Tag Archives: সান্তুআ

ভালোবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটি বিষ

সাঙদারি[*]

পটভূমি: দুইটি বিধ্বস্ত জীবন

দু’জন মদ্যাসক্ত ব্যক্তির বর্ণনা দিয়ে আমার এ আলোচনা শুরু করব। (তাদেরকে অনেকে হয়ত চিনতে পারবেন, আশা করি এতে কেউ ক্ষুন্ন হবেন না। ব্যক্তিবিশেষকে হেয় বা বিব্রত করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই, বরং, এ দু’জনের মধ্যে গোটা ত্রিপুরা সমাজের যে একটা করুণ বাস্তবতা প্রতিফলিত, তাই তুলে ধরতে চাই।) প্রথমজনের নাম ধরা যাক ত-ফা। যখনই পথে দেখা হয়, তাকে দেখতে পাই নেশায় টলছে, প্রলাপ বকছে। একবারই তাকে অ-নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখেছিলাম, খুব সকালে। তাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখতে এতই অভ্যস্ত ছিলাম যে এদিন তাকে আমার অস্বাভাবিক লেগেছিল, তার অপ্রতিভ আত্মসচেতন রূপ দেখে এক ধরনের করুণা হয়েছিল তার উপর। অবশ্য এর এক ঘণ্টা পরেই সে তার ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় জনকে ডাকব দ-ফা বলে। তাঁরও প্রায় একই অবস্থা। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন, ‘আতা [দাদা], তুমি মদ ছাড়া থাকতে পার না?’ দ-ফার জবাব, সকালে এক বোতল আর সন্ধ্যায় আর এক বোতল না হলেই নয় তাঁর। পেটে মদ না পড়লে হাত পা কাঁপতে থাকে।

দু’জনই বাইরে খুব নিরীহ। বাংলা ছায়াছবির মাতাল লম্পট বা দুর্বৃত্ত চরিত্রদের সাথে তাদেরকে মেলানো যায় না। তাদের দেখে রাগ হয় না। বরং দুঃখ হয়। রাগ হয় বৈকি, নিজের উপর, সমাজের আর দশজনের উপর। আমাদের চোখের সামনে কিভাবে ত-ফা আর দ-ফার মত লোকেরা মদের কাছে তাদের জীবন, তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত, বিকিয়ে দিল?

আমার স্কুলজীবনের শুরুতে ত-ফা আমার সহপাঠী ছিল। আর দ-ফা ছিলেন আমার শিক্ষক। তাই তাদের এই পরিণতি আমার কাছে আরো বেশি পীড়াদায়ক। আর যখন তাদের সন্তানদের দিকে তাকাই, দেখতে পাই দারিদ্র্য, হতাশা ও অভিভাকত্বহীনতার অসহায় শিকার তারা এবং কেউ উদ্যোগী না হলে সময়ে তারা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই মদের হাতে নিজেদের ছেড়ে দেবে। ত-ফার ছেলে ত-কে আমি একজন ভাল ছাত্র হিসেবে জানতাম। তার মধ্যে সৃজনশীলতার আভাসও দেখেছিলাম – একটা শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার সূত্রে। একদিন খবর নিয়ে জানতে পারি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়েই তার স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। যে দ-ফা একদিন নিজে শিক্ষক ছিলেন, দেখলাম তাঁর দু’জন কনিষ্ঠ সন্তান অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত পায় নি, অথচ তাদের পড়াশুনার বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগে! ত-ফা ও দ-ফার পরিবারের অবস্থা আর বিশদভাবে বলার কিছু নেই। যে কেউই তা কল্পনা করে নিতে পারেন।

ত-ফা ও দ-ফা দু’জনেরই সঙ্গতি ছিল সন্তানদের স্কুলে পড়ানোর। কিন্তু সন্তানদের প্রতি তাদের যতটুকু যত্ন, মনোযোগ ও ভালবাসা দেখানো উচিত ছিল – তা তারা দেখাতে পারে নি, কারণ তাদের শিরায় উপশিরায় ঢুকে গেছে ভালবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটা উপাদান, একটা বিষ – মদ। প্রকৃতপক্ষে ত-ফা ও দ-ফা রীতিমত অসুস্থ। মদের কবল থেকে তাদেরকে উদ্ধার করতে হলে ডাক্তারি চিকিৎসা অপরিহার্য হতে পারে।

এতো গেল মদ্যাসক্তির একটা চূড়ান্ত রূপ। এরকম উদাহরণ প্রায় প্রতিটা ত্রিপুরা গ্রামেই মিলবে। কিন্তু শুধু ত-ফা ও দ-ফাদের মত লোকদের শরীরে নয়, আমাদের গোটা সমাজ দেহে চলছে মদের মারাত্মক বিষক্রিয়া। ত্রিপুরাদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত, তরুণ-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যেভাবে কমবেশি মদ্যাসক্ত, সে অবস্থাকে সামগ্রিক আত্মহননের প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আমাদের এই আত্মঘাতী প্রবণতাকে রোধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এর জন্য চাই জীবনমুখী, আশাবাদী ও সংগ্রামী চেতনা এবং সংকল্পের ব্যাপক প্রসার। আশার বিষয়, এই চেতনা ও সংকল্প তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিদ্যমান। নিচে তারই একটা উদাহরণ দেওয়া গেল।

মদ্যাসক্তি নিয়ে তরুণদের ভাবনা

এ বছর [১৯৯১] বৈসু উপলক্ষে খাগড়াছড়ির বৈসু উদযাপন কমিটির তরুণ সদস্যরা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। কমিটি একটি রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিল যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা: “মদ্যপান ত্রিপুরা সমাজের অনুন্নতির অন্যতম কারণ”। বিভিন্ন স্কুল কলেজের মোট নয়জন ছাত্রছাত্রী রচনা জমা দিয়েছিল, তারা হল – বরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, গীতা দেববর্মন, প্রতিমা রাণী ত্রিপুরা, মণিকা ত্রিপুরা, প্রভাত জ্যোতি ত্রিপুরা, সুচরিতা রোয়াজা, চিত্রা রোয়াজা, পুষ্পেশ্বর ত্রিপুরা ও কিশোর কুমার ত্রিপুরা। তাদের সবার রচনায় যে কটি বিষয়ে জোর ঐকমত্য প্রকাশ পেয়েছে সেগুলোর সারসংক্ষেপ এখানে দেওয়া হল:

১. চিরাচরিত প্রথানুযায়ী ত্রিপুরাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মদ এখনও একটি অপরিহার্য উপাদান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মদের আশীর্বাদ না পেলে একজন ত্রিপুরার চলে না। আবুয়াক সুনাই [শিশু জন্ম উপলক্ষে আয়োজিত কৃত্য] থেকে শুরু করে বিবাহোৎসব, শ্রাদ্ধক্রিয়া – সবখানেই মদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক বলা চলে। কিন্তু মদের ব্যবহার শুধু সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেই আর সীমাবদ্ধ নেই, সব শ্রেণীর ত্রিপুরাদের মধ্যে দৈনিক ভিত্তিতে মদ্যপান চালু হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মদকে একটি সম্মানজনক সামাজিক পানীয় হিসেবে আর গ্রহণ করা উচিত নয়।

২. মদের অপব্যবহারের ফলে আসক্তরা যেমন নিজেরা দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি তাদের পরিবারে তথা গোটা সমাজে মদের ক্ষতিকারক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। মদের কারণে বা মদকে উপলক্ষ করে দেখা দেয় পারিবারিক অশান্তি, আত্মীয়-পড়শিদের সাথে বিবাদ, এক কথায় সামাজিক অনৈক্য এবং বিশৃঙ্খলা।

৩. ত্রিপুরাদের নেতৃস্থানীয় ও শিক্ষিত অংশ মদের এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে নিজেরাই নেশায় বিভোর। মদের অভিশাপ থেকে গোটা সমাজকে মুক্ত করতে হলে এদের নিজেদের প্রথম আসক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে।

৪. যে সমস্ত কারণে মানুষ মদ্যাসক্ত হয়  পড়ে – হতাশা, সঙ্গদোষ, সর্বোপরি মদের সামাজিক প্রশ্রয় – সামগ্রিকভাবে এই কারণগুলোর মোকাবেলা করতে হবে।

৫. যে সমস্ত দরিদ্র পরিবার ও বৃদ্ধা বিধবারা মদ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদেরকে বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে।

৬. তরুণ প্রজন্মের সামনে মদ্যাসক্তিমুক্ত একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার আদর্শ তুলে ধরতে হবে আর তরুণদের সংকল্পবদ্ধ হয়ে এই নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রামে নামতে হবে।

মদ্যাসক্তির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

ত্রিপুরাদের জুমভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় এক সময় হয়ত মদের একটা সমর্থনযোগ্য স্থান বা ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে যে ভাঙন দেখা দিয়েছে, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সবদিক থেকে আমরা যে বিপর্যয়ের মধ্যে আছি, মদ্যাসক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠাতো দূরের কথা, আত্ম-বিধ্বংসী একটা আবর্তে আমরা আরো বেশি করে ডুবে যাচ্ছি।

সমাজতাত্ত্বিক বিচারে অবশ্য মদ্যাসক্তির প্রসার কোনো সমাজের অবনতির মূল কারণ নয়, বরং একটি লক্ষণ মাত্র, যা সচরাচর দেখা যায় বিভিন্ন কারণে সমাজ সংস্কৃতিতে ভাঙন দেখা দেওয়ার ফলে। কিন্তু এটাও ঠিক, মদ্যাসক্তির প্রসার সে ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। এরকম উদাহরণ অনেক আছে। যেমন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মূল অধিবাসীদের বংশধর, যারা নেটিভ আমেরিকান নামে পরিচিত, তাদের মধ্যে মদ্যাসক্তি একটা বড় সমস্যা। এ অবস্থা সবসময় ছিল না। আনাস্তাসিয়া ষ্কিলনিক (Anastasia Shkilnyk) নামের এক গবেষক তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত A Poison Stronger Than Love: The destruction of an Ojibwa community শিরোনামের গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন কিভাবে কানাডার একটি পুনর্বাসন পল্লীতে ওজিবোয়ে (Ojibwa) সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা মদ্যাসক্তির মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করছে। এ পল্লীর লোকদের যখন [১৯৬৩ সালে] তাদের পুরানো বসতিগুলো থেকে সরকারি উদ্যোগে নতুন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন থেকেই মদ্যাসক্তির ব্যাপক প্রসার তাদের সমাজে দেখা দেয়। পাশাপাশি দেখা দেয় ব্যাপক হারে আত্মহত্যা, খুন খারাবি, সন্তানদের প্রতি অবহেলা। বাইরের আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে না পারা থেকে যে ক্ষমতাহীনতা ও অসহায়ত্বের বোধ এবং পরনির্ভরশীলতা জন্ম নেয়, সেসবই আত্মঘাতী রূপ নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এটা মন্দের ভাল যে ত্রিপুরাদের অবস্থা এখনও এত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় নি, কিন্তু এখনই সচেতন ও সক্রিয় না হলে আমাদেরও ফেরার পথ থাকবে না।

উপসংহার

ত্রিপুরাদের সমস্যা বহুবিধ। বহুযুগের রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছি। শিক্ষার প্রসার আমাদের মধ্যে ঘটেনি, আমাদের সামাজিক ঐক্য অটুট নেই। কিন্তু এ অবস্থার জন্য ইতিহাস বা ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের মধ্যে আনতে হবে সংগ্রামী মনোভাব, বিপ্লবী চেতনা, আর অনমনীয় সংকল্প যে, আমরা একটা সুস্থ, স্বাভাবিক ও উন্নত সমাজ হিসাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবই যে কোনো মূল্যে। বিকেল হলেই বা বন্ধুবান্ধব জুটলেই নেশায় বুঁদ হয়ে বসে থাকলে নিজেদের বা সমাজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশই আমরা পাব না। সময় হয়েছে জীবনকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসে, আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে, মদ নামক বিষকে সমাজ দেহ থেকে ঝেড়ে ফেলার। আমাদের প্রত্যেককে প্রথমে নিজের সাথে যুদ্ধ করে নবচেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে। আমরা যারা বয়সে তরুণ, যারা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই জীবনমুখী, আশাবাদী ও সংগ্রামী চেতনা দিয়ে, আমাদেরকেই হতে হবে নতুন সমাজের অভিযাত্রায় অগ্রপথিক – সান্তুআ।[**]

