সংখ্যা দেখলাম, যেটা হল আজ এ পর্যন্ত কতজন মানুষ ক্ষুধায় মারা গেছে সে হিসাব। সংখ্যাটা ছিল ৯,০০০-এর উপর, তখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে সাতটার মত। দেখলাম, সংখ্যাটা দুই-তিন সেকেন্ড অন্তর এক এক করে বাড়ছিল! তখন রীতিমত টাইমার দিয়ে গুনে দেখলাম, প্রতি মিনিটে বিশ জনের উপরে মানুষ মারা যাচ্ছে ‘ক্ষুধা’য়! আর ওয়েবসাইটটির দেওয়া তথ্য মোতাবেক, ‘দৈনিক’ হিসাবটা দেখানো হচ্ছে আমার কম্পিউটারে সেট করা ঘড়ির সময় অনুযায়ী, মানে রাত ১২টার পর সাত ঘণ্টা যেতে না যেতেই ‘ক্ষুধা’য় পৃথিবীতে মারা গেছে ৯,০০০ মানুষ! তাহলে চব্বিশ ঘণ্টায় এই হিসাব কত গিয়ে দাঁড়াবে? একই সময়কালে কভিড-১৯-এ কতজন মারা গেছে বা যাবে, সে তুলনায় হয়ত যাওয়ার দরকার নেই। তবে আমার মনে করোনাভাইরাস-বিষয়ক পরিসংখ্যান জানার শখ চলে গিয়ে একটা পুরানো প্রশ্ন নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে। ‘ক্ষুধা’র কারণে, অথবা অপুষ্টি ও শিক্ষাহীনতার কারণে পৃথিবীতে প্রতিদিন বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ খাদ্যের অভাব নয়, বরং অসমতা ও বৈষম্য। এগুলি জেনেও আমরা সবাই সচরাচর চুপ করে বসে থাকি কেন?

এপ্রিল ২০২০-এর কোনো এক সময় ফেসবুকে পোস্ট করা আমার বানানো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার প্যারোডি

চলুন, মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলে উঠি, ‘জীবন মোবারক’!, এপ্রিল ২৫, ২০২০

[কবিতার আকারে ফেসবুকে প্রকাশ করা নিজের কিছু করোনাকালীন ভাবনা]

বুড়িয়ে যাওয়া, বুড়িয়ে যেতে থাকা আমরা অনেকেই
দ্বিধাগ্রস্ত মনে ভাবি, ‘বাইরে বেরুনো কি ঠিক হবে?’
‘বেরুনো যেতেই পারে, কিন্তু মাস্ক ছাড়াতো প্রশ্নই ওঠে না।’ বলতে বলতে কেউবা মনে মনে প্রুফ্রকের কবিতা আওড়াই, ‘Do I dare eat a peach?’

বাইরে বেরুনোর কথা না হয় বাদ দিলাম,
ঘরে বসেই কত কিছু নিয়ে আমাদের ভুগতে হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে!
এই যেমন,
ফেসবুকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে আমাদের ভাবতে হয়,
‘মোবারক’ লিখব না ‘মুবারক’? বাংলা একাডেমি না বলেছিল ‘ইদ’ লিখতে?

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি,
প্রচুর মানুষ – বেশিরভাগ কিশোর কিশোরী, শিশুও আছে,
কিছু নববিবাহিত দম্পতিও থাকতে পারে –
দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে ঈদের জামাকাপড় পরে,
যেগুলি গায়ে দেওয়ার পর কেউ বোধহয় ম্যাচিং কোন মাস্ক খুঁজে পায় নি!
অথবা, পরার দরকারই আর মনে করে নি!

জীবন কী তা নিয়েই এখনো যারা ভাবে নি,
মরণ বলে যে কিছু আছে, থাকতে পারে, তা নিয়ে ভাবার সময় কই?
জীবন মোবারক! জয় বেঁচে থাকা!

ডেন্টিস্টের চেম্বারে অপেক্ষমান অবস্থায় তোলা সেলফি

পুনশ্চ:

টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ভিশন’ কথাটি, যা দিয়ে বোঝায় দুই চোখে সমান ও স্পষ্ট করে দেখার ক্ষমতা, চোখের ডাক্তারদের পাশাপাশি অন্যরাও ব্যবহার করেন রূপক অর্থে। আমিও তাই করেছিলাম দুই হাজার বিশ সালের শুরুতে, যখন একদিন জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি নাগাদ কোনো এক সভায় কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম, ‘আশা করি ২০২০ সালে আমরা সামনের দিকে তাকাতে পারব স্পষ্টভাবে’। তবে ভাগ্যের পরিহাস হল, মার্চে একবার চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর [যেমনটা উপরে ১ম ‘করোনাভাইরাস-নামা’য় উল্লেখ করা হয়েছে] আমার আরেকবার তার কাছে যাওয়ার দরকার ছিল নতুন এক জোড়া চশমার মাপজোক চূড়ান্ত করার জন্য, কিন্তু ২০২০ সালে তা আর হয়ে ওঠে নি, ফলে পুরো বছরটি আমি কাটিয়েছি ২০/২০ দৃষ্টি ছাড়াই! তবে এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নাই। বরং, বছরের শেষ দিকে দাঁতের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হওয়া ছাড়া অন্য কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াই যে বছরটা পার করতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি। এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনার কথা বলে এই পোস্ট শেষ করছি। ডেন্টিস্টের কাছে প্রথম যাওয়ার দিন তার চেয়ারে শোয়ার পর আমি বোকার মত প্রশ্ন করেছিলাম, আমার মাস্কটা কি খুলতে হবে? 🙂

