জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে

গ্রন্থপরিচিতি

২০১৮ সালে  প্রকাশিত, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা

এই লেখায় আমার জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে  বইটির বিশদ পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন সূত্রসমেত। বইটির যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে এর পেছনের মলাটে, সেটির পর নিচে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হয়েছে এর সূচিপত্র, মুখবন্ধের অংশবিশেষ, ও ভূমিকার বিভিন্ন নির্বাচিত অংশ। যেসব পাঠকের জন্য বইটি সংগ্রহ করা দুরূহ, তাঁদের সুবিধার্থে এতে থাকা অনেকগুলি প্রবন্ধের পূর্ব-প্রকাশিত ভাষ্যের (যেসব লেখা এই ব্লগসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে পাওয়া যায় সেগুলির) হাইপারলিংক  দেওয়া হয়েছে সূচিপত্রে উল্লিখিত শিরোনামগুলির সাথে। অন্য লেখাগুলির বেলায় প্রাসঙ্গিক সূত্র দেওয়া হয়েছে এই পোস্টের শেষে দেওয়া টীকার মাধ্যমে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, প্রকাশিত বইয়ে এমন কিছু প্রবন্ধ রয়েছে, যেগুলি অন্তর্জাল-ভিত্তিক কোনো মাধ্যমে এখনো প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া অধিকাংশ প্রবন্ধের বেলায় এমন কিছু সম্পাদিত অংশ, টীকা বা তথ্যসূত্র থাকতে পারে, যেগুলি পূর্ব-প্রকাশিত ভাষ্যগুলিতে নেই। কাজেই আগ্রহী পাঠকদের অনুরোধ করব, সম্ভব হলে ছাপানো বইটি জোগাড় করে পড়তে (বইটি সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা সংহতি প্রকাশনের শো-রুমে পাওয়া যাওয়ার কথা, যেটির ঠিকানা হল ১২৯ কনকর্ড এম্পোরিয়াম,  কাটাবন, ঢাকা। এছাড়া এই বইসহ আমার প্রকাশিত আরো দুইটি বই রকমারি থেকেও পাওয়া যাওয়ার কথা, যে সংক্রান্ত লিংক এখানে দেওয়া হল: https://www.rokomari.com/book/author/33636/prashanta-tripura)। তবে যাঁদের পক্ষে আমার বইটি সংগ্রহ করা সম্ভব না, তাঁরা এই পোস্টে দেওয়া বিভিন্ন সূত্র অনুসরণ করে অনেকগুলি নিবন্ধের কোনো না কোনো ভাষ্য পড়ে নিতে পারবেন এবং এর ভিত্তিতে পুরো বইটি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাবেন বলে আশা করছি।

মলাটের পেছনে দেওয়া গ্রন্থপরিচিতি

বাংলাদেশে হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানত বাঙালির, মুসলমানের, শিক্ষিতজনের, বিত্তবানের এবং পুরুষের দেশ। এই উপেক্ষিত বাস্তবতার আলোকেই লেখা হয়েছে এই গ্রন্থে সংকলিত বিবিধ রচনা। বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে তাদের উপজাতি হসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রান্তিকতার আরও কিছু রূপ গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। এসব রচনায় প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত জনপদে বাস করা ম্রো, ত্রিপুরা, গারো, ওরাঁও, সান্তালসহ নানা প্রান্তিক জাতির মানুষদের কথা, ভিটামাটি হারানো, হত্যা, ধর্ষণসহ তাদের অহরহ মুখোমুখি হতে হয়, এমন অনেক ঘটনার বিবরণ। তবে প্রান্তিকতার খাদে থাকা মানুষদের ক্ষোভ বা হতাশাকে বড় করে দেখানোর বদলে অধিকাংশ রচনাতেই সামনে আনা হয়েছে তাদের সংগ্রামের কাহিনী, এবং আহ্বান জানানো হয়েছে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন, যথাযথ সংকল্প ও নিরলস প্রয়াসের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার।

সূচিপত্র

মুখবন্ধ [নিচে নির্বাচিত অংশবিশেষ রয়েছে]

ভূমিকা: যে ধরনের প্রান্তিকতা ও স্বপ্ন নিয়ে এই সংকলন [নিচে নির্বাচিত অংশবিশেষ রয়েছে]

প্রান্তিকতার পটভূমি

উত্তরণের সংকল্প

স্বপ্নের গতিপথ

টীকা

তথ্যসূত্র

মুখবন্ধ

এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ২৫ বছরের একটা দীর্ঘ কালপর্বের দুই প্রান্ত থেকে বেছে নেওয়া আমার বিভিন্ন রচনা, যেগুলিতে প্রান্তিকতার বিশেষ কিছু রূপ ও দিক সম্পর্কে বর্ণনা-বিশ্লেষণ ও সেসবকে কাটিয়ে ওঠার আহ্বান রয়েছে। ভূমিকা বাদে মোট যে সতেরটি নিবন্ধ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলিকে কালানুক্রিকভাবে মোটা দাগে দুইটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে রয়েছে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে লেখা পাঁচটি নিবন্ধ, যেগুলি রাখা হয়েছে সংকলনের শুরুর দিকে, ‘প্রান্তিকতার পটভূমি’ শিরোনামের আওতায়। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে লেখা মোট ১২টি নিবন্ধ, যেগুলিকে আবার বিষয়গতভাবে দুইটি ভাগে সাজানো হয়েছে ‘উত্তরণের সংকল্প’ এবং ‘স্বপ্নের গতিপথ’ শিরোনামের আওতায়, যেগুলিতে যথাক্রমে পাঁচটি ও সাতটি লেখা রয়েছে।

সংকলনের প্রথম ভাগে অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি নিবন্ধের রচনাকাল (১৯৯১ – ২০০০) মোটামুটিভাবে আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মেয়াদের সাথে মিলে যায়। তবে এই কালপর্ব থেকে নেওয়া নিবন্ধগুলির মধ্যে দুইটি আমি লিখেছিলাম ‘সাঙদারি’ ছদ্মনামে, একটি জাবিতে যোগদানের ঠিক আগে, এবং আরেকটি জাবির শিক্ষক থাকা অবস্থায়। উভয় লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তুআ নামের একটা সাময়িকীতে, যে কাগজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে আমি কিছু সময় সক্রিয় ছিলাম। স্বনামে লেখা নিবন্ধ তিনটি রচিত বা প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি ভিন্ন পরিসরে: একটি ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের বিদ্যাজগতে সুপরিচিত গবেষণা পত্রিকা সমাজ নিরীক্ষণ-এ; আরেকটি হল ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ, যে সেমিনারটি আয়োজিত হয়েছিল তৎকালীন দুইজন বিরোধীদলীয় সাংসদের নেতৃত্বে, ‘বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয়’ মর্মে ঘোষিত সে সময়কার সরকারি অবস্থানের পটভূমিতে; আর তৃতীয়টি হল ২০০০ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত আমার একটি ‘প্রতিক্রিয়া’, যা সে সময় বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এগুলিসহ যে পাঁচটি নিবন্ধ সংকলনের শুরুতে রাখা হয়েছে ‘প্রান্তিকতার পটভূমি’ শিরোনামের আওতায়, সেগুলি তুলনামূলকভাবে আগেকার লেখা হলেও এখনো সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি, এবং লেখাগুলি যেহেতু এর আগে সহজলভ্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত হয় নি, এই সংকলনে সেগুলির অন্তর্ভুক্তিকে অনেক পাঠক স্বাগত জানাবেন বলে আশা করছি।

সংকলনে অন্তর্ভুক্ত বাকি ১২টি নিবন্ধের সবই লেখা হয়েছে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, এবং একটি বাদে এসব লেখার প্রায় প্রতিটাই আমি লিখেছি অনুরুদ্ধ হয়ে, যদিও আগ্রহ ও আনন্দের সাথেই এগুলি লিখেছিলাম। লেখাগুলির অধিকাংশই ছিল শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য, ফলে এগুলিতে সাধারণভাবে ‘তরুণদের উদ্দেশ্যে আমার কিছু কথা’ গোছের একটা স্বর আছে। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ২০১২ সালের প্রথমার্ধে আমি আমার তখনকার চাকরি – যা ছিল একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় – ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ফলে সে বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আমি নতুন করে লেখালেখিতে মনোযোগ দেওয়ার সময় পেয়েছিলাম। কাজেই এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত শেষের ১২টি রচনার মধ্যে একটি বাদে সবগুলিই ছিল সেই চাকরি ছাড়ার পরের সময়কালে লেখা। এক্ষেত্রে যে লেখাটি একটু ব্যতিক্রম, ‘নতুন দিনের আলোর দিশারীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ শিরোনামের একটি রচনা, তা হল আমার একটা দীর্ঘতর স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধের অংশ, যা আমি লিখেছিলাম ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পূর্বোল্লিখিত চাকরিতে খুব কর্মব্যস্ত থাকা অবস্থায়।  আমার মনে আছে, নিবন্ধটি আমি শেষ করেছিলাম কক্সবাজারের একটি হোটেলে, যেখানে আমাদের প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত কর্মশালা হচ্ছিল। সেই কর্মশালায় আমার নিজের ভূমিকা আমি যথাযথভাবেই পালন করেছিলাম, কিন্তু এর বাইরে তখন আমার সমস্ত মনোযোগ ছিল সেই রচনার প্রতি, যা আমি উপস্থাপন করেছিলাম কক্সবাজারের কর্মশালাটি শেষ হওয়ার ঠিক পরেই খাগড়াছড়িতে আয়োজিত একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে। কে জানে, সেই রচনা লেখার অভিজ্ঞতা হয়তবা আমার ভেতরের লেখক-গবেষক সত্তাকে প্ররোচিত করেছিল ৯টা-৫টা চাকরির শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে!  যাই হোক, এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বহুজাতির বাংলাদেশ শিরোনামে আমার যে সংকলন ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে, সেটিতে অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ প্রবন্ধও মূলত ২০১২ সালের প্রথমার্ধের পরই লেখা। সেই বিবেচনায় এবং বিষয়বস্তুর বিচারে বইটির একটি সম্পূরক গ্রন্থ বিসাবে দেখা যায় বর্তমান সংকলনকে।

এখানে একটা বিষয় যেটা উল্লেখ না করলেই নয় সেটা হল, যে লেখাগুলি নিয়ে বর্তমান সংকলন, সেগুলির একটা বড় অংশ – ‘স্বপ্নের গতিপথ’ শিরোনামের আওয়তায় সাজানো মোট সাতটি রচনা – আমি লিখেছিলাম বাংলাদেশের ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম’ (টিএসএফ)-এর বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য। প্রকৃতপক্ষে, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার একটি অনুষ্ঠানে [যা আয়োজিত ছিল টিএসএফ-এর প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষে] যোগ দিতে গিয়েই প্রথমে আমার মাথায় এই সংকলনের চিন্তা এসেছিল। এক্ষেত্রে শুরুতে আমার ভাবনা ছিল আমার বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক লেখা একটি বইয়ের আকারে বাঁধাই করে সীমিত আকারে উপহার হিসেবে বিতরণ করার। পরে যখন বুঝতে পারি, এতে যে খরচ পড়বে, তা দিয়ে একটি বইই ছাপিয়ে ফেলা যায়, আমি একটু সময় নিয়ে তাই করার সিদ্ধান্ত নেই। সে অনুযায়ী টিএসএফের সেই অনুষ্ঠানে আমি বর্তমান বইটি প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে শিরোনামটাও জানিয়ে দিয়েছিলাম। তবে ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের মূল পাঠকগোষ্ঠী ধরে নিয়ে লেখা আমার যে রচনাগুলি সংকলনের শেষে রয়েছে, অথবা সংকলনের অন্যত্র ত্রিপুরাদের উদাহরণ-কেন্দ্রিক আরো যে কয়েকটি নিবন্ধ রয়েছে, সেগুলিতে উপস্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ের সাথে অন্যান্য প্রান্তিক বর্গভুক্ত বহু পাঠকও নিজেদের অভিজ্ঞতা মেলাতে পারবেন, এবং লেখাগুলি থেকে ভাবনার খোরাক পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসএফের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বেশ কয়েকজন কর্মীও আমাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন, আমার কথা আগ্রহ নিয়ে শুনেছিলেন, এবং পরে আমার সাথে কথাও বলেছিলেন। এ ধরনের অভিজ্ঞতাও আমাকে উৎসাহিত করেছে বর্তমান সংকলনটিকে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরার জন্য উপযোগী করে সাজাতে।  এক্ষেত্রে আমি কতটা সফল হয়েছি, তা বিচারের ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।

[মুখবন্ধের বাকি অংশে রয়েছে বিভিন্নজনের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার।]

ভূমিকা: যে ধরনের প্রান্তিকতা ও স্বপ্ন নিয়ে এই সংকলন

বাংলাদেশকে যদি আমরা একটি নির্মাণাধীন স্বপ্ন হিসেবে কল্পনা করি, তবে মনের চোখে আমরা সহজেই দেখতে পাই, এই রাষ্ট্রের নির্মাণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বিপজ্জনক ও অরক্ষিত গহ্বর, যেগুলিতে নিয়মিত হারিয়ে যাচ্ছে বহু মানুষ, বিশেষত বিভিন্ন প্রান্তিক বর্গের শিশু-কিশোর-তরুণেরা।

অবশ্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক খাদে হারিয়ে যাওয়া থেকে এদেশের শিশুদের কিভাবে রক্ষা করা যায়, সে প্রসঙ্গের প্রতি সরাসরি বিশেষ নজর দেওয়া হয় নি এই গ্রন্থের কোথাও। বরং সার্বিকভাবে এতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এমন কিছু বিশ্লেষণ ও বক্তব্য, যেগুলি প্রান্তিকতার কিছু রূপ সম্পর্কে পাঠকের জন্য ভাবনার খোরাক জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস। একই সাথে এটিও আমি আশা করছি যে, সংকলিত লেখাগুলি নানান ধরনের প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকা তরুণদের উদ্বুদ্ধ করবে সকল বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, সেটা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্নের সন্ধানে বা সমাজ ও রাষ্ট্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধনের সামষ্টিক লক্ষ্যে, যেটাই হোক না কেন।

‘প্রান্তিকতা’র বহুমাত্রিকতা

‘প্রান্তিকতা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে এই গ্রন্থে, তা একটু স্পষ্ট করে নেওয়া যাক শুরুতেই।  এক্ষেত্রে যে বিষয়টা শুরুতেই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে, তা হল, ‘প্রান্তিকতা’ একটি প্রেক্ষিত-সাপেক্ষ ও বহুমাত্রিক ধারণা, যার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এক বা একাধিক ‘কেন্দ্র’। যেমন, জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় ‘বাঙালি’ রয়েছে কেন্দ্রে, ফলে যারা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি হিসেবে পরিচিত নয় বা নিজেদের এই বর্গে ফেলে না, তারা এই প্রেক্ষিতে, জাতিগতভাবে, প্রান্তিক। একইভাবে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কেন্দ্রে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অবস্থানের প্রেক্ষিতে অন্য সকল ধর্ম ও বিশ্বাস-ব্যবস্থার অনুসারীরা প্রান্তিক হয়ে যায়। এ ধরনের পরিচয়ের বাইরে একজনের সামাজিক অবস্থান আরো নির্ভর করতে পারে তার বংশমর্যাদা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিত্ত, লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে, যেসবের কোনো না কোনো মাপকাঠিতে একজন প্রান্তিক হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

সংকলনের একেবারে শুরুতে যে প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা ও আত্মপরিচয়ের সংকট’ শিরোনামে, সেখানে প্রান্তিকতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে দুইটি পর্যায়ে – প্রথমত, একটি জাতি কিভাবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে উঠতে পারে, তা দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর উদাহরণ দিয়ে, এবং দ্বিতীয়ত, ‘উপজাতি’ ধারণার নিগড়ে ত্রিপুরাসহ বাংলাদেশের একাধিক জাতি কিভাবে প্রান্তিকতায় পর্যবসিত হয়েছে, সে বিষয়টি পর্যালোচিত হয়েছে সাধারণভাবে। দ্বিতীয় নিবন্ধে, যা লেখা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ-ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ উপলক্ষে, বাংলাদেশে সরকারিভাবে ‘উপজাতীয়’ হিসেবে অধিকতর পরিচিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে রাষ্ট্র কিভাবে তাদেরকে প্রান্তিক করে দিয়েছিল আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনযোগ্য কিছু অধিকারের প্রশ্নে, সেই প্রবণতার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তৃতীয় নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে কিভাবে প্রান্তিকতার স্মৃতি ও তা অতিক্রমের কল্পনা সাংস্কৃতিকভাবে লালিত হতে পারে একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস বোধ, লোককাহিনী, ধর্মীয় ঐতিহ্য ইত্যাদির মাধ্যমে।  এক্ষেত্রেও আলোচনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের অভিজ্ঞতা। এরপর আরো সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া কিছু উদাহরণ সহকারে পেশ করা আলোচনার মাধ্যমে,  ‘ভালবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটি বিষ’ শিরোনামের নিবন্ধে নজরে আনা হয়েছে প্রান্তিকতার অনুষঙ্গ হিসেবে পরিলক্ষিত একটি বিশেষ সামাজিক সমস্যা, মদ্যাসক্তি, যা বহু আদিবাসী সমাজেই চোখে পড়ে। এরপর ‘প্রান্তিকতার স্মৃতি ও ইতিহাস’ শিরোনামের আওতায় অন্তর্ভুক্ত পঞ্চম ও সর্বশেষ নিবন্ধ ‘পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালের একটি কাহিনী’র পটভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের একটি বিশেষ সময়ের ছবি তুলে ধরা হয়েছে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের নানাভাবে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে।

প্রান্তিকতা কাটিয়ে উঠে স্বপ্নের মহাকাশে বিচরণের আহ্বান

‘প্রান্তিকতার পটভূমি’র পর বাকি যে রচনাগুলি এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলিতে পাঠকদের জন্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সকল ধরনের প্রান্তিকতাকে অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গী, সংকল্প ও স্বপ্ন। এই রচনাগুলিকে দুই ভাগে সাজানো হয়েছে মূলত প্রকাশের ক্ষেত্র অনুযায়ী। ‘উত্তরণের সংকল্প’ শিরোনামের আওতায় সাজানো পাঁচটি লেখার প্রথমটি, ‘‘ভালোবাসা দিবসে’ তরুণদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি খোলা চিঠি’, আমি লিখেছিলাম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রকাশনার জন্য। এই প্রেক্ষাপটে সংগঠনটির সাথে আমার একসময়কার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার পটভূমি তুলে ধরার মাধ্যমে আমি বলার চেষ্টা করেছি, দেশে ও গোটা বিশ্বে বিরাজমান বিভিন্ন অন্যায় ও বৈষম্য যেমন আমাদের প্রজন্মের বহু তরুণকে সংগ্রামী চিন্তাচেতনা ও তৎপরতার দিকে ধাবিত করেছিল, সমকালীন প্রেক্ষাপটেও নতুন প্রজন্মের তরুণেরা নিশ্চয় একই ধরনের পথ খুঁজে নিচ্ছেন, নেবেন। এই গুচ্ছের পরবর্তী দুইটি রচনাতেও প্রায় অভিন্ন স্বরে বলা কিছু কথা রয়েছে, যদিও আমার বক্তব্যের পরিধি নির্ধারিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমগুলির প্রেক্ষাপটে: ‘সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড়ো না’ শিরোনামের রচনাটি আমি লিখেছিলাম ‘সান্তুআ’ (‘পথপ্রদর্শক’ অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ) নামে খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত একটি সাময়িকীর জন্য, যে কাগজটির সাথে একদা আমি সম্পৃক্ত ছিলাম একজন প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবে; আর ‘নতুন দিনের আলোর দিশারীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ লেখাটির উদ্দিষ্ট শ্রোতারা ছিলেন খাগড়াছড়িতে লেখকের পৈতৃক গ্রামে বসবাসরত তরুণ শিক্ষকবৃন্দ, যাঁদেরকে একটি অনুষ্ঠানে সম্বর্ধিত করা হয়েছিল।  এরপর সংকলনের এই অংশে ‘একটি মাঠ, দুইটি গোলক ও একটি গোলকধাঁধা’ শিরোনামের যে নিবন্ধ রয়েছে, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল আদিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ‘সান্তুআ’ পত্রিকার একটি সংখ্যায়, সেখানে চেষ্টা করা হয়েছে ‘আদিবাসী’ ধারণার প্রাসঙ্গিকতা স্থানিক থেকে বৈশ্বিক, সকল পরিসরের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার জন্য। আর  ‘উত্তরণের সংকল্প’ শিরোনামের আওতায় পঞ্চম যে নিবন্ধটি সংকলনে রাখা হয়েছে, ‘সুজাতা ও সাগরীর জন্য ন্যায়বিচার কেন আমাদের লড়াইয়েরও অংশ’, সেখানে সাধারণ একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়েছে যেটির মূল কথা হচ্ছে এই যে, নানান ধরনের প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করছেন, তাঁদের সবাইকে নজর দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সেইসব দুর্বলতম অংশের প্রতি, যাদের বেলায় প্রান্তিকতার সকল মাত্রাই এক বিন্দুতে এসে উপনীত হয়েছে। উল্লেখ্য, সুজাতা ও সাগরী নামের দুইজন শিশু হচ্ছে এমন একটি বর্গের (দরিদ্র-আদিবাসী-নারী-শিশু) দুইজন প্রতিনিধি, নানান প্রান্তিকতার মিলিত অভিঘাত যাদের উভয়ের জীবন অকালে কেড়ে নিয়েছিল একই সময়কালে।

সংকলনের শেষে যে সাতটি লেখা একত্রিত করা হয়েছে ‘স্বপ্নের গতিপথ’ শিরোনামের আওতায়, সেগুলি রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম’-এর বিভিন্ন ম্যাগাজিনের জন্য, যেগুলি প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে। এই সাতটি লেখার মধ্যে প্রথমটিতে রয়েছে বাকি ছয়টির প্রসঙ্গসহ সার্বিক একটি পর্যালোচনা, এরপর অন্যান্য লেখার মধ্যে রয়েছে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের তিনটি মূলনীতি (শিক্ষা, ঐক্য ও প্রগতি) নিয়ে লেখা তিনটি রচনা, এবং ‘ত্রিপুরাদের মধ্যে কে প্রথম মঙ্গলগ্রহে যাবে?’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ, যা রাখা হয়েছে সংকলনের একেবারে শেষে। উল্লেখ্য, শেষোক্ত রচনাটি, কাজ করেছে এই গ্রন্থের শিরোনামে উল্লিখিত ‘স্বপ্নের মহাকাশ’ কথাটির পটভূমি হিসেবে। বলা বাহুল্য, এটি ব্যবহৃত হয়েছে মূলত প্রতীকী অর্থে, তরুণ পাঠকদেরকে উৎসাহিত করতে যেন তারা নিজেদের স্বপ্নের সীমানা চেনা গণ্ডীতে বেঁধে না নেয়। তবে আমার একাধিক রচনায় যে ধরনের স্বপ্ন দেখার কথা আমি বলেছি, সেগুলি কোনো আকাশ কুসুম কল্পনার পেছনে ছোটার আহ্বান নয়, বরং আমি চেষ্টা করেছি পাঠকদের উৎসাহিত করতে তাঁরা যেন ইতিহাসের শিক্ষার আলোকে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখেন। একই ধরনের কথা আমি তরুণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমাবেশে দেওয়া মৌখিক বক্তৃতায়ও বলে থাকি সুযোগ পেলে [এ বিষয়ক কিছু  সুনির্দিষ্ট উদাহরণ ও সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে ভূমিকার বাকি অংশে, যেগুলির কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হয়েছে]।

ইতিহাসের শিক্ষা হোক স্বপ্নের ভিত্তি       

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গায় অবস্থিত, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সেখানে জুম চাষ হত, এবং সেই জুমিয়া কৃষকেরা ত্রিপুরা ছিল, এমন অনুমান করা যায় ইতিহাসের কিছু ছিন্ন সূত্র মেলালে। এই সম্ভাবনার কথা আমি বলেছিলাম  ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম চট্টগ্রাম মহানগর শাখার একটি অনুষ্ঠানে। বিষয়টি কল্পনা করার জন্য শ্রোতাদের আহ্বান জানিয়ে আমি এরপর তাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, ১৮৬০ সালে যখন ব্রিটিশ শাসকেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি করে, সেটি আসলে ছিল পরবর্তীতে ‘পাহাড়ি’ ও ‘উপজাতীয়’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা বিভিন্ন জাতির মানুষদের জন্য জীবন-জীবিকা-পরিচয়ের গণ্ডী বেঁধে দেওয়া। বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি ভূভাগে বসবাসরত ত্রিপুরা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জুমিয়া কৃষকরা কী করেছিল যখন ব্রিটিশ শাসকরা তাদের জন্য জুমচাষ নিষিদ্ধ করে দেয়? উল্লেখ্য, ১৮৬০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামক জেলার সীমানা টেনে বলা হয়েছিল, শুধুমাত্র সেটির অভ্যন্তরে জুমচাষ অনুমোদিত হবে। এ অবস্থায় উল্লিখিত জুমিয়াদের অনেকেই হয়ত সরে গিয়েছিল বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত বিভিন্ন স্থানে, অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাধীন অন্য কোথাও। অন্যদিকে যেসব ত্রিপুরারা রয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই প্রভৃতি এলাকায়, তাদের উত্তরসুরীদের অনেকেই এখন নিজেদের আগেকার কৃষিভূমিতে শ্রমদাস হিসেবে নিয়োজিত। উনবিংশ শতাব্দীতে তাদের পূর্বসুরীরা কি কল্পনা করতে পেরেছিল এই অবস্থার কথা? নাকি তাদের অনেকে তুষ্ট ছিল অল্প আয়াসের জীবনে, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজকীয় অতীত থেকে বিচ্ছুরিত আভার ক্ষয়িষ্ণু ধারায় স্নাত নিজেদের অহমিকাকে সম্বল করে? তবে আমরা যদি এটা ধরেও নেই যে, এসবক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসুরীরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না, তাহলে তাদেরকে দোষ দিয়ে বসে না থেকে আমাদের এখন মাথা খাটাতে হবে, এমন কী পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি, কী বিষয় নিয়ে ভাবতে পারি, যাতে করে আমাদের উত্তরসুরীদের মনে না হয় যে আমরা ভুল করেছি?

প্রতিরোধ ও উত্তরণের দৃষ্টান্ত: গোবিন্দগঞ্জ থেকে ভূষণছড়া, এবং একজন লাজারুস টুডু

সামষ্টিক প্রতিরোধের একটা অভিনব দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালের নভেম্বরে গোবিন্দগঞ্জে, যেখানে তাদের দাবি করা ভূমি থেকে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে কিছু রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে উচ্ছেদ হওয়া সান্তালরা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। ঘটনাক্রমে সেই গোবিন্দগঞ্জেই রয়েছেন সান্তাল সম্প্রদায়ভুক্ত লাজারুস টুডু নামের একজন ব্যক্তি, পেশায় দন্ত চিকিৎসক, যিনি হলেন ব্যক্তিগত চেষ্টার জোরে নানান প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের ভাগ্যের মোড় ঘোরাতে পারা একজন মানুষ। [তাঁর কাহিনী [যা ছাপানো বইয়ে বিস্তারিত রয়েছে] ২০১৫ সালের অক্টোবরে শোনার পর আমি এতটাই চমৎকৃত হয়েছিলাম যে সেটা আমি বলেছিলাম সেই মাসেই পরের দিকে ঢাকায় আয়োজিত ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের একটি অনুষ্ঠানে। আবার ঘটনাক্রমে টিএসএফের সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ঠিক আগের দিন আমি উপস্থিত ছিলাম রাঙামাটির বরকল উপজেলায় অবস্থিত ভূষণছড়া নামক একটি জায়গায়। এক সময় গণহত্যাসহ ভয়াবহ সহিংসতা সংঘটিত হয়েছিল, এমন একটি স্থান হিসেবে এটির নাম আমার আগে থেকেই জানা ছিল। সেই সুবাদে আমি আমার এক কবিতায়ও ‘ভূষণছড়া’ নামটি ব্যবহার করেছিলাম আগেই, কিন্তু ২০১৫ সালের অক্টোবরে যেদিন সেখানে প্রথমবারের মত উপস্থিত হই, আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম চাকমা সম্প্রদায়ভুক্ত সেখানকার স্থানীয় মানুষদের আশাবাদী মনোভাব ও কর্মতৎপরতা দেখে। সেখানে আমি গিয়েছিলাম এমন একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম দেখতে, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শান্তি’ চুক্তি হওয়ার কয়েক মাস পরে, যে তথ্য জানতে পারি সেখানে যাওয়ার পর। সেখানে পাঠরত শিশুদের যে অভিভাবকরা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর পরিচালনায়ও যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের অনেকেই নিজেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেন নি, কারণ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে, অনাহারে অর্ধাহারে বা বুনো খাবার খেয়ে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছিল। সেই তাঁরাই নতুন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের পরিবার ও সমাজকে নতুন একটা স্থিতিশীল ভিত্তি দেওয়ার, এবং তাঁরা স্বপ্ন দেখেন তাঁদের সন্তানেরা লেখাপড়া করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই ভূষণছড়া থেকে ফেরার পরের দিন ঢাকায় টিএসএফের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আমি তাই সেখানকার মানুষদের সংগ্রাম ও সংকল্পের গল্পও বলেছিলাম আমার বক্তৃতায়।  লাজারুস টুডুর কাহিনীতে অবশ্য সরাসরিভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগের সাথে লড়াইয়ের বিষয় নেই, তবু তাঁর মধ্যে ‘ভাগ্যের বিড়ম্বনা’কে অতিক্রমের যে সংকল্প দেখেছিলাম, তা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে বলে আমার মনে হয় [যা ছাপানো বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে]।

যে উদ্দেশ্যে এবং যাদের জন্য এই সংকলন

এই সংকলনে ত্রিপুরাদের প্রসঙ্গকেন্দ্রিক অনেকগুলি নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এই বইটি সার্বিকভাবে শুধুমাত্র, বা প্রধানত, ত্রিপুরা পাঠকদের কথা মনে রেখে জন্য সাজানো হয় নি। বরং, বইটিতে এক সূত্রে গাঁথা হয়েছে ‘সর্বজনের ও বহুজাতির বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামরত তরুণদের জন্য একগুচ্ছ রচনা’। এখানে ‘সর্বজন’ কথাটি বোঝানো হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-লিঙ্গ-এলাকা প্রভৃতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিককে বোঝাতে, যাদের সবার একই মৌলিক অধিকার ও সমান মর্যাদা থাকার কথা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সর্বজনের বাংলাদেশ’ হল এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা, যার লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, এবং যার রূপরেখা তুলে ধরা রয়েছে এ দেশের সংবিধানে। অন্যদিকে ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ বলতে বোঝানো হয়েছে এমন একটি রাষ্ট্রের ধারণা যা শুধুমাত্র বা প্রধানত ‘বাঙালি’র বলে কল্পিত হবে না, বরং যেটিতে এ দেশে বসবাসরত সকল জাতি ও ভাষারও যথাযথ স্বীকৃতি থাকবে। তাত্ত্বিকভাবে ‘সর্বজনের বাংলাদেশ’ ধারণার মধ্যেই ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ও নিহিত থাকার কথা, কিন্তু বর্তমানে সেই বাস্তবতা পুরোপুরি বিরাজ করছে না।  এ কারণেই আলাদা করে ‘বহুজাতির বাংলাদেশ’ ধারণাটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।

সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশকে সর্বজনের ও বহুজাতির একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান, এমন যে কেউ আদর্শগতভাবে সকল ধরনের বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেবেন। অন্যভাবে বলা যায়, ‘সর্বজনের ও বহুজাতির বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামরত তরুণ’ হলেন সেই জন, যিনি মনে প্রাণে গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করেন, যিনি বিশ্বাস করেন রাষ্ট্র হবে সকল নাগরিকের, যাতে কোনো বিশেষ শ্রেণী, গোষ্ঠী বা বর্গের মানুষ অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে প্রান্তিক ও অধস্তন হয়ে না পড়ে। এমন যে কোনো ব্যক্তি, যিনি সব ধরনের কাঠামোগত প্রান্তিকতা ও প্রান্তিকায়নের প্রবণতার বিরুদ্ধে ভাবেন, কাজ করেন, আমার বিশ্বাস এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলোকে তিনি নিজের মত করে পাঠ করতে পারবেন।

[…]

ছাপানো বইটি কিভাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে, এ সংক্রান্ত তথ্য পাবেন এই ব্লগের ‘প্রকাশিত গ্রন্থাবলী’ পাতায়।

টীকা/তথ্যসূূূত্র

[১] প্রশান্ত ত্রিপুরা (১৯৯২) সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা ও আত্মপরিচয়ের সংকট: বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী, সমাজ নিরীক্ষণ, নং ৪৬ [নভেম্বর ১৯৯২], পৃষ্ঠা ২৬-৩৮

[২] এই লেখাটি আগে সরাসরি অনলাইনে পড়ার সুযোগ না থাকলেও ২০২১ সালের আগস্টে বর্তমান ব্লগেই পোস্ট করা হয়েছে, যেটির হাইপারলিংক উপরে শিরোনামের সাথেই আছে। তাই আগে টীকার মাধ্যমে এখানে দেওয়া অন্য সূত্র মুছে দেওয়া হয়েছে।

[৩] ‘নতুন দিনের আলোর দিশারীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ শিরোনামের রচনাটি হল ‘ফেলে আসা দিনগুলির আলোর দিশারীরা’ শিরোনামে রচিত দীর্ঘতর একটি নিবন্ধের অংশবিশেষ, যা এই ব্লগে রয়েছে।

[৪] প্রশান্ত ত্রিপুরা (২০১৩ক) আশি অনুচ্ছেদে বিশ্বভ্রমণ বা ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের সাথে একটি স্বপ্নাভিযান, Yakhlwi ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান