Tag Archives: আদি-দ্রাবিড়

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজার সমস্যা

অথবা, “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব  ঘটেছে”, এমন ধারণা কেন গোলমেলে

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

পটভূমি

যে বিষয়ের উপর এই লেখায় আলোকপাত করা হয়েছে, সেটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাকে ভাবতে হয়েছে, কিছুটা পড়াশুনাও করতে হয়েছে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যেমন, যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলাম (১৯৯১-২০০১), ‘বাংলাদেশ: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’ নামক একটি কোর্স পড়াতে গিয়ে বাংলায় লেখা অনেক বইপত্রে এমন কিছু ধ্যানধারণার দেখা পেতাম, যেগুলিকে সমকালীন নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে গোলমেলে মনে হত। এমনই একটা ধারণা মিশে আছে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথাটার মধ্যে, যা নিয়ে আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করি ২০১২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে, যখন কোনো ধরনের পূর্ণকালীন চাকরিতে যুক্ত না থাকাতে আমি লেখালেখিতে বেশ সময় দিতে শুরু করি। উদাহরণস্বরূপ,  ২০১২ সালে ৮ই আগস্ট আমি একটা ফেসবুক নোট প্রকাশ করেছিলাম বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ প্রসঙ্গে  শিরোনামে, যে লেখার তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপট ছিল আগের রাতে আমি অংশ নিয়েছিলাম, এমন একটা লাইভ টিভি টক শো-তে দর্শকদের মধ্য থেকে আসা একটি প্রশ্ন, “বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কি?” বলা বাহুল্য, এটা এমন এক ধরনের প্রশ্ন, আমার কাছে যেটির সরাসরি উত্তর খোঁজার বদলে আরো জরুরি হল ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ জাতীয় কথাটি ঠিক কোন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, বা এমন ধারণার আওতায় কি ধরনের লেখালেখি ও চিন্তাভাবনা অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, এসব বোঝা।

এদিকে অতি সম্প্রতি এই ব্লগে প্রকাশিত প্রশ্নোত্তরে ‘আদিবাসী’ প্রসঙ্গ শিরোনামের একটি পোস্টে কথাপ্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, “‘প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে’ – এমনতর বহু গোলমেলে বা ভ্রান্ত ধারণা হামেশাই দেখা মেলে বাঙালি বিদ্বৎসমাজের উজ্জ্বলতম অংশের মধ্যেই।” আমার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একজন পাঠক (যিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমার ফেসবুক বন্ধু) আমাকে জানান যে, বক্তব্যটি “বাঙালিদের রেসিয়াল আইডেন্টটি বিষয়ক মেটান্যারেটিভের সাথে মেলে না”, যে ধরনের ‘মেটান্যারেটিভ’ বা ‘মহাবৃত্তান্ত’ নীহাররঞ্জন রায়, গোলাম মুরশিদ প্রমুখের লেখায় পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। আর এ বিষয়ে আমার কোনো লেখা আছে কিনা, উক্ত বন্ধু তাও জানতে চান। তখন আমি তাঁকে বলি যে, আমার বহুজাতির বাংলাদেশঔপনবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ শীর্ষক দুইটি বইয়ের প্রতিটিতে একটি করে প্রবন্ধ রয়েছে, যেগুলিতে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট আলোচনা রয়েছে। তবে এই লেখাগুলির কোনোটিই চট করে দেখে নেওয়া যায়, এমন কোনো মাধ্যমে এ যাবত প্রকাশিত হয়নি। তাই সম্ভাব্য পাঠকদের সুবিধার্থে দুটি লেখার মধ্যে যেটা অধিকতর সাম্প্রতিক কালের – শেষোক্ত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ খোঁজার ইতিবৃত্ত” শীর্ষক অধ্যায় – তা থেকে ‘‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ অন্বেষণের স্বরূপ’ শীর্ষক একটি অংশের সম্পাদিত (ও সামান্য সংক্ষেপিত) ভাষ্য নিচে তুলে ধরা হল।[1]      