যাই হোক, আমরা আশা করব, ২০২১ সালে আমাদের সবার জীবন স্বাভাবিকতর হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। পাঠকের প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভকামনা।

নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান ‘সমস্যাজনক’ কেন

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

প্রকাশ্যে ধূমপান করার কারণে রাজশাহীতে সম্প্রতি (ডিসেম্বর ৬, ২০২০ তারিখে) এক নারীকে হেনস্তা করা হয়েছিল, যে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।[১] দেশে বর্তমানে প্রচলিত আইন অনুসারে জনপরিসরে ধূমপান নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ, কিন্তু রাস্তাঘাটে বহু মানুষ প্রতিনিয়তই এই আইন ভেঙে চলছে, যা নিয়ে অনেকেরই কোনো মাথা ব্যথা নেই। রাজশাহীর উল্লিখিত ঘটনাতেও সিগারেট খাওয়ার জন্য একজন নারীকে হেনস্তা করতে গিয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আইন ভাঙার অভিযোগ করে নি। বরং তাদের কথা ছিল, একজন নারী কেন প্রকাশ্যে ধূমপান করবে?

কিম তাই-হি, কোরিয়ান সুপারস্টার অভিনেত্রী (ছবির উৎস, এবং কোরিয়ার প্রসঙ্গ যে প্রেক্ষাপটে এসেছে সেটির উল্লেখ, ৩ নং টীকায় রয়েছে।)

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এবং জনপরিসরে ধূমপান বেআইনি, এটা মেনে নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন – যাঁদের মধ্যে রাজশাহীতে হেনস্তার শিকার হওয়া সেই নারীও রয়েছেন – তা হল, নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে এমনিতে সমস্যা ঠিক কী? এই প্রশ্নেরই একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই আমরা একমত হতে পারি যে, বাংলাদেশে নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান আসলেই বিরল এক দৃশ্য।[২] ফলে দেশের কোথাও যদি এ দৃশ্য দেখা যায়, তাহলে অনেকের দৃষ্টিতেই তা ‘সমস্যাজনক’ হয়ে দাঁড়ায়। তবে লিঙ্গীয় বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন যে কেউ বলবেন, এক্ষেত্রে সমস্যা যতটা না ধূমপায়ী ব্যক্তির, তার চাইতেও সমাজ ও সংস্কৃতির।

উপরে উল্লেখ করা বক্তব্য মেনে নিয়েই এই নিবন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে যে প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব, তা হল, প্রকাশ্যে ধূমপান ঠিক কেন বাংলাদেশের নারীদের বেলায় সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, অথবা, এমন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পেছনে ঠিক কী ধরনের সাংস্কৃতিক যুক্তি কাজ করছে? বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এখানে সংশ্লিষ্ট সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বা সাংস্কৃতিক যুক্তির সাফাই গাওয়া হচ্ছে না, স্রেফ সেটির একটা বিবরণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে মাত্র।

চরিত্রের প্রশ্ন

নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান করা প্রসঙ্গে ঠাট্টাচ্ছলে হলেও সামাজিকভাবে প্রচলিত যে ‘যুক্তি’টা অনেকে সামনে নিয়ে এসেছেন, তা হল, ধূমপান পুরুষরা করলে তাতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, আর নারীরা করলে হয় ‘চরিত্রের ক্ষতি’। এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘চরিত্র’ বলতে সচরাচর কী বোঝানো হয়, তা কমবেশি সবারই জানা। প্রচলিত অর্থে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক বা বহুগামিতায় অভ্যস্ত হিসাবে বিবেচিত নারী-পুরুষদের ক্ষেত্রেই চরিত্রহীনতার তকমা বেশি করে প্রয়োগ করা হয়। তবে এ অর্থে ধূমপান যে সত্যিই চরিত্রের কোনো ক্ষতি করে, অর্থাৎ সামাজিকভাবে অনুমোদিত নয় এমন  যৌন আচরণের দিকে ধূমপায়ীদের ঠেলে দেয়, তেমন কোনো প্রমাণ রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

যাই হোক, প্রমাণের কথা বাদ দিয়ে যদি শুধু সামাজিকভাবে প্রচলিত ধ্যানধারণার কথা বলি,  তাহলে অন্তুত পুরুষ ধূমপায়ীদের বেলায় এমন কোনো বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত নয় যে, ধূমপান তাদের ‘চরিত্রে’র কোনো ক্ষতি করে। তাহলে নারী ধূমপায়ীদের বেলায় যখন তাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, সেখানে ‘চরিত্র’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? নারী ধূমপায়ীরা কি কোনোভাবে এমন কোনো ইঙ্গিত দেন যে, তাঁরা নিজেরা যৌন ‘ব্যভিচারে’ লিপ্ত, বা এমন আচরণে অন্যদের উৎসাহিত করছেন? এক্ষেত্রে যে ধরনের প্রচ্ছন্ন অনুমান কাজ করে, তা আরেকটু গভীরে গিয়ে আমরা তলিয়ে দেখব কিছুক্ষণ পর, যাতে দেখা যাবে যে, এক্ষেত্রে আসলেই চরিত্রের প্রশ্ন জড়িত, তবে সেটা উপরে উল্লিখিত অর্থে নয়, বরং আমরা দেখব যে, এতে আসলে সমাজের একটা বিশেষ চরিত্রই ফুটে ওঠে। সেটা ঠিক কী, তা আরো খোলাসা করে বলছি একটু পরেই, তবে তার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক, নারীদের ধূমপানের ব্যাপারে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে কী ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।        

স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধূমপায়ী নারীদের দৃশ্যমানতার তারতম্য

পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে – যেমন তুরস্কে – প্রকাশ্যে নারীদের ধূমপান নাকি বিরল দৃশ্য নয়। বাংলাদেশেও কিছু জায়গায় আমি নিজেই নারীদের ধূমপান করতে দেখেছি, যা নিয়ে আশেপাশের কাউকে উচ্চবাচ্য করতে দেখি নি। যেমন, একবার একটি বাসে চড়ে সেটি ছাড়ার অপেক্ষায় জানালার পাশের এক সিটে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম (এটি যে সময়কার ঘটনা তখন বাংলাদেশে জনপরিসরে ধূমপানের বিরুদ্ধে কোনো আইন ছিল না এবং আমিও ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম)। আমার সিগারেট খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ এক নারী এসে আমার কাছে আগুন চাইলেন, আর আমি লাইটার ধার দেওয়ার পর তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে তাঁর আরেক নারী সঙ্গীসহ বাসের ভেতরে খাওয়া শুরু করলেন। ঘটনাস্থল ছিল খাগড়াছড়ির বাস স্টেশন। বাংলাদেশের অন্যত্র খুব কম জায়গাতেই হয়ত কেউ এমন দৃশ্য দেখেছেন, কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় অনেকে তা দেখে থাকতে পারেন।

উল্লেখ্য, খাগড়াছড়িতে আমার দেখা ধুমপায়ী সেই নারী সহযাত্রীদের পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা ছিলেন মারমা, তবে তাঁদের জাতিগত পরিচয়ের পাশাপাশি শ্রেণীগত অবস্থানও উল্লেখ করার মত। দু’জনেই ছিলেন সাধারণ কৃষক শ্রেণীর, তাঁদের বেশভূষা-ভাষা-চালচলন তাই বলছিল। পড়ালেখা করা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোনো পাহাড়ি নারী বাসের মত জায়গায় প্রকাশ্যে ধুমপান করবেন, এমন দৃশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও অনেকটা অপ্রত্যাশিত, অন্তত আমি কখনো দেখি নি। অন্যদিকে ঢাকায় বা আশেপাশে রাস্তার পাশে ইট ভাঙার মত কাজ করার ফাঁকে বিড়ি ফুঁকছেন, এমন নারী মনে হয় আমি দেখেছি একাধিকবার। এদিক থেকে দেখলে আসলে জাতি-ধর্ম বা অঞ্চল নির্বিশেষে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদের ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে ধূমপান সামাজিকভাবে অপ্রত্যাশিত, এবং এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে তাঁদের বেলাতেই চরিত্র নিয়ে বেশি কথা ওঠে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা বাজারে পাইপ মুখে এক বয়স্ক আদিবাসী নারী (ছবি এডাম জোন্স/উইকিমিডিয়া)
ধূমপানরত এক বাংলাদেশি নারী (ছবিটা নেওয়া হয়েছে ২নং টীকায় উল্লেখ করা এক প্রতিবেদন থেকে)

বস্তুত পশ্চিমা সমাজেও – অন্তত মধ্যবিত্ত পরিসরে –  নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান একসময় সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ছিল। এই প্রেক্ষাপটে উনিশশত ষাটের দশকের শেষ দিকে তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ফিলিপ মরিস নারীদের জন্য ‘ভার্জিনিয়া স্লিমস’ নামের একটা সিগারেট বাজারে নিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়কার মধ্যবিত্ত মার্কিন সমাজে নারী স্বাধীনতার যে জোয়ার দেখা দিয়েছিল, তার সাথে তাল মিলিয়ে কোম্পানিটি তাদের এই পণ্যের জন্য চতুরভাবে একের পর এক বিজ্ঞাপন তৈরি করতে শুরু করে, যেগুলিতে একদিকে দেখানো হত অতীতে নারীদের লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য বা তুলনীয় কোনো বিষয়, যার বিপরীতে ভার্জিনিয়া স্লিমসের সাহচর্যে দেখানো হত আধুনিক আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী নারীদের। বিজ্ঞাপনের অংশ হিসাবে বড় করে একটা স্লোগান লেখা থাকত, “You’ve come a long way, baby.”। তবে ঊনিশশত আশির দশক নাগাদ, স্বাস্থ্যের উপর ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতার প্রসার তথা নারীদের মধ্যে ধূমপানের হার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে, কোনো এক চিকিৎসক নাকি উক্ত স্লোগানের কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন, “You’ve come the wrong way, baby!” যাই হোক, আমাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে যে বিষয়টা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, তা হল, ধূমপানের সাথে সবসময়ই বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় যুক্ত ছিল।

উল্লেখ্য, ১৪৯২ সালে কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকা আবিষ্কারের আগে ইউরোপ, এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষদের কাছে তামাক বা তামাকের ব্যবহার ছিল অজানা একটি বিষয়। অন্যদিকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা বহু আগে থেকেই তামাকের নানাবিধ ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। তবে এই নতুন মহাদেশগুলিতে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ গড়ে ওঠার পর তামাক চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটে, এবং গড়ে ওঠে তামাকজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার। সেই সূত্র ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে তামাকের নানাবিধ ব্যবহার, যেগুলির সাথে স্থানীয় সমাজ কাঠামো ও সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রবণতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল গোড়া থেকেই। আমেরিকার কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় আচারের অংশ হিসাবে তামাক সেবন বা মৈত্রী প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসাবে তামাক বিনিময়ের প্রথা থেকে শুরু করে উপমহাদেশের সামন্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত হুঁকা, বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন মুলুকে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠা ভার্জিনিয়া স্লিমস, অথবা সমকালীন বাংলাদেশি নারীদের মুখে অনেকের দৃষ্টিতে ‘অশোভন’ বলে বিবেচিত সিগারেট, কত তার বহুমাত্রিক রূপ, প্রয়োগ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য!

