~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~
এই লেখায় যে দার্শনিকের গল্প রয়েছে, তাঁকে নিয়ে একটা ফেসবুক নোট প্রকাশ করেছিলাম ২৬ মে ২০১৭ তারিখে, একদিন সকালে হাঁটতে বেরুনোর পর দেখা এক দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। নিচে সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে শুরু হওয়া পুরানো ফেসবুক নোটটির একটা সম্পাদিত ভাষ্য পেশ করা হল এই ব্লগের পাঠকদের জন্য।[1]
যে সময়ের কথা বলছি (২০১৭ সাল নাগাদ), আমি থাকতাম মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে, এবং তখন নিকটস্থ গণভবনের অদূরে, পুরাতন থানা রোড নামে অধিকতর পরিচিত আওরঙ্গজেব রোডের পাশে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন প্রশস্ত ফুটপাথে প্রতিদিন ভোরে শাকসবজি ফলমূল ইত্যাদির ক্ষণস্থায়ী প্রাতঃকালীন হাট বসত। সকালে হাঁটার ফাঁকে প্রায়ই সেখানে গিয়ে কলা, ডাব ইত্যাদি কিনে আনতাম আমি। এভাবে কলা বা ডাব কেনার জন্য একদিন সেখানে গিয়ে দেখি, একটি গাছের নিচে কালো রঙের খুব ছোট একটি বাচ্চা কুকুর একা বসে ছিল। তার কাছে যেতেই সে সরে গিয়ে ফুটপাথের ধারে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমানো এক লোকের মাথা ঘেঁষে শুয়ে পড়েছিল। এরপর আমি আর বাচ্চা কুকুরটিকে বা তার সহচর ঘুমন্ত মানুষটিকে ঘাঁটাইনি। তবে সেই দৃশ্যটা দেখার পর আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ‘কুত্তা’ হিসাবে আখ্যা পাওয়া এক দার্শনিকের কথা, যার সম্পর্কে প্রচলিত এক গল্পই নতুন আঙ্গিকে ফেসবুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম।
বাচ্চা কুকুর সাথে করে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা লোকটিকে দেখার পর আমি চিন্তা করছিলাম, আমি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী গোছের ক্ষমতাধর কেউ হতাম, তাহলে কি করতাম? হয়তবা এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত লোকটিকে বলতাম, “এই যে, আপনি রাস্তায় শুয়ে আছেন কেন? ঘরবাড়ি নেই? দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আপনাকে দেখেতো মনে হচ্ছে আপনি কিছুই করেন না, বরং ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নিয়েছেন। কেন? বলেন, আপনার কি চাই?” ধরা যাক এর উত্তরে ফুটপাথে শোয়া লোকটি বলে উঠলেন, “মাফ করবেন, আমার কিছু লাগবে না এখন। আমাকে শুধু একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেন”, এবং এরপর বাচ্চা কুকুরকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আবার কম্বলে মুড়িয়ে নিলেন নিজেকে!
রাস্তায় কুকুরের সাথে শুয়ে থাকা লোকটির সাথে প্রধানমন্ত্রী গোছের একজনের সাক্ষাতের যে কল্পিত বিবরণ দেওয়া হল উপরে, তেমন একটি ঘটনা নাকি সত্যিই ঘটেছিল। অন্তত সেরকম একটি কাহিনি চালু রয়েছে আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে নামডাক কুড়াতে শুরু করেছিলেন, এমন একজন গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনেস (Diogenes) সম্পর্কে, যাঁকে একটা ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল যার অর্থ ছিল ‘কুত্তা’ বা ‘কুকুর’, এবং যাঁর নাম জড়িয়ে আছে cynicism নামে পরিচিত দর্শনের একটি বিশেষ তরিকার সাথে। এ প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেলের A History of Western Philosophy থেকে ছোট একটি অনুচ্ছেদের অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হল।[2]
ডায়োজিনেস [রাস্তার] কুকুরের মত করে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁর কারণে তাঁকে cynic বলা হত, যে শব্দটির আদি অর্থ হল ‘কুকুর-সম্বন্ধীয়’ [canine]। তিনি সমস্ত প্রচলিত প্রথা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেটা ধর্মীয় রীতিনীতি, বেশভূষা, থাকাখাওয়া, শালীনতার প্রকাশ যে বিচারেই হোক না কেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি [রাস্তার পাশে রাখা] একটি টাবে [বৃহদাকার মৃৎপাত্রে] বাস করতেন। জীবন ধারণ করতেন ভারতীয় ফকিরদের মত করে, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে। তিনি নিজের ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করেছিলেন সবার সাথে, তবে শুধু গোটা মানবজাতির বেলায় নয়, বরং গোটা প্রাণীজগতের সাথেই। তাঁর সম্পর্কে তাঁর জীবদ্দশাতেই নানান কিংবদন্তী চালু হয়েছিল। একটি হল আলেকজান্ডারের সাথে তাঁর কথিত সাক্ষাতের কাহিনি, যে অনুযায়ী ইতিহাসখ্যাত এই বীর একদিন তাঁর কাছে গিয়ে নিজেই জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি কি কোনো সাহায্য চাও?” ডায়োজেনিসের উত্তর ছিল, “হ্যাঁ, একটু যদি সরে দাঁড়াতেন! আপনি রোদ আটকে রেখেছেন।”
ডায়োজিনেস ও আলেকজান্ডার (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত একটি শিল্পকর্ম)
ইংরেজিতে cynic, cynical প্রভৃতি শব্দ বর্তমানে যে অর্থে (মানুষ মাত্রই স্বার্থপর এমন বিশ্বাস লালন করা এবং অন্যের সততা বা নিঃস্বার্থ মনোবৃত্তিতে সন্দেহ করা লোকদের বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বোঝানোর জন্য) ব্যবহৃত হয়, সেটির সাথে আদি ‘সিনিক’ দর্শনের প্রায় কোনো মিল নেই। বাংলায় cynicism-এর যে পারিভাষিক প্রতিশব্দ করা হয়েছে, ‘হতাশাবাদ’, সেটিও আসলে ডায়োজিনেস ও তাঁর সমমনা দার্শনিকদের দর্শন বা সেটির ঐতিহাসিক পটভূমি ঠিকমত তুলে ধরে না। সত্য মিথ্যা যাই হোক, ‘কুত্তা’ আখ্যা পাওয়া দার্শনিক ডায়োজিনেসের নামে যেসব কাহিনি এখনো জনপ্রিয়, সেগুলির আবেদনের মূলে অন্য কিছু থাকলেও ‘হতাশা’ কখনই মুখ্য ছিল না। আমি নিজে তাঁর নামে প্রচলিত যে গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম কিশোর বয়সে, তা নিচে তুলে ধরছি।
মানুষের সংজ্ঞা কি হবে, একবার এই প্রশ্ন নিয়ে প্ল্যাটোর একাডেমিতে ব্যাপক আলোচনা তর্ক বিতর্কের পর সবাই নাকি সক্রেটিসের একটি সংজ্ঞাকেই ঘষামাজা করে ঠিক করেছিলেন, “মানুষ হল পালকবিহীন দ্বিপদ প্রাণী”। এটি শুনে পরের দিন ডায়োজিনেস নাকি সব পালক তুলে ফেলা একটি মুরগি হাতে একাডেমিতে গিয়ে হাজির হন, এবং সবার সামনে ঘোষণা করেন, “এই যে, একটা মানুষ নিয়ে এসেছি!” (গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময়, খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে আমাদের শিক্ষক অশোক কুমার দেওয়ানের মুখে।[3] তবে ডায়োজিনেসের নাম তিনি বলে থাকলেও তা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক পরে, নৃবিজ্ঞানের একটি পাঠ্যবইয়ে মানুষের সংজ্ঞা বিষয়ক একটি আলোচনায় যখন আবার গল্পটি পড়ি, তখন বুঝতে পারি এর পেছনে রয়েছেন ডায়োজিনিস ওরফে ‘কুত্তা’!)
ডায়োজিনেসের জন্ম হয়েছিল বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত সিনোপ নামের একটি স্থানে। সেখানে তাঁর একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যেখানে দেখা যায় তাঁর হাতে একটি বাতি, এবং পাশে একটি কুকুর। বাতির গল্পটি হল এই যে, ডায়োজিনেস নাকি দিনে দুপুরে বাতি নিয়ে ঘুরতেন, এবং তাঁর হাবভাব দেখে মনে হত তিনি কিছু একটা বা কাউকে খুঁজছেন। কি বা কাকে খুঁজতেন তিনি? এ নিয়ে কেউ জানতে চাইলে ডায়োজিনেস নাকি উত্তর দিতেন, “একজন সৎ মানুষ।”
টীকা
[1] মূল ফেসবুক পোস্টটির শিরোনাম ও লিংক এখানে দেওয়া হল: কুত্তা দার্শনিক।
[2] রাসেলের মূল কথাগুলি (এবং সেগুলির উৎস) আমি টুকে রাখিনি আমার ফেসবুক নোটটি লেখার সময়। হতে পারে আমি তাঁর বইয়ের যে কপি আমার সংগ্রহে ছিল (এবং এখনো হয়ত আছে), সেখান থেকে সরাসরি নেওয়া, বা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।
[3] অশোক কুমার দেওয়ানের কথা আমার এই ব্লগের একাধিক লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে। এগুলির মধ্যে বাস্তবতার পর্ণকুটিরে ‘স্বজাতির ইতিহাস’ খোঁজা শীর্ষক একটি লেখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার শীর্ষক একটি গ্রন্থের উপর আলোচনা রয়েছে।