পোস্ট স্ক্রিপ্ট 

এ নিবন্ধ লিখে শেষ করার পর খবর এল, সম্প্রতি [খাগড়াছড়ির] গাছবান গ্রামের এক ব্যক্তি অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মারা যায়। আমাদের সমাজে মদ্যাসক্তির বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যে কত জরুরি হয়ে পড়েছে, এই দুঃসংবাদ যেন তাই মনে করিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল। স্মরণ করা যেতে পারে, বৈসুর সময়েও [খাগড়াছড়ির] ঠাকুরছড়ায় এক ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পুকুরে ডুবে মারা যায়। [খাগড়াছড়ি, জুলাই ২১, ১৯৯১] 

~~~

সবশেষে একটা সুখবর

উপরে বর্ণিত সব তথ্য হল ১৯৯১ সালে যেমনটা আমি জানতাম। এরপর বহুবছর হল ত-ফা আর দ-ফা দু’জনেরই জীবনাবসান ঘটেছে। তবে নিবন্ধটি লেখার দেড় যুগ পর একটি বিষয় জেনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম, সেটা হল, ‘ত’ নামের যে ছেলেটি স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিল বলে জানতাম, সে পরবর্তীতে নিজের পায়ে ভালোভাবেই দাঁড়াতে পেরেছিল, যার পেছনে  তার নিজের চেষ্টা আর মায়ের উৎসাহ, দুই-ই ছিল। [এই কথাগুলি টীকা আকারে রয়েছে বর্তমান নিবন্ধের যে ভাষ্য আমার জাতিরাষ্ট্রের কিনারায় গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, সেটির সাথে।]

টীকা


[*]এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তুআ নামের একটি সামিয়িকীর ১ম সংখ্যা-য়, এবং পরে লেখকের প্রবন্ধসংকলন জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে গ্রন্থের অংশ হিসাবে পুনঃপ্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।  উল্লেখ্য, ‘সাঙদারি’ শব্দটি ত্রিপুরা ভাষায় ব্যবহৃত হয় আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই, এমন মানুষদের বোঝাতে। এই ছদ্মনামে আমি [প্রশান্ত ত্রিপুরা] নিজের সম্পাদিত সান্তুআ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলাম, তবে দু’টি প্রবন্ধের পর এই ধারা আর রক্ষা করা হয় নি। (‘সাঙদারি’ ছদ্মনামে প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধটিও এ ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে, যেটি হল: মাণিক্য রাজবংশ, বুরাসা দেবতা এবং খুমপুই-এর কাহিনী।)

[**] ‘সান্তুআ’ শব্দটি, যেটি ককবরকে ব্যবহৃত হয় ‘তীর্থযাত্রীদের পথপ্রদর্শক’ অর্থে, এখানে ব্যবহার করা হয়েছে স্রেফ পথিকৃৎ অর্থে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে খাগড়াছড়ি থেকে প্রথমে শুধু সান্তুআ নামে একটি সাময়িকীর প্রকাশ শুরু হয়েছিল, যেটির একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম আমি। সামিয়িকীটির নামে তৃতীয় বা পরের সংখ্যা থেকে ‘জার্নাল’ শব্দটিও যুক্ত হয়, এবং এই নামে (‘সান্তুআ জার্নাল’) এটি এখনো অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় খাগড়াছড়ি থেকে। তবে এটি সম্পাদনা বা প্রকাশনার সাথে আমি বর্তমানে আর যুক্ত নই। সামিয়কীটির সাথে বর্তমান লেখকের আবেগিক সম্পৃক্ততার বিবরণ আরো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে আমার  ‘সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড় না’ নামের একটি লেখায়।

সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড়ো না

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

এই লেখাটি এই ব্লগে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নতুন পথের দিশারী ‘সান্তুআ’দের উদ্দেশ্যে কিছু কথা’ শিরোনামে। তবে ইতোপূর্বে একাধিক মাধ্যমে প্রকাশের সময় লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড়ো না‘, যা এই পোস্টেও ফিরিয়ে আনা হল আবার। উল্লেখ্য, ‘সান্তুআ’ একটি ককবরক শব্দ যার অর্থ হল ‘পথপ্রদর্শক’, এবং এই নামে ১৯৯১ সালে খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত একটা সাময়িকীর যাত্রা শুরু হয়েছিল, যেটির প্রকাশনা ও সম্পাদনার সাথে শুরুতে আমি জড়িত ছিলাম। মাঝখানে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও ২০১২ সালে কাগজটি পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নেন কিছু তরুণ, যে প্রেক্ষিতে এই লেখাটি লিখেছিলাম।[১] 

গোড়ার কথা: যেভাবে সান্তুআর যাত্রা শুরু

১৯৯১ সালের জুলাইয়ের দিকে [খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত একটি অনিয়মিত সাময়িকী] সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল। শক্তি [শক্তিপদ ত্রিপুরা] আর আমি মিলে সম্পাদনার ভার নিয়েছিলাম।  যে সময়ের কথা বলছি, তখন দীর্ঘ আট বছরের প্রবাসী ছাত্র জীবন, আমার অসমাপ্ত পিইএচডি, এসব পেছনে ফেলে এসে দেশে বসে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কী আমি করতে চাই, কী আমি করতে পারি।  এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম, মাঝে ত্রিপুরা রাজ্যেও ছিলাম একমাস। শক্তি তখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, শেষ পর্যায়ের দিকে। তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও সমাজ ভাবনা ছিল। তিনি, এবং তাঁর মত আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট এরকম আরো যে কয়েকজনের সাথে আমি মিশতাম, সময় সুযোগ মিললে আমরা আলাপ করতাম, সমাজের জন্য আমরা কিভাবে কী করতে পারি। এমন আলোচনা থেকেই একটা সাময়িকীর কথা আমরা ভাবি, যেটার নাম ঠিক করা হয় ‘সান্তুআ’ [প্রথম দিককার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটির নাম একটু পাল্টে  ‘সান্তুআ জার্নাল’ করা হয়েছিল, যা এখনো চালু রয়েছে]। 

গ্রামাঞ্চলের ত্রিপুরাদের কাছে, অন্তত খাগড়াছড়িতে, ‘সান্তুআ’ একটা সুপরিচিত শব্দ। এর মানে তীর্থযাথীদের সঙ্গী, পথপ্রদর্শক। অনেকে ‘সাত্তুআ’ও উচ্চারণ করে। পরে অভিধান ঘেঁটে আমি বের করেছি, বাংলায়ও একই রকম একটা শব্দ আছে, ‘সাথুয়া’। অর্থ একই।  তবে বলা বাহুল্য, যদিও সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যাকে আমরা বলেছিলাম ‘কের পূজা সংকলন’, আমাদের আগ্রহ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক ছিল না। বরং আমাদের সুপ্ত বাসনা ছিল, সাময়িকী রূপের ‘সান্তুআ’ সন্ধান দেবে সেইসব তীর্থস্থানের, যেখানে মিলবে শিক্ষার আলো, বৈষম্য ও বঞ্চনা নিরসনের নিশানা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা।  

বেশ উৎসাহের সাথে, অনেকের সহযোগিতা, শুভকামনা ও প্রত্যাশাকে পাথেয় করে, আমরা, এই সাময়িকীর উদ্যোক্তারা, কাজে নেমেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে আমরা লিখেছিলাম,  “একটি বিশেষ অভাববোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে সীমিত সাধ্য নিয়েই আমরা কয়েকজন এ উদ্যোগ নিয়েছি। ত্রিপুরা সমাজে সার্বিকভাবে লক্ষ্য করা যায় সংহতির অভাব, ভবিষ্যৎমুখী ও আশাবাদী চিন্তাভাবনা কর্মতৎপরতার অভাব, সুষ্ঠু দিক নির্দেশনার অভাব। সময়ের অভিঘাতে আমরা অনেকেই বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত অবস্থায় আছি। কেরপূজার লগ্নে আমরা কামনা করব এ অবস্থার যেন অবসান ঘটাতে পারি আমরা সবাই মিলে।”

সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যায় যা ছিল

খুব সাদামাটাভাবে সাজানো, কোনো অলংকরণ বা ছবি ছাড়া, এ-ফোর সাইজের চার পাতার সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল ‘সম্পাদকীয় নিবেদন’। এরপর একে একে ব্রজনাথ রোয়াজা, সাঙদারি ও অসাই ত্রিপুরার প্রবন্ধ, খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরার সাক্ষাতকার, আর সবশেষে বাংলা ও ককবরকে একটি করে কবিতা, যথাক্রমে Salkamwng Tripura ও গীতা দেববর্মনের। প্রত্যেকের ভাবনায় ঘুরে ফিরে কোনো না কোনোভাবে ছিল সমাজকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা; আশাবাদকে পাথেয় করে, সাধনার সিঁড়ি বেয়ে, সুন্দর একটি আগামীর তীর্থচূড়ায় আরোহণের স্বপ্ন। নিচে আমি কিছু নমুনা তুলে ধরছি (তবে কেউ চাইলে সান্তুআ-র ১ম সংখ্যাটির পুরোটা পড়ে দেখতে পারেন এখানে দেওয়া পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে)।

ব্রজনাথ রোয়াজা, “ত্রিপুরা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে কিছু কথা” বলতে গিয়ে লিখেছিলেন: “আমাদের উচিত ত্রিপুরা লোক সাহিত্যের সব ঐতিহ্য তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করা এবং এগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে দেশের বৃহত্তর অংশের কাছেও জনপ্রিয় করে তোলা। … এসবের পাশাপাশি ককবরকের লিখিত চর্চা ও আধুনিক ককবরক সাহিত্য গড়ে তোলার কাজও করতে হবে।”

অসাই ত্রিপুরা, “বান্দরবান জেলার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবন” শিরোনামের নিবন্ধে আলোচ্য বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুলে ধরেছিলেন:

বান্দরবান জেলার ত্রিপুরারা অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল। … সঠিক নেতৃত্বের এবং নেতার অভাবে এদের সামাজিক অবস্থা বড়ই নড়বড়ে। ফলে অধিকাংশ ত্রিপুরারা ঠিকানা বিহীন এবং পরনির্ভরশীল হয়ে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। … তবুও আনন্দের বিষয় বর্তমানে কিছু শিক্ষিত যুবক যুবতী বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে।

… [আমরা] রাখালবিহীন ভেড়ার মত যত্রতত্র ঘুরে মরছি। কিন্তু কেন? এর কি কোনো সমাধান নেই? এর কি অবসান নেই? অবশ্যই আছে। এবং বর্তমান যুবসমাজই এর সমাধান দিতে পারে।… সমাজ, জাতি এবং সময়ের প্রয়োজনে যুবসমাজকে সর্বদা এগিয়ে আসতে হবে।

“মদ: ভালবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটি বিষ” নিবন্ধে মদ্যাসক্তির প্রসারকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সাঙদারি ছদ্মনামে আমি লিখেছিলাম,

ত্রিপুরাদের সমস্যা বহুবিধ। বহুযুগের রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্রমশঃ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছি। শিক্ষার প্রসার আমাদের মধ্যে ঘটেনি, আমাদের সামাজিক ঐক্য অটুট নেই। কিন্তু এ অবস্থার জন্য ইতিহাস বা ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের মধ্যে আনতে হবে সংগ্রামী মনোভাব, বিপ্লবী চেতনা, আর অনমনীয় সংকল্প যে, আমরা একটা সুস্থ, স্বাভাবিক ও উন্নত সমাজ হিসাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবই যে কোন মূল্যে। … সময় হয়েছে জীবনকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসে, আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে, [মদ্যাসক্তিকে] সমাজ দেহ থেকে ঝেড়ে ফেলার। …আমরা যারা বয়সে তরুণ, যারা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই জীবনমুখী, আশাবাদী ও সংগ্রামী চেতনা দিয়ে, আমাদেরকেই হতে হবে নূতন সমাজের অভিযাত্রায় অগ্রপথিক – সান্তুআ।

শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরার যে সাক্ষাতকার ছাপানো হয়েছিল,  সেটির পটভুমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা লিখেছিলাম:

‘সান্তুআ’ প্রকাশের ব্যাপারে যে তাগিদগুলো আমাদের মনে কাজ করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষাক্ষেত্রে ত্রিপুরাদের অনগ্রসরতা। এ বিষয়ে আলাপের জন্য আমরা মুখোমুখি হই খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরার, যিনি এ অঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনেই শুধু নয়, সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেও একজন পথিকৃৎ।

সান্তুআর পক্ষ থেকে  সাক্ষাতকারটি গ্রন্থনার দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি। আগে থেকে তৈরি করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দিয়েছিলেন ভেবে চিন্তে, লিখিতভাবে, যা অবশ্য-সংরক্ষণীয় একটি মূল্যবান দলিল।  তাঁর কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, “ত্রিপুরা ছাত্রসমাজ ও তরুণদের প্রতি আপনার কোনো উপদেশ, প্রশংসা, সমালোচনা আছে কি?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন:

ছাত্রসমাজ ও তরুণরা আমাদের মূলধন। তাদের মনে মহৎ আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করতে পারলে সমাজের মুক্তি আসবে। কিন্তু কিভাবে তা করা সম্ভব, সে পথের সঠিক সন্ধান দেয়া দুরূহ। কর্মীর অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। কিছু কিছু সংস্কারমুক্ত গঠনমূলক চিন্তা ধারা ছাত্র সমাজে দেখা গেলেও মনে হয় সক্রিয় সমর্থনের অভাবে তা বিকশিত হয়ে ওঠে না। ত্রিপুরা ছাত্র সমাজে মতৈক্যের অভাব আমাদের পক্ষে বিব্রতকর। তাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাঞ্ছনীয়।

শেষের পাতায়, ‘বীজের আত্মকথা’ শিরোনামের কবিতায় Salkamwng Tripura লিখেছিলেন:

জানে বীজ, কঠিন মাটি ভেদ করে
তাকে জন্ম নিতে হবে।
তবু, সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
জানে চারা, সারা দিন রাত
রৌদ্র আর ঝড়ঝঞ্ঝার চাবুক
খেয়ে খেয়ে বড় হতে হবে;
তবু, সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

খুব সহজ রূপক দিয়ে সাজানো উপরের পঙ্‌ক্তিগুলো যেনবা ছিল তরুণদের নিয়ে শ্রদ্ধেয় নবীন কুমার ত্রিপুরার প্রত্যাশা ও সংশয়ের উত্তরে লেখা, যেনবা পুরানো প্রজন্মের এক পথিকৃৎকে তাঁর উত্তরসূরীরা এই বলে আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, “ভয় নেই। আমরা তরুণরা জানি আমাদের কী করতে হবে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ লক্ষ্যে অবিচল আছি। আমাদের উপর আস্থা রাখুন। আর আশীর্বাদ করবেন, আমরা যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারি সব বাধা পেরিয়ে।”

সবশেষে, ‘নাইসিঙই তঙজাগ’ কবিতায় গীতা দেববর্মন একটি প্রতীক্ষার কথা তুলে ধরেছেন, যে প্রতীক্ষায় ভালবাসার প্রতিশ্রুতি আছে, আছে আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, তবে সেগুলি শুধু কোনো নারী বা পুরুষের একান্ত চাওয়া পাওয়ার বিষয় নয়, বরং এই অনুভূতিগুলি যুগসন্ধিক্ষণের চেতনায় ঋদ্ধ।  (মূল কবিতাটি ছাপা হয়েছিল বাংলা হরফে, তবে নিচের উদ্ধৃতিটা তুলে ধরা হল রোমানে, যেহেতু w–কারটা আমি লিখতে পারি না বাংলা হরফে, তাছাড়া বাংলাদেশের ত্রিপুরারা বর্তমানে সংগঠিতভাবে রোমান হরফেই ককবরকের লিখিতরূপের চর্চা করছে।)

Oswk sal je bwkhwrwi
Perno hinwi ang naisingwi tongkha
Nwng ani o bwkhwrwini khumbar.

Jeswk machaya, manwngya, makanyarokno
Nwng khanarono ashani kok,
Huoi rono jotoni mokolni mwktwi,
Phunukno por sakangni sal kwtal.
Nwng ani o emangni borok.

বাংলা অনুবাদ

এত বছর ধরে যে কুঁড়ি
ফুটবে বলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম
তুমি হলে সেই কুঁড়ি ফুটে হয়ে ওঠা ফুল


যত ভুখা-নাঙা মানুষদের
তুমি শোনাবে আশার কথা,
মুছে দেবে তুমি তাদের চোখের অশ্রু,
সামনে তাদের তুমি দেখাবে নতুন দিনের আলো।
তুমি আমার সেই স্বপ্নের মানুষ।

যেতে হবে আরো বহুদূর, স্মৃতি ও স্বপ্নকে সাথী করে

সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যা ছাপা হওয়ার পর মাঝে [২০১২ নাগাদ] একুশ বছর পেরিয়ে গেছে । শুরুর দিকে পরপর আরো কিছু সংখ্যা ছাপা হয়েছিল। আমার হাতের কাছে অবশ্য প্রথম সংখ্যাটি ছাড়া আর কোনোটাই নেই। যাহোক, মনে পড়ে পরের দিকে সাময়িকীর কলেবর আরো বেড়েছিল, বেরুত বাঁধানো অবস্থায়। বিষয়বস্তুর পরিধিও বেড়েছিল, বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক নতুন বিষয় সামনে চলে এসেছিল: যেমন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরাদের অংশগ্রহণের কথা, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে সাক্ষাতকার থেকে শুরু করে খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকের খ্রিস্টান ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক, অনেক কিছু। নবীন-প্রবীণ আরো অনেকেই লেখা দিয়েছিলেন, সুরজিত নারায়ণ ত্রিপুরা, কুবলেশ্বর ত্রিপুরা, বীরবিক্রম রোয়াজা থেকে শুরু করে কল্লোল রোয়াজা, মথুরা ত্রিপুরা এমন অনেকে। সম্পাদনার দায়িত্ব নিতেও এগিয়ে এসেছিলেন অন্যরা, ৫ম সংখ্যার জন্য মথুরা, এরপর ফাল্গুনী, নবলেশ্বর, অমল ও সূর্য ত্রিপুরা। [তৃতীয় বা পরের কোনো] সংখ্যা থেকে সাময়িকীর নামের সাথে যোগ হয় ‘জার্নাল’ শব্দটি।

সান্তুআ-র সাথে আমার নিজের যুক্ততা একটু কমে গিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার পর, যদিও এরপরও মোটামুটি যোগাযোগ ছিল শক্তি ও অন্য যাঁরা তখনো সক্রিয় ছিলেন তাঁদের সাথে।  এক পর্যায়ে পত্রিকাটি মনে হয় কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। তার পরেও, অনিয়মিতভাবে হলেও, এটি বেশ অনেক বছর চালু ছিল।  শেষের দিকে, আমার যতটা মনে পড়ে, চন্দ্রা ত্রিপুরার মত একেবারের নতুন প্রজন্মেরও অনেকে সাময়িকীটির প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ঠিক কবে থেকে জানি না, অনেকদিন হল সান্তুআ-র নতুন কোনো সংখ্যা চোখে পড়েনি আমার (এ লেখা শেষ করার মুহূর্তে জেনেছি, ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এ বের হয়েছিল আগের সর্বশেষ, ২২তম, সংখ্যা)। এ অবস্থায়, সম্প্রতি [২০১২ সালে] সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যাটি আমি আমার পুরানো কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার পর,  এর প্রথম পৃষ্ঠার একটা ছবি ফেসবুকে ছেড়েছিলাম তেমন কোনো কিছু না ভেবেই। সেটি যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্য বিনয় ত্রিপুরা প্রথম মন্তব্য জুড়ে দিলেন, “অনেকদিন সান্তুআর দেখা নেই, এটি আবার বের করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।” তখন অমল বিকাশ ত্রিপুরা জানালেন, তিনি চেষ্টা করছেন অন্তত বছরে দু’টি করে সংখ্যা বের করে এটিকে আবার চালু করতে। এরপর একে একে, জয়, মানস, ফাইহাম, ফাল্গুনী, ও নবলেশ্বর ত্রিপুরা, সবাই জানালেন তাঁরা থাকবেন এই উদ্যোগের সাথে। তাঁদের সাথে যোগ দেন মথুরা ত্রিপুরা, সান্তুআকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার কাজে এগিয়ে আসা তরুণদেরকে যথাযথ পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য একজন সুযোগ্য ব্যক্তি।  যেমন বলা তেমন কাজ। তাঁরা খাগড়াছড়িতে এরমধ্যে সভা করেছেন, এবং জুলাই ১৪ [২০১২]-তে ফেসবুকে সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যার ছবিটা আসার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমার কাছে খবর আসল, সাথে একটা অনুরোধও যে, কের পূজা ও আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে সান্তুআ বের করা হচ্ছে, এবং আমাকে একটা লেখা দিতে হবে।  সেই লেখাটাই আজ জুলাই ৩১, ২০১২ তারিখে লিখতে বসে যাই আগের দিন জয় আরেকবার তাগাদা দেওয়ার পর।

এ পর্যায়ে একটু থেমে আমি মনে মনে, আপনাদেরকে সাথে করে, চলে যেতে চাই আজ [অর্থাৎ ২০১২ সাল] থেকে একুশ বছর পরের ভবিষ্যতে। চলুন আমরা কল্পনা করি যে,  উপরে সান্তুআর যে সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ ইতিহাস আমি লিখেছি আমার বয়ানে, তা আরো পরিপূর্ণভাবে, সংশ্লিষ্ট সকলের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গীকে ধারণ করে, এবং পুরানো সব সংখ্যা যাচাই করে দেখে, লেখা রয়েছে ২০১২-র আগস্টে বেরুনো সান্তুআর এই সংখ্যাটা পর্যন্ত।  এর পরে আমরা নিশ্চয় একটা ছোট বাক্যই পড়তে চাইব সবাই ২০৩৩ সালে বসে? সেটি হবে, “বাকিটা ইতিহাস।” অর্থাৎ, কল্পনায় আমরা দেখতে চাইব, সান্তুআ ২০১২’র আগস্ট থেকে নিয়মিত বেরুতে শুরু করার পর আর থেমে থাকেনি, নিয়মিত বেরিয়েছে। সময়ের সাথে তাল রেখে একপর্যায়ে এটির একটি ‘অনলাইন’ এবং ‘ইন্টারেক্টিভ’ সংস্করণ চালু হয়েছে, যেটি আমাদের সন্তান বা তাদের সন্তানদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে।  ইত্যাদি।

২০৩৩-এ বসে সান্তুআর যে ইতিহাস আমরা পড়তে চাই,  তা নিয়ে উপরে যে ছক আঁকা হয়েছে, তা কি একটি স্বপ্ন?  এই প্রশ্ন করা হলে আমরা নিশ্চয় সবাই বলব, হ্যাঁ। এখন যদি আরেকটা প্রশ্ন করা হয়, এই স্বপ্ন কি অসম্ভব কিছু? আপনার উত্তর কী হবে? এক্ষেত্রে আমরা সবাই নিশ্চয় সমস্বরে বলব, না, এটা মোটেও কোনো অসম্ভব স্বপ্ন নয়। একুশ বছর আগে অমল, জয়, মানস, বা ফাল্গুনী, সবাই প্রায় শিশুই ছিলেন। চন্দ্রা বা তাঁর মত অনেকে আছেন যাঁরা সান্তুআর জন্য কাজ করেছেন, করবেন, তাঁদের তখন জন্মই হয়নি।  তাঁরা যখন উদ্যম ও আগ্রহের সাথে এগিয়ে আসেন, তখন মনে হয়, আমাদের একুশ বছর আগের উদ্যোগ, সেটা যত সামান্য বা অসমাপ্তই হয়ে থাকুক না কেন, একেবারে নিষ্ফল হয়নি।

সান্তুআর প্রথম সংখ্যাটা হাতে পাওয়ার পর আমি ভাবছিলাম, যে স্বপ্ন নিয়ে আমি, শক্তি বা অন্য যাঁরা আমাদের সাথে ছিলেন, আমরা পথ চলতে শুরু করেছিলাম, সেই স্বপ্ন কতটুকু আমাদের নাগালে এসেছে?  যে অভাববোধের তাড়নার কথা সম্পাদকীয় নিবেদনে বলা হয়েছিল, তা কতটুকু ঘুচেছে?  জানি, এখনো আমাদের অনেক ‘অভাব’ আছে। যখন এসব ভাবি, মনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধের খোঁচা টের পাই, মাঝে মধ্যে মনে হয় নেপথ্যে পরিহাসের সুরে কে যেন বলছে, সান্তুআ কোথায় অন্যদের পথ দেখাবে, ও নিজেইতো পথ হারিয়ে বসে আছে! না, এখানে সান্তুআ বলতে আমি নিজেকে বা এককভাবে কাউকে বোঝাচ্ছি না।  ত্রিপুরাদের মত পিছিয়ে থাকা, শতাব্দীর বঞ্চনার উত্তরাধিকার কাঁধে বয়ে বেড়ানো, ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতির মানুষদের মধ্যে যখন ভাগ্যকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার স্পৃহা জাগ্রত হয়, যখন তারা বলে ওঠে, বঞ্চনার বেড়াজাল ছিঁড়ে, আশায় বুক বেঁধে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে, সংগ্রামী চেতনায় স্নাত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাবে, তখন প্রত্যেকে হয়ে ওঠে এক এক জন সান্তুআ।

যে সান্তুআদের কথা বলছি, তারা এমন জায়গায় নিজেরা যেতে চায়, অন্যদের নিয়ে যেতে চায়, যেখানে তারা নিজেরা যায়নি, পূর্বসূরিরাও পথ বাতলে দিয়ে যেতে পারেনি। ১৯৯১ সালে যখন শ্রদ্ধেয় নবীন কুমার ত্রিপুরার সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম আমরা, তাঁর কথায় এই সুর ছিল। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৩৬ সালে বি, কে, রোয়াজা স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর দীর্ঘ ২০ বছর পেরিয়ে ত্রিপুরাদের মধ্যে এই লক্ষ্য ছুঁতে পারা দ্বিতীয় ব্যক্তি। সারাজীবন শিক্ষকতা করার পর, অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, যেগুলো উপরে উদ্ধৃত হয়েছে, সেখানে আশাবাদ ছিল, আবার সংশয়ও ছিল।  তাঁর মনে অতৃপ্তি ছিল, কিন্তু যতটুকু তিনি করে গিয়েছিলেন, করে যেতে পেরেছিলেন, তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে তা ছিল অনেক, যার জন্য আমরা তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর কাছে চিরঋণী।  তিনি আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমাদের হাতে একটি মশাল দিয়ে গেছেন – শিক্ষকতার, জ্ঞানের আলো জ্বালানোর – যা থেকে নতুন মশাল জ্বালিয়ে নতুন প্রজন্মের অনেক শিক্ষক পথ চলছেন।  এরকম যদি আরো অনেকে এগিয়ে আসে, শিক্ষকতার ব্রত নিয়ে, এবং  শিক্ষকরাসহ আমরা সবাই যদি আমাদের আশেপাশে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত অগণিত শিশুদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই মমতার সাথে, দায়বদ্ধতার সাথে, এক প্রজন্মেই নিজ নিজ এলাকাকে, সমাজকে, জাতিকে আমূল পাল্টে দিতে পারি আমরা। আমি বলছি না যে সবাইকে শিক্ষক হতে হবে, তবে মেধাবী ও নিষ্ঠাবান তরুণরা যেন ব্যাপকভাবে শিক্ষকতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের যেন যথাযথ স্বীকৃতি ও সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।  এ দায়িত্ব শুধু সরকার বা জেলা পরিষদের নয়, বরং এর মূল প্রেরণা ও প্রণোদনা তৈরি করতে হবে সামাজিকভাবে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য আরো অনেক ক্ষেত্রেও, যার যেখানে আগ্রহ, দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে, সে অনুযায়ী স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, উৎকর্ষের চর্চা করে সান্তুআর ভুমিকায় পথ চলতে হবে বর্তমান প্রজন্মের সবাইকে। সেটা জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন[৩] হওয়া থেকে শুরু করে  সংগীত, শিল্প বা নৃত্যে কৃতিত্ব অর্জন, সুদূর কোরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সৎপথে পরিশ্রম করে স্বচ্ছলতা অর্জন, সরকারি কোনো বিভাগের প্রথম ত্রিপুরা কর্মকর্তা হওয়া, প্রথম নারী পুলিশ কর্মকর্তা বা নারী বাস চালক হওয়া, কোনো কারখানায় বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ একজন কর্মী হওয়া,  গ্রামবাসীদের উদ্বুদ্ধকরণে পারদর্শী একজন নিষ্ঠাবান উন্নয়নকর্মী, একজন সফল কৃষক, বা বাগান চাষী হওয়া, নতুন কোনো ব্যবসায় হাত পাকানো, একটি অনাথ আশ্রমকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করা, অনেক কিছুই হতে পারে।  চলার পথে আমরা হোঁচট খেতেই পারি, পা  পিছলে পড়েই যেতে পারি কেউ, বা কেউবা ভুল কোনো মোড় নিয়ে জীবনের চোরাগলিতে বা অকুল পাথারে পড়ে যেতে পারি।  তবুও হাল ছাড়লে চলবে না। আমরা যদি নিজ গন্তব্যে নাও পৌঁছাতে পারি কোনো কারণে, আমাদের চলার পথের লব্ধ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার কথা বলে যেতে হবে আমাদের অনুজদের, আমাদের উত্তরসূরিদের।  আমরা যে যেখানেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, আমাদের মনের গভীরে, আমাদের শেকড় ও ফেলে আসা পথের স্মৃতি এবং আগামীর স্বপ্নকে সযতনে আগলে পথ চলতে হবে। আমি যদি পথের স্পষ্ট নিশানা নাও দিয়ে যেতে পারি আরেকজনকে, আমাদের স্মৃতির ছবি আর স্বপ্নের রূপরেখা আমরা রেখে যাব, যে স্মৃতি আর স্বপ্ন হবে আগামীর সান্তুআদের সাথী।

টীকা


সান্তুআ জার্নাল, সংখ্যা ২৩ (আগস্ট ২০১২)

[১] লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তআ জার্নাল-এর ২৩তম সংখ্যায়, ২০১২ সালের আগস্টে, যখন একটি ফেসবুক নোট আকারেও এটি প্রকাশিত হয়। পরে এটির একটি সম্পাদিত ভাষ্য পুনঃপ্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে প্রকাশিত লেখকের জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে শিরোনামের গ্রন্থে সংকলিত একটি নিবন্ধ হিসাবে। উল্লেখ্য, শেষোক্ত ভাষ্যে গীতা দেববর্মনের কবিতা থেকে তুলে ধরা উদ্ধৃতি ছিল না, যা এখানে আবার রাখা হয়েছে, সাথে উদ্ধৃতাংশের একটা বাংলা অনুবাদও জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা আগে কোথাও ছিল না (অনুবাদটি বর্তমান ভাষ্যের জন্য লেখকের নিজের তৈরি করা)।

[২] জব্বারের বলী খেলা হল চট্টগ্রাম-ভিত্তিক একটি ঐতিহ্যবাহী কুস্তি প্রতিযোগিতা, যেটিতে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত খাগড়াছড়ির মর্ম সিংহ ত্রিপুরা পরপর কয়েক বছর চ্যাম্পিয়ন (একক বা যুগ্মভাবে) হয়ে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন।

আমার স্মৃতি ও স্বপ্নের কিছু তীর্থের কথা

ছোটবেলায় বা তরুণ বয়সে আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে আর কিছুক্ষেত্রে আমার স্বপ্নেরও অনেকাংশ জুড়ে আছে, এমন বিবিধ স্থান / প্রতিষ্ঠান / বিষয় নিয়ে রচিত একটি নিবন্ধ [*]

~ প্রশান্ত ত্রিপুরা ~

যে ছয়টি ‘তীর্থ’ নিয়ে আমার এই লেখা

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘তীর্থ’ বলতে সচরাচর বোঝায় নদি তীরবর্তী বা জলাশয় কেন্দ্রিক কোনো স্থান, যা পবিত্র হিসাবে বিবেচিত এবং যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে এই নিবন্ধে আমি শব্দটি ব্যবহার করব একটু ভিন্ন অর্থে, আমার স্মৃতিতে মিশে থাকা বিশেষ কিছু স্থান, প্রতিষ্ঠান বা বিষয়কে বোঝাতে, যেগুলির দিকে ফিরে তাকানো আমার কাছে এক ধরনের তীর্থ ভ্রমণের মতই। এই লেখায় রয়েছে এমন মোট ছয়টি তীর্থের বিবরণ, যেগুলির মধ্যে রয়েছে (১) একটি ছোট নদি (‘খাগড়াছড়ি’); (২) একটি ভাষা (ককবরক নামের একটি বিশেষ ‘তিতক’); (৩) একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (‘খাহা’), এবং (৪) একটি বিশেষ ভূখণ্ড (‘স্বপ্নের ত্রিপুরা রাজ্য’)। এছাড়া (৫) যে সীতাকুণ্ড এলাকায় সত্যিকারের এক তীর্থস্থানে অনেকেই যান, সেখানে একবার বেড়াতে গিয়ে অর্জিত আমার নিজস্ব এক বিশেষ অভিজ্ঞতার কথাও আমি বলেছি। সবশেষে (৬) সান্তুআ নামের একটি পত্রিকার একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে যে ধরনের তীর্থে ভ্রমণের স্বপ্ন আমি একদা দেখেছিলাম, তা তুলে ধরেছি এ লেখায় (উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ির ককবরকভাষীদের কাছে ‘সান্তুআ’ কথাটির অর্থ হল ‘তীর্থযাত্রীদের পথপ্রদর্শক’)। 

আমার কাছে পবিত্রতম স্রোতস্বিনী: খাগড়াছড়ি নামের একটি ছোট নদি

খাগড়াছড়ির যে গ্রামে আমার জন্ম, সেই খাগড়াপুরের মাঝ দিয়ে একটি ছড়া – খুবই ছোট একটি নদি – বয়ে গেছে, যেটি এঁকে বেঁকে আরো কিছুদূর যাওয়ার পর চেঙ্গী নদিতে গিয়ে মিশেছে। এটিই আসল খাগড়াছড়ি, যে ছড়ার নামে এলাকাটিরও নামকরণ হয়েছে। ছোটবেলায় ছড়াটিকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলাম ককবরকে। এই নিবন্ধ লিখতে বসার পর সেটির দুটি ভাষ্য আমি খুঁজে পেয়েছি আমার পুরানো খাতাপত্র ঘেঁটে। তাতে দেখেছি, কবিতাটি আমি লিখেছিলাম ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এবং ‘রাফ খাতা’য় প্রথম  লেখার পর আরেকটা খাতায় আবার টুকে রেখেছিলাম গুছিয়ে।

এই ‘ছড়া’ বা ছোট নদিটাই খাগড়াছড়ি, যেটির নামে এলাকারও নামকরণ হয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমি ককবরকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম বাংলা হরফে। ‘চিনি পারানি তৈসা’ (‘আমাদের গ্রামের ছড়া’) নামের কবিতাটি আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন আমার ককবরক ব্লগে (Chini Parani Twisa), যেখানে রোমান হরফে প্রকাশিত কবিতাটির পাশাপাশি বাংলা হরফে হাতে লেখা মূল ভাষ্যের ছবিও রয়েছে।

বলা বাহুল্য, আমার স্মৃতিতে সতত ঝিরঝির শব্দে বয়ে চলা ‘খাগড়াছড়ি’ নামের স্বচ্ছতোয়া ছোট নদিটি আমার কাছে পৃথিবীর পবিত্রতম জলপ্রবাহ, সেটির বর্তমান বাস্তব চেহারা যাই হয়ে থাকুক না কেন।   

ককবরক নামক এক বিশেষ ‘তিতক’

আমার মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষা হল ককবরক (Kokborok), যেটি আমার কাছে একটা বিশেষ ‘তিতক’ স্বরূপ। উল্লেখ্য, সংস্কৃত তীর্থ শব্দটির একটা ককবরক রূপ হল ‘তিতক’, যে ধরনের শব্দকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সুবাদে ‘অপভ্রংশ’ বা ‘বিকৃত রূপ’ হিসেবে দেখতে শিখেছিলাম ছোটবেলায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান পড়ার পর বুঝেছি, ভাষা সংক্রান্ত বিবিধ ধারণা যেভাবে আমাদের শেখানো হয়েছিল, সেসব যথেষ্ট গোলমেলে ছিল। বাংলা না জানা বা ‘শুদ্ধ’ ভাবে বলতে না পারার কারণে যে কোনো ধরনের হীনমন্যতায় আমার বা আমার সহপাঠীদের ভোগার কথা ছিল না, এসব ছোটবেলায় আমরা বুঝি নি।  

উল্লেখ্য, বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের পৌর এলাকার মধ্যে পড়ে গেছে, এমন একটি গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, যেখানে মূলত কবরকভাষী আত্মীয়স্বজন ও সহপাঠীদের মধ্যেই আমার জীবনের প্রথম আটটি বছর কেটেছিল। এরপর ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর আমাকে পড়তে পাঠানো হয়েছিল খাগড়াছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে সহপাঠীদের অধিকাংশই ছিল চাকমা ও চাটগাঁইয়া-ভাষী বাঙালি। আমার মনে পড়ে, “তোমার বাড়ি কোথায়” ধরনের এক প্রশ্নের উত্তর ঠিকমত গুছিয়ে বলতে না পারায় এক শিক্ষক আমাকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়েছিলেন!

উল্লিখিত ঘটনার বিস্তারিত কিছুই  আমার মনে নেই, তবে যেটা মনে আছে, সেটা হল, আমার তৎকালীন বাংলা ভাষাজ্ঞানের স্বল্পতা ছিল শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর আমার ঠিকমত বলতে না পারার প্রধান কারণ। এই লাঞ্ছনার শোধ আমি পরে একভাবে তুলেছি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে খোদ ঢাকার বুকে অবস্থিত একটি নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাঙালি সহপাঠীদের হারিয়ে বাংলা ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে যে কথা বলার জন্য শৈশবের সেই স্মৃতি টেনে এনেছি, সেটা হল, বৈরী পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বেড়ে উঠলেও মাতৃভাষা ককবরকের প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিন কমে নি। সময়ের পরিক্রমায় বাংলা ও ইংরেজিতে আমার দখল বেড়েছে, এবং মূলত এ ভাষাগুলিই আমি ব্যবহার করি পেশাগত ক্ষেত্রে, যেগুলিতে আমি নিয়মিত লেখালেখিও করি। কিন্তু নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ককবরকেও আমার সে চেষ্টা আছে কিছুটা হলেও।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কৈশোরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ককবরকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, এমনকি ভাষাটির ব্যাকরণ নিয়েও যে কিছুটা ভেবেছিলাম, তার কিছু নমুনা আমি সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছি। পরে আমার সুযোগ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নকালে নৃবিজ্ঞানের পাশাপাশি ভাষাবিজ্ঞানেও পড়াশুনা করার। ফলে নিজের মাতৃভাষাকে নতুন আলোয় দেখার ও বোঝার সক্ষমতাও অর্জন করেছি খানিকটা। আর সেই বোঝাপড়ার সূত্রেই আমি জোর গলায় বলতে পারি, বলছি, ‘তীর্থ’ শব্দটি যদি ককবরকে এসে ‘তিতক’ হয়ে যায়, তবে সেটিকে ‘বিকৃত’ ভেবে ‘শুদ্ধ’ বানান বা উচ্চারণ আরোপের চিন্তা করাটাই আসলে অশুদ্ধ। পৃথিবীর সকল ভাষার মতই ককবরকেরও নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে, যেটির প্রেক্ষিতে ‘তিতক’ শব্দটিই আসলে স্বাভাবিক।

বলা বাহুল্য, অন্য যে কোনো ভাষাভাষীর বেলায় যেমনটা হতে পারে, তেমনি যে শিশু জন্মের পর ককবরকেই কথা বলতে ও চিন্তা করতে শেখে, তার স্মৃতিতে ও মননে এই ভাষার একটা আলাদা – ‘তিতক’ বা তীর্থের মত – জায়গা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।   

তীর্থতুল্য যে স্কুলকে আমি ‘খাহা’ নামে স্মরণ করি

‘খাহা’  নামটি আমি প্রথম ব্যবহার করেছিলাম ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় ছাপানো আমার একটি লেখায়। এক্ষেত্রে ‘খাগড়াছড়ি হাইস্কুল’ কথাটির একটি সংক্ষিপ্তরূপ হিসাবে ‘খাহা’ নামটি বেছে নেওয়ার পেছনে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ কিছু ব্যঞ্জনাও কাজ করেছিল। যেমন, আমার ঘনিষ্ঠ সতীর্থদের মধ্যে পরস্পরের নাম বা এলাকার নাম সংক্ষেপে বলার একটা রেওয়াজ ছিল, এবং ‘খাহা’ কথাটিকে একটা ককবরক শব্দ হিসাবে চালানো যায়, যেটার অর্থ হতে পারে, ‘হৃদয়পুর’। এসব বিষয়ের ব্যাখ্যাসহ আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকা খাগড়াছড়ি হাইস্কুলকে কেন একটা তীর্থ হিসাবে স্মরণ করি, তার বিশদ বিবরণ আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন এই ব্লগে থাকা আমার ‘খাহা: আমাদের স্মৃতির এক তীর্থ’ শিরোনামের লেখায়।   

আমার কল্পনা ও স্বপ্নের ‘ত্রিপুরা রাজ্য’

জন্মসূত্রে অর্জিত একটা বিশেষ পরিচয়ের কারণে বাংলাদেশের আরো অনেক ত্রিপুরার মত আমিও ইতিহাসে বর্ণিত ‘ত্রিপুরা’ নামের সামন্ত রাষ্ট্র বা সেটির যে অংশ বর্তমানে একই নামে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে রয়েছে, সেসব স্থানকে কল্পনায় বিশেষ জায়গা দিয়েছিলাম বেড়ে ওঠার সময়। তবে বাস্তবের ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্য সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক পরে, যেখানে প্রথমবার বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৯৯১ সালে। এর আগে শৈশবে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরার একটি প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে এক দিন ও এক রাত কাটানোর এক বিশেষ স্মৃতি আমার আছে, যা খুব বেশি সুখকর ছিল না। সেখানে স্থানীয় ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা প্রথমে আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছিল, যদিও পরে আমাদেরকে তাদের গ্রামের পাশের স্কুলঘরে থাকতে দিয়েছিল, যেখানে রাত্রে আমরা অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।

আগরতলার ‘উজ্জয়ন্ত’ রাজপ্রাসাদ (২০০১ সালের জানুয়ারিতে লেখকের তোলা ছবি)

পরিণত বয়সে প্রথমবার যখন ত্রিপুরায় গিয়েছিলাম, মূলত আগরতলাতেই ছিলাম, যেখানে মোট এক মাস কাটিয়েছিলাম। সেসময় স্বপ্নের ‘ত্রিপুরা রাজ্যে’ বেড়াতে গিয়ে মনে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা ককবরকে একটি কবিতার আকারে টুকে রেখেছিলাম, যা Emangni Tipra Ha (‘স্বপ্নের ত্রিপুরা রাজ্য’) শিরোনামে আমার ককবরক ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি আমি ইংরেজিতেও অনুবাদ করেছি আমার ‘A journey to a land of my dreams’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের অংশ হিসেবে। মূল কবিতাটি বা এর ইংরেজি অনুবাদ সম্বলিত নিবন্ধটি পড়ে দেখলে পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করবেন, এসব লেখায় ‘স্বপ্নের রাজ্যে’ পৌঁছানোর আনন্দের পাশাপাশি শ্রুতিনির্ভর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক দেখতে পেয়ে তা থেকে সৃষ্ট আমার অন্তরের বেদনা, দ্বিধা, সংশয় ও প্রশ্নও চলে এসেছে।           

সীতাকুণ্ডে একদিন

সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরাদের কাছে সীতাকুণ্ড হল একটি তীর্থস্থান। আমিও সেখানে একবার গিয়েছিলাম, বেড়াতে, তবে প্রচলিত অর্থে কোনো তীর্থ দর্শনের উদ্দেশ্য আমার ছিল না। কিন্ত কোনো ধর্মীয় স্থাপনায় না গিয়েও অপ্রত্যাশিতভাবে ঠিকই এক ধরনের তীর্থ দর্শনের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল সেই যাত্রায়। ব্যাপারটা  খুলে বলছি।

ঘটনাটা ১৯৮৯ সালের। আমি সীতাকুণ্ডে গিয়েছিলাম আমার এক আত্মীয়ের সাথে, যিনি সম্পর্কে ছিলেন আমার ‘কুমুই’ (‘দুলা ভাই’)। তাঁরা থাকতেন চট্টগ্রাম মহানগরে, যেখান থেকে কুমুই তাঁর তৎকালীন কর্মস্থল সীতাকুণ্ডে দৈনিক আসা যাওয়া করতেন। সেই সুবাদে একদিন আমিও তাঁর সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। এক পর্যায়ে কুমুই যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, আমি একাই বাইরে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি। সেই সূত্রে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা আমি টুকে রেখেছিলাম আমার ডায়েরিতে। ১৯৮৯ সালের ১২ই জুন তারিখে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত এক বর্ণনা আমি ককবরকে লিখেছিলাম, যার পুরোটাই নিচে বাংলা অনুবাদে তুলে ধরা হল:

কতক্ষণ আর অফিসে বসে থাকা যায়? দুপুরের খাবার সেরে আড়াইটার দিকে ঘুরতে বের হলাম। একটা রিকশা নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে যেতে থাকলাম, যেটির চূড়ায় একটা মন্দির রয়েছে [যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটা তীর্থস্থান]। রিকশা চালক সন্দ্বীপের লোক। সিজন ভেদে তিনি অন্য কাজও করেন। [রাঙামাটি জেলার] রাণীরহাটে নাকি একবার গিয়েছিলেন ধান কাটতে।

শংকর মঠ এলাকায় পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে আমি পায়ে হাঁটতে শুরু করি। আমার আগে কিছুদূর সামনে আরেক পথচারী একই দিকে হাঁটছিলেন, যাঁর পরনে ছিল ধুতি, আর বগলে ছাতা গোঁজা। একটু দূর থেকে তাঁকে দেখেই কেন জানি ত্রিপুরা বলে মনে হয়েছিল আমার। আমি হাঁটার গতি বাড়াতেই তাঁর একেবারে কাছে পৌঁছে গেলাম, এবং যখন দেখলাম তিনি বড় রাস্তা ছেড়ে একটা পায়ে হাঁটা পথে জঙ্গলের দিকে মোড় নেবেন, আমি বাংলায় প্রশ্ন করলাম, “মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা কোনদিকে”?

[আলাপ শুরু হওয়ার পর] বুঝলাম, আমার অনুমান ঠিক ছিল। লোকটা ত্রিপুরা। বিষয়টা বুঝতে পেরেই আমি ককবরকে আলাপ জুড়ে দেই। জানলাম, তাঁর বাসার নারী সদস্যরা [যাঁদেরকে তিনি ককবরকের ফাতুং উচ্চারণে ‘বিসিরক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন] নাকি লাকড়ি কুড়াতে বেরিয়ে তখনো বাসায় ফেরেন নি। তাঁদের খোঁজে তিনি বেরিয়েছেন। আমি কোথাকার মানুষ, সীতাকুণ্ডে কী করতে এসেছি, এসব তিনি জানতে চাইলেন। দেখলাম, সীতাকুণ্ডে আমার যে কুমুই কর্মরত ছিলেন, তাঁর কথা তিনি জানেন। [লোকটির নাম আমার জানা হয়ে ওঠে নি, কিন্তু ধরা যাক তাঁর নাম ছিল মহেন্দ্র, যে নামে আমার বিবরণের বাকি অংশে তাঁকে উল্লেখ করা হল।]

সামনে সবুজ পাহাড়। অনেক খাড়া। রাস্তার আশেপাশে বাগান আছে। আবার কিছু খালি জায়গাও আছে। মনোরম পরিবেশ, তবে নিরিবিলি।

হঠাৎ বৃষ্টি আসল। সদ্য আলাপ হওয়া মহেন্দ্র তাঁর ছাতা মেলে ধরলেন, এবং তা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাতে ভিজে যাওয়া থেকে আমি বেঁচে গেলাম।

এক পাহাড়ের পাদদেশে বুনো একটা পথের মোড়ে একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দু’জন ত্রিপুরা। এর আগে কোনোদিন কেউ কাউকে দেখি নি, আমাদের কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না। কবে কোন কালে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম আমরা [একই জনগোষ্ঠীর দুটি ধারার সদস্য হিসেবে]। হঠাৎ, কতযুগ পরে, অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের দেখা হল এভাবে!

এরপর অনেক কথা হল।

শংকর মঠের কাছে পুকুরের দক্ষিণ দিকে এক মাইলের মত দূরত্বে নাকি মহেন্দ্রদের পাড়া, যেখানে সাত-আটটি ত্রিপুরা পরিবার রয়েছে।

কিছুক্ষণ আলাপের পর মহেন্দ্র চলে গেলেন তাঁর বাসার নারী সদস্যদের খোঁজে। আমিও আর না এগিয়ে ফিরতি পথে হাঁটতে থাকলাম। একটু পর দেখলাম দু’জন তরুণ রিকশাচালক, যাদের চেহারা দেখে আমি অনুমান করলাম, ত্রিপুরা হবে। আমি ককবরকে বললাম, ‘থাংনি?’, অর্থাৎ, ‘যাবে’? যাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, সে খুব খুশি হয়ে উঠল। তার নাম বিমল। বাড়ি ফটিকছড়ি। … লেখাপড়া ছেড়েছে সেই ১৯৭৬ সালে। ক্লাস ফোরের পর আর পড়া হয় নি। এ নিয়ে এখন খুব আফসোস বিমলের। (তার এক মামাতো ভাই নাকি আইএ পড়ছে নাজিরহাট কলেজে।)

আমি রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে দেখলাম বিমল কিছুতেই টাকা নেবে না। আমি জোর করে তার হাতে ১০ টাকা গুঁজে দিলাম। বললাম, তার বাচ্চাদের কিছু যেন কিনে দেয় সে। (জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের কথা বিমলের জানা আছে। বাঙালিরা নাকি এ কারণে সব পাহাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখে, তাদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলে। আজই নাকি এমন কিছু কথা শোনার পর কাদের সাথে প্রায় হাতাহাতি হয়েছিল তার! সে বলল, ককবরকে, “আমার প্রাণের মায়া নেই!”

বিমল আর আমি হ্যান্ডশেক করে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

উপরের কথাগুলির জের হিসাবে আমার ডায়েরির পরের পাতায় একই তারিখে আরো কিছু লিখেছিলাম, বাংলায়, যেগুলির অংশবিশেষ নিচে তুলে ধরা হল:

সীতাকুণ্ড রেইন্‌জ-এর পাদদেশে ইতিহাসের দুটি ছিন্ন ধারা আজ হঠাৎ মুখোমুখি হল। একপাশে আমি, অপরপাশে নাম না জানা আর একজন ‘চানি বোরোক’। সংশয়, দ্বিধা, বিস্ময়, বিস্মৃত ইতিহাসের মুছে যাওয়া পায়ে চলা পথ – সম্পর্কের একটি নিওলিথিক সূত্র ধরে মুহূর্তে সব পেরিয়ে আসলাম আমরা। কিন্তু লাকড়ীর খোঁজে নিরুদ্দেশ সেইসব নারীরা (জঙ্গল থেকে) ফেরার আগেই আমি ফিরে এলাম। ইট বিছানো রাস্তার ধারের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ঝর্ণাটার মতই এই হঠাৎ মিলনও কোনো খরস্রোতা ধারার জন্ম দিল না। প্রায় আকস্মিকভাবেই আমরা আবার যে যার পথে হাঁটা ধরলাম। তারপর বিমলের সাথে দেখা। আর এক ‘চানি বোরোক’। রিকশার সীটে বসিয়ে সে যাকে সোৎসাহে মহাসড়কে নিয়ে এল … এই আমি কি স্থান কাল পাত্রের [সীমানা ছাড়ানো] এক তীর্থ থেকে ঘুরে এলাম [না] আজ?

‘সান্তুআ’ হিসাবে যে তীর্থে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম

খাগড়াছড়ি-কেন্দ্রিক সাময়িকী সান্তুআ যখন ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল (যেটির নাম শুধু সান্তুআ-র বদলে সান্তুআ জার্নাল  রাখা হয় কয়েক সংখ্যা পর), আমি এটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম একজন সম্পাদক হিসাবে। কাগজটির নাম আমরা সান্তুআ রেখেছিলাম এ কারণে যে, খাগড়াছড়ির ত্রিপুরারা শব্দটি ব্যবহার করে তীর্থযাথীদের সঙ্গী  বা পথপ্রদর্শক অর্থে। তবে সান্তুআ-র প্রথম সংখ্যাকে ‘কের পূজা সংকলন’ বলা হলেও আমাদের আগ্রহ ঠিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক ছিল না। বরং, ‘সান্তুআ, যদি হারিয়েও ফেল দিশা, হাল ছেড়ো না’ শিরোনামের একটা লেখায় যেমনটা বলেছি, আমাদের স্বপ্ন ছিল যে “সাময়িকী রূপের ‘সান্তুআ’ সন্ধান দেবে সেই তীর্থস্থানের, যেখানে মিলবে শিক্ষার আলো, বৈষম্য ও বঞ্চনা নিরসনের নিশানা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা।”