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা ও পুঁজিবাদের অন্যতম অনুষঙ্গ তথা কয়েক শতাব্দী জুড়ে বহু মহাদেশের অগণিত সমাজের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে মিশে যাওয়া একটি বিশাল-বিস্তীর্ণ বিষয় হিসাবে তামাকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের খুব সামান্যই আমরা বর্তমান নিবন্ধের পরিসরে আলাপ করতে পারব। তবে সংক্ষেপে যেটুকু পর্যালোচনা আমরা করলাম, তা থেকে আশা করি পাঠক বুঝতে পারছেন যে, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারীকে সিগারেট খেতে দেখাতে রাজশাহীতে কিছু লোক যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তার পেছনেও বিবেচনায় নেওয়ার মত বিস্তীর্ণ এক ঐতিহাসিক পটভূমি তথা সংশ্লিষ্ট অনেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান ছড়িয়ে আছে। এগুলির মধ্যে ধূমপানের সাথে সমাজের একটি ‘বিশেষ চরিত্র’ মিশে আছে বলে যে কথা আগেই বলেছি, তা আরেকটু খোলাসা করার মাধ্যমে আমি বর্তমান আলোচনার সমাপ্তি টানব।

ধূমপানের সাথে সমাজের যে বিশেষ চরিত্র জড়িয়ে আছে

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায়, অন্তত শহুরে মধ্যবিত্ত পরিসরে, শুধু নারীদের বেলাতেই যে প্রকাশ্যে ধূমপান অগ্রহণযোগ্য বা অনভিপ্রেত হিসাবে বিবেচিত তা নয়, বরং সকলেই জানেন, সাধারণভাবে বড়দের সামনে ছোটদের সিগারেট খাওয়া বারণ। এই ‘বড়’ আর ‘ছোট’ হতে পারে বয়সের মানদণ্ডে, বা আর্থসামাজিক পদমর্যাদার বিচারে। এভাবে দেখলে পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থায় জনপরিসরে নারীদের ধূমপানও আসলে বিদ্যমান লিঙ্গীয় অসমতার সাথে ‘বেমানান’ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে জনপরিসরে নারীদের ধূমপানের ব্যাপারে পুরুষদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি আলাদাভাবে দেখার আগে যে প্রশ্ন আমরা বিবেচনায় নিতে পারি, তা হল, ধূমপানের এমন কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার সাথে প্রতীকীভাবে সামাজিক ক্ষমতা বা মর্যাদার তারতম্যের বিষয়টি জড়িয়ে আছে?

উপরে ওঠানো প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে যে বিষয়টা আমরা সামনে নিয়ে আসতে পারি, তা হল, যেসব সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাস বা পদমর্যাদার তারতম্য খুব প্রকট, এবং যেখানে সাংস্কৃতিকভাবে এসব তারতম্যের প্রকাশ ঘটানো হয় বিবিধ প্রতীক ও প্রাত্যহিক চর্চার মাধ্যমে, সেখানে কে কতটা পরিসর বা জায়গা জুড়ে রয়েছে, কে উপরে বা নিচে, ডানে বা বামে রয়েছে, এসব অনেক বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। যিনি পদমর্যাদায় যত বড়, তিনি তত বেশি জায়গা জুড়ে – প্রতীকীভাবে তথা পরিসরগতভাবে – থাকবেন, এটা প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে ধূমপানের ফলে একজন ব্যক্তি তার নিজের চারপাশে ধোঁয়ার যে বলয় তৈরি করে, তা পদমর্যাদার অনুপাতে ব্যক্তিগত পরিসরের আপেক্ষিক বিন্যাসে ব্যাঘাত ঘটায়, যদি ‘ছোট’রা ‘বড়’দের সামনে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ে। উল্লিখিত কারণেই একজন উঁচু পদমর্যাদার কেউ অন্যদের মুখের সামনে ইচ্ছামত ধোঁয়া ছাড়তে পারে, বা মুখে পাইপ, সিগারেট ইত্যাদি গুঁজে কথা বলতে পারে, কিন্তু উল্টোটা অনেক সমাজেই করা যায় না।[৩] যদি তা করা হয়, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবেই গণ্য হয়, এবং ঠিক এই কারণেই উঠতি বয়সের অনেক কিশোর তরুণ হাত পা ছুঁড়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রাস্তায় পথ চলে, যার মধ্য দিয়ে তারা তাদের দ্রোহ প্রকাশ করে। অন্যদিকে সমাজের উপরের দিকে থাকা ব্যক্তিবর্গ ঠিকই এসব খেয়াল করে, এবং সুযোগ পেলেই এমন তরুণদের তাদের জায়গা চিনিয়ে দিতে ছাড়ে না। এদিক থেকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখা যাওয়া কোনো নারীর দিকে পুরুষদের তেড়ে যাওয়াটাও নারীদেরকে সমাজে তাদের পুরুষতন্ত্র-নির্ধারিত ‘জায়গা’ মনে করিয়ে দেওয়ারই একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত। এটাই এখনো  সমাজের এক বিশেষ চরিত্র, যা পাল্টাতে গেলে সংস্কৃতির গভীরে মিশে থাকা অনেক বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বহুজনকে।


