Monthly Archives: মে 2023

‘কুত্তা’ আখ্যা পাওয়া এক দার্শনিক

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

এই লেখায় যে দার্শনিকের গল্প রয়েছে, তাঁকে নিয়ে একটা ফেসবুক নোট  প্রকাশ করেছিলাম ২৬ মে ২০১৭ তারিখে, একদিন সকালে হাঁটতে বেরুনোর পর দেখা এক দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। নিচে সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে শুরু হওয়া পুরানো ফেসবুক নোটটির একটা সম্পাদিত ভাষ্য পেশ করা হল এই ব্লগের পাঠকদের জন্য।[1]

যে সময়ের কথা বলছি (২০১৭ সাল নাগাদ), আমি থাকতাম মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে, এবং তখন নিকটস্থ গণভবনের অদূরে, পুরাতন থানা রোড নামে অধিকতর পরিচিত আওরঙ্গজেব রোডের পাশে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন প্রশস্ত ফুটপাথে প্রতিদিন ভোরে শাকসবজি ফলমূল ইত্যাদির ক্ষণস্থায়ী প্রাতঃকালীন হাট বসত। সকালে হাঁটার ফাঁকে প্রায়ই সেখানে গিয়ে কলা, ডাব ইত্যাদি কিনে আনতাম আমি। এভাবে কলা বা ডাব কেনার জন্য একদিন সেখানে গিয়ে দেখি, একটি গাছের নিচে কালো রঙের খুব ছোট একটি বাচ্চা কুকুর একা বসে ছিল। তার কাছে যেতেই সে সরে গিয়ে ফুটপাথের ধারে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমানো এক লোকের মাথা ঘেঁষে শুয়ে পড়েছিল। এরপর আমি আর বাচ্চা কুকুরটিকে বা তার সহচর ঘুমন্ত মানুষটিকে ঘাঁটাইনি। তবে সেই দৃশ্যটা দেখার পর আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ‘কুত্তা’ হিসাবে আখ্যা পাওয়া এক দার্শনিকের কথা, যার সম্পর্কে প্রচলিত এক গল্পই নতুন আঙ্গিকে ফেসবুকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম।

বাচ্চা কুকুর সাথে করে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা লোকটিকে দেখার পর আমি চিন্তা করছিলাম, আমি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী গোছের ক্ষমতাধর কেউ হতাম, তাহলে কি করতাম? হয়তবা এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত লোকটিকে বলতাম, “এই যে, আপনি রাস্তায় শুয়ে আছেন কেন? ঘরবাড়ি নেই? দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আপনাকে দেখেতো মনে হচ্ছে আপনি কিছুই করেন না, বরং ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নিয়েছেন। কেন? বলেন, আপনার কি চাই?” ধরা যাক এর উত্তরে ফুটপাথে শোয়া লোকটি বলে উঠলেন, “মাফ করবেন, আমার কিছু লাগবে না এখন। আমাকে শুধু একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেন”, এবং এরপর বাচ্চা কুকুরকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আবার কম্বলে মুড়িয়ে নিলেন নিজেকে!

রাস্তায় কুকুরের সাথে শুয়ে থাকা লোকটির সাথে প্রধানমন্ত্রী গোছের একজনের সাক্ষাতের যে কল্পিত বিবরণ দেওয়া হল উপরে, তেমন একটি ঘটনা নাকি সত্যিই ঘটেছিল। অন্তত সেরকম একটি কাহিনি চালু রয়েছে আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর আগে নামডাক কুড়াতে শুরু করেছিলেন, এমন একজন গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনেস (Diogenes) সম্পর্কে, যাঁকে একটা ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল যার অর্থ ছিল ‘কুত্তা’ বা ‘কুকুর’, এবং যাঁর নাম জড়িয়ে আছে cynicism নামে পরিচিত দর্শনের একটি বিশেষ তরিকার সাথে। এ প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেলের A History of Western Philosophy থেকে ছোট একটি অনুচ্ছেদের অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হল।[2]

ডায়োজিনেস [রাস্তার] কুকুরের মত করে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাঁর কারণে তাঁকে cynic বলা হত, যে শব্দটির আদি অর্থ হল ‘কুকুর-সম্বন্ধীয়’ [canine]। তিনি সমস্ত প্রচলিত প্রথা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেটা ধর্মীয় রীতিনীতি, বেশভূষা, থাকাখাওয়া, শালীনতার প্রকাশ যে বিচারেই হোক না কেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি [রাস্তার পাশে রাখা] একটি টাবে [বৃহদাকার মৃৎপাত্রে] বাস করতেন। জীবন ধারণ করতেন ভারতীয় ফকিরদের মত করে, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে। তিনি নিজের ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করেছিলেন সবার সাথে, তবে শুধু গোটা মানবজাতির বেলায় নয়,  বরং গোটা প্রাণীজগতের সাথেই। তাঁর সম্পর্কে তাঁর জীবদ্দশাতেই নানান কিংবদন্তী চালু হয়েছিল। একটি হল আলেকজান্ডারের সাথে তাঁর কথিত সাক্ষাতের কাহিনি, যে অনুযায়ী ইতিহাসখ্যাত এই বীর একদিন তাঁর কাছে গিয়ে নিজেই জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি কি কোনো সাহায্য চাও?” ডায়োজেনিসের উত্তর ছিল, “হ্যাঁ, একটু যদি সরে দাঁড়াতেন! আপনি রোদ আটকে রেখেছেন।”

ডায়োজিনেস ও আলেকজান্ডার (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত একটি শিল্পকর্ম)

ইংরেজিতে cynic, cynical প্রভৃতি শব্দ বর্তমানে যে অর্থে (মানুষ মাত্রই স্বার্থপর এমন বিশ্বাস লালন করা এবং অন্যের সততা বা নিঃস্বার্থ মনোবৃত্তিতে সন্দেহ করা লোকদের বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী বোঝানোর জন্য) ব্যবহৃত হয়, সেটির সাথে আদি ‘সিনিক’ দর্শনের প্রায় কোনো মিল নেই। বাংলায় cynicism-এর যে পারিভাষিক প্রতিশব্দ করা হয়েছে, ‘হতাশাবাদ’, সেটিও আসলে ডায়োজিনেস ও তাঁর সমমনা দার্শনিকদের দর্শন বা সেটির ঐতিহাসিক পটভূমি ঠিকমত তুলে ধরে না। সত্য মিথ্যা যাই হোক, ‘কুত্তা’ আখ্যা পাওয়া দার্শনিক ডায়োজিনেসের নামে যেসব কাহিনি এখনো জনপ্রিয়, সেগুলির আবেদনের মূলে অন্য কিছু থাকলেও ‘হতাশা’ কখনই মুখ্য ছিল না। আমি নিজে তাঁর নামে প্রচলিত যে গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম কিশোর বয়সে, তা নিচে তুলে ধরছি।

মানুষের সংজ্ঞা কি হবে, একবার এই প্রশ্ন নিয়ে প্ল্যাটোর একাডেমিতে ব্যাপক আলোচনা তর্ক বিতর্কের পর সবাই নাকি সক্রেটিসের একটি সংজ্ঞাকেই ঘষামাজা করে ঠিক করেছিলেন, “মানুষ হল পালকবিহীন দ্বিপদ প্রাণী”। এটি শুনে পরের দিন ডায়োজিনেস নাকি সব পালক তুলে ফেলা একটি মুরগি হাতে একাডেমিতে গিয়ে হাজির হন, এবং সবার সামনে ঘোষণা করেন, “এই যে, একটা মানুষ নিয়ে এসেছি!”  (গল্পটি প্রথম শুনেছিলাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময়, খাগড়াছড়ি হাই স্কুলে আমাদের শিক্ষক অশোক কুমার দেওয়ানের মুখে।[3] তবে ডায়োজিনেসের নাম তিনি বলে থাকলেও তা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক পরে, নৃবিজ্ঞানের একটি পাঠ্যবইয়ে মানুষের সংজ্ঞা বিষয়ক একটি আলোচনায় যখন আবার গল্পটি পড়ি, তখন বুঝতে পারি এর পেছনে রয়েছেন ডায়োজিনিস ওরফে ‘কুত্তা’!)

ডায়োজিনেসের জন্ম হয়েছিল বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত সিনোপ নামের একটি স্থানে। সেখানে তাঁর একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যেখানে দেখা যায় তাঁর হাতে একটি বাতি, এবং পাশে একটি কুকুর। বাতির গল্পটি হল এই যে, ডায়োজিনেস নাকি দিনে দুপুরে বাতি নিয়ে ঘুরতেন, এবং তাঁর হাবভাব দেখে মনে হত তিনি কিছু একটা বা কাউকে খুঁজছেন। কি বা কাকে খুঁজতেন তিনি? এ নিয়ে কেউ জানতে চাইলে ডায়োজিনেস নাকি উত্তর দিতেন, “একজন সৎ মানুষ।”

টীকা 


[1] মূল ফেসবুক পোস্টটির শিরোনাম ও লিংক এখানে দেওয়া হল:  কুত্তা দার্শনিক

[2] রাসেলের মূল কথাগুলি (এবং সেগুলির উৎস) আমি টুকে রাখিনি আমার ফেসবুক নোটটি লেখার সময়। হতে পারে আমি তাঁর বইয়ের যে কপি আমার সংগ্রহে ছিল (এবং এখনো হয়ত আছে), সেখান থেকে সরাসরি নেওয়া, বা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া।  

[3] অশোক কুমার দেওয়ানের কথা আমার এই ব্লগের একাধিক লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে। এগুলির মধ্যে বাস্তবতার পর্ণকুটিরে ‘স্বজাতির ইতিহাস’ খোঁজা শীর্ষক একটি লেখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যেখানে তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার শীর্ষক একটি গ্রন্থের উপর আলোচনা রয়েছে।

শ্রীলঙ্কা: যেনবা এক ফোঁটা চোখের পানি

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

পটভূমি

শ্রীলঙ্কাকে দেখতে এক ফোঁটা অশ্রুর মতই লাগে, যদি আমরা মানচিত্রে দেশটিকে দেখি। এই মিলের বিষয়টা খেয়ালে আসে ২০২২ সালের মে ১১ নাগাদ, শ্রীলঙ্কার সেই সময়কার ঘটনাবলীর উপর একটা ইংরেজি প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে, যেখানে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বর্ণনা করা হয়েমছিল ‘অশ্রু-আকৃতি’র দেশ হিসাবে![১] কিছুটা কাব্যিক এই তুলনা প্রতিবেদন-লেখক ব্যবহার করে থাকতে পারেন দেশটিকে ঘিরে অনেকের মনে জেগে ওঠা বেদনার প্রেক্ষিতে। উল্লেখ্য, সেই সময় আর্থিকভাবে প্রচণ্ড সংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার তথা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদেরও নজর ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই।

উক্ত পটভূমিতে যখন শ্রীলঙ্কার জনগণ ফুঁসে উঠতে শুরু করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে, এসব ঘটনার খবর পড়ে নেটিজেনরা অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশটির ব্যাপারে উৎকণ্ঠা, সহমর্তিতা ইত্যাদি প্রকাশ করছিলেন। যেমন, মে ১০ ২০২২ তারিখে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার এক ফেসবুক বন্ধু তাঁর একটা ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “শ্রীলঙ্কার জন্য মন কাঁদছে।“ তাঁর মনের এই কান্না নিশ্চয় জনরোষের আগুন থেকে পালানোর চেষ্টা করা পতিত নেতাদের জন্য ছিল না, বরং শ্রীলঙ্কার জনগণের জন্য, এবং আপাতদৃষ্টিতে ছিমছাম, সুন্দর ও অপার সম্ভাবনার একটা দেশ কিভাবে এক মহাসঙ্কটময় দশায় চলে এসেছিল, সে কথা ভেবে।

শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে আমরা (বাংলাদেশিরা) কতটা জানি, কিভাবে জানি 

২০১২ সালের মে মাস নাগাদ শ্রীলঙ্কার যেসব ঘটনা গোটা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে চলে এসেছিল, ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে সেগুলির খবর তেমন একটা মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করছিলাম না। তথাপি নানান হেডলাইন পড়ে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছিলাম, ঠিক কি ধরনের পালাবদল সে দেশে ঘটছিল, এবং কেন। সেই প্রেক্ষাপটে তখন সাধারণভাবে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন জেগেছিল, বাংলাদেশে বসে আমরা সচরাচর শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে কতটুকু জানি, বা খোঁজখবর রাখি? আমাদের এই জানার ধরনটা কেমন?  

উপরের প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিল, ছোটবেলায় স্কুলের বইপত্রে শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে তেমন কিছু পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে পৌরাণিক ‘লঙ্কা’ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল বেশ আগে থেকেই, এবং বাংলা ২য় পত্রের মাধ্যমে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ গোছের বাগধারা ইত্যাদি তথা সম্পর্কিত কিছু ধ্যানধারণা অনেকের মত আমিও আত্মস্থ করে নিয়েছিলাম বেড়ে ওঠার কালে। এছাড়া সাহিত্যের সূত্রে – যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতার “সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি” চরণটি আবৃত্তির সময় – মানসপটে হয়তবা ‘সিংহল’ বা ‘শ্রীলঙ্কা’র একটা অস্পষ্ট ছবি ফুটে উঠত, কিন্তু দেশটি নিয়ে আলাদা করে ভাবার তাগিদ বোধ করিনি। তবে এটা মনে পড়ে, একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম, পৌরাণিক ‘লঙ্কা’র ধারণার পেছনে যদি বাস্তবের ভূগোল বা ইতিহাসের কোনো ভিত্তি থাকেও, সেসবের সাথে সমকালীন শ্রীলঙ্কার সীমানা নাও মিলতে পারে!

যাই হোক, আমার উচ্চতর শিক্ষাপর্বে, ‘এথনিসিটি’র মত প্রসঙ্গে (বিশেষ করে ‘এথনিক সংঘাত’ বিষয়ে), শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে কিছুটা জেনেছিলাম, তবে তা ছিল সীমিত আকারে। আরো অনেক পরে, দু’বার, আমার শ্রীলঙ্কা যাওয়ার সুযোগও হয়েছিল।  প্রথমবার ছিল ২০০০ সালের নম্ভেম্বরে (আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময়), যখন এথনিসিটি-সম্পর্কিত একটা সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়বার, ২০০৩ সালের মার্চে, শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলাম কেয়ারের একটা কর্মশালার সুবাদে।

দু’বারই কলম্বোতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার শ্রীলঙ্কা দেখা, তাও হোটেলেই সিংহভাগ সময় কেটেছিল। তবুও এয়ারপোর্টে নামার পর ঢাকার তুলনায় অধিকতর সুশৃঙ্খল একটা পরিবেশ, এবং রাস্তাঘাটে অনেক নারীও দিব্যি স্কুটার চালিয়ে চলাফেরা করছেন এমন দৃশ্য, দেখে ভালো লেগেছিল। শ্রীলঙ্কা যে সাক্ষরতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার চেয়ে এগিয়ে, এটাও জানতাম। সব মিলিয়ে কলম্বো বা শ্রীলঙ্কাকে আমার মনে একটা ভালো লাগার জায়গাই দিয়ে রেখেছিলাম। তবে দু’বারই কলম্বো শহরের অনেক জায়গায় সেনা চৌকি চোখে পড়েছিল, যা ভালো লাগেনি, তবে এই ভালো না লাগার একটা কারণ ছিল এমন দৃশ্যের সাথে আমার পূর্বপরিচিতি! এছাড়া কলম্বোর আরেকটা বিষয় আমি পছন্দ করে উঠতে পারিনি,তবে এক্ষেত্রে কারণটা ছিল অনভ্যস্ততা বা পূর্বপরিচয় না থাকা, আর বিষয়টা ছিল, নারিকেল তেল দিয়ে ভাজা খাবার খাওয়া!

শ্রীলঙ্কায় প্রথমবার সফরে যাওয়ার পর জেনেছিলাম, সেদেশে প্রতিষ্ঠিত এক কিংবদন্তী তথা কিছু প্রাচীন বৃত্তান্ত অনুসারে শ্রীলঙ্কার সিংহল জাতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিজয় সিংহ নামের এক রাজপুত্র, যিনি এই দ্বীপরাজ্যে গিয়েছিলেন বাংলা অঞ্চল থেকে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে, এবং সেখানকার এক স্থানীয় রাজাকে হটিয়ে নিজের তথা তাঁর বংশের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এই সুবাদে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের প্রতি সিংহলিদের অনেকের এক ধরনের ‘জাতিগত’ আত্মীয়তাবোধ কাজ করে বলে মনে হয়, যদিও বিষয়টার গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করিনি আমি, আর এই যোগসূত্রের পেছনকার প্রকৃত ইতিহাস ঠিক কি, বা এ বিষয়ের উপর বাংলাদেশের সাক্ষর সমাজ কতটা খোঁজখবর রাখেন, এসবও আমার জানা হয়ে ওঠেনি।

সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কা তথা পৌরাণিক লঙ্কার আয়নায় নিজেদের দেখা

শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের সম্পর্কে, বা তাদের দমন করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকারের নেওয়া নানান নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে, একদা নিয়মিত খবর থাকত পত্রপত্রিকায়। পরবর্তীতে এই তামিল বিদ্রোহীদের কিভাবে দমন করা হয়েছে, সে খবরও কমবেশি জানা অনেকেরই। এক্ষেত্রে দূর থেকে সবাই যে ধরনের খবর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছেন, তার বাইরে আমি নিজে আলাদাভাবে আর খোঁজ রাখিনি। তবুও ভাসা ভাসা ভাবে যেসব হেডলাইন চোখে পড়ত মাঝেমধ্যে, সেই সুবাদে মনে হয়েছে, যে ‘রাজাপক্ষ’ পরিবার দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, তাদের উত্থানের পেছনে তামিলদের বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমনের একটা যোগসূত্র ছিল।

সম্ভবত উপরে উল্লিখিত প্রেক্ষাপটেই ২০১২ সালের মে মাস নাগাদ সংঘটিত ঘটনাবলীর প্রসঙ্গে শ্রীলঙ্কার সিংহলিদের উদ্দেশ্যে এক তামিল জনপ্রতিনিধির বলা কিছু কথা তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল আমার কাছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের এক প্রয়াত নেতা নাকি একদা এ ধরনের কথা বলেছিলেন, “আজ যেসব বন্দুক আমাদের (অর্থাৎ তামিলদের) দিকে তাক করা, মনে রেখো, একদিন এগুলি তোমাদের (সিংহলি জনগণের) দিকেও ঘুরে যেতে পারে। তখন তোমরা বুঝবে আমরা কিসের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।”[২]

শ্রীলঙ্কায় যেসব কারণে তামিলদের অনেকে সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিল, আর তাদের বিদ্রোহ দমনে সামরিক পন্থা ছাড়া অন্যান্য পন্থা কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল, এসব বিষয়ে ভালো করে না জেনে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক দুরবস্থার পেছনে ‘তামিলদের দমনের অভিশাপ’ জাতীয় কিছু খুঁজতে যাওয়া হয়ত ঠিক হবে না। তবুও অন্য অনেক কিছুর মত বিষয়টিও বিবেচনায় রাখার মত বৈকি। তাছাড়া জাতিগত ভেদরেখার মত বিষয় যদি আমরা বিবেচনায় নাও নেই, একটা বাংলা প্রবাদ আমরা সবসময় মনে রাখতেই পারি, যেটা হল: যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। এমন প্রবাদের পেছনে যে লোকজ প্রজ্ঞা রয়েছে, তা থেকে শিখবার ও ভাববার অনেক কিছুই আছে। এই প্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার আয়নায় নিজেদের ভালো করে দেখে নেওয়ার অনেক কিছু আছে।

টীকা


[১] এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল একটি ফেসবুক পোস্ট হিসাবে, ১৩ মে ২০২২ তারিখে, ব্যাপক জনরোষের মুখে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহিন্দ রাজাপক্ষের পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার কিছুদিন পর। উল্লেখ্য, এরপর আরো মাস দুয়েকের উত্তাল ঘটনাপ্রবাহের পর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন আরেক রাজাপক্ষও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, যেভাবে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের পরিবারের আধিপত্যের অবসান ঘটে। যাই হোক, তখনকার ঠিক কোন প্রতিবেদনে আমি প্রথম শ্রীলঙ্কাকে অশ্রু-আকৃতির দেশ (teardrop-shaped country) হিসাবে বর্ণিত হতে দেখি, তা আমি লিখে রাখিনি। তবে পরে বুঝেছি, এই উপমা শ্রীলঙ্কার বেলায় নিয়মিতই প্রয়োগ করা হয়, যা আগ্রহী যে কোনো পাঠক একটু গুগল করলেই দেখতে পাবেন।   

[২] উদ্ধৃতিটা আমি সম্ভবত নিজের মত করে লিখেছিলাম  ইন্টারনেটে বিক্ষিপ্ত অনুসন্ধানের সূত্রে পাওয়া কিছু তথ্যের ভিত্তিতে, যেগুলির নির্দিষ্ট সূত্র লিখে রাখিনি।