~~~


[*] এই লেখাটি ভিন্ন শিরোনামে পূর্বপ্রকাশিত একটি নিবন্ধের সম্পাদিত রূপ। আগের ভাষ্যটির শিরোনাম ছিল ‘সাঙদারির তীর্থ ভ্রমণ’, যা প্রকাশতি হয়েছিলসান্তুআ জার্নাল-এর ২৬ সংখ্যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। আগের শিরোনামটির প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘সাঙদারি’ কথাটি খাগড়াছড়ির কককবরকভাষীরা ব্যবহার করে ‘আত্মীয়-স্বজন বিহীন ব্যক্তি’ অর্থে।  এটি আমি নিজের ছদ্মনাম হিসাবে ব্যবহার করেছিলাম আমার সহ-সম্পাদনায় যাত্রা শুরু করা সান্তুআ [জার্নাল] পত্রিকায় ১৯৯১-৯৫ সালের মধ্যে প্রথম প্রকাশিত আমার দু’টি নিবন্ধের বেলায়, যেগুলি সংকলিত হয়েছে ২০১৮ সালে প্রকাশিত আমার জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে শিরোনামের গ্রন্থে (নিবন্ধ দু’টির শিরোনাম হল, ‘ভালোবাসার চাইতেও শক্তিশালী একটি বিষ’ এবং ‘মাণিক্য রাজবংশ, বুরাসা দেবতা এবং খুমপুই-এর কাহিনী’)।  

মাণিক্য রাজবংশ, বুরাসা দেবতা এবং খুমপুই-এর কাহিনী

উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ (২০০১ সালের জানুয়ারিতে লেখকের তোলা ছবি)

প্রশান্ত ত্রিপুরা

(এই নিবন্ধের মূল ভাষ্য প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ থেকে ‘৯৪ সালের মধ্যে। বর্তমান ব্লগ সংস্করণটি তৈরি করা হয়েছে লেখকের জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে  নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ভাষ্যের ভিত্তিতে।)[১]

এক. প্রথম আগরতলা ভ্রমণ

১৯৯১ সালে আগরতলা বেড়ানোর সময় একদিন শেষ বিকেলে রিকশায় করে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।[২] যেটাকে সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা আমার। প্রাসাদের চৌহদ্দির ভেতরের বড় দীঘিতে তখন বিদায়ী সূর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মনোরম এই দৃশ্যপটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমি কী ভাবছিলাম মনে নেই – হয়ত ভাবছিলাম ১৯৪৯-এর ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরা রাজ্যের আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। হয়ত আমি তাকিয়ে ছিলাম প্রাসাদের সম্মুখ তোরণের পাশের প্রহরী-গৃহের শরীর ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা বট না অশথ গাছের দিকে। কিন্তু বিশেষ কোনো অনুভূতি তখন আমার জাগেনি। এইটুকু মনে হয়েছিল, সাথে আমার ক্যামেরাটা থাকলে ভাল হত। মাণিক্য রাজবংশের বহু শতাব্দীর শেষ সাক্ষী এই বিশাল প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আমার বুকে কোনো দীর্ঘশ্বাস জাগেনি। এর কারণ হয়ত এই যে, আমরা যেসব ত্রিপুরারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করি, ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল বহু আগে। মাণিক্য রাজাদের কথা আমরা ইতিহাসের বইয়ে পড়ি। শুনি জনশ্রুতিতে, কিংবদন্তীতে। কিন্তু তাদের সাথে নাড়ীর টান অনুভব করি না। অন্তত আমি করি না। তার মানে অবশ্য এই নয় যে ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে, সেখানকার সাধারণ মানুষদের সাথে, আমাদের সব সম্পর্ক চুকে গেছে। এই সম্পর্ক এখনও আবিষ্কার করা যায় সংস্কৃতির গভীরে ঢুকলে, সেই সংস্কৃতি – যেটাকে বয়ে এনেছে ককবরকভাষী জুমিয়া কৃষকরা। কী এই সংস্কৃতির রূপ?

দুই. খুমপুই-এর কাহিনী ও ত্রিপুরার রাজাদের আখ্যান

আগরতলা থেকে চড়িলাম নামের (এটি নাকি ককবরক ‘চরই লাম’-এর বিকৃত বানান) একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সাথে। সেখানে যে বাড়িতে উঠেছিলাম, সে বাড়িতে মাত্র দু’জন মানুষ ছিলেন – এক বৃদ্ধা মহিলা এবং তাঁর বিধবা মেয়ে। তাঁদের পূর্বপুরুষরা নাকি ছিলেন ‘ঠাকুর’, অর্থাৎ ত্রিপুরার সামন্ত শ্রেণীর [‘ঠাকুর’ বলতে মূলত বোঝানো হত ত্রিপুরার মহারাজার ভাইদের]। কিন্তু তাঁদের বর্তমান জীবনযাত্রায় আভিজাত্যের ছাপ নেই, তার বদলে দেখেছি সাধারণ কৃষিজীবী পরিবারের আদল। সেখানে রাতে ‘চুআক’ দিয়ে আপ্যায়িত হলাম। খাওয়া দাওয়ার পরে বন্ধু বায়না ধরল রূপকথার গল্প শুনবে ‘দিদি’র কাছ থেকে। দিদি তখন গল্প বলা শুরু করলেন। ককবরকে। খুমপুই-এর কাহিনী।[৩]