টীকা

[১] সেই ঘটনা ও পরবর্তী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার যেসব খবর বিভিন্ন মাধ্যমে এসেছে, সেগুলির মধ্য থেকে কয়েকটির লিংক এখানে দেওয়া হল: একটিতে রয়েছে উক্ত ঘটনার প্রাথমিক খবর, এবং অন্যটিতে রয়েছে সেই হেনস্তার ঘটনার প্রেক্ষিতে একই স্থানে প্রকাশ্যে ধুমপান করে কিছু তরুণ-তরুণীর প্রতিবাদের খবর। উল্লেখ্য, ঘটনার কয়েকদিন পর হেনস্তার শিকার হওয়া নারী নিজেই ফেসবুকে লাইভে এসে সেই ঘটনার ভিডিও করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তির মুখোমুখি হন, এবং তাঁকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন, যে অভিনব ঘটনার ভিডিওটিও অনেকের নজর কেড়েছে।  

[২] অবশ্য  ২০১৬ সালে একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ধূমপানের হার নাকি বিশ্বে সর্বোচ্চ। ক্রোয়েশিয়ার একটি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণার বরাতে পরিবেশিত এই তথ্য যদি পুরোপুরি ঠিক নাও হয় (যেমন, হতে পারে তারা বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তামাকের সব ধরনের ব্যবহারকেই ধূমপান হিসাবেই ধরে নিয়েছিল), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ থেকে পাওয়া উপাত্ত অনুসারে, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার একেবারে কম নয়, যদিও ২০০৯-এর তুলনায় ২০১৭ সাল নাগাদ তা কমেছে (তবে এই কমার হার পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেলায় কম ঘটেছে)।

[৩] ধূমপানে সৃষ্ট ধোঁয়া তথা সিগারেট বা পাইপের মত ধূমপানের উপকরণের সাথে সামাজিক পদমর্যাদার তারতম্যের প্রতীকী সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি কোরিয়ার পটভূমিতে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন C. Paul Dredge  নামের একজন মার্কিন নৃবিজ্ঞানী, তাঁর ‘Smoking in Korea’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে, যা প্রকাশিত হয়েছিল Korea Journal  নামের একটি পত্রিকায় (Vol. 20, No. 4, April 1980)। তিনযুগ আগে নৃবিজ্ঞানের এক সংকলনে পড়া এই নিবন্ধটি বর্তমানে আমার হাতের কাছে নেই, এবং নেট ঘেঁটেও তা খুঁজে পাই নি, তবে কোরিয়ায় ধূমপান বিষয়ক একটি লেখায় নিবন্ধটির উল্লেখ রয়েছে একটুখানি। সেই লেখা থেকেই এই পোস্টে ব্যবহৃত প্রথম ছবিটিও নেওয়া হয়েছে, যেটাতে দক্ষিণ কোরিয়ার খুবই জনপ্রিয় এক অভিনেত্রীকে ধূমপানরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়াতে ধূমপানের বহুল প্রচলন এবং  সেদেশে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ব্যাপক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও সেদেশেও নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান এখনো অনেক পুরুষের কাছে দৃষ্টিকটু বলে গণ্য হয়। এ বিষয়ে ইন্টারনেটে পাওয়া দুইটি প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনের লিংক এখানে দেওয়া হল: একটিতে কোরিয়াতে নারী ধূমপায়ী হওয়ার অভিজ্ঞতা সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে,  অন্যটিতে একটি বাস স্টপে ধূমপানরত দুই তরুণীকে এক বয়স্ক কোরিয়ান পুরুষের চড় মারা-র একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। অন্য দেশের প্রেক্ষিতে পাওয়া এসব উদাহরণ তুলে ধরার অর্থ এই নয় যে, রাজশাহীতে ধূমপানের জন্য একজন নারীকে হেনস্তা করার ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। মোটেও তা নয়, বরং এসব ঘটনার পেছনে যে ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে, তাকেই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে।        

ঔপনিবেশিকতার একশ বছর (১৮৭১-১৯৭১), এবং অতঃপর

এই লেখাটি ২০২০ সালে প্রকাশিত ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ: এক নৃবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর চোখে দেখা স্বদেশের ছবি বইটির ভূমিকার অংশবিশেষ।

ইতিহাসের আলোয় আমার বেড়ে ওঠার কাল

বয়সে আমি বাংলাদেশের চেয়ে নয় বছরের বড়। খাগড়াছড়ির একটি ত্রিপুরা গ্রামে জন্ম নেওয়ার সুবাদে জ্ঞান হওয়ার পর মাতৃভাষা ককবরকেই আমি নিজেকে প্রকাশ করতে শিখেছিলাম, সেই ভাষাতেই সবার সাথে কথা বলতাম বাড়িতে ও গ্রামে। তবে অল্প বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের আশেপাশে তিনটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলা লোকজনও ছিল, যারা ছিল বাঙালি, চাকমা ও মারমা (ককবরকে প্রতিটা জাতির আলাদা নাম রয়েছে)। এদিকে বাড়িতে ককবরকে কথা চললেও আমাদের লেখাপড়ার ভাষা ছিল বাংলা। তারপরও ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর যখন গ্রামের স্কুল ছেড়ে খাগড়াছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি, বাংলায় ভালো দখল না থাকার কারণে এক শিক্ষকের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। বলা বাহুল্য, ঘটনাটা আমাকে মানসিকভাবে বেশ আহত করেছিল, যদিও ধাক্কাটা বাহ্যিকভাবে দ্রুতই সামলে নিয়েছিলাম। অন্যদিকে সেই বয়সে স্কুলের এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে ‘পাক সার জামিন’ গানটাও গেয়েছিলাম বলে আবছাভাবে মনে পড়ে, যদিও গানটার অর্থ বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত নতুন একটা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শিখেছিলাম, যে গানটা স্কুলের আঙিনায় গাওয়ার আগেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় গেয়েছিলাম আমার কাছাকাছি বয়সের আরো কয়েকজনের সাথে, ১৯৭১ সালের মধ্য ডিসেম্বরের কোনো এক দিন। 

বলা বাহুল্য, ১৯৭১ সালে আমার যে বয়স ছিল, তাতে আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আমার মা-বাবা’র অন্য যে চার সন্তান ছিল, সবাই ছেলে, তারাও ছিল অপরিণত বয়সের (আমি ছিলাম দ্বিতীয় সন্তান, এবং আমার বড় ভাই ছিল আমার থেকে আড়াই বছরের বড়)। নতুবা আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজনের দেখাদেখি আমরাও হয়তবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতাম। মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে রাঙামাটি থেকে আমাদের এক নিকটাত্মীয় পরিবারের সবাই আলাদা দুই বা তিন ভাগে পর্যায়ক্রমে পালিয়ে এসে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা শহরের এক কোনায় অবস্থিত খাগড়াপুর নামের গ্রামে আমাদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছিলেন। সেই পরিবারের এক সন্তান অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই, কাজেই সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আমরাও কিছুকাল একত্রে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। একবার, সম্ভবত চৈত্র সংক্রান্তির দিন, বৈসুর আয়োজন অসমাপ্ত রেখেই আমরা সবাই আশ্রয় নিয়েছিলাম পাশের এক গ্রামে, যখন আমাদের গ্রামের কাছে এক জায়গায় খাগড়াছড়ি বাজার এলাকা থেকে জড়ো করা বিহারি পুরুষদের একযোগে মেরে ফেলা হয় অন্যত্র কোথাও (হয়তবা চট্টগ্রামে) সংঘটিত একই ধরনের – অর্থাৎ ভাষাগত বা জাতিগত বিভক্তি অনুসারে পরিচালিত – কোনো হত্যাকাণ্ডের বদলা হিসাবে।

কে কাকে কেন মারছিল, সেসব ভালো করে বুঝে ওঠার বয়স অবশ্য আমার বা আমার ভাইদের হয়ে ওঠেনি একাত্তরে, তবে এটুকু আমাদের কয়েকজনের এখনো স্পষ্ট মনে আছে যে, মৃত ভেবে গণকবরে ফেলে রাখা দুইজন গুলিবিদ্ধ মানুষ একটা পর্যায়ে চলে এসেছিলেন আমাদের গ্রামের সীমানায়, একজন হামাগুড়ি দিতে দিতে, এবং তাঁর পেছনে আরেকজন টলতে টলতে। তাঁদের আবার নিয়ে যাওয়া হয় গণকবরে, এবং পরে আমরা শুনেছিলাম, সেই আহত লোক দু’জন নাকি প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে উর্দুতে বলেছিলেন, “হামভি মুসলমান, তুমভি মুসলমান…।” সেই মানুষদের পূর্বসূরিরা হয়তবা বিহার বা উত্তর ভারতের অন্য কোনো এলাকা থেকে ১৯৪৭ সালে বা এর পরে কোনো এক সময় পাড়ি দিয়েছিলেন ‘মুসলমানদের রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের পূর্বাংশে। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ সেই রাষ্ট্রের একটা অংশে যে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় গৌণ হয়ে যাবে, তা কি তাঁরা ভাবতে পেরেছিলেন? অন্যদিকে, সেই বছরই যখন মার্চ নাগাদ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলা কোনো এক মিছিলে আমিও অংশ নিয়েছিলাম খুব ছোট বয়সে – যখন আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম একজন ‘জয়’ বলার পর অন্যরা সবাই ‘বাংলা’ বলার মাধ্যমে – আমাদের স্কুলের কাছ থেকে শুরু হয়ে বাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করা সেই মিছিলে শুধু বাঙালিরাই ছিল না, বরং ত্রিপুরা-মারমা-চাকমারাও ছিল অনেকে।

নয় বছর বয়সে পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে বিশেষ সচেতন ছিলাম না বটে, তবে এটা ঠিকই বুঝতাম যে, আমি একজন ‘ত্রিপুরা’, বাঙালি নই। অন্যদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটা শুধু বাঙালিদের জন্য, এমন কোনো ধারণা আমাদের ছিল বলে মনে পড়ে না। বরং মুক্তিযুদ্ধ পুরোদমে শুরু হওয়ার পর যখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সবাই বিভিন্ন দিকে ছুটতে আরম্ভ করে, আমরা কিভাবে যেন জানতাম কাদের দেখলে ভয় পেতে হবে, সাবধান হতে হবে।  সেই সময় একটা পর্যায়ে আমরা রাঙামাটির সেই আত্মীয় পরিবারের সদস্যরাসহ বিভিন্ন পথে সীমান্তবর্তী এক জায়গায় মামাবাড়িতে জড়ো হয়েছিলাম, এবং সেখান থেকে, তীব্র গোলাগুলির মধ্যে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত কোনো এক ত্রিপুরা গ্রামের একটি স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের তখন সীমান্ত পাড়ি দিতে সহায়তা করেছিলেন চান মিয়া নামের একজন বাঙালি, যিনি ককবরক বা ত্রিপুরা ভাষা খুব ভালোভাবে বলতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর,  ২০১২ সালে এক ত্রিপুরা বিয়ে বাড়িতে, আমি তাঁর আরেক ভাইকে আবিষ্কার করি, যিনিও একইভাবে ককবরকে খুব পারদর্শী। তখন এটাও জানতে পারি, চান মিয়াদের আদি নিবাস ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে, যেখান থেকে তাঁরা ‘এপারে’ চলে আসেন ১৯৪৭ সালের পর।

যাই হোক, আবার যদি ফিরে যাই ১৯৭১ সালে, সেবার আমাদের নিকটাত্মীয়দের সাথে মা তার পাঁচ নাবালক ছেলেকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেও এক রাত পরেই বাবা – যিনি নিজে অন্যত্র পালিয়ে ছিলেন – আমাদের আবার ফিরিয়ে আনেন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, যেখানে খাগড়াছড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে উঁচু পাহাড়ের সারিতে অবস্থিত একটা গ্রামে আমরা ছিলাম অনেকদিন। সেই গ্রাম থেকে একদিন আমাকে পাঠানো হয়েছিল খাগড়াপুরে আমাদের বাড়িটার অবস্থা দেখে আসতে। হাটবারের দিন এক জুমিয়া লোকের সাথে আমাকে পাঠানো হয়েছিল হাফপ্যান্টের বদলে গামছা পরিয়ে, যাতে আমাকেও সাধারণ একটি জুমিয়া পরিবারের ছেলে মনে হয়। আমার মনে আছে, নিজেদের গ্রামে ঢোকার মুখে সবুজ ইউনিফর্ম পরা দু’জন সশস্ত্র লোককে দেখে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। তারা ছিল ‘মিজো বাহিনী’র সদস্য, যে বাহিনী ছিল (বড় হয়ে জেনেছি) ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামক একটি সশস্ত্র সংগঠন, যেটি পাকিস্তান সরকারের আশ্রয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছিল এবং  মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশ্যে এসেছিল।  পরে, মুক্তিযুদ্ধের একটা পর্যায়ে যখন আমরা আবার বাড়ি ফিরে আসি, এই মিজো বাহিনীর একজন – যাঁর নাম ‘লিয়ানা’ ছিল – আমাদের অনেকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের জন্য। আবার একই বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে ‘বিজাতীয়’ সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ থেকে শুরু করে আগ্রাসনের দু’একটি ক্ষুদ্র পরিসরের নমুনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছিল। তবে সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে মিজোদের কথা বলছি ১৯৭১ সালের এসব বাস্তবতার সাথে তখনকার চাইতে ঠিক একশত বছর আগেকার ভিন্ন আরেক বাস্তবতার তুলনা করার সুবিধার্থে।        

মুক্তিযুদ্ধের একশত বছর আগেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম

ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে যদি আমরা বেশ পেছনে ফিরে যাই, তখন দেখতে পাই যে মুক্তিযুদ্ধের বছরের একশত বছর আগে, ১৮৭১ সালে, লুসাই পার্বত্যাঞ্চল অভিমুখে, যেখানে বর্তমানে ‘মিজোরাম’ নামে ভারতের একটি রাজ্য রয়েছে, ব্রিটিশদের একটা সশস্ত্র অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, যেটির আওতায় দু’টি সেনাদল অংশ নিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের দুটি সীমান্তবর্তী প্রান্ত থেকে, একটা গিয়েছিল ‘বেঙ্গল’ প্রদেশের সীমানায় মাত্র ১৮৬০ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে, আরেকটি পরিচালিত হয়েছিল আসামের কাছাড় থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, সেটির রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই জেলার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন। ‘কুকি’দের দমনে নিয়োজিত এই ক্যাপ্টেন লুইনের রেখে যাওয়া বিবরণের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে, এবং তৎকালীন বিবিধ ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে, আরো বিস্তারিত জানা যাবে ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ বইটির একাধিক অধ্যায়ে [একটির অংশবিশেষ, যা এই ব্লগে আগেই প্রকাশিত হয়েছে ক্যাপ্টেন লুইন ও ঔপনিবেশিক জাদু বাস্তবতা শিরোনাম, আগ্রহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন]। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির পেছনে ব্রিটিশদের একটা প্রধান উদ্দেশ্য নাকি ছিল ‘কুকি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা জনগোষ্ঠীদের মোকাবেলা করা, যাদের আওতায় লুসাইরাও পড়ত, এবং যাদের নিয়ে ব্রিটিশদের যথেষ্ট মাথাব্যথা ছিল। লুইনের রেখে যাওয়া বিবরণ থেকে আমরা এও জানতে পারি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ‘পার্বত্য উপজাতি’ বা ‘হিল ট্রাইব’ কোনো অভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত ছিল না। বরং স্থানীয়ভাবে এই গোষ্ঠীগুলি নাকি বিভক্ত ছিল ‘খিয়ংসা’ ও ‘তংসা’ নামের দুটি বর্গে, মারমা ভাষায় যেগুলির অর্থ হল, যথাক্রমে, ‘নদির সন্তান’ ও ‘পাহাড়ের সন্তান’। মারমা ও চাকমাদের মত কয়েকটি জাতি ছিল প্রথমোক্ত বর্গে, আর লুসাইসহ আরো বেশ কিছু গোষ্ঠী ছিল শেষোক্ত বর্গে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, লুইন তথা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য ব্রিটিশ প্রশাসকদের দেওয়া ‘পার্বত্য উপজাতি’ তকমাটাই কালক্রমে হয়ে ওঠে নদির সন্তান বা পাহাড়ের সন্তান নির্বিশেষে একাধিক গোষ্ঠীর জন্য অভিন্ন পরিচয়ের একটা ক্ষেত্র, যার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ‘পাহাড়ি’ পরিচয়, যেটির নতুন এক সংস্করণ হল ‘জুম্ম’ জাতীয়তার ধারণা। এসব বিষয়ে এই গ্রন্থে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, তবে এখানে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘পাহাড়ি’র মত ‘মিজো’ পরিচয়টাও আধুনিক কালের নির্মাণ, যেটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থও হল ‘পাহাড়ের মানুষ’ (‘মি’ অর্থ মানুষ, ‘জো’ অর্থ উঁচু ভূমি)।   

