Tag Archives: পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস

ঔপনিবেশিকতার একশ বছর (১৮৭১-১৯৭১), এবং অতঃপর

এই লেখাটি ২০২০ সালে প্রকাশিত ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ: এক নৃবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর চোখে দেখা স্বদেশের ছবি বইটির ভূমিকার অংশবিশেষ।

ইতিহাসের আলোয় আমার বেড়ে ওঠার কাল

বয়সে আমি বাংলাদেশের চেয়ে নয় বছরের বড়। খাগড়াছড়ির একটি ত্রিপুরা গ্রামে জন্ম নেওয়ার সুবাদে জ্ঞান হওয়ার পর মাতৃভাষা ককবরকেই আমি নিজেকে প্রকাশ করতে শিখেছিলাম, সেই ভাষাতেই সবার সাথে কথা বলতাম বাড়িতে ও গ্রামে। তবে অল্প বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের আশেপাশে তিনটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলা লোকজনও ছিল, যারা ছিল বাঙালি, চাকমা ও মারমা (ককবরকে প্রতিটা জাতির আলাদা নাম রয়েছে)। এদিকে বাড়িতে ককবরকে কথা চললেও আমাদের লেখাপড়ার ভাষা ছিল বাংলা। তারপরও ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর যখন গ্রামের স্কুল ছেড়ে খাগড়াছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি, বাংলায় ভালো দখল না থাকার কারণে এক শিক্ষকের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। বলা বাহুল্য, ঘটনাটা আমাকে মানসিকভাবে বেশ আহত করেছিল, যদিও ধাক্কাটা বাহ্যিকভাবে দ্রুতই সামলে নিয়েছিলাম। অন্যদিকে সেই বয়সে স্কুলের এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে ‘পাক সার জামিন’ গানটাও গেয়েছিলাম বলে আবছাভাবে মনে পড়ে, যদিও গানটার অর্থ বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত নতুন একটা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শিখেছিলাম, যে গানটা স্কুলের আঙিনায় গাওয়ার আগেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় গেয়েছিলাম আমার কাছাকাছি বয়সের আরো কয়েকজনের সাথে, ১৯৭১ সালের মধ্য ডিসেম্বরের কোনো এক দিন। 

বলা বাহুল্য, ১৯৭১ সালে আমার যে বয়স ছিল, তাতে আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আমার মা-বাবা’র অন্য যে চার সন্তান ছিল, সবাই ছেলে, তারাও ছিল অপরিণত বয়সের (আমি ছিলাম দ্বিতীয় সন্তান, এবং আমার বড় ভাই ছিল আমার থেকে আড়াই বছরের বড়)। নতুবা আমাদের কিছু আত্মীয়স্বজনের দেখাদেখি আমরাও হয়তবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতাম। মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে রাঙামাটি থেকে আমাদের এক নিকটাত্মীয় পরিবারের সবাই আলাদা দুই বা তিন ভাগে পর্যায়ক্রমে পালিয়ে এসে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা শহরের এক কোনায় অবস্থিত খাগড়াপুর নামের গ্রামে আমাদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছিলেন। সেই পরিবারের এক সন্তান অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই, কাজেই সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আমরাও কিছুকাল একত্রে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম অধিকতর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। একবার, সম্ভবত চৈত্র সংক্রান্তির দিন, বৈসুর আয়োজন অসমাপ্ত রেখেই আমরা সবাই আশ্রয় নিয়েছিলাম পাশের এক গ্রামে, যখন আমাদের গ্রামের কাছে এক জায়গায় খাগড়াছড়ি বাজার এলাকা থেকে জড়ো করা বিহারি পুরুষদের একযোগে মেরে ফেলা হয় অন্যত্র কোথাও (হয়তবা চট্টগ্রামে) সংঘটিত একই ধরনের – অর্থাৎ ভাষাগত বা জাতিগত বিভক্তি অনুসারে পরিচালিত – কোনো হত্যাকাণ্ডের বদলা হিসাবে।