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ অন্বেষণের স্বরূপ

‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটি একটা জ্ঞানকাণ্ডের পুরানো নাম, আবার সাম্প্রতিক কালে ভিন্ন অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের প্রয়োগে। উল্লেখ্য, ইংরেজিতে ‘এনথ্রপলজি’ নামে পরিচিত শাস্ত্রেরই (বিশেষ করে এর একটি বিশেষায়িত শাখা ‘এথনোলজি’র) একটি পুরানো প্রতিশব্দ হল ‘নৃতত্ত্ব’, যেটির বদলে বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নৃবিজ্ঞান’ নামটিই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে ‘নৃতত্ত্ব’ পদটির প্রয়োগের সাথে অনেকক্ষেত্রে মিশে রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের এমন কিছু গোলমেলে ধ্যান-ধারণা, যেগুলি সমকালীন নৃবিজ্ঞানে বাতিল বলে বিবেচিত হলেও এখনো দিব্যি চালু রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের লেখালেখিতে – ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বা ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ধরনের প্রয়োগে – এবং সম্প্রতি নতুন জীবন লাভ করেছে সংবিধানে সংযুক্ত ‘মাইনর রেইস’ (minor race) ও ‘নৃ-গোষ্ঠী’ ধারণার মাধ্যমে।[2]

অবশ্য একটা পারিভাষিক উদ্ভাবন হিসাবে বাংলা ভাষায় ‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটির সংযোজন খুব বেশি আগের ঘটনা নয়, যা বড় জোর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঘটেছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান (গোলাম মুরশিদ ২০১৩) অনুসারে ‘নৃতত্ত্ব’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন ১৯০৫ সালে, ethnology অর্থে, যেটির প্রতিশব্দ হিসাবে পরে ‘জাতিতত্ত্ব’ অধিকতর প্রচলিত হয়ে ওঠে।[3] অন্যদিকে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের প্রয়োগের মাধ্যমে নৃতত্ত্ব পদের যে ভিন্ন ব্যবহার শুরু হয়, তা আরো অনেক পরের – আনুমানিক ১৯৮০’র দশকের – ঘটনা।  একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এ ধরনের ক্ষেত্রে ‘নৃতাত্ত্বিক’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় ‘ethnic’ বা ‘racial’ অর্থে, যা চালু হওয়ার ও বহাল থাকার পেছনে প্রধান দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়: একটা হল ‘নৃতত্ত্ব’ নামক জ্ঞানকাণ্ড সম্পর্কে প্রচলিত কিছু পুরাতন ধ্যানধারণা (যেমন, নৃতত্ত্ব মানেই মানুষের বাহ্যিক দৈহিক বৈশিষ্ট্য-কেন্দ্রিক অধ্যয়ন, এমন ধারণা) এখনো ব্যাপকভাবে চালু থাকা; এবং অন্যটি হল ‘এথনিসিটি’ ও ‘রেইস’ (race) ধারণার কোনো প্রতিষ্ঠিত বাংলা প্রতিশব্দ না থাকা।[4] এ বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে, যেটির শিরোনাম হল ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ (অজয় রায় ১৯৮৭)। সেই অধ্যায়ের আলোচনার বিষয় ও পরিধি অনুসারে ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথার সুনির্দিষ্ট অর্থ দাঁড়ায় রেইস সংক্রান্ত পরিচিতি।