দিদির বলা কাহিনীতে সামান্য ভিন্নতা ছিল। গল্পের বোন দুটোর নাম নাকি সিপিংতি আর মাইরুংতি। এটাও আমার জানা ছিল না। কিন্তু মূল কাহিনী একই, এবং সেই একই পরিচিত সুরে ‘চিবুক’টাকে  [অর্থাৎ সাপের বেশ ধরা দেবতা] ভাত খেতে ডাকা, ‘কুমুই অইইই কুমুই অইই …..।’ মন আমার চলে গেল নিজের ছেলেবেলায়, যখন এ কাহিনী বহুবার শুনেছি। এরকম অভিজ্ঞতা আমার আর একবার হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের এক ত্রিপুরা গ্রামে বেড়াতে গিয়ে। সেখানে এক বৃদ্ধার মুখে, bwtwk খেতে খেতে, শুনেছিলাম একই কাহিনী। ঝড়ের সময় আশ্রয় করে দেওয়ার বিনিময়ে সাপরূপী এক দেবতা (বা কোনো ভাষ্যে রাজকুমার) বড় বোনকে বিয়ে করে। কিন্তু মেয়ে দুটোর বাবা খবর পেয়ে সাপটিকে মেরে ফেলে। স্বামী হারানোর শোকে বড় বোন নিজের চোখের জলে ডুবে যায়, আর অনুতপ্ত ও বিলাপরত সুন্দরী ছোট বোন শিকারে বেরুনো রাজার চোখে পড়ে যায়। রাজা তাকে বিয়ে করে রাণীর আসনে নিয়ে বসায়। তারপর, রূপকথায় যেমনটা হয়, অন্যান্য রাণীর হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর গল্পের শেষে সাত পুত্র ও এক কন্যা সমেত সে আবার ফিরে পায় তার যথাযথ মর্যাদার আসন।

যে কাহিনীর সূত্রে শ্রীমঙ্গলের এক বৃদ্ধা এবং সুদূর চড়িলামের এক বিধবা নারীর সাথে আমি সাংস্কৃতিক নৈকট্য, আত্মিক একটা বন্ধন অনুভব করেছি, এর শেকড় কোথায়? আমি মনে করি এই শেকড় প্রোথিত আছে আমাদের অভিন্ন ভাষা ককবরকে, এবং জুম ভিত্তিক সংস্কৃতি চেতনায়। খুমপুই-এর কাহিনীতে আমরা তিন শ্রেণীর চরিত্র পাই – এক, জুমিয়া কৃষক; দুই, অতিপ্রাকৃত শক্তি – সাপরূপী দেবতা, এবং তিন, রাজা। কাহিনীর শ্রোতারা নিঃসন্দেহে জুমের কাজে বেরুনো বোন দুটোর সাথেই একাত্মতা বোধ করে। সিপিংতি ও মাইরুংতির ভয় ভীতি, ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের ভাগ্যের উত্থান পতনের ভেতর দিয়েই শ্রোতারা কাহিনীর প্রবাহে যুক্ত হয়, কাহিনীকে অনুধাবন করে, নিজেদের সংস্কৃতি চেতনার অংশ করে নেয়।

এই সংস্কৃতি চেতনায় রাজাদের স্থান কোথায়? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, খুমপুই-এর কাহিনীতে জুমিয়া কৃষকদের একটা প্রচ্ছন্ন স্বপ্ন ফুটে উঠেছে – কষ্টকর জুমিয়া জীবন ছেড়ে রাজপ্রাসাদের প্রাচুর্য ও আয়েশের জীবনের অংশীদার হওয়া। কিন্তু এ শুধু স্বপ্নই, অর্থাৎ ফ্যান্টাসি। বাস্তবে মাণিক্য রাজবংশের সাথে তাদের জুমিয়া প্রজাদের মধ্যে ছিল দুস্তর ব্যবধান। এ ব্যবধান ছিল বলেই তা অতিক্রমের জন্য কল্পনা ও দৈবযোগের সাহায্য নিতে হয় কাহিনীতে।

ঐতিহাসিকভাবে দেখলে দেখা যাবে, মাণিক্য রাজাদের সাথে ত্রিপুরা জুমিয়া কৃষকদের সম্পর্ক মধুর ছিল না। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখের ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরারা ত্রিপুরা মহারাজাদের সৃষ্ট পঞ্চ ত্রিপুরী সমাজ বিভাজনে নোয়াতিয়া শ্রেণীভুক্ত ছিল। তাদের শাসনের  শেষদিকে প্রবর্তিত একটা কর ব্যবস্থায় নোয়াতিয়া ও রিয়াং কৃষকদের জন্য ধার্য করের পরিমাণ ছিল পুরাণতিয়া (দেববর্মা) ও জমাতিয়াদের তুলনায় অনেক বেশি। স্বভাবতই রিয়াং ও নোয়াতিয়ারা বিদ্রোহ করেছিল এই অসম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। [বিংশ] শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়াতে সংঘটিত রিয়াং বিদ্রোহ নামে পরিচিত এই কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামেরই ‘নোয়াতিয়া’ সন্তান সাধু রতনমণি রোয়াজা। (আগরতলায় আমি শুনেছিলাম, উজ্জয়ন্ত প্রাসাদেই নাকি সাধু রতনমণিকে হত্যা করা হয়েছিল, যদিও সে তথ্য নির্ভুল ছিল কিনা তা আমি জানি না।) এটা কোনো ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা নয় যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন চালু হওয়ার পর, বা তারও আগে মুগল ও আরাকানি শাসনামলে, ‘নোয়াতিয়া’দের অনেকে ত্রিপুরা রাজ্যের সংকুচিত সীমানায় ফিরে যাওয়ার বদলে নতুন শাসকদেরই মেনে নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ত্রিপুরা রাজাদের শোষণ এড়াতে অনেকে খোদ ত্রিপুরা রাজ্য ছেড়ে ব্রিটিশ শাসনের আওতায় চলে এসেছিল মনে হয়।

আমরা আধুনিক প্রজন্মের ত্রিপুরারা অনেকে মাণিক্য রাজবংশের ইতিহাস পড়ে গর্ব বোধ করি, হতাশও হই এই ভেবে, আমরা কী ছিলাম আর কী হলাম। কিন্তু এই ধরনের ইতিহাস দর্শন আমাদের অতীতকেতো বটেই, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রেও একটা ভ্রান্তির মায়াজাল বিছিয়ে রাখে। মাণিক্য রাজবংশের ইতিহাসের সাথে আমাদের ইতিহাস সম্পর্কিত সন্দেহ নেই, কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে আমাদের সেই রাজাদের রাজত্বে আমরা সবাই রাজা ছিলাম না এবং তাদের রাজত্বের অন্তিমকালে উপেক্ষা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে আমরা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরারা ত্রিপুরা রাজ্যের মূল ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। ইতিহাসকে এভাবে মূল্যায়ন করার অর্থ এই নয় যে মনে আমাদের কোনো তিক্ততা বয়ে বেড়াতে হবে অতীত রাজশক্তির প্রতি। মাণিক্য রাজারা এক সময় আমাদের প্রতি যাই অবিচার করে থাকুক, ইতিহাসের আরও প্রবলতর স্রোতে তারা নিজেরাই এখন হারিয়ে গেছে। আমার একটাই বক্তব্য, কোনো ধরনের মিথ্যে অহঙ্কার দিয়ে নয়, অতীতের দিকে আমাদের তাকাতে হবে নির্মোহ সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিতে। তা নাহলে আমরা আমাদের বর্তমানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারব না।

Khumpui

খুমপুই-এর ছবির উৎস/PC: My Cluture, My Tripura (ফেসবুক লিংক)

তিন. বুরাসা দেবতা

মাণিক্য রাজারা ছাড়া ত্রিপুরাদের উপর আধিপত্য ছিল আর এক শক্তির – বুরাসা। বুরাসার রাজত্ব ছিল পার্বত্য বনাঞ্চলে। তাকে ভয় করা হত, সমীহ করা হত। খুমপুই-এর সেই সাপরূপী দেবতা বুরাসা ছিল কিনা জানি না, সম্ভবত ছিল না। কারণ বুরাসা খুব বেশি দয়ালু ছিল বলে আমরা জানি না। অনেকের মতে বুরাসা নাকি mwtai-দের মধ্যে সবার বড়। তাহলে আমি বলব, বুরাসা ছিল আরণ্য ভূমির স্বৈর শাসক। তাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা ত্রস্ত থাকত। কারণ তার অসন্তোষের কারণে রোগশোক এবং অন্যান্য পার্থিব ক্ষতি হত। বুরাসা কি বৈরী, খেয়ালি প্রকৃতির প্রতিভূ ছিল? হয়তবা। কিন্তু আমরা যারা জুমচাষ ছেড়ে দিয়েছি, যারা বর্তমানে শহরে থাকি, তারা বুরাসার কথা খুব একটা জানি না, কদাচিৎ তার নাম শুনি মাত্র। আমরা নিশ্চয় বুরাসার নাগালের বাইরে চলে এসেছি। আর বনাঞ্চল যেভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে, তাতে বুরাসার থাকার জায়গা আর আছে কিনা সন্দেহ। হয়ত বুরাসাই এখন ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ লাইন, দালানকোঠা বা এমনকি রাবার বাগান – এসব কি বুরাসার আবাসস্থল কেড়ে নেয়নি? বুরাসার কি দিন শেষ? আমরা মানে ত্রিপুরারা, বিশেষ করে যারা জুম ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং আসছি। সন্দেহ নেই, এই নতুন পথের বিভ্রান্ত পথিকরাই ক্রমশঃ সংখ্যায় বাড়ছে, বাড়তে থাকবে।

আমি বুরাসাকে চিহ্নিত করেছি খেয়ালি, বৈরী প্রকৃতির প্রতিভূ হিসাবে যার সাথে ত্রিপুরারা নিজেদের সামাজিক ধ্যান ধারণার আদলে তৈরি করে নিয়েছিল এক বিশেষ সম্পর্ক। সে হিসাবে বুরাসা আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য এবং প্রধান অংশ ছিল। আমাদের মনোজগতে তার আসন ছিল স্বেচ্ছাচারী এক পিতার মত, যার শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা এবং প্রবণতা এতই ব্যাপক যে তার মধ্যে যে স্নেহ ও মমতা থাকতে পারে, আছে, একথা ভাবার বিশেষ অবকাশ আমরা পাইনি। কিন্তু সেই মহা প্রতাপশালী বুরাসা এখন বুড়িয়ে গেছে, মৃত্যুপথযাত্রী হয়তবা। এমতাবস্থায় আমাদের কী করণীয়? পিতা যদি নিষ্ঠুরও হয়, তার মৃত্যুর সম্ভাবনায় সন্তানরা মুষড়ে পড়বেই। আমরাও চাইব বুরাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার সেবা করে তাকে বর্তমানের মুমূর্ষু অবস্থা থেকে সারিয়ে তুলতে। ভয়ে নয়, ভালবেসে, শ্রদ্ধায়। তার শক্তি ফিরে পেলে, সে আবার বেঁচে উঠলে হয়ত আমরা নতুন এক বুরাসাকে পাব, যার সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক নির্ভরতার, সমতার, শ্রদ্ধার। আর বুরাসা বুড়ো হলেও তার আসল ক্ষমতা কিন্তু কমেনি। আমরা জানি, বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা বুঝতে পেরেছে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করা মানে নিজের সমাধি রচনা করা। প্রকৃতিকে আমরা এতদিন আমাদের প্রতিপক্ষ বলে ভেবে এসেছি, কিন্তু প্রকৃতির উপর স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর আমাদের বোধোদয় হচ্ছে, প্রকৃতি মরলে আমরাও বাঁচব না।

চার. একালের রাজ-পরিত্যক্ত সন্তানদের ভবিষ্যত

বিশ্ব সভ্যতার বিশাল স্রোতধারা পৃথিবীর সর্বত্র প্লাবনের রূপে ছড়িয়ে পড়ছে। এর থেকে ত্রিপুরা সমাজও নিস্তার পায় নি, পাবেও না। পরিবর্তনের স্রোতে আমাদের সংস্কৃতির অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, যাবে। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি? যা হারিয়ে গেছে, তা নিয়ে আক্ষেপ করে কোনো লাভ হবে না। সব ধরনের নৈরাশ্য, তিক্ততা ও স্মৃতিকাতরতা ভুলে গিয়ে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। মহত্তর, বৃহত্তর কিছুতে যুক্ত হতে হবে আমাদের। যা আছে, যা রাখা যাবে, তাকে লালন করে বিকাশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যা কিছু নড়বড়ে হয়ে গেছে, ভেঙে সম্পূর্ণভাবে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।

ভাষা: প্রথমেই আমরা ভাষার কথা ভাবতে পারি। ককবরককে ধরে রাখার, বিকশিত করে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে ছাগলের পেট কেটে হরফ উদ্ধার করার আশা আমরা করতে পারি না। হাতের কাছেই রয়েছে রোমান হরফ, যাকে আমরা ভাষা বিজ্ঞান দ্বারা নিরূপিত পদ্ধতিতে কাজে লাগাতে পারি। বাংলা হরফেও ককবরক লেখার আদর্শ পদ্ধতি দাঁড় করানো যায়, তবে বাংলার চাইতে রোমান (ইংরেজি) হরফ আমাদের জন্য অনেক বেশি উপযোগী হবে বলে আমি মনে করি।

অর্থনীতি: অর্থনীতির ক্ষেত্রে ত্রিপুরাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমরা অনেকে সময় থাকতে জুমচাষ ছেড়ে উপত্যকাগুলোতে লাঙল চাষের পথ ধরিনি। সে ভুলের দাম এখন দিচ্ছি চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। জুমিয়া জীবনের দিন শেষ এতে কোনো সন্দেহ নেই। ত্রিপুরা জুমিয়াদের অনেকেই এখন বাজারে লাকড়ি, ছন বা শুধুমাত্র শ্রম বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু লাকড়ি আর ছন বিক্রির পথও বেশিদিন থাকবে না। আর কোনো রকম দক্ষতা ছাড়া শুধুমাত্র পেশীশক্তির কোনো দাম আজকের দুনিয়ায় নেই, তাও আমরা বুঝতে পারছি ইতোমধ্যেই। যেভাবে হোক, ত্রিপুরাদেরকে বিভিন্ন নতুন পথে তাদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা করে দেখতে হবে শিল্পে, বাণিজ্যে, নতুন ধরনের কৃষিকাজে। এসবের জন্য পুঁজির চাইতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল শিক্ষা, সচেতনতা এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে গড়ার অদম্য স্পৃহা। খুমপুই গল্পের মত দুর্দিনে কোন সাপবেশী দেবতা আমাদের সাহায্যে আসবে না, বরং দেবতাবেশী সাপরাই হয়ত অযাচিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়াবে। আর ক্ষমতাধরদের কৃপা লাভের আশায় সিপিংতির মত গাছের মাথায় বসে বিলাপ করেও কিছু হবে না, তার চেয়ে বরং বাড়ির পাশে কিছু সবজির বীজ পোঁতা অনেক ভালো হবে।

ধর্ম:  সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ধর্মের দিক দিয়েও ত্রিপুরারা একটা নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে আছে। ত্রিপুরা ধর্মের মৌলিক এবং সামগ্রিক রূপটা কী? এক কথায়, আমরা জানি না। বুরাসার কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তার মত ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব প্রতিপত্তির আরো অনেক দেবদেবী ত্রিপুরা সংস্কৃতিতে এখনও তাদের ম্রিয়মাণ অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। এ অবস্থা অবশ্য সাম্প্রতিক কালের সৃষ্ট নয়। অন্তত পাঁচশ বছর আগে হিন্দু [‘আর্য’] সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার পর এসব দেব দেবীরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। Mailwngma-কে এখনও আমরা পূজি, কিন্তু নতুন নামে, নতুন বেশে – লক্ষ্মী। হিন্দু সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে পারস্পরিক দেয়া নেয়ার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হওয়ার বদলে যা কিছু ঘরের তা বর্জনীয় এবং যা কিছু পরের তা গ্রহণীয়, এই নীতি নিয়ে শুধু হীনমন্যতা ও সাংস্কৃতিক দীনতাবোধই আমরা পেয়েছি। ত্রিপুরাদের অনেকের মধ্যে অবশ্য কৌলিন্যের অহমিকা ঢুকেছে ঠিকই। আগরতলায় আমি পৈতাধারী (ক্ষত্রিয়) কিছু দেববর্মাকে দেখেছি, কিন্তু বাস্তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের বলয়ে ত্রিপুরাদের অধিকাংশই রয়ে গেছে অন্ত্যজ অবস্থানে। তবু আমাদের মোহ কাটেনি। দুর্গামণ্ডপে রিনাই পরে ঢোকা যাবে না, ঠিক আছে, শাড়ি পরেই না হয় ঢুকলাম, এই ছিল আমাদের মানসিকতা। Bwraigi-দের দেখি বাংলায় ভগবানের বন্দনা করতে। তাতে দোষ নেই। কিন্তু ভগবান কি ককবরক একদমই বোঝে না? সাধু রতনমণি, বলং রায়দের মত করে ত্রিপুরা Bwraigi-দের ক’জন মাতৃভাষায় আধ্যাত্মিক গান রচনার প্রয়াস চালিয়েছেন? ধর্ম প্রসঙ্গে এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখ করতে হয়। ত্রিপুরাদের মধ্যে যারা নিজেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মনে করেন, তাদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ধারণা প্রচলিত যে ত্রিপুরা মাত্রই হিন্দু। এতে দুটো বিষয় উপেক্ষিত থেকে যায়। এক, ঠিক কোন্‌ অর্থে আমরা হিন্দু, তা কিন্তু পরিষ্কার নয়। দুই, ত্রিপুরাদের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ খিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে, করছে। এই নতুন ধারা অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের মধ্যে বিভেদ ও তিক্ততা এনে দেবে, তবে  যিশু খ্রিস্টের সাম্য, ভালবাসা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বাণী সঠিক উপায়ে প্রচারিত হলে তাতে আমাদের সমাজে চেতনার একটা পুনর্জাগরণও দেখা দিতে পারে।

রাজনৈতিক চেতনা: আমাদের অবশ্যই জেগে উঠতে হবে, সর্বক্ষেত্রে – শিক্ষায়, চেতনায়, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে। আমরা বহু শতাব্দী ধরে শুধু পালিয় বেড়িয়েছি। এসবতো জানা কথা। আমি [বিংশ] শতাব্দীরই একটা উদাহরণ দেব। গ্রিয়েরসনের ‘লিংগুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ থেকে জানা যায় [বিংশ] শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঢাকা জেলায় কয়েকশত ত্রিপুরা (ককবরকভাষী) বাস করত। কিন্তু তারা সব কোথায় গেল? [১৯৮০ বা ৮১ সালের কোনো এক সময়] এক বন্ধুর সাথে নরসিংদীর একটা গ্রামে বেড়াতে গিয়ে শুনি, সেখানে দুই তিন পুরুষ আগেও ত্রিপুরাদের বসতি ছিল, তারা নাকি সেখানে জুম চাষ করত। তাদের খনন করা একটা পুকুরও আমাদের দেখানো হয়। বলা বাহুল্য, আজ সেখানে তাদের কোনো বংশধর নেই। প্রশ্ন হল, তারা সব গেল কোথায়? আমার ধারণা, অনেকেই ত্রিপুরায় চলে গেছে। আর যারা যেতে পারেনি, তারা বৃহত্তর সংস্কৃতির স্রোতে হারিয়ে গেছে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বিসর্জন দিয়ে। এই দুই ধরনের পরিণতির কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। পালাতে পালাতে দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। যে যেখানে আছি, সেখানেই সবার সাথে পাশাপাশি থাকার, একসাথে বাঁচার মনোভাব নিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের কাজে নামতে হবে।

আমাদের মধ্যে এখনও অনেকে অবস্থা বেগতিক দেখলেই ত্রিপুরা রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরা হয়ত ভুলে গেছেন যে দেশ বিভাগের পর ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে একবার পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু ত্রিপুরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মারা যায়।[৪]  আমাদের মনে রাখতে হবে ত্রিপুরায় আমাদের জন্য কোনো স্বর্গরাজ্য অপেক্ষা করছে না, যদি তাই হত তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের বাপ ঠাকুরদারা অনেক আগেই ওপাশে ফিরে যেত বা তাদের বাপ ঠাকুরদারা ওপাশ ছেড়ে এদিকে চলে আসত না। আর এ কথাও আমাদের ভুললে চলবে না যে এই বাংলাদেশের সীমানায় আমরা আছি বহু শতাব্দী ধরে। এটা ঠিক যে ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত আমাদের ইতিহাস এখানেও বঞ্চনার, অবহেলার, অধিকার হরণের। কিন্তু এই ভূখণ্ডেই আমাদের বাঁচতে হবে। আমরা একসময় ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় ছিলাম। কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও আমাদের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব আছে। এসব জনপদ কতদিন থাকবে জানি না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেও আমাদের শেষ চিহ্ন মুছে যাক, তা আমরা চাইব না।

এ ভূখণ্ডের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই নতুন পরিচয়ে, নতুন উদ্দীপনায় আমাদের বাঁচতে হবে। শতাব্দীর বঞ্চনার ক্ষোভকে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে পরিণত করতে হবে। আমরা হয়ত কোনো উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ বানাতে পারব না। সেরকম কিছু আমাদের উদ্দেশ্যও নয়। কিন্তু সবাই মিলে যদি প্রত্যেক ত্রিপুরা গ্রামে একটি করে স্কুল, একটি করে মন্দির বা চার্চ, ক্লাব এবং হ্যাঁ, একটা করে দোকান বা অন্য কোনো অর্থকরী উদ্যোগ গড়ে তুলতে পারি তাও বা কম কি? এ যুগের সিপিংতিদের পরিত্যক্ত সন্তানরা বেড়ে উঠছে কোনো তৈবুকমার আশ্রয় ছাড়াই। তাদের নিজেদেরই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। তারা সফল হলে, খেয়ালি বৃদ্ধ বুরাসাও হয়ত বলে উঠবে, ঠিক তাই চেয়েছিলাম। আমরা, সিপিংতি ও মাইরুংতির সন্তানরা, প্রস্তুত কি?

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের সিপিংতি ও মাইরুংতি (খাগড়াপুর, খাগড়াছড়ি, ১৯৮৪ বা ‘৮৫ সালে তোলা ছবি। স্বত্ব: প্রশান্ত ত্রিপুরা)

[১] জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে  বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে, সংহতি প্রকাশন থেকে। খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সান্তুআ  পত্রিকায় লেখাটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে কোনো  এক সময়), লেখকের নাম দেখানো হয়েছিল ‘সাঙদারি’ হিসাবে, যে ছদ্মনামে এটি ছিল আমার দ্বিতীয় ও শেষ লেখা।  একই ছদ্মনামের আড়ালে লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল রাঙ্গামাটি থেকে, ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সংকলন লাম্প্রা: বৈসু উত্তর প্রকাশনা-তে (১৯৯৫)। সান্তুআ-র যে সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি বর্তমানে আর লেখকের সংগ্রহে নেই। যতদূর মনে পড়ে, শুরুতে দীর্ঘতর একটি শিরোনাম ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে ‘স্বৈরাচারের হাজার বছর’ কথাটি ছিল। লেখাটির আগের ভাষ্যগুলিতে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নাম ভুলে ‘উজ্জয়নী’ লেখা হয়েছিল।

[২] আমার আগরতলায় প্রথমবার বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আরো একটু বিশদভাবে বর্ণনা করা রয়েছে আমার ইংরেজি ব্লগের এই নিবন্ধে: A Journey to a Land of My Dreams;  এছাড়া বর্তমান ব্লগেই ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রাসঙ্গিক লেখায় তখনকার অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ রয়েছে:  চৌকির তলা থেকে তুলে আনা আগরতলার গল্প

[৩] ‘খুমপুই’ একটি ফুলের নাম (লেখাটির আগের ভাষ্যগুলিতে শব্দটিকে ‘খুমপৈ’ হিসেবে লেখা হয়েছিল। ককবরকে দফা ভেদে শব্দটি khumpwi ও khumpui, উভয় রূপে উচ্চারিত হতে পারে)।   আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রয়াত বরেন ত্রিপুরা তাঁর দু’একটি লেখায় খুমপুই-কে বাংলায় ‘এলাচ চাঁপা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রচলিত খুমপুই-এর কাহিনীর কিছু দিক বাংলা অঞ্চলের লোককাহিনী ‘সাত ভাই চম্পা’র সাথে মিল রয়েছে, তবে খুমপুই-এর কাহিনীতে ত্রিপুরাদের জন্য পবিত্র বলে গণ্য একাধিক স্থান ও নদির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

[৪] এই তথ্য কোথায় পেয়েছিলাম, বা ঘটনার বিশদ বিবরণ কী ছিল, সেসব এখন মনে পড়ছে না।