কে কাকে কেন মারছিল, সেসব ভালো করে বুঝে ওঠার বয়স অবশ্য আমার বা আমার ভাইদের হয়ে ওঠেনি একাত্তরে, তবে এটুকু আমাদের কয়েকজনের এখনো স্পষ্ট মনে আছে যে, মৃত ভেবে গণকবরে ফেলে রাখা দুইজন গুলিবিদ্ধ মানুষ একটা পর্যায়ে চলে এসেছিলেন আমাদের গ্রামের সীমানায়, একজন হামাগুড়ি দিতে দিতে, এবং তাঁর পেছনে আরেকজন টলতে টলতে। তাঁদের আবার নিয়ে যাওয়া হয় গণকবরে, এবং পরে আমরা শুনেছিলাম, সেই আহত লোক দু’জন নাকি প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে উর্দুতে বলেছিলেন, “হামভি মুসলমান, তুমভি মুসলমান…।” সেই মানুষদের পূর্বসূরিরা হয়তবা বিহার বা উত্তর ভারতের অন্য কোনো এলাকা থেকে ১৯৪৭ সালে বা এর পরে কোনো এক সময় পাড়ি দিয়েছিলেন ‘মুসলমানদের রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের পূর্বাংশে। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ সেই রাষ্ট্রের একটা অংশে যে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় গৌণ হয়ে যাবে, তা কি তাঁরা ভাবতে পেরেছিলেন? অন্যদিকে, সেই বছরই যখন মার্চ নাগাদ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলা কোনো এক মিছিলে আমিও অংশ নিয়েছিলাম খুব ছোট বয়সে – যখন আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম একজন ‘জয়’ বলার পর অন্যরা সবাই ‘বাংলা’ বলার মাধ্যমে – আমাদের স্কুলের কাছ থেকে শুরু হয়ে বাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করা সেই মিছিলে শুধু বাঙালিরাই ছিল না, বরং ত্রিপুরা-মারমা-চাকমারাও ছিল অনেকে।

নয় বছর বয়সে পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে বিশেষ সচেতন ছিলাম না বটে, তবে এটা ঠিকই বুঝতাম যে, আমি একজন ‘ত্রিপুরা’, বাঙালি নই। অন্যদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটা শুধু বাঙালিদের জন্য, এমন কোনো ধারণা আমাদের ছিল বলে মনে পড়ে না। বরং মুক্তিযুদ্ধ পুরোদমে শুরু হওয়ার পর যখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সবাই বিভিন্ন দিকে ছুটতে আরম্ভ করে, আমরা কিভাবে যেন জানতাম কাদের দেখলে ভয় পেতে হবে, সাবধান হতে হবে।  সেই সময় একটা পর্যায়ে আমরা রাঙামাটির সেই আত্মীয় পরিবারের সদস্যরাসহ বিভিন্ন পথে সীমান্তবর্তী এক জায়গায় মামাবাড়িতে জড়ো হয়েছিলাম, এবং সেখান থেকে, তীব্র গোলাগুলির মধ্যে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত কোনো এক ত্রিপুরা গ্রামের একটি স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের তখন সীমান্ত পাড়ি দিতে সহায়তা করেছিলেন চান মিয়া নামের একজন বাঙালি, যিনি ককবরক বা ত্রিপুরা ভাষা খুব ভালোভাবে বলতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর,  ২০১২ সালে এক ত্রিপুরা বিয়ে বাড়িতে, আমি তাঁর আরেক ভাইকে আবিষ্কার করি, যিনিও একইভাবে ককবরকে খুব পারদর্শী। তখন এটাও জানতে পারি, চান মিয়াদের আদি নিবাস ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে, যেখান থেকে তাঁরা ‘এপারে’ চলে আসেন ১৯৪৭ সালের পর।