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৭১-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ফিরে এসে আবার একটু নজর দেওয়া যাক ১৯৭১ সালে, যখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে খাগড়াছড়ি শহর থেকে পাক বাহিনী ও মিজো বাহিনী সরে গিয়ে সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ার পর আমি ও আমার দু’ভাই আমাদের সমবয়সী একটা বালকদলের অংশ হয়ে পলাতক অবস্থা থেকে নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছিলাম ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে আমরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছিলাম, যাদের অনেকের নাম আমরা জানতাম, যেহেতু তাদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠা ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধাও কয়েকজন ছিলেন।  সেই সময় ঘুণাক্ষরেও কি আমাদের মনে কোনো আশঙ্কা জেগেছিল যে, এই স্বাধীন বাংলাদেশেই একটা দশক না পেরুতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবার ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যে সময়কার ঘটনাপ্রবাহের জেরে  ‘পাহাড়ি’ পরিচয়ের আওতায় ত্রিপুরাদেরও অনেকে আবার ঘরবাড়ি জমিজমা হারিয়ে দেশান্তরী হবে, বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতরেই অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে? সেই সহিংস কালপর্বের কিছু ঝাপটা এই লেখকের দেহমনেও এসে পড়েছিল কিশোর বয়সেই। যেমন, ১৯৭৭ সালে রাঙামাটিতে পড়ার জন্য প্রথম বাড়ি ছাড়ার দিন তখনকার আর্মড পুলিশ জাতীয় কোনো এক সংস্থার লোকজন ভাড়ায় খাটা একটি গাড়ি নিজেদের দখলে নেওয়ার পর তাঁদের দলনেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, “সিভিলদের কোনো লোককে” সেই গাড়িতে নেওয়া হবে না। ঘটনাটা আমার কিশোর মনে বেশ দাগ কেটেছিল বিধায় তা ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলাম তখন। সেই ঘটনার বছর দু’য়েক পর, যখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক পর্বে ঢাকায় পড়তে শুরু করি, একবার রাঙামাটি হয়ে খাগড়াছড়ি ফেরার পথে লঞ্চে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলাম একই ধরনের কোনো এক বাহিনীর একজন সশস্ত্র সদস্যের হাতে, যিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এখানে এ দু’টি ঘটনা উল্লেখ করলাম বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নিজের ‘আত্মপরিচয়’ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিশেষ কিছু উপলক্ষের উদাহরণ হিসাবে।

১৯৭৭ সালে যে ‘চাঁদের গাড়ি’ থেকে সব ‘সিভিল’ (সাধারণ নাগরিক) যাত্রীকে  নামিয়ে দিয়ে একটা সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন নিজেদের ব্যবহারের জন্য নিয়ে নিয়েছিলেন, সেটি কি এক হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতীক ছিল না? [এখানে যে প্রশ্নটি আমি উঠিয়েছি, তার পেছনে থাকা ঘটনার বিশদতর বিবরণ – যা ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ বইটির ভূমিকায় তুলে হয়েছে – আগ্রহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন এই ব্লগেও, চল্লিশ বছরে কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্টে।] তবে আমার স্মৃতি থেকে তুলে আনা গল্পে প্রচ্ছন্ন আকারে যে ‘সিভিল-মিলিটারি’ বিভাজন রয়েছে, সেটার শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সামরিক শাসন-কবলিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তথা, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে। যেমন, এই উপমহাদেশের সেনাবাহিনীগুলিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানে এবং খানিকটা বাংলাদেশে, এমনকি হয়তবা ভারতেও, ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ কথাটি এখনো বেশ চালু রয়েছে বলে জানা যায়, যেটি হল একটি খাঁটি ব্রিটিশ উত্তরাধিকার। উল্লেখ্য, ‘ব্লাডি’ কথাটি মূলত ব্রিটিশ ইংরেজিতেই ব্যবহৃত হত (এবং এখনো হয়) বিরক্তি প্রকাশে, এবং ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে শাসন করতে শুরু করে, তখন থেকেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে নিয়োজিত সামরিক ও অ-সামরিক (সিভিলিয়ান) প্রশাসকদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। যেমন, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এ তরুণ একজন প্রশিক্ষণার্থী সেনা-কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দিতে আসার পর কালক্রমে পুলিশের সুপারিন্টেন্ড (ও আরো পরে একজন ডেপুটি কমিশনার) হিসাবে দায়িত্ব পালন করা লুইন তাঁর স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থে কথাপ্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, “নতুন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টদের অনেকেই আমার মত ছিল তরুণ সামরিক ব্যক্তি, যাদের অপরাধ তদন্ত বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না, এবং যারা দায়িত্বে থাকা সিভিলিয়ান ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্ব  স্বেচ্ছায় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। এর কারণ হল, স্মরণাতীত কাল থেকেই প্রশাসনের এই দুইটি শাখার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি চলে এসেছে।”  তবে ১৯৭৭ সালে ‘সিভিলদের কোনো লোক’ গাড়িতে নেওয়া হবে না বলে যে ঘোষণাটা আমি শুনেছিলাম, সেখানে সংকীর্ণ অর্থে ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা ‘সিভিল-মিলিটারি’ বিভাজন কাজ করছিল, নাকি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র সামরিকায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ‘সিভিল’ কথাটির মাধ্যমে সাধারণ জনগণকেই বোঝানো হয়েছিল, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা যাই হোক, সংশ্লিষ্ট পটভূমিতে যে কোনো না কোনো আকারে ‘ঔপনিবেশিকতার ছায়া’ দেখা যায়, তা আমরা বলতে পারি।