উপরে উল্লিখিত বইটির এক জায়গায় রেইস ধারণার দৈহিক বৈশিষ্ট্য-কেন্দ্রিক সংজ্ঞা উদ্ধৃত করা হয়েছে মিখাইল নেস্তুর্খ (১৯৭৬) নামক একজন সোভিয়েত প্রাইমেটবিদ-নৃবিজ্ঞানীর[5] লেখা একটি গ্রন্থ থেকে, যা একদা বাংলাদেশে খুব সহজলভ্য ছিল। একই জায়গায় পাদটীকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নৃবিজ্ঞানের আলোচনায় আমরা race অর্থে নৃগোষ্ঠী [শব্দটি] ব্যবহার করব’ (অজয় রায় ১৯৮৭:৭১-৭২)।[6] অবশ্য পরবর্তীতে অনেকে (যেমন সেলিম আল দীন) ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘এথনিক গোষ্ঠী’ অর্থে, যদিও এটা স্পষ্ট না তাঁরা সবাই ‘রেইস’ আর ‘এথনিসিটি’ ধারণাকে আলাদা বা সম্পর্কিত করে দেখেন কিনা। যাই হোক, সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে ২০১১ সালে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দটি সংবিধানে সন্নিবেশিত হওয়ার পর, এথনিক গ্রুপ (বা সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্য অনুযায়ী ‘এথনিক সেক্ট’) অর্থেই ‘নৃগোষ্ঠী’ পদের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে আগে থেকেই পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দলিলপত্রে এথনিক গ্রুপ অর্থে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ কথাটিরও প্রচলন ছিল। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিপুলা পৃথিবী গ্রন্থে ‘এথনিক মাইনরিটি’ অর্থে ‘নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু’ কথাটা দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে (আনিসুজ্জামান ২০১৫:৪৯৮)। অন্যদিকে ২০০৬ সালে প্রণীত জাতীয় সংস্কৃতি নীতিতে ‘ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠি’ কথাটি পাওয়া যায় (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০০৬:২), এবং এটি দিয়ে কাদের বোঝানো হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যখন দেখা যায় একই দলিলের ৫.৮ নং অনুচ্ছেদে  (পৃ.১৯) ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি’ ও ‘উপজাতীয় জনগোষ্ঠী’ কথাগুলি (যথাক্রমে ‘জনগোষ্ঠি’ ও ‘জনগোষ্ঠী’ বানানে) সমার্থকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। 

‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ ধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যুৎপত্তিগতভাবে সমস্যাজনক হলেও এসব যখন বাংলা একাডেমির মত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বা দেশের স্বনামধন্য পণ্ডিতদের নামখচিত গ্রন্থে স্থান পায়, জায়গা করে নেয় বিভিন্ন সরকারি নথিপত্রে, তখন সেটিকে অসতর্কতাজনিত ‘ভুল’ হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং, এমন প্রবণতার পেছনে কাজ করছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে রয়ে যাওয়া  বিভিন্ন গোলমেলে ধারণার ছায়া, যেগুলির অন্যতম হচ্ছে ‘রেইস’। যেমন, বর্তমান সংবিধানের ইংরেজি ভাষ্যে আমরা minor race শব্দগুচ্ছটি দেখতে পাই, যেটিকে দেখানো হয়েছে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ পদের ভাষান্তর হিসাবে। উল্লেখ্য, ইংরেজি ‘রেইস’ শব্দকে অনেকক্ষেত্রে শুধু ‘জাতি’ হিসাবেও বাংলায় অনুবাদ করা হয়। যেমন, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে ঢাকার সিভিল সার্জন হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী James Wise-এর লেখা Notes on the Races, Castes and Trades of Eastern Bengal নামক একটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ‘পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ’ শিরোনামে (জেমস ওয়াইজ ১৯৯৮-২০০২)। একইভাবে ২০১৪ সালে ‘অনগ্রসর নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা, সমান সুযোগ ও পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন বিষয়ে আইন কমিশনের সুপারিশ’ নামে ইন্টারনেটে পাওয়া একটি ধারণাপত্রে racial discrimination-এর বাংলা করা হয়েছে ‘জাতিগত বৈষম্য’। অর্থাৎ বাংলায় ‘জাতি’ শব্দটির সাথে বিভিন্নভাবে মিশে আছে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত একাধিক ধারণা: race, ethnicity, nation ইত্যাদি। স্পষ্টতই, এসবক্ষেত্রে অনুবাদ সংক্রান্ত ও ধারগাগত কিছু সমস্যা রয়েছে যেগুলির একটি মিলিত ফল হিসাবে টিকে আছে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ কথাটি।

অবশ্য বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে এখনো ‘রেইস’ ধারণার উপস্থিতি রয়ে গেলেও খোদ পশ্চিমা বিশ্বে, যেখান থেকে ধারণাটি আমদানি করা হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ দৈহিক বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রেইস ধারণা নৃবৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই সমস্যাজনক বলে বিবেচিত হয়েছিল, ফলে সমকালীন নৃবিজ্ঞানে এটি  অচল ও পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে কয়েক দশক হল।[7] বলা বাহুল্য, রেইস সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধ্যানধারণার রাজনৈতিক পরিণতি কেমন বিভীষিকাময় হতে পারে, ‘আর্য’ শ্রেষ্ঠত্ববাদী নাৎসিরা তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখিয়েছিল। আধুনিক মার্কিন নৃবিজ্ঞানের জনক বলে খ্যাত বোয়াস – যিনি জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন – অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু করে তাঁর বিভিন্ন গবেষণাকর্মের মাধ্যমে ‘রেইস’ ধারণার অসারতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতির ধারণার সাথে এটিকে গুলিয়ে ফেলার সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছিলেন (Boas 1940)। পরবর্তীকালে জিন-ভিত্তিক গবেষণার ফলাফলসহ জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন অগ্রগতির ফলে আরো স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘নিগ্রোয়েড’, ‘মঙ্গোলয়েড’, ‘ককেশয়েড’, ‘অস্ট্রালয়েড’ প্রভৃতি রেইস-এর ধারণার বিশেষ কোনো ‘বৈজ্ঞানিক’ ভিত্তি বা উপযোগিতা নেই।  অথচ বাংলা একাডেমি থেকে অপেক্ষাকৃত সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজা হয়েছে এমন পরিত্যাজ্য ধারণার ভিত্তিতে। শুধু তাই নয়, সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক যুগের ‘প্রশাসনিক-নৃতাত্ত্বিক’ বিভিন্ন উৎস (যেমন রিজলি)[8] থেকে আহরিত এমন সব তথ্য উপাত্ত, যেগুলি ছিল তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত উভয়দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এসব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশে এখনো যাঁরা ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ খোঁজায় ব্যস্ত রয়েছেন, বা ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’র ধারণা ব্যবহার করছেন, বৈশ্বিক বিদ্যাজাগতিক মানদণ্ডে তাঁরা একশত বছরের মত পিছিয়ে রয়েছেন!

এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাংলা একাডেমি থেকে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ শিরোনামের অধ্যায়যুক্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড) শীর্ষক গ্রন্থ যে বছর প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৮৭ সালে), তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান বিভাগ সবেমাত্র এক বছরে পা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৃবিজ্ঞান পঠনপাঠনের ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারিত হলেও তা মূলত সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান ও বিভিন্ন সমকালীন প্রসঙ্গকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। ফলে এদেশের বিদ্বৎসমাজে ‘নৃতত্ত্ব’, ‘নৃগোষ্ঠী’ প্রভৃতি ধারণাকে ঘিরে যে পশ্চাৎপদ জ্ঞান শেকড় গেড়ে আছে, সেটিকে হটানোর ব্যাপারে এখনো খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনি বাংলাদেশে গড়ে ওঠা নৃবিজ্ঞানী সমাজ। তবে সাধারণভাবে অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডেও আসলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক ধ্যান-ধারণা, তত্ত্ব ও পদ্ধতি বহাল তবিয়তে আছে যেগুলি বৈশ্বিক পরিসরে সমকালীন বিদ্যাজগতে বাতিল হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বাংলাদেশে এখনো বহুলভাবে প্রচলিত, এমন কিছু ভ্রান্ত বা সমস্যাজনক ধারণার একটা তালিকা সংক্ষেপে পেশ করছি।

বাঙালিরা একটি সংকর জাতি: এই ধারণার মূলে রয়েছে একদা পৃথিবীতে ‘বিশুদ্ধ’ কিছু রেইস ছিল এমন বিশ্বাস, যা ভ্রান্ত ও সমস্যাজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষ করে নাৎসিরা যে ধরণের বর্ণবাদী তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে এই ধারণা অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে যায় জাতিসংঘের পরিসরে  (Comas 1951; আরো দেখুন, Montagu 1980)। সমকালীন নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই কমবেশি ‘মিশ্র’, কাজেই আলাদাভাবে কোনো বিশেষ জাতিকে ‘সঙ্কর’ হিসাবে চিহ্নিত করা নিরর্থক।

দ্রাবিড়রা হল বাঙালিদের অন্যতম একটি প্রাচীন জাতিগত উৎস: ‘দ্রাবিড়’ আসলে একটি ভাষাগত বর্গ, এবং বাংলার উপর দ্রাবিড় ভাষাসমূহের প্রত্যক্ষ প্রভাব বা প্রাচীনকালে বাংলা অঞ্চলে দ্রাবিড়ভাষীদের ব্যাপক উপস্থিতির কোনো প্রমাণ নেই (Maloney 1984)। (ঠিক কখন কিভাবে ‘দ্রাবিড়’ বর্গে বাঙালিরা নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজতে শুরু করে, তা গবেষণা সাপেক্ষ বিষয়। তবে এটা অনুমান করা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো প্রভৃতি স্থানে আবিস্কৃত প্রাচীন ‘সিন্ধু সভ্যতা’র মূল ধারক-বাহকরা দ্রাবিড় ছিল, যারা ‘আর্য’দের চাইতেও বেশি ‘সভ্য’ ছিল, এমন ধারণা তৎকালীন শিক্ষিত ভারতীয়দের কল্পনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে কল্পিত আর্য বা আশরাফ উৎসের বদলে ‘দ্রাবিড়’ বর্গে নিজেদের অতীত খুঁজতে শুরু করেন – এখনো খোঁজেন – অনেকে।) 

বাঙালি মুসলমানেরা প্রধানত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর: এই ধারণার মূল সমস্যা হচ্ছে এই যে, পূর্ববঙ্গে ইসলামি সংস্কৃতি পৌঁছানোর সময় এ অঞ্চলে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক ছিল না; তাছাড়া ‘জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ করেছে’ এই তত্ত্ব সমগ্র উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ইতিহাসসম্মত নয়, যে ধরনের যুক্তি অন্যদের মধ্যে রিচার্ড ইটনের কাজে ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়  (Eaton 1993)।   

বাংলা একটি আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা: ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের রেওয়াজ অনুসারে এই বর্গীকরণ ঠিক হলেও এর ফলে ভিন্ন ‘পরিবার’-ভুক্ত বলে চিহ্নিত বিভিন্ন ‘দেশি’ ভাষা, যেমন সান্তালি (‘সাঁওতাল’), মুন্ডা, কোচ, গারো, খাসি (‘খাসিয়া’) প্রভৃতির সাথে বাংলার, বিশেষত ‘অশুদ্ধ’ বলে বিবেচিত বাংলার তথাকথিত বিভিন্ন ‘আঞ্চলিক’ রূপের, যোগসূত্রসমূহ অনেকাংশে দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় (এ প্রসঙ্গে এই ব্লগে প্রকাশিত ‘কেমন আছে বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলি’ নিবন্ধটি দেখা যেতে পারে।)

উপরে বর্ণিত পর্যবেক্ষণসমূহের প্রতিফলন রয়েছে, এমন একটি উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হল, যা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া (উৎস হিসাবে দেখানো হয়েছে অতুল সুরের লেখা বাঙালি জীবনের নৃতাত্ত্বিক রূপ, যা সরাসরি যাচাই করা হয়ে ওঠেনি):

বাংলার আদিম অধিবাসীরা ছিলেন প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় তাদের বলা হয় আদি-অষ্ট্রাল। আদি-অষ্ট্রাল বলার কারণ হলো, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক গঠনের মিল রয়েছে। দৈহিক গঠনের মিল ছাড়া অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের রক্তের মিলও রয়েছে। এক সময় আদি-অষ্ট্রালদের বসতি উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগে তারা ভারত থেকে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে প্রথম পৌঁছায়। বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ওই গোষ্ঠীর লোক। এদের সঙ্গে মিশে গেছে আগন্তুক দ্রাবিড় ভাষাভাষী জাতি। দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আলপীয়রা আসার আগে। আর আদি-অষ্ট্রাল, দ্রাবিড় ভাষাভাষী ও আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোকদের সংমিশ্রণেই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বুনিয়াদ গঠিত হয়েছিল।

উপরের উদ্ধৃতিতে বর্ণিত ‘নৃতাত্ত্বিক বুনিয়াদ’ যে ভেঙে গেছে, অথবা কোথাও টিকে থাকলেও আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের একটা ভিত্তি হিসাবে যে আর ব্যবহারোপযোগী নয়, এ খবর বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে এখনো হয়তবা ব্যাপকভাবে পৌঁছায়নি!  

শেষ কথা

এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে পাঠককে অনুরোধ করব একটু ভেবে দেখতে, শুরুতে তুলে ধরা একটা বক্তব্য – “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে”, এমন ধারণা কেন গোলমেলে – ভালোভাবে বোঝা গিয়েছে কিনা। যদি কোনো অস্পষ্টতা থেকে থাকে, তাহলে এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু কথা আরেকটু খোলাসা করে বলছি। প্রথমত, প্রধানত ভাষিক ও ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘বাঙালি’ অথবা অনুরূপ যে কোনো পরিচয়ের ইতিহাস খুঁজতে গেলে তা ‘রক্তধারা’র ভিত্তিতে করতে যাওয়া খুবই সমস্যাজনক, যে ধরনের উদ্যোগের পেছনে সচেতনভাবে হোক বা অসচেতনভাবে হোক, নাৎসিদের ‘আর্য’ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সাথে তুলনীয় মতাদর্শ মিশে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, ‘দ্রাবিড়’, ‘অস্ট্রিক’, ‘আর্য’ প্রভৃতি মূলত ভাষিক বর্গ, যেগুলিকে ‘রেসিয়াল’ বা ‘রক্তধারা’-সংশ্লিষ্ট বর্গ হিসাবে দেখা খুবই গোলমেলে। বহু আগেই বোয়াসের মত নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে, একই ধরনের ভাষাভাষী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন ভৌগোলিক ও জেনেটিকভাবে নানান উৎস থেকে আসতে পারে, তেমনি জেনেটিকভাবে ঘনিষ্ঠ-সম্পর্কিত কিছু জনগোষ্ঠী নানা কারণে ভিন্ন ভিন্ন ‘ভাষা পরিবার’ভুক্ত ভাষা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়ত, ‘আর্য’ বা শেখ-সৈয়দ-মুগল-পাঠান জাতীয় কল্পিত অভিজাত উৎসের বদলে  বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বাংলা অঞ্চলেই নিজেদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও ‘জাতিগত’ শেকড় খোঁজেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীকে মোটাদাগে অধিকতর গণতান্ত্রিক তথা বাস্তবসম্মত বলা যেতে পারে, তবে এমন দৃষ্টভঙ্গীর সাথে ধারণাগত ও পদ্ধতিগত বিভ্রান্তি মিশে যায় যখন ‘দ্রাবিড়’ (বা ‘প্রাক-দ্রাবিড়’) ও ‘অস্ট্রিক’ গোছের বর্গে সেই শেকড় খোঁজা হয়।

‘দ্রাবিড়’ বর্গের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যার বিষয়টি আগেই সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে, তাই সেটির পুনরাবৃত্তির বদলে ‘অস্ট্রিক’ বর্গ সম্পর্কে দু’টি কথা যোগ করেই এই আলোচনা শেষ করব। পাঠকের জানা থাকতে পারে যে, অস্ট্রিক, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রালয়েড প্রভৃতি শব্দের ভিত্তি হল ‘দক্ষিণ (দিকের)’ বোঝায়, এমন লাতিন মূল austro-, australis)। বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গায় চোখে পড়া লেখালেখি থেকে মনে হয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে চলে আসা কিছু গোলমেলে ধ্যানধারণার সূত্রে সাক্ষর বাঙালিদের অনেকের মধ্যে এমন একটা অনুমান কাজ করছে যে, বাঙালিদের একটা প্রধান উৎস হল ‘অস্ট্রিক’ বা ‘অস্ট্রাল’ বর্গের কিছু প্রাচীন জাতি, যাদের গায়ের রঙ ছিল কালো, গড়ন ছিল ছোটখাটো, ইত্যাদি। বাস্তবে ‘অস্ট্রিক’ কথাটি একদা মূলত ভাষিক একটা বর্গ হিসাবেই ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীদের অনেকে। এই বর্গের আওতায় ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’ বিভিন্ন ভাষার সাথে (দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মন ও খ্‌মের ভাষা থেকে শুরু করে উপমহাদেশের খাসি, সান্তালি, মুন্ডা) ‘অস্ট্রোনেশিয়ান’ (অস্ট্রো = দক্ষিণ, নেশিয়া = দ্বীপ) বিভিন্ন ভাষাকে পরস্পরসম্পর্কিত হিসাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই অনুমানের বাস্তব ভিত্তি যাই হোক না কেন, এসব ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের সবাই দেখতে একই ধরনের, বা সবাই ‘রক্তধারা’র দিক থেকে একই উৎস থেকে আসা, একথা বলা যায় না।

সান্তালদের ভাষা আর ক্যাম্বোডিয়ার খ্‌মের (Khmer) ভাষা একই ‘ভাষা-পরিবার’ (‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’)-ভুক্ত বলে বিবেচিত

অন্যদিকে ‘অস্ট্রালয়েড’ বলে আরেকটা বর্গ আছে (যেটাকে ‘নিগ্রোয়েড’, ‘ককেশয়েড’ ও ‘মঙ্গোলয়েড’ বর্গের পাশাপাশি একটা প্রধান ‘রেইস’ হিসাবে একদা চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও এসব ভাগ অধুনা অনেকটাই পরিত্যক্ত হয়েছে), যেটির প্রতিনিধিত্বকারী জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল অস্ট্রেলিয়া আদিবাসীরা, যাদের মধ্যে প্রচুর ভাষিক বৈচিত্র্য থাকলেও ‘অস্ট্রিক’ বা ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক’ বিভিন্ন ভাষার সাথে বিশেষ কোনো নিকট সম্পর্ক নেই। কাজেই ‘অস্ট্রাল’ কথাটি যে অর্থেই ব্যবহার করা হোক না কেন, এর পেছনে স্বচ্ছ কোনো ধারণা আছে, একথা বলার কোনো উপায় নেই। কাজেই সব মিলিয়ে আমরা বলতেই পারি, “প্রাক-দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও আর্য রক্তধারার মিশ্রণে বাঙালি জাতির আবির্ভাব ঘটেছে”, এমন ধারণা অবশ্যই গোলমেলে, এবং অবশ্য-পরিহার্য!                               

টীকা


[1] বহুজাতির বাংলাদেশ গ্রন্থে যে প্রবন্ধটি রয়েছে – ‘জাতির কী রূপ: বাঙালির ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ও ‘হাজার বছরের ইতিহাস’ পর্যালোচনা – সেটির একটি পূর্বতন ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছিল সর্বজনকথা পত্রিকার ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যায় (নভেম্বর ২০১৪)। শুধু ‘জাতির কী রূপ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটির পিডিএফ কপি আগ্রহী পাঠক নামিয়ে নিয়ে পড়ে দেখতে পারেন।    

[2] তৎসম ‘নৃ’ (যা ‘নর’ ও ‘নারী’ শব্দসমূহের সাথে সম্পর্কিত) অর্থ মানুষ হলেও বাংলা ভাষায় বিদ্যাজগতের বাইরে এই শব্দমূলের বহুল ব্যবহার নেই। ফলে অনেকেই ‘নৃ’-যুক্ত বিভিন্ন শব্দ লিখতে গিয়ে হাইফেন জুড়ে দেন, যেমন ‘নৃ-বিজ্ঞান’। একই ধারাবাহিকতায়  ২০১১ সালে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে ‘নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দটি, যেটির হাইফেন এটির আপেক্ষিক নবীনত্ব নির্দেশ করছে। অবশ্য হাইফেনবিহীন আকারেও শব্দটির প্রচলন ছিল কিছুটা আগে থেকেই। এই লেখায় উভয় বানানই ব্যবহার করা হয়েছে, তবে  হাইফেনযুক্ত রূপটির প্রয়োগ করা হয়েছে মূলতঃ সংবিধানের প্রেক্ষাপটে।  

[3] যেমন চট্টগ্রামে অবস্থিত Ethnological Museum-এর বাংলা নাম ‘জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর’।

[4] ইংরেজি ethnic বা ethnicity শব্দের মূল উৎস হল জাতিবাচক গ্রিক শব্দ ethnos/ethnikos, যে মূল অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে নৃবিজ্ঞানের বিশেষায়িত দুটি ধ্রুপদী ধারা ethnography ও ethnology (জাতিতত্ত্ব)-এর।

[5] প্রাইমেটবিদ (primatologist)-রা জীবজগতে মানুষের সাথে সবচাইতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ‘প্রাইমেট’ বর্গীয় প্রাণীদের অধ্যয়ন করেন (যেমন বিভিন্ন ধরনের বানর, উল্লুক, ওরাং উটান, শিম্পাঞ্জি ও গরিলা)। উল্লেখ্য, মানুষও প্রাইমেট বটে। 

[6]Race শব্দটির অন্য একটি প্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘নরগোষ্ঠী’ (সাদাত উল্লহ খান ২০০১), যা ‘নৃগোষ্ঠী’র কাছাকাছি, যদিও পরেরটি লিঙ্গনিরপেক্ষ। ‘এথনিক গোষ্ঠী’ অর্থে ‘নৃগোষ্ঠী’  শব্দটির প্রবর্তক হিসাবে অনেক সময় প্রয়াত সেলিম আল দীন বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের কথা বলা হয় (যেমন ‘নিও-এথনিক থিয়েটার’-এর বাংলা করা হয়েছে ‘নব্য নৃগোষ্ঠীর নাট্যচর্চা’), তবে দাবিটা পুরোপুরি ঠিক যদি নাও হয়, শব্দটিকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তোলার পেছনে তাঁদের নিশ্চয় ভূমিকা ছিল।

[7] দৈহিক বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রেইস–এর ধারণা যে সমকালীন নৃবিজ্ঞানে পরিত্যক্ত হয়েছে, তা বোঝা যাবে দৈহিক নৃবিজ্ঞানের উপর যে কোনো সাম্প্রতিক টেক্সট বই খুলে দেখলে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, Jurmain et al. (2014)

[8] Herbert Hope Risely  ছিলেন একজন ঔপনিবেশিক প্রশাসক, যিনি ১৮৮৫ সালে বাংলার ‘এথনোগ্রাফিক সার্ভে’ পরিচালনা করার দায়িত্ব পান। নাসাঙ্ক (nasal index), শিরাঙ্ক (cephalic index) প্রভৃতি মাপজোকের ভিত্তিতে পরিচালিত এই কাজের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি মেনে নেওয়া হলেও সার্বিকভাবে সেটিকে ‘কালজয়ী’ হিসাবে অভিহিত করেছেন অজয় রায় (১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৮)।

তথ্যসূত্র

অজয় রায় (১৯৮৭) বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড,  সম্পা. আনিসুজ্জামান প্রমুখ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

আনিসুজ্জামান (২০১৫) বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা, ঢাকা।

আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, কাজী দীন মুহম্মদ, মমতাজুর রহমান তরফদার ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সম্পাদক  (১৯৮৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (২০০৬) জাতীয় সংস্কৃতি নীতি-২০০৬, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা [বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর ২৯, ২০০৬]

গোলাম মুরশিদ, সম্পা. (২০১৩ক) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান প্রথম খণ্ড (অ-ঞ), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

—–(২০১৩খ) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান দ্বিতীয় খণ্ড (ট-), বাংলা একাডেমি, ঢাকা

জেমস ওয়াইজ (১৯৯৮-২০০২) পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ [১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত তিন ভাগে প্রকাশিত; ফওজুল করিম অনূদিত ও  মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত], ইউপিএল, ঢাকা।

মিখাইল নেস্তুর্খ [Mikhail Nesturkh] (১৯৭৬) মানব সমাজ: জাতি প্রজাতি ও প্রগতি, [দ্বিজেন শর্মা অনূদিত] প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।

সাদাত উল্লাহ খান (২০০১) নৃবিজ্ঞান কোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

Boas , Franz (1940) Race, Language and Culture. New York: The Macmillan Company.

Comas, Juan (1951) Racial Myths: The Race Question in Modern Science.  UNESCO, Paris.

Eaton, Richard (1993) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760.  Berkeley: University of California Press.

Jurmain, Robert et al. (2013) Introduction to Physical Anthropology [14th Edition], Belmont, CA: Wadsworth.

Maloney, Clarence T. (1984) Tribes of Bangladesh and Synthesis of Bengali Culture.  In Mahmud Shah Qureshi, ed. Tribal Cultures of Bangladesh, Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi University, Rajshahi.

Montagu, Ashley (1980) The Concept of Race.  Greenwood Press.