যাই হোক, আবার যদি ফিরে যাই ১৯৭১ সালে, সেবার আমাদের নিকটাত্মীয়দের সাথে মা তার পাঁচ নাবালক ছেলেকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেও এক রাত পরেই বাবা – যিনি নিজে অন্যত্র পালিয়ে ছিলেন – আমাদের আবার ফিরিয়ে আনেন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, যেখানে খাগড়াছড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে উঁচু পাহাড়ের সারিতে অবস্থিত একটা গ্রামে আমরা ছিলাম অনেকদিন। সেই গ্রাম থেকে একদিন আমাকে পাঠানো হয়েছিল খাগড়াপুরে আমাদের বাড়িটার অবস্থা দেখে আসতে। হাটবারের দিন এক জুমিয়া লোকের সাথে আমাকে পাঠানো হয়েছিল হাফপ্যান্টের বদলে গামছা পরিয়ে, যাতে আমাকেও সাধারণ একটি জুমিয়া পরিবারের ছেলে মনে হয়। আমার মনে আছে, নিজেদের গ্রামে ঢোকার মুখে সবুজ ইউনিফর্ম পরা দু’জন সশস্ত্র লোককে দেখে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। তারা ছিল ‘মিজো বাহিনী’র সদস্য, যে বাহিনী ছিল (বড় হয়ে জেনেছি) ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামক একটি সশস্ত্র সংগঠন, যেটি পাকিস্তান সরকারের আশ্রয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছিল এবং  মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশ্যে এসেছিল।  পরে, মুক্তিযুদ্ধের একটা পর্যায়ে যখন আমরা আবার বাড়ি ফিরে আসি, এই মিজো বাহিনীর একজন – যাঁর নাম ‘লিয়ানা’ ছিল – আমাদের অনেকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের জন্য। আবার একই বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে ‘বিজাতীয়’ সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ থেকে শুরু করে আগ্রাসনের দু’একটি ক্ষুদ্র পরিসরের নমুনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছিল। তবে সেসব ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে মিজোদের কথা বলছি ১৯৭১ সালের এসব বাস্তবতার সাথে তখনকার চাইতে ঠিক একশত বছর আগেকার ভিন্ন আরেক বাস্তবতার তুলনা করার সুবিধার্থে।        

মুক্তিযুদ্ধের একশত বছর আগেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম

ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে যদি আমরা বেশ পেছনে ফিরে যাই, তখন দেখতে পাই যে মুক্তিযুদ্ধের বছরের একশত বছর আগে, ১৮৭১ সালে, লুসাই পার্বত্যাঞ্চল অভিমুখে, যেখানে বর্তমানে ‘মিজোরাম’ নামে ভারতের একটি রাজ্য রয়েছে, ব্রিটিশদের একটা সশস্ত্র অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, যেটির আওতায় দু’টি সেনাদল অংশ নিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের দুটি সীমান্তবর্তী প্রান্ত থেকে, একটা গিয়েছিল ‘বেঙ্গল’ প্রদেশের সীমানায় মাত্র ১৮৬০ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে, আরেকটি পরিচালিত হয়েছিল আসামের কাছাড় থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, সেটির রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই জেলার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন। ‘কুকি’দের দমনে নিয়োজিত এই ক্যাপ্টেন লুইনের রেখে যাওয়া বিবরণের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে, এবং তৎকালীন বিবিধ ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে, আরো বিস্তারিত জানা যাবে ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ বইটির একাধিক অধ্যায়ে [একটির অংশবিশেষ, যা এই ব্লগে আগেই প্রকাশিত হয়েছে ক্যাপ্টেন লুইন ও ঔপনিবেশিক জাদু বাস্তবতা শিরোনাম, আগ্রহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন]। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির পেছনে ব্রিটিশদের একটা প্রধান উদ্দেশ্য নাকি ছিল ‘কুকি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা জনগোষ্ঠীদের মোকাবেলা করা, যাদের আওতায় লুসাইরাও পড়ত, এবং যাদের নিয়ে ব্রিটিশদের যথেষ্ট মাথাব্যথা ছিল। লুইনের রেখে যাওয়া বিবরণ থেকে আমরা এও জানতে পারি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ‘পার্বত্য উপজাতি’ বা ‘হিল ট্রাইব’ কোনো অভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত ছিল না। বরং স্থানীয়ভাবে এই গোষ্ঠীগুলি নাকি বিভক্ত ছিল ‘খিয়ংসা’ ও ‘তংসা’ নামের দুটি বর্গে, মারমা ভাষায় যেগুলির অর্থ হল, যথাক্রমে, ‘নদির সন্তান’ ও ‘পাহাড়ের সন্তান’। মারমা ও চাকমাদের মত কয়েকটি জাতি ছিল প্রথমোক্ত বর্গে, আর লুসাইসহ আরো বেশ কিছু গোষ্ঠী ছিল শেষোক্ত বর্গে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, লুইন তথা তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য ব্রিটিশ প্রশাসকদের দেওয়া ‘পার্বত্য উপজাতি’ তকমাটাই কালক্রমে হয়ে ওঠে নদির সন্তান বা পাহাড়ের সন্তান নির্বিশেষে একাধিক গোষ্ঠীর জন্য অভিন্ন পরিচয়ের একটা ক্ষেত্র, যার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ‘পাহাড়ি’ পরিচয়, যেটির নতুন এক সংস্করণ হল ‘জুম্ম’ জাতীয়তার ধারণা। এসব বিষয়ে এই গ্রন্থে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, তবে এখানে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘পাহাড়ি’র মত ‘মিজো’ পরিচয়টাও আধুনিক কালের নির্মাণ, যেটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থও হল ‘পাহাড়ের মানুষ’ (‘মি’ অর্থ মানুষ, ‘জো’ অর্থ উঁচু ভূমি)।   

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৭১-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ফিরে এসে আবার একটু নজর দেওয়া যাক ১৯৭১ সালে, যখন মুক্তিযুদ্ধ শেষে খাগড়াছড়ি শহর থেকে পাক বাহিনী ও মিজো বাহিনী সরে গিয়ে সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ার পর আমি ও আমার দু’ভাই আমাদের সমবয়সী একটা বালকদলের অংশ হয়ে পলাতক অবস্থা থেকে নিজেদের গ্রামে ফিরে এসেছিলাম ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে আমরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছিলাম, যাদের অনেকের নাম আমরা জানতাম, যেহেতু তাদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠা ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধাও কয়েকজন ছিলেন।  সেই সময় ঘুণাক্ষরেও কি আমাদের মনে কোনো আশঙ্কা জেগেছিল যে, এই স্বাধীন বাংলাদেশেই একটা দশক না পেরুতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবার ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যে সময়কার ঘটনাপ্রবাহের জেরে  ‘পাহাড়ি’ পরিচয়ের আওতায় ত্রিপুরাদেরও অনেকে আবার ঘরবাড়ি জমিজমা হারিয়ে দেশান্তরী হবে, বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতরেই অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে? সেই সহিংস কালপর্বের কিছু ঝাপটা এই লেখকের দেহমনেও এসে পড়েছিল কিশোর বয়সেই। যেমন, ১৯৭৭ সালে রাঙামাটিতে পড়ার জন্য প্রথম বাড়ি ছাড়ার দিন তখনকার আর্মড পুলিশ জাতীয় কোনো এক সংস্থার লোকজন ভাড়ায় খাটা একটি গাড়ি নিজেদের দখলে নেওয়ার পর তাঁদের দলনেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, “সিভিলদের কোনো লোককে” সেই গাড়িতে নেওয়া হবে না। ঘটনাটা আমার কিশোর মনে বেশ দাগ কেটেছিল বিধায় তা ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলাম তখন। সেই ঘটনার বছর দু’য়েক পর, যখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক পর্বে ঢাকায় পড়তে শুরু করি, একবার রাঙামাটি হয়ে খাগড়াছড়ি ফেরার পথে লঞ্চে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছিলাম একই ধরনের কোনো এক বাহিনীর একজন সশস্ত্র সদস্যের হাতে, যিনি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এখানে এ দু’টি ঘটনা উল্লেখ করলাম বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নিজের ‘আত্মপরিচয়’ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিশেষ কিছু উপলক্ষের উদাহরণ হিসাবে।

১৯৭৭ সালে যে ‘চাঁদের গাড়ি’ থেকে সব ‘সিভিল’ (সাধারণ নাগরিক) যাত্রীকে  নামিয়ে দিয়ে একটা সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন নিজেদের ব্যবহারের জন্য নিয়ে নিয়েছিলেন, সেটি কি এক হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতীক ছিল না? [এখানে যে প্রশ্নটি আমি উঠিয়েছি, তার পেছনে থাকা ঘটনার বিশদতর বিবরণ – যা ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ বইটির ভূমিকায় তুলে হয়েছে – আগ্রহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন এই ব্লগেও, চল্লিশ বছরে কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্টে।] তবে আমার স্মৃতি থেকে তুলে আনা গল্পে প্রচ্ছন্ন আকারে যে ‘সিভিল-মিলিটারি’ বিভাজন রয়েছে, সেটার শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সামরিক শাসন-কবলিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তথা, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে। যেমন, এই উপমহাদেশের সেনাবাহিনীগুলিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানে এবং খানিকটা বাংলাদেশে, এমনকি হয়তবা ভারতেও, ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ কথাটি এখনো বেশ চালু রয়েছে বলে জানা যায়, যেটি হল একটি খাঁটি ব্রিটিশ উত্তরাধিকার। উল্লেখ্য, ‘ব্লাডি’ কথাটি মূলত ব্রিটিশ ইংরেজিতেই ব্যবহৃত হত (এবং এখনো হয়) বিরক্তি প্রকাশে, এবং ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে শাসন করতে শুরু করে, তখন থেকেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে নিয়োজিত সামরিক ও অ-সামরিক (সিভিলিয়ান) প্রশাসকদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। যেমন, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এ তরুণ একজন প্রশিক্ষণার্থী সেনা-কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দিতে আসার পর কালক্রমে পুলিশের সুপারিন্টেন্ড (ও আরো পরে একজন ডেপুটি কমিশনার) হিসাবে দায়িত্ব পালন করা লুইন তাঁর স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থে কথাপ্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, “নতুন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টদের অনেকেই আমার মত ছিল তরুণ সামরিক ব্যক্তি, যাদের অপরাধ তদন্ত বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না, এবং যারা দায়িত্বে থাকা সিভিলিয়ান ম্যাজিস্ট্রেটের কর্তৃত্ব  স্বেচ্ছায় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। এর কারণ হল, স্মরণাতীত কাল থেকেই প্রশাসনের এই দুইটি শাখার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি চলে এসেছে।”  তবে ১৯৭৭ সালে ‘সিভিলদের কোনো লোক’ গাড়িতে নেওয়া হবে না বলে যে ঘোষণাটা আমি শুনেছিলাম, সেখানে সংকীর্ণ অর্থে ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা ‘সিভিল-মিলিটারি’ বিভাজন কাজ করছিল, নাকি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র সামরিকায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ‘সিভিল’ কথাটির মাধ্যমে সাধারণ জনগণকেই বোঝানো হয়েছিল, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা যাই হোক, সংশ্লিষ্ট পটভূমিতে যে কোনো না কোনো আকারে ‘ঔপনিবেশিকতার ছায়া’ দেখা যায়, তা আমরা বলতে পারি।