Monthly Archives: নভেম্বর 2021

বহুজাতির বাংলাদেশ: ধারণা, বাস্তবতা ও সম্ভাবনা

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

(রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট আয়োজিত ৪৪২তম সাপ্তাহিক পাবলিক লেকচার, ১৩ নভেম্বর ২০২১)

বক্তৃতার সারসংক্ষেপ[*]

নিচে উল্লেখ করা আমার আমার তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থে ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ ধারণাটি বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে, যে প্রেক্ষাপটে এই ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই বক্তৃতায়।

বহুজাতির বাংলাদেশ: ধারণা

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ‘বাঙালি’ হিসাবে পরিচিত হলেও এই পরিচয়ের বাইরেও বিভিন্ন নামে পরিচিত আরো অনেক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বহুকাল ধরেই এই ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশে বসবাস করে এসেছে। এই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে প্রকাশিত আমার একটি বইয়ের শিরোনামে আমি ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলাম। তবে এটি আমার উদ্ভাবন ছিল না, বরং আগে থেকেই অন্যরাও কেউ কেউ ব্যবহার করেছেন। আর ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ কথাটি সরাসরি ব্যবহৃত হোক বা না হোক, এর সাথে যে ধারণা জড়িয়ে আছে, সেটি অজানা কোনো বিষয় নয়, বরং কোনো না কোনোভাবে এটিকে তুলে ধরার চেষ্টা দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পঞ্চম শ্রেণীর আমার বাংলা বই নামক বইয়ের ‘এই দেশ এই মানুষ’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে লেখা রয়েছে, “বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি হলেও তাদের ছাড়া আরও লোকজন আছে – চাকমা, গারো, মারমা … ইত্যাদি। এদের ভাষা এদের নিজেদের। … একই দেশ, অথচ কত বৈচিত্র্য।” এই বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশকেই আমরা অভিহিত করছি ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ হিসাবে।

তবে শুরুতেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘বাঙালি’ ছাড়া ‘অন্য’ যারা বাংলাদেশে রয়েছে, তারাতো আসলে ‘উপজাতি’, বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’, তাদেরকে কি ‘জাতি’ বলা যায়? আবার আরেকদিক থেকে প্রশ্ন তোলা যায়, ‘জাতি’ বলতেইবা আমরা কি বুঝি? কখন কোন প্রেক্ষাপটে কাদেরকে কোন অর্থে আমরা ‘জাতি’ বলতে পারি? এমন প্রশ্ন সামনে রেখে ‘জাতি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি, বিবিধ অর্থ ইত্যাদি পর্যালোচনা করতে গেলে দেখা যায়, সমকালীন প্রেক্ষাপটে মূলত ইংরেজি ‘নেশন’ শব্দের সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত ‘জাতি’ শব্দটি একদা ব্যবহৃত হত ব্যাপকতর অর্থে, সাধারণভাবে ‘প্রকার’ বোঝাতে (যেমন ‘নারী জাতি’, ‘উদ্ভিদ জাতি’ ইত্যাদি)। অন্যদিকে ‘জাতিতে মুচি/ব্রাহ্মণ/মুসলমান’ ইত্যাদি বিবরণও সাহিত্যে পাওয়া যায়।  আবার ব্রিটিশ শাসনামলে চালু হওয়া ‘ট্রাইব’ কথাটির বাংলা হিসাবে বিংশ শতাব্দী নাগাদ ‘উপজাতি’ কথাটির প্রচলন শুরু হলেও এই বর্গের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বেলায়ও ‘জাতি’ কথাটা বিনাপ্রশ্নেই ব্যবহার করা হত একদা।

আমাদের আলোচনার প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, তা হল, বাংলাদেশে জাতি শব্দটা প্রধানত ‘বাঙালি’দের বেলায় প্রয়োগ করার প্রবণতা শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে। অন্যদিকে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য এথনিক গোষ্ঠীর বেলায় ‘জাতি’ শব্দের বদলে প্রয়োগ হতে থাকে বিবিধ পারিভাষিক উদ্ভাবন, যেগুলির মধ্যে রয়েছে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, জাতিগোষ্ঠী, জনজাতি, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, নৃ-গোষ্ঠী ইত্যাদি। এদিকে ইংরেজিতে প্রচলিত ‘এথনিক গ্রুপ’ কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে বাংলাদেশে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ও পরে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ কথাগুলি ইদানিং ব্যবহৃত হলেও শুরুতে এই কথাগুলিকে অনেকে ইংরেজি ‘রেইস’ শব্দের সমার্থক হিসাবেই ব্যবহার করতেন, যে ‘রেইস’ শব্দটি বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধ্যানধারণা বেশ গোলমেলে।

বহুজাতির বাংলাদেশ: বাস্তবতা

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের পেছনে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বড় ভূমিকা রেখেছিল, তা যে যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল, এবং সংকীর্ণ কোনো গণ্ডীতে বাঁধা ছিল না, তার অন্যতম প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের পাশাপাশি এদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক জাতির মানুষেরাও ব্যাপক হারে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল। এই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে শুধু ‘বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম’, বা বাংলাদেশকে শুধু ‘বাঙালির রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখার কোনো সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না। তথাপি আমরা দেখি যে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত গণপরিষদে যখন এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয় যে, “বাংলাদেশের নাগরকিগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন”, তখন প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে একমাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নিঃসঙ্গ প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল!

এদিকে গত পঞ্চাশ বছরে সংবিধানে অনেক অদলবদল ঘটেছে। এই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে সূচিত সংবিধানের বিভিন্ন পরিবর্তনকে আমরা যেভাবেই মূল্যায়ন করি না কেন, সমকালীন বাংলাদেশে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের বাইরে থাকা অন্যান্য জাতিসমূহকে এখনো প্রান্তিক করে রেখে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবেই। এই বক্তব্যের সমর্থনে বর্তমান সংবিধানের ৬(২), ৯ প্রভৃতি অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়, যেগুলিতে এমন কোনো স্বীকৃতি নেই যে, বাংলাদেশে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের বাইরে অন্য কোনো জাতি রয়েছে বা থাকতে পারে। একইভাবে, বাঙালি হিসাবে পরিচিত ছিলেন না, এমন বহু গারো, সাঁওতাল, কোচ, ত্রিপুরা, মারমা ইত্যাদি গোষ্ঠীভুক্ত যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অবদানকে সে অর্থে স্বীকার করা হয় নি। একইভাবে বাংলাদেশে যে বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষা প্রচলিত রয়েছে, এটিও সংবিধানের কোথাও আমলে নেওয়া হয় নি।  মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দেওয়া একমাত্র জাতি হিসাবে অহংকারের দাবিদার বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা কিভাবে এদেশের ভাষিক বৈচিত্র্যকে সাংবিধানিকভাবে আমলে নিতে ব্যর্থ হলেন, তা সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়। 

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটিকে অনেকে বাংলাদেশের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি হিসাবে দেখে থাকেন। কিন্তু এই অনুচ্ছেদে যে শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে (“উপজাতি, ক্ষুদ্র … নৃ-গোষ্ঠী”) বা সেগুলির সরকারি ইংরেজি অনুবাদ যেভাবে করা হয়েছে (“tribe, minor race”), এসব যথেষ্ট গোলমেলে। আর বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের স্বীকৃতির যে দাবি জানানো হয়ে আসছিল আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়, সে দাবির উত্তর হিসাবে যাঁরা সংবিধানের ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদকে দেখতে চান, তাঁরা এই বাস্তবতা অগ্রাহ্য করেন যে, উক্ত দাবির পেছনে মৌলিক যে বিষয়গুলি ছিল – আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও ভাষিক স্বাতন্ত্রের বিষয় – সেগুলির কোনো উল্লেখ এই অনুচ্ছেদে নেই!   

সংবিধানে যেভাবে বাংলাদেশের জাতিগত বৈচিত্র্যের বিষয়টি অনেকটাই অস্বীকৃতির আড়ালে রয়ে গেছে, তার প্রতিফলন অন্য আরো বিভিন্ন পরিসরেও দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে পঞ্চম শ্রেণীর আমার বাংলা বই-এর ‘এই দেশ এই মানুষ’ শীর্ষক রচনাটির কথা আবার উল্লেখ করা যায়, যা শুরু হয়েছে এই কথাগুলি দিয়ে, “আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা বাংলাদেশে জন্মেছি। আমরা বাংলাদেশের বাঙালি।” কিন্তু প্রশ্ন হল,  বাংলাদেশ যে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ, এই কথাটি বোঝানোর জন্য লেখা কোনো রচনার শুরুর কথাটা “আমাদের সৌভাগ্য যে … আমরা বাংলাদেশের বাঙালি” হওয়া কাম্য কি? উক্ত রচনায় বা অন্যত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলি কেন বাঙালিময় হবে?

আসলে বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষদের সম্পর্কে উল্লিখিত পাঠ্যপুস্তকের বাঙালি-কেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এই প্রবণতা কাজ করছে ব্যাপকতর পরিসরে, বিভিন্ন পর্যায়ে – জাতীয়তার চেতনা নির্মাণে, ইতিহাসবোধে, রাষ্ট্রীয় নীতিমালায়, সাহিত্যে, এবং এদেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির মধ্যে।  এই বিষয়গুলিকেই আমি সামনে নিয়ে এসেছি আমার বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে। 

জাতিরাষ্ট্রের কিনারা থেকে বৈচিত্র্যবান্ধব এক স্বপ্নের স্বদেশ তথা পৃথিবীর দিকে যাত্রা

বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বরূপকে বাঙালি-কেন্দ্রিক, একদেশদর্শী ও বৈচিত্র্যবিমুখ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টার পর আমার যে দ্বিতীয় প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আমি এদেশের প্রান্তিক মানুষদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে ‘প্রান্তিকতা’র বিষয়টিকে আমি প্রধানত আদিবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরলেও এমন উপস্থাপনাকে আমি নমুনা হিসাবেই পেশ করেছি। পাশাপাশি সাধারণভাবে আমি এও বলে নিয়েছি শুরুতেই যে,  ‘প্রান্তিকতা’ একটি প্রেক্ষিত-সাপেক্ষ ও বহুমাত্রিক ধারণা, যার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এক বা একাধিক ‘কেন্দ্র’। ফলে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রান্তিকতার রূপ ও মাত্রা যে বহুবিধ হতে পারে, হয়ে থাকে, তা আমলে নিয়েই সেগুলির দু’একটি দিকের উপর সীমিত পরিসরে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি আমি আমার বইটিতে। এক্ষেত্রে আমি এও যোগ করেছি যে, জাতিরাষ্ট্রের কিনারায় শিরোনামে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ সংকলনে এক সূত্রে গাঁথা হয়েছে ‘সর্বজনের ও বহুজাতির বাংলাদেশের লক্ষ্যে সংগ্রামরত তরুণদের জন্য একগুচ্ছ রচনা’। এখানে ‘সর্বজন’ কথাটি বোঝানো হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-লিঙ্গ-এলাকা প্রভৃতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিককে বোঝাতে, যাদের সবার একই মৌলিক অধিকার ও সমান মর্যাদা থাকার কথা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সর্বজনের বাংলাদেশ’ হল এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা, যার লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এবং যার রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সংবিধানের কিছু জায়গায়। অন্যদিকে ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ বলতে বোঝানো হয়েছে এমন একটি রাষ্ট্রের ধারণা যা শুধুমাত্র বা প্রধানত ‘বাঙালি’র বলে কল্পিত হবে না, বরং যেটিতে এ দেশে বসবাসরত সকল জাতি ও ভাষারও যথাযথ স্বীকৃতি থাকবে। তাত্ত্বিকভাবে ‘সর্বজনের বাংলাদেশ’ ধারণার মধ্যেই ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ও নিহিত থাকার কথা, কিন্তু বর্তমানে সেই বাস্তবতা পুরোপুরি বিরাজ করছে না।  এ কারণেই আলাদা করে ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।

সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশকে সর্বজনের ও বহুজাতির একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান, এমন যে কেউ আদর্শগতভাবে সকল ধরনের বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবেন। অন্যভাবে বলা যায়, ‘সর্বজনের ও বহুজাতির বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামরত তরুণ’ হলেন সেই জন, যিনি মনে প্রাণে গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করেন, যিনি বিশ্বাস করেন রাষ্ট্র হবে সকল নাগরিকের, যাতে কোনো বিশেষ শ্রেণী, গোষ্ঠী বা বর্গের মানুষ অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে প্রান্তিক ও অধস্তন হয়ে থাকবে না।

ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় ঢাকা একদেশদর্শী বাংলাদেশ থেকে বেরুনোর তাগিদ

২০২০ সালে ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ শিরোনামে আমার যে বই প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ ধারণাটি প্রাসঙ্গিক হিসাবে পেশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিকতার ছায়া শনাক্ত করার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র হিসাবে যেসব বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছে, সেগুলির মধ্যে সমকালীন বাংলাদেশিদের ব্যবহৃত কয়েক ধরনের পরিচয় (যেমন পাহাড়ি, বাঙালি, জুম্ম) থেকে শুরু করে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর কিছু দিক, এদেশের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস, জনগণের বিবিধ অংশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য প্রভৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে আবার তুলে ধরতে গিয়ে আমি লিখেছি, তথাকথিত মূলধারার বিভিন্ন উপস্থাপনায় আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত যে বাংলাদেশকে হাজির করা হয়, তা যে শুধু ঔপনিবেশিকতার ছায়াতেই ঢাকা তা নয়, একই সাথে বর্তমান সময়ের প্রবল জাতীয়তাবাদেও মোড়া থাকে। এই প্রবণতার বাইরে যে বাংলাদেশের সম্ভাবনার উপর এই গ্রন্থে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হল বহুজাতির, বহুভাষার ও বহু সংস্কৃতির বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে ভাষা, সংস্কৃতি, ও জাতীয়তার বিচারে সমরূপ হিসাবে তুলে ধরার একদেশদর্শী প্রবণতা বিভিন্ন পর্যায়ে শিকড় গেড়ে থাকলেও বাস্তবে খোদ ‘বাঙালি’ বর্গের ভেতরে যেমন যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি এই বর্গের বাইরে থাকা বাংলাদেশিরা জনসংখ্যার আকারে ‘ক্ষুদ্র’ বলে বিবেচিত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ব্যাপক বৈভব। এমন সব গোষ্ঠীকে আমলে নিলে বাংলাদেশের সার্বিক বৈচিত্র্য যে অনেক বেশি বর্ণিল হয়ে ধরা দেবে, তা বলা বাহুল্য। এই বিষয়টি সামনে রেখে একদেশদর্শী জাতীয়তাবাদ তথা ঔপনিবেশিকতার ছায়ার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশকে বর্ণিল এক নকশিকাঁথা হিসাবে কল্পনা করে তা সামনে আনার সম্ভাব্য পন্থা আমি আলোচনা করেছি।


[*]Zoom-এ আয়োজিত বক্তৃতার জন্য যারা নিবন্ধন করেছিলেন, তাঁদের জন্য এই সারসংক্ষেপটি আমি তৈরি করেছিলাম আয়োজক সংস্থার অনুরোধে। পুরো বক্তৃতার যে পূর্বলিখিত ভাষ্য আমি ব্যবহার করেছিলাম, তা নিচে দেওয়া হল।   

মৃতদের নামের কারবার

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

না, নিহতের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই – না রক্তের, না আত্নার।
আমি এসেছি তার নাম শুনে,
কারণ আমার কারবার হল মৃতদের নানান বাহারের নাম কুড়ানো।
প্রজাপতি সংগ্রাহকদের মতই আমি কুড়িয়ে বেড়াই,
মরে যাওয়া বিভিন্ন সত্তার নামের খোলস,
এমন সব নাম যেগুলির রয়েছে প্রভূত চাহিদা –
কবিতায়, সংবাদে, বিবৃতিতে, বক্তৃতায়, প্রকল্প প্রস্তাবনায়…।

আমার ঝুলিতে জমা আছে অনেক বাহারি নামের খোলস –
মৃত মানুষের নাম,
মৃত জনপদের নাম,
মৃত বিশ্বাসের নাম।

শুনবেন কিছু নাম – এমন কিছু নাম যেগুলো দিয়ে সাজানো যায় কবিতা?

শুনুন তাহলে –

লংগদু
সুজাতা
সাগরি
নিশ্চিতপুর
ফেলানী
রামু
সাভার
তাইন্দং
আদুরী
সাঁথিয়া
শ্যামল হেমব্রম

(৪/১১/২০১৩ তারিখের একটি ফেসবুক পোস্টের একটুখানি সম্পাদিত ও হালনাগাদকৃত ভাষ্য। কিছু নামের সাথে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে লেখা কবিতা বা নিবন্ধের লিংক রয়